ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

২. অজগরের শিকার

২. অজগরের শিকার

নেকড়ের দল থেকে বিতাড়িত হওয়ার আগে মোগলির জীবনে যে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটেছিল, এখানে তারই বিবরণ দিচ্ছি। বৃদ্ধ ভাল্লুক বালু তখন মহা-উৎসাহে মোগলিকে জঙ্গলের নিয়মকানুন শেখাচ্ছে। নেকড়ের বাচ্চার চাইতে অনেক তাড়াতাড়ি জংলি শিক্ষার পাঠ বুঝে নিতে পারে মোগলি। মানুষের বাচ্চার মতো এমন একটি বুদ্ধিমান ছাত্র পেয়ে বালু ভারি খুশি। কিন্তু একই কথা বার বার বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে ওঠে মোগলি, সে তখন আর সুবোধ ছাত্রের মতো গুরুর নির্দেশ মানতে চায় না। তখন তার মুখে এবং দেহের উপর পড়ে বালুর থাপ্পড়। ওইরকম একটি দিনে যখন বালুর থাবার কয়েকটি চপেটাঘাত লাভ করে ক্রুদ্ধ মোগালি গুরুর সান্নিধ্য ত্যাগ করে ছুটে পালিয়েছে, সেইসময় তার খোঁজ করতে এল কালো চিতা বাঘিরা। সে মাঝে মাঝে আসে তার আদরের ছোট্ট ভাইটি কেমন শিক্ষালাভ করছে দেখার জন্য। বালু বাঘিরাকে উদ্দেশ করে বলল, মানুষের বাচ্চা তো, কত আর হবে? তবে আমি যখন ধরেছি, তখন জঙ্গলের আইন ওকে শিখতেই হবে। বেয়াড়া বেচাল আমি কিছুতেই সহ্য করব না। যদি ভালো কথায় শিখতে না চায়, তাহলে ঘাড় ধরে শেখাব।

কিন্তু ভেবে দ্যাখো ও কত ছোটো, কালো চিতা বলল; মোগলির শিক্ষার ভার যদি তার উপর থাকত, তাহলে মানুষের বাচ্চাটিকে সে যে আদর দিয়ে নষ্ট করত, সেবিষয়ে সন্দেহ নেই, ওইটুকু ছেলের ছোট্ট মাথায় অত বিদ্যা ধরবে কেন?

ছোটো বলে জঙ্গলের খুনিরা কি কাউকে ছেড়ে দেয়? না, ছাড়ে না। সেইজন্যই আমি ওর শিক্ষার ভার নিয়েছি; আর সেইজন্যই দরকার হলে একটু-আধটু থাবা চালাই তবে খুব আস্তে।

আস্তে? খু-উ-উব আস্-সূতে? তোমার থাবাগুলো লোহার মতন শক্ত। তুমি আস্তে মেরে ছেলেটার কী দুর্দশা করেছ, সেটা একবার তাকিয়ে দেখেছ কি? তোমার একটু-আধটু আস্তে থাবা চালানোর ফলে ওই কচি বাচ্চার মুখটা থেতলে গেছে।

যারা ওকে ভালোবাসে, তাদের হাতে মার খেয়ে যদি মাথা থেকে পা পর্যন্ত থেতলে যায়, তাতে ক্ষতি নেই; কিন্তু জঙ্গলের আইন-কানুন না জানলে ওর সাংঘাতিক ক্ষতি হতে পারে। আমি এখন ওকে জঙ্গলের বিভিন্ন ভাষা শেখাচ্ছি। যে-শিক্ষা আয়ত্ত করতে পারলে শুধু পশুপক্ষী নয়, বিষাক্ত সর্পকুলের কাছ থেকেও মানুষের বাচ্চাটা নিরাপদ থাকবে। অবশ্য ওর স্বজাতি অর্থাৎ মানুষের কবল থেকে আমার শিক্ষা ওকে বাঁচাতে পারবে না।

ওহে বৃদ্ধ ভাল্লুক, একটা কথা মনে রেখো, বাচ্চাটার শরীর গাছের গুঁড়ির মতো শক্ত নয়। সুতরাং ওর দেহের উপর তোমার নখের ধার পরখ করা নিতান্তই অনুচিত কর্ম। আমার ভয় হচ্ছে, তোমার ওই সাংঘাতিক শিক্ষা শেষ হওয়ার আগেই বেচারার জীবনটা শেষ না হয়ে যায়। তা তোমার ওই আরণ্যক বিদ্যা আমার ছোট্ট ভাইটি কতটা আয়ত্ত করেছে সেটাই আমি জানতে চাই।

আমি মোগলিকে ডাকছি, বাঘিরা আবার বলল, আমার ছোট্ট ভাইটি কতটা শিখেছে, আর কী শিখেছে সেটা জানতেই আজ আমি এসেছি।

বাঘিরার গুরুগম্ভীর কণ্ঠের গর্জিত আহ্বান বন থেকে বনান্তরে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই একটা মস্ত উঁচু গাছ বেয়ে সড়াৎ করে অকুস্থলে আবির্ভূত হল শ্রীমান মোগলি, মৌমাছির চাকে যেমন শব্দ হয়, ঠিক তেমনি বোঁ-বোঁ শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমার মাথার মধ্যে–বালুর থাপ্পড় আমার মাথার ঘিলু নড়িয়ে দিয়েছে। আমি বুড়ো হোঁৎকা বালুর সঙ্গে দেখা করতে আসিনি, আমি এখন দেখা করতে এসেছি বাঘিরার সঙ্গে।

বালু মোগলির কথায় দুঃখ পেলেও মুখে তা প্রকাশ করল না, তোমাকে জঙ্গলের যে-ভাষা আজ শিখিয়েছি, বাঘিরার সামনে তার পরীক্ষা দাও।

বাহাদুরি দেখানোর সুযোগ পেয়ে মোগলি ভারি খুশি। মহা-উৎসাহে ভাষাজ্ঞানের পরিচয় দিল সে। জঙ্গলে যারা শিকার করে, অর্থাৎ বাঘ, ভাল্লুক, নেকড়ে প্রভৃতি শিকারি জন্তুর প্রচলিত ভাষায় সে তাদের সম্বোধন জানাল। অবশেষে পাখি আর সাপের নিজস্ব ভাষায় আপ্যায়ন জানিয়ে মোগলি প্রমাণ করলে সে দস্তুরমতো মনোযোগী ছাত্র- বালুর অবহেলার পাত্র নয়। অধীত বিদ্যার পরিচয় দিতে পেরে খুব আনন্দিত হল মোগলি, একলাফে বাঘিরার পিঠে চড়ে সে বলে উঠল, এবার আমি একটা দল তৈরি করব। গাছ থেকে গাছে সেই দলটাকে চালিয়ে নিয়ে যাব আমি।

সে আবার কী? বাঘিরা বিস্মিত হল, তুমি কি দুঃস্বপ্ন দেখছ?

গাছের উপর থেকে শুকনো ডালপালা আর ধুলো ছিটিয়ে দেওয়া হবে বুড়ো ভাল্লুক বালুর উপর, মোগলি বলল, ওরা আমায় কথা দিয়েছে বালুকে ওইভাবেই শায়েস্তা করা হবে- আঃ!

এক প্রচণ্ড থাপ্পড়ে মোগলিকে বাঘিরার পিঠের উপর থেকে ছিটকে ফেলে দিল বালু। দুই থাবার মাঝখানে ধরাপৃষ্ঠে লম্বমান হয়ে মোগলি বুঝল বিপুলবপু ভাল্লুক এখন অতিশয় ক্রুদ্ধ!

মোগলি! বালু গর্জন করে বলল, তুমি এখন বাঁদরদের দলে ভিড়েছ? তাদের সঙ্গে কথা কইছ?

সমর্থনের আশায় বাঘিরার দিকে তাকাল মোগলি, কিন্তু তার আশা পূর্ণ হল না- মোগলি সবিস্ময়ে দেখল, কালো চিতার মরকতমণির মতো জ্বলন্ত দুই চোখে ফুটে উঠেছে কঠিন তিরস্কার!

তুমি তাহলে বাঁদরদের সঙ্গে মেলামেশা করছ, কঠোরস্বরে বলল বাঘিরা, ওই বাঁদরগুলো কোনো নিয়ম-কানুন মানে না, খাদ্যাখাদ্যের বিচার করে না- জঙ্গলের তাবৎ জানোয়ার ওদের ঘৃণা করে।

একটু আগে বালুর থাপ্পড় খেয়ে আমার মাথা যখন ব্যথায় টন-টন করছিল, তখন আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম, মোগলি বলল (তখনও সে মাটিতে লম্বমান, উঠে বসার সুযোগ হয়নি), সেই সময় কেবল বাঁদরের দলই গাছ থেকে নেমে আমায় সান্ত্বনা দিয়েছিল। আর কেউ তো আমায় সহানুভূতি দেখাতে আসেনি।

বাঁদরদের সহানুভূতি! বালু নাক দিয়ে একটা অবজ্ঞাসূচক শব্দ করল, পাহাড়ি ঝর্নার গতিহীন অচল অবস্থা আর দুপুরের সূর্যকিরণের শীতলতার মতোই বাঁদরের সহানুভূতি এক অবাস্তব ও অসম্ভব ব্যাপার;–যাকগে, তারপর কী হল?

তারপর বাঁদররা আমাকে বাদাম আর অন্যান্য সুস্বাদু খাবার দিল। তারা আমাকে হাতে হাতে তুলে গাছের মগডালে নিয়ে গেল। তারা বলল লেজ না থাকলেও আমি তাদের সহোদর ভাই। একদিন বাঁদররা আমাকে তাদের দলের নেতা করবে, এমন কথাও বলেছে।

বাজে কথা, বাঘিরা বলল, বাঁদরদের কোনো নেতা নেই।

 ওরা আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছে। বালুর মতন আমাকে ওরা মারধর করেনি। ওদের মনে দয়ামায়া আছে। আমি ওদের সঙ্গে খেলতে চাই।

শোনো, মানুষের বাচ্চা, ক্রুদ্ধ গর্জনে ফেটে পড়ল বৃদ্ধ ভাল্লুকের কণ্ঠস্বর, আমি তোমাকে জঙ্গলের তাবৎ আইন-কানুন শেখালেও বাঁদরদের বিষয়ে কোনো কথাই বলিনি। ওদের কোনো দলপতি নেই, ওরা কোনো নিয়ম মানে না, নিজেদের মধ্যে ওরা সর্বদাই মারামারি করে। ওরা কোনো কাজ শুরু করলেও সেই কাজটা শেষ করতে পারে না, কিন্তু মুখে সব সময় বড়ো বড়ো কথা বলে। জঙ্গলের কোনো জানোয়ারই ওদের পছন্দ করে না। ওরা যে-জলাশয়ে জলপান করে, আমরা সেই জলাশয়ের ধারেকাছেও যাই না। ওরা যেখানে খাদ্যের সন্ধান করে, আমরা সেখানে কখনো শিকার করি না। বনবাসী অন্যান্য পশুর কাছে বাঁদররা অচ্ছুৎ। সেইজন্য বনের অন্য জন্তুদের উপর বাঁদরদের ভারি রাগ। আমি তোমায় অনেক কিছু বলেছি, অনেক কিছু শিখিয়েছি, কিন্তু বাঁদরদের বিষয়ে কখনো কিছু বলিনি। কারণ, ওদের মতন নির্লজ্জ অসামাজিক প্রাণীকে নিয়ে আলোচনা করলে শুধু সময় নষ্ট হয় তাই আমরা কখনো ওদের নিয়ে মাথা ঘামাই না।

বালুর বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগেই অনেকগুলো বাদাম আর শুকনো ডালপালা উপর থেকে তাদের মাথায় ঝরে পড়ল; সেই সঙ্গে গাছের ডালে লাফালাফির শব্দ আর ক্রুদ্ধ কণ্ঠের তীব্র চিৎকার! বাঁদরদের সম্বন্ধে চমৎকার মন্তব্যগুলি যে বৃক্ষশাখায় উপবিষ্ট পূর্বোক্ত লাঙ্গুলধারীদের শ্রুতিগোচর হয়েছে, সেবিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রইল না। মাথার উপর বানরবাহিনীর আস্ফালন, চিৎকার আর বৃক্ষশাখার সশব্দ আলোড়ন বালু এবং বাঘিরাকে বিশেষ বিচলিত করতে পারল না– এমনকী নিক্ষিপ্ত বৃক্ষশাখার আঘাতও তারা অগ্রাহ্য করল নির্বিকারচিত্তে।

মনে রেখো মোগলি, বালু বলল, বনের বাসিন্দারা বাঁদরদের সঙ্গে মেলামেশা করে না।

সত্যি কথা, বাঘিরার মন্তব্য, তবে বালুর উচিত ছিল বাঁদরদের বিষয়ে অনভিজ্ঞ মোগলিকে সতর্ক করা।

বাঃ! আমি কী করে জানব যে, ওই অচ্ছুৎ হতভাগাদের সঙ্গে মোগলি গিয়ে ভিড়বে?

আবার এক ঝাঁক শুকনো ডালপালা এসে পড়ল তাদের মাথার উপর। কিন্তু বানরদের বোমা বর্ষণে হৃক্ষেপ না করে বালু ও বাঘিরা গভীর অরণ্যে নিরাপদ আশ্রয় নিতে এগিয়ে চলল অক্লান্ত পদক্ষেপে। মাথার উপর গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে বাঁদররা তাদের অনুসরণ করল অনেকক্ষণ, তারপর একসময়ে ধৈর্য হারিয়ে থেমে গেল। বালু, বাঘিরা আর মোগলি যখন বিশ্রাম নিতে থামল, মধ্যাহ্নসূর্য তখন মাথার উপর আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। ততক্ষণে নিজের অন্যায় আর অপরাধের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে মোগলি, বালু ও বাঘিরার মাঝখানে শুয়ে পড়ে সে মনে মনে স্থির করল ভবিষ্যতে কোনোদিন সে বাঁদরদের সঙ্গে মেলামেশা করবে না। ভাবতে ভাবতেই তার চোখ জুড়িয়ে এল..

হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠল মোগলি প্রথমেই সে অনুভব করল তার দুই হাত আর দুই পায়ের উপর চেপে বসেছে অনেকগুলো ছোটো ছোটো বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন- তারপরই মুখের উপর দোদুল্যমান বৃক্ষশাখার আঘাত। অনেক উঁচু থেকে সে দেখতে পেল ভীষণ চিৎকারে বন কাঁপিয়ে তুলেছে বালু। আর যে-গাছটার উপর তাকে টেনে তুলেছে বাঁদরের দল, সেই গাছ বেয়ে দ্রুত উঠে আসছে বাঘিরা– তার হাঁ-করা মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি!

দুটি বলিষ্ঠ বাঁদর মোগলির দুই হাত শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে শূন্যে ঝাঁপ দিল, পরক্ষণেই বিশ ফুট দূরত্ব পার হয়ে তারা পোঁছে গেল আর একটা গাছের উপর। তারপর ওইভাবেই গাছ থেকে গাছে মোগলিকে বহন করে ছুটল বানর দুটি, তাদের সঙ্গে মহা-আনন্দে গাছে-গাছে লাফিয়ে ছুটে চলল বাঁদরের দল। কিছুক্ষণ তাদের অনুসরণ করল বাঘিরা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারল না। মোগলিকে নিয়ে গাছ থেকে গাছে লাফাতে লাফাতে বাঁদরের দল বাঘিরার দৃষ্টিসীমার বাইরে অন্তর্ধান করল…

মোগলি দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। সে বুঝল তার বন্ধুদের পক্ষে বাঁদরদের অনুসরণ করা সম্ভব নয়। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় জোর খাটানো চলবে না, বাঁদরদের হাত ফসকালে গাছের উপর থেকে পড়ে মৃত্যু নিশ্চিত। হঠাৎ উপরদিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেল মাথার উপর নীল আকাশের গায়ে চক্রাকারে উড়ছে চিল। তৎক্ষণাৎ বালুর কাছে লব্ধ বিদ্যা কাজে লাগাল সে, চিলের ভাষায় চিলের মতোই তীব্র তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করে বলল, তুমি আর আমি একই রক্তের অধিকারী। শোনো চিল, তুমি আকাশপথে আমায় অনুসরণ কর, তারপর আমার খবর পৌঁছে দাও বালু আর বাঘিরার কাছে।

চিল মনে মনে হাসল, বাঁদররা এবার ভালো ঝামেলা পাকিয়েছে। বালু খুব দুর্বল জন্তু নয়, আর বাঘিরা তো মূর্তিমান বিভীষিকা। বাঁদরের দল এবার শক্ত পাল্লায় পড়েছে।

ডানায় ভর দিয়ে অনেক উপরে উঠে গেল চিল, লক্ষ্য রাখতে লাগল মোগলি আর বানরবাহিনীর উপর…

দারুণ ক্রোধে অস্থির হয়ে উঠেছে বালু আর বাঘিরা। সগর্জনে বালুর উপর দোষারোপ করতে লাগল বাঘিরা কেন সে আগেই বাঁদরদের সম্পর্কে মানুষের বাচ্চাটাকে সাবধান করে দেয়নি, যদি তাকে বাঁচাতেই না পারবে, তবে মারের চোটে আধমরা করা হয়েছে কেন ওই বাচ্চাটাকে? বাঁদরদের কবল থেকে মানুষের বাচ্চাটাকে আর উদ্ধার করা যাবে না, হয়তো গাছ থেকে পড়ে একসময় মারা পড়বে মোগলি। বাঁদররা থাকে গাছের উপর গাছে উঠে তাদের নাগাল পাওয়া পশুদের পক্ষে অসম্ভব, তাই কোনো জানোয়ারকেই ভয় পায় না তারা।

প্রত্যেকেরই ভয় পাওয়ার মতন কিছু দুর্বল জায়গা থাকে, বালু বলল, বাঁদররাও একজনকে যমের মতো ভয় করে। সে হচ্ছে কা–বিশাল এক অজগর। সে বাঁদরদের মতোই গাছে উঠতে পারে। চল, আমরা তার কাছে যাই।

কিন্তু সে কি আমাদের সাহায্য করতে রাজি হবে? বাঘিরা চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করল, ও আমাদের জাতভাই নয়। ওর পা নেই, বুকে হেঁটে চলে আর ওর দৃষ্টিতে ভর করে আে শয়তান।

তবুও ওর কাছেই আমাদের যেতে হবে, বালু বলল, আশা করি আমরা দুজনে মিলে ওকে রাজি করাতে পারব।

অতঃপর দুই বন্ধু চলল কা নামক পাহাড়ি অজগরের সন্ধানে…

 কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি আর খোঁজাখুঁজির পর একটা পাহাড়ের বেরিয়ে-আসা তাকের মতো অংশের উপর অজগরকে দেখতে পেল তারা। সে তখন তার সুদীর্ঘ শরীর দিয়ে কুণ্ডলীর পর কুণ্ডলী রচনা করছে, শিকারের আশায় তার চেরা জিভ বার বার বেরিয়ে আসছে মুখের বাইরে।

ওই হচ্ছে কা, বালু বলল, ও এখন খোলস ছেড়েছে, এই সময় ওর চোখের দৃষ্টি ভালো চলে না, আর ও প্রায় সব সময়ই ক্ষুধার্ত থাকে। কাজেই সতর্ক থেকো। মনে রেখ, কা আঘাত করে বিদ্যুৎবেগে।

কা নির্বিষ সাপ, বিষধর সর্পের মতো দংশনে বিষ ঢেলে শিকারকে সে হত্যা করতে পারে না–কিন্তু তার ত্রিশ ফুট দীর্ঘ শরীরে অসাধারণ শক্তি, সে যদি শিকারকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারে, তাহলে আর রক্ষা নেই প্রচণ্ড পেষণে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে হাড়গোড় ভেঙে মৃত্যুবরণ করে হতভাগ্য শিকার।

উত্তম শিকার,কা-কে শুভেচ্ছা জানাল বালু। সর্পজাতি কানে কম শোনে, কা তাই প্রথমে বালুর কণ্ঠস্বর শুনতে পায়নি। মাথা একটু তুলে শরীরটাকে গুটিয়ে নিয়ে সে আঘাত হানার জন্য তৈরি হল; কিন্তু আঘাত করার পূর্বমুহূর্তে তার চোখে সব কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠল।

আমাদের সকলের জন্যই জুটবে উত্তম শিকার,কা বলল, আরে! বালু না? সঙ্গে বাঘিরাও রয়েছে দেখছি। আচ্ছা, বল তো, আশেপাশে শিকার আছে কি? আমার এখন ভীষণ খিদে পেয়েছে।

আমরা শিকারের খোঁজেই বেরিয়েছি, বালু জানাল।

তাহলে আমাকেও তোমাদের সঙ্গী হওয়ার অনুমতি দাও, কা বলল, বাঘিরা, তোমার পক্ষে শিকার জোটানো মোটেই কঠিন নয়। কিন্তু আমার অবস্থা ভাবো– দিনের পর দিন আমাকে অপেক্ষা করতে হয় হরিণের জন্য বনপথের পাশে, অথবা মাঝরাতে গাছে উঠে খোঁজাখুঁজি করতে হয়, যদি একটা বাঁদরের বাচ্চা পাওয়া যায় এই আশায়। এখনকার গাছগুলো তেমন সুবিধার নয়। আমার যৌবনে যেসব গাছ দেখেছি, সেগুলো ছিল দস্তুরমতো মজবুত এখনকার গাছগুলো নিতান্ত কমজোরি পস্কা, যে-কোনো সময়েই আমার ওজনে ডাল ভেঙে যেতে পারে।

বালু বলল, তোমার বয়স বেড়েছে, শরীর বেড়েছে আর শরীরের সঙ্গে ওজনটাও বেড়ে গিয়ে বিভ্রাটের সৃষ্টি করেছে।

হ্যাঁ, তোমার কথাটা সত্যি। আমার শরীরটা যে খুবই লম্বা, সেকথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এখনকার নতুন গাছগুলোই আমার দুরবস্থার জন্য দায়ী। এই দ্যাখো না, কয়েকদিন আগেই একরাতে হঠাৎ আমি পড়ে যাচ্ছিলাম– অতি কষ্টে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলাম বটে, কিন্তু গাছের গায়ে আমার শরীরের পাকগুলো ফসকে যাওয়ার শব্দ ঘুমন্ত বাঁদরের দলটাকে জাগিয়ে দিল। ফলে সেই রাতে আর আমার শিকার জুটল না। সারারাত রইলাম উপোস করে, তার উপর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো বাঁদরগুলো আমায় যাচ্ছেতাই করে গালাগালি দিল।

হ্যাঁ, আমিও শুনেছি, বাঘিরা বলল, বাঁদররা তোমায় বুকে-হাঁটা হলদে পোকা বলে। গালি দিয়েছে।

তাই নাকি? আমি বুকে-হাঁটা হলদে পোকা?

ওরা আরও বলেছে, বাঘিরা বলল, তুমি নাকি নিতান্ত ভীরু মাটির পোকা। ছাগলের বাচ্চা ছাড়া কোন জানোয়ারকে আক্রমণ করার সাহস তোমার নেই। এমন কী জোয়ান মদ্দা ছাগলকেও তুমি ভয় পাও, কারণ তারা শিং দিয়ে তোমাকে তো মারতে পারে।

কা-এর মতন বিশালদেহী অজগর রাগ হলেও তা চট করে প্রকাশ করে না, এখনও সে চুপ করেই রইল– কেবল তার চোয়ালের প্রচণ্ড শক্তিশালী পেশীগুলো ফুলে উঠে বুঝিয়ে দিল কা এখন বাঁদরদের উপর ভীষণ রেগে গেছে।

ওই বাঁদরদেরই আমরা অনুসরণ করছি, বালু বলল। কথাটা বলেই সে চুপ হয়ে গেল। কারণ, বনবাসী কোনো জন্তু কখনো বাঁদরদের নিয়ে মাথা ঘামায় না, বাঁদরদের সম্বন্ধে কৌতূহল প্রকাশও পশুসমাজে লজ্জার বিষয়।

ব্যাপারটা নিশ্চয়ই খুব গুরুতর, কা বলল, না হলে বালু আর বাঘিরার মতো দুই বিখ্যাত শিকারি বাঁদরদের অনুসরণ করত না। আচ্ছা, ব্যাপারটা কী বল তো?

তখন খুব সংক্ষেপে বালু আর বাঘিরা জানাল যে, মোগলি নামে মানুষের বাচ্চাটাকে তাদের কাছ থেকে তুলে নিয়ে গেছে বাঁদরের দল এবং তাকে উদ্ধার করার জন্যই কা-এর সাহায্যপ্রার্থী হয়েছে তারা। বর্তমানে বাঁদরগুলো মোগলিকে নিয়ে কোথায় আছে, তা অবশ্য দুই বন্ধু জানে না, তবে তার আশা বাঁদরগুলো মোগলিকে যেখানে নিয়ে গেছে, সেই জায়গাটা কা জানে।

আমি ওই মানুষের বাচ্চাটার কথা শুনেছি, তবে তাকে কখনো দেখিনি, কা বলল, তোমাদের সাহায্য করতে আমি রাজি আছি। কিন্তু বাঁদররা বাচ্চাটাকে নিয়ে কোথায় রয়েছে তা আমি জানি না। আমার সামনে পড়লে বাঁদরদের আমি শিকার করি বটে, তবে তাদের খোঁজে জঙ্গল ভেঙে আমি ঘোরাঘুরি করি না।

উপরে, উপরে, উপরে তাকাও-ঈ-ঈ-ঈ- সিওনী নেকড়েদের শিক্ষাগুরু বালু উপরে তাকাও!

সবিস্ময়ে শব্দ লক্ষ্য করে মুখ তুলল বালু;- আকাশ থেকে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে নেমে আসছে চিল। সন্ধ্যা নামছে, এখন চিলের বাসায় ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে কিন্তু ঘন জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে বালুকে এতক্ষণ দেখতে পায়নি বলেই আকাশে টহল দিচ্ছিল চিল। আমি মোগলিকে দেখেছি। নদীর ওপারে শীতল গহ্বর নামে বাঁদরদের যে-শহরটা আছে, সেখানে মোগলিকে নিয়ে গেছে বাঁদরের দল। আমি বাদুড়দের বলে এসেছি তারা যেন রাত্রে মোগলির উপর নজর রাখে। খবরটা তোমাদের দিলাম। এখন তোমরা, যারা তলায় রয়েছ, তাদের সকলের যেন উত্তম শিকার জুটে যায়, এই কামনা করি।

সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আসন্ন রাত্রির ঘনায়মান অন্ধকারে ডানা মেলে চিল উধাও হল তার আস্তানার উদ্দেশ্যে…

আর কথা নয়, বাঘিরা বলল, এখন আমরা শীতল গহ্বর নামে কুখ্যাত শহরের দিকে যাত্রা করব।

চিল এবং বাঘিরা শীতল গহবর নামে যে-শহরটার উল্লেখ করল, একসময় সেখানে বাস করত বহু মানুষ। বহুকাল পূর্বেই সেটা পরিত্যক্ত হয়ে বাঁদরদের বাসস্থানে পরিণত হয়েছে। বনবাসী জন্তুরা ওই পরিত্যক্ত শহরের সন্ধান জানলেও কেউ সেখানে পদক্ষেপ করে না।

বাঘিরা বলল, খুব জোরে ছুটলে রাত্রির মাঝামাঝি সময়ে ওই পরিত্যক্ত শহরে পৌঁছাতে পারব।

কা বলল, আমার পা থাকলেও আমি যে-কোনো চারপেয়ে জন্তুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারি।

কা মিছে জাঁক করেনি। দ্রুতগতির জন্য চিতাবাঘ বিখ্যাত তবু তীরবেগে ধাবমান বাঘিরার সঙ্গে সমানভাবেই ছুটছিল পাহাড়ি অজগর কা। মাঝে মাঝে পথে যখন পাহাড়ি নদী পড়ছিল, তখন অবশ্য লাফ মেরে নদী ডিঙ্গিয়ে অজগরকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল বাঘিরা– কিন্তু নদী পার হয়েই আবার স্বচ্ছন্দে বাঘিরাকে ধরে ফেলছিল কা।

বাঘিরা বিস্মিত কণ্ঠে বলল, তুমি তো বেশ তাড়াতাড়ি ছুটতে পার, দেখছি!

আমি ক্ষুধার্ত,কা বলল, তাছাড়া বাঁদরগুলোকে কিছু শিক্ষা দেওয়া দরকার। ওরা আমাকে পোকা বলেছে।

শুধু পোকা নয়, বাঘিরা হাসল, মাটির পোকা– হলুদ রং-এর মাটির পোকা।

তাড়াতাড়ি চলো।

চলার গতি আরও বাড়িয়ে দিল অজগর, ঝড়ের বেগে ছুটে চলল সরীসৃপ ও শ্বাপদ, দ্রুত থেকে দ্রুততর হল তাদের গতি…।

পরিত্যক্ত শহরের ভিতর মোগলিকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল বাঁদরের দল, কিন্তু মোগলির বন্ধুদের নিয়ে তারা একটুও চিন্তিত ছিল না। একটা মস্ত প্রাসাদ যেটা ছিল রাজবাড়ি তার ছাদের উপর মোগলিকে নিয়ে বসেছিল একদল বাঁদর। মোগলির দারুণ খিদে পেয়েছিল, কিন্তু বাঁদররা তাকে কিছুই খেতে দেয়নি। কয়েকটা বাঁদর অবশ্য তার জন্য ফলমূল সংগ্রহ করতে গিয়েছিল, তবে সেই ফল শেষ পর্যন্ত মোগলির হাতে পৌঁছায়নি। কারণ ফল নিয়ে ফেরার সময় ঝগড়া বেধে গেল, মারামারির সময়ে ফলগুলো ছিটকে পড়ল মাটিতে এবং লড়াই যখন শেষ হল, তখন বাহকরা ফলের কথা ভুলে গেছে একেবারেই।

মোগলিকে মাঝখানে বসিয়ে তার চারদিকে ভিড় করল অসংখ্য বাঁদর। তারপর শুরু হল বক্তৃতা একজনের পর আর একজন বাঁদর উঠে জানাতে লাগল তারা বনবাসী পশুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং মোগলিকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে তারা অত্যন্ত খুশি হয়েছে। মোগলিও যে তাদের মতো বুদ্ধিমান প্রাণীদের সাহচর্যে এসে উপকৃত হয়েছে, একথাও জানাতে ভুলল না তারা। বার বার একই কথা বলতে লাগল বিভিন্ন বক্তা। মোগলি তাদের কথায় কান দিচ্ছিল না, সে লক্ষ্য করছিল একটা কালো মেঘ এগিয়ে আসছে এই বুঝি মেঘটা ঢেকে ফেলল চাঁদকে…।

পরিত্যক্ত শহরের ভগ্ন প্রাচীরের তলায় একটা খাদের ভিতর থেকে ওই মেঘটাকে লক্ষ্য করছিল আরও দুজন– কা এবং বাঘিরা। তারা দুজনেই জানত দলে ভারী হলে বাঁদররা যেকোনো জানোয়ারকেই আক্রমণ করতে পারে অবশ্য একের বিরুদ্ধে সংখ্যাটা যখন একশো দাঁড়ায়, তখনই তারা সাহসী হয়ে ওঠে। বাঘিরা আর কা তাই অন্ধকার গাঢ় হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। রাত্রির ঘন অন্ধকার যখন বাঁদরদের দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দেবে, তখনই আঘাত হানবে তারা।

আমি পশ্চিমদিকের পাঁচিলের কাছে যাব, কা ফিস ফিস করে বলল, ওইদিকের নীচু জমি দিয়ে আমি খুব তাড়াতাড়ি নেমে আসতে পারব। ওরা কখনোই আমার পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহস পাবে না, কিন্তু

জানি, বাঘিরা বলল, ওরা এখন দলে-ভারী, আমায় আক্রমণ করতে ওরা ভয় পাবে না। বালু থাকলে ভালো হত, কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করা উচিত হবে না। মেঘটা চাঁদকে ঢেকে ফেললেই আমি ছাদের উপর উপস্থিত হব। ওখানে ছেলেটাকে ঘিরে বাঁদরদের পরামর্শ সভা বসেছে।

কিছুক্ষণ পরেই মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ল চাঁদ। উত্তম শিকার, বলেই পশ্চিমের পাঁচিল লক্ষ্য করে চলতে লাগল কা। মোগলি যখন ভাবছে এবার কী ঘটতে পারে, ঠিক তখনই ছাদের উপর বাঘিরার মৃদু পদশব্দ শুনতে পেল সে। কালো চিতা প্রায় নিঃশব্দে উঠে এল ছাদে এবং নীরবেই আঘাত হানল সে- মোগলিকে ঘিরে বসেছিল পঞ্চাশ কী ষাটটি বাঁদর বাঘিরার প্রচণ্ড থাবা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কয়েকটি বাঁদরকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল বাঁদরের দল, তারপর হঠাৎ একটি বাঁদর চেঁচিয়ে উঠল, একজন মাত্র, একজন আমাদের আক্রমণ করেছে। মারো, মারো, ওকে খুন কর।

তৎক্ষণাৎ জান্তব বন্যার মতো বাঘিরার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল একপাল বাঁদর— আঁচড়ে, কামড়ে, টানাটানি করে শত্রুর প্রাণবিপন্ন করে তুলল। পাঁচ-ছ-টা শক্তিশালী বাঁদর মোগলিকে টেনে নিয়ে একটা ভাঙা গম্বুজের গর্তের ভিতর ধাক্কা মেরে ফেলে দিল, এখন এখানেই থাকো। তোমার বন্ধুদের হত্যা করার পর আমরা তোমার সঙ্গে খেলব– অবশ্য ততক্ষণ পর্যন্ত বিষাক্ত জনগণ যদি তোমায় জীবিত রাখে।

মানুষের ঘরে পালিত মোগলির বয়সী কোনো ছেলেকে যদি ওইভাবে ফেলে দেওয়া হত, তাহলে নিশ্চয়ই সে আঘাত পেত সাংঘাতিকভাবে কিন্তু বালুর শিক্ষা ভুলে যায়নি মোগলি, এমন কৌশলে দু-পায়ের উপর ভর করে সে তলার জমিতে পড়ল যে, প্রায় পনেরো ফুট উপর থেকে পড়েও তার দেহ ছিল সম্পূর্ণ অক্ষত! পতনের ধাক্কা সামলে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েই মোগলি সাপের ভাষায় বলে উঠল, তোমরা আর আমি একই রক্তের অধিকারী!

পড়ে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে তার চারদিকে সরীসৃপের চলমান দেহের শব্দ শুনতে পেয়েছিল মোগলি। ভারতের সব পরিত্যক্ত অট্টালিকাই হচ্ছে বিষাক্ত সর্পকুলের প্রিয় বাসস্থান। এই শহরের ভগ্ন গৃহ ও প্রাসাদগুলিও ওই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল না।

মোগলির ঘোষণার উত্তর এল হিস হিস শব্দে, ছোটো ভাইটি, স্থির হয়ে দাঁড়াও। নড়া-চড়া করলে তোমার পায়ের আঘাতে আমাদের আহত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

বালুর শিক্ষা আবার কাজে লাগল– নিকটবর্তী সর্পগণের সঙ্গে তাদের নিজস্ব ভাষায় বন্ধুত্ব ঘোষণা না করলে বিষাক্ত দংশনে মোগলির মৃত্যু ছিল অবধারিত।

সরীসৃপ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে অন্যদিকে মন দিল মোগলি- রাতের বাতাসে ভেসে আসছিল লড়াই-এর শব্দ। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সেই শব্দ শুনতে শুনতে মোগলি ভাবতে লাগল, বাঘিরা নিশ্চয়ই একা আসেনি, সঙ্গে বালুও রয়েছে মনে হয়।

লড়াই-এর শব্দ শুনে মোগলি বুঝতে পারল অসংখ্য বাঁদরের আক্রমণে বাঘিরার জীবন এখন বিপন্ন– সে চিৎকার করে উঠল, বাঘিরা! বাঘিরা! যেমন করে পার পুকুরের দিকে চলে যাও। জলে ঝাঁপিয়ে পড়ো।

মোগলির কণ্ঠস্বর বাঘিরার দেহে ও মনে নূতন শক্তি সঞ্চার করল, সে বুঝল তার প্রিয় ছোট্ট ভাইটি এখনও জীবিত এবং বিপদ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি সে সনখ থাবার প্রচণ্ড চপেটাঘাতে বানরবাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে অগ্রসর হতে লাগল জলাশয়ের দিকে। আর ঠিক তখনই ভগ্ন প্রাচীরের নিকটবর্তী জঙ্গল থেকে ভেসে এল বালুর রণহুঙ্কার, বাঘরা! আমি এসে পড়েছি। এখনই আমি পাঁচিলটা টপকে আসছি। হতভাগা বাঁদরের দল! দাঁড়া, আমি আসছি– অররর! ঝড়ের মতন বাঁদরের পালে হানা দিল বালু, পিছনের দুই পায়ে ভর করে সামনের দুই থাবা দিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত করতে লাগল– দুটি নৌকার দাঁড় যেন সশব্দে আছড়ে পড়তে লাগল বাঁদরদের দেহে ফট! ফট! ফট!

হঠাৎ একটা ভারী শরীর জলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ শুনতে পেল মোগলি- সে বুঝল বাঘিরা বানরবাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে জলাশয়ের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে।

বাঁদরগুলো পুকুরের পাড়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আস্ফালন করতে লাগল। বাঘিরা জল থেকে উঠে বালুকে সাহায্য করতে অগ্রসর হলেই তারা আবার দল বেঁধে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

জলের উপর মুখ তুলল বাঘিরা, তারপর সর্পজাতির ভাষায় চিৎকার করে সাহায্য প্রার্থনা করল, তুমি আর আমি একই রক্তের অধিকারী।

বালুর দেহের উপর তখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে অনেকগুলো বাঁদর, তাদের সঙ্গে প্রাণপণে যুদ্ধ করতে করতেও হাসি চাপতে পারল না বাল– অরণ্যের বিভীষিকা বাঘিরা, অসমসাহসী বাঘিরা- আজ সাহায্য চাইছে প্রাণভয়ে!

সাহায্য এল তৎক্ষণাৎ

পশ্চিমদিকের পাঁচিল ডিঙিয়ে নিঃশব্দে শহরের ভিতর প্রবেশ করেছিল কা, বাঁদরদের লক্ষ্য করে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে সে এগিয়ে আসছিল ধীরে ধীরে এইবার বালুর চারদিক ঘিরে যে বাঁদরের দলটা আক্রমণ চালাচ্ছিল, সেই ভিড়ের ঠিক মাঝখানে সজোরে ছোবল মারল কা!

একটা সাত-আট ফুট লম্বা অজগর যেকোনো বলিষ্ঠ মানুষের বুকে ছোবল মেরে তাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলতে পারে তাহলে অনুমান কর কা-এর মতো ত্রিশ ফুট লম্বা একটা অজগরের ছোবল কতটা মারাত্মক হতে পারে! কা-এর মাথাটা একটা প্রকাণ্ড বল্লমের মতন ছুটে এসে বানরদের ছত্রভঙ্গ করে দিল। দ্বিতীয়বার আঘাত করার দরকারই হল না। ভয়ার্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল বাঁদরের দল, কা! কা! কা এসেছে! পালাও! পালাও!

বাঁদরের দল ছুটে পালাতে লাগল ঊর্ধ্বশ্বাসে কা-এর কবল থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য তারা চটপট লাফ মেরে উঠে পড়ল ভাঙাবাড়ির দেয়ালে আর ছাদে। বালুও নিষ্কৃতি পেয়ে একটা গভীর শ্বাসগ্রহণ করল। জলাশয় ত্যাগ করে ডাঙায় উঠে সশব্দে ঝাড়া দিয়ে গায়ের জল ঝেড়ে ফেলল বাঘিরা। আর তখনই হিস হিস শব্দে বানরদের প্রতি তার বিদ্বেষ ও ঘৃণা প্রকাশ করল কা। সেই শব্দ শুনে ভীষণ আতঙ্কে চলচ্ছক্তি হারিয়ে স্থির হয়ে গেল বাঁদরের দল। মোগলি তখন ভাঙাবাড়ির গর্তটার মধ্যে লাফাচ্ছে আর চিৎকার করছে।

মানুষের বাচ্চাটাকে ওই ফাঁদ থেকে উদ্ধার কর, বাঘিরা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ওরা আবার আক্রমণ করার আগেই মোগলিকে নিয়ে আমরা সরে পড়তে চাই।

আমার হুকুম না পেলে ওরা নড়বে না। শ-শ-শ– যেখানে আছ, সেখানেই থাকো, বানরদের উদ্দেশে কা হুকুম জারি করল। সমগ্র পরিত্যক্ত নগরীর বুকে নেমে এল ভয়াবহ স্তব্ধতা, বাঁদররা হয়ে পড়ল প্রাণহীন মূর্তির মতো নিশ্চল, নীরব।

আমার একটু দেরি হয়ে গেল, বাঘিরার দিকে তাকাল কা, তুমি বোধ হয় আমাকে ডাকছিলে?

ইয়ে-হা-আমি-আমি হয়তো লড়াই-এর সময় তোমাকে ডেকেছিলাম, বাঘিরা জবাব দিল, বালু, তুমি জখম হওনি তো?

বিলক্ষণ! আমার সারা শরীর জ্বালা করছে, মনে হচ্ছে শরীরটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, বালু বলল, কিন্তু আমরা কা-এর কাছে কৃতজ্ঞ কা সাহায্য না করলে বাঘিরা এবং আমার মৃতদেহ এখানেই পড়ে থাকত।

ওসব কথা যেতে দাও, কা বলল, মানুষের বাচ্চাটা এখন কোথায় আছে?

এই যে আমি এখানে, ভাঙা গম্বুজের ভিতর থেকে মোগলি বলে উঠল। তার মাথার অনেক উপরে রয়েছে গোলাকৃতি ছাদের ভগ্নাংশ।

আমি ফাঁদে আটকা পড়েছি, মোগলি চেঁচিয়ে উঠল, বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছি না।

ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও, হিস্ হিস্ শব্দে বলল অনেকগুলো গোখরো সাপ, ও এমন লাফাচ্ছে যে, আমাদের বাচ্চাগুলো যেকোনো সময়ে ওর পায়ের চাপে মারা পড়তে পারে।

অস্ফুট শব্দে হেসে উঠল কা, মানুষের বাচ্চাটা দেখছি সকলের সঙ্গেই বন্ধুত্ব করতে পারে। সরে দাঁড়াও মানুষের খোকা; ওহে বিষাক্ত জনগণ, তোমরাও গা-ঢাকা দাও আমি দেয়ালটা ভাঙছি।

সমস্ত শরীর গুটিয়ে নিল কা, দেয়ালের একটা ফাটল পরীক্ষা করল, সেই দুর্বল জায়গাটা নাক দিয়ে একবার আস্তে ধাক্কা মারল তারপর মাটি থেকে শরীরটা ছ-ফুট উপরে তুলে ভীষণ জোরে পর পর ছয়বার আঘাত করল ফাটা জায়গাটার উপরে।

ধুলোর মেঘ তুলে সশব্দে ভেঙে পড়ল দেয়াল, ভাঙা পাথর আর আবর্জনার স্তূপ ভেদ করে একলাফে বেরিয়ে এল মোগলি, দাঁড়িয়ে পড়ল বালু আর বাঘিরার মাঝখানে দুই হাতে আঁকড়ে ধরল দুটি প্রকাণ্ড ঘাড়।

পরম আদরে তাকে জড়িয়ে ধরে বালু জিজ্ঞাসা করল, তোমার আঘাত লাগেনি তো?

আমার শরীরে অনেক জায়গায় কেটে গেছে, থেতলে গেছে, খিদেও পেয়েছে সাংঘাতিক, মোগলি বলল, কিন্তু তোমরা ভীষণ মার খেয়েছ, তোমাদের গা থেকে রক্ত পড়ছে।

ওদের অবস্থাও আমাদের চাইতে ভালো নয়, জলাশয়ের ধারে এবং ভগ্নস্তূপের উপর বাঁদরদের মৃতদেহগুলির দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল বাঘিরা।

ওইটুকু আঘাত আমরা গ্রাহ্য করি না, তোমাকে বিপদ থেকে মুক্ত করতে এইটুকু আঘাত আমরা অনায়াসে সহ্য করতে পারি।

এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা পরে চিন্তা-ভাবনা করব, বাঘিরার নীরস কণ্ঠস্বর শুনে মোটেই খুশি হল না মোগলি, কিন্তু কা না থাকলে এই লড়াইতে আমরা জিততে পারতাম না, আর তোমারও প্রাণরক্ষা হত না। ওকে ধন্যবাদ জানাও মোগলি।

ঘুরে দাঁড়িয়ে মোগলি দেখল তার মাথার উপর এক ফুট উপরে শূন্যে দুলছে প্রকাণ্ড এক অজগরের মাথা।

ওঃ! এই তাহলে সেই মানুষের বাচ্চা, কা বলল, তোমাকে দেখতে বাঁদরছানার মতো, শরীরটাও দেখছি বেশ নরম তুলতুলে। দ্যাখো বাপু, আমি খোলস ছাড়ার পর কিছুদিন চোখে ঝাপসা দেখি- সেই সময় হঠাৎ আমার সামনে এসে পড়লে আমি হয়তো তোমাকে বাঁদর বলে ভুল করতে পারি। সুতরাং সাবধান!

তুমি আর আমি একই রক্তের অধিকারী, মোগলি বলল, আজ তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। কা, তুমি যদি ক্ষুধার্ত হও, তাহলে আমার শিকারে তুমি ভাগ বসাতে পারবে সর্বদাই।

ধন্যবাদ, ছোট্ট ভাইটি, ধন্যবাদ, কা-এর দুই চোখে চাপা হাসির আভাস, এমন সাহসী শিকারি কী শিকার করতে পারে? জানা থাকলে আমিও তাকে অনুসরণ করতে পারব।

না, এখন আমি কিছু শিকার করতে পারি না; কারণ, আমি খুবই ছোটো, মোগলি বলল, তবে আমি তোমার মুখে ছাগল তাড়িয়ে নিয়ে আসতে পারি। বালু, বাঘিরা আর তোমাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তোমাদের সকলেরই যেন উত্তম শিকার জোটে, এই কামনা করি।

অজগর তার মাথাটা নামিয়ে এনে রাখল মোগলির কাঁধে, সাহসী হৃদয় আর মুখের ভদ্র ভাষা, সে বলল, তোমাকে জঙ্গলের অনেক বিপদ থেকে বাঁচাবে, মানুষের খোকা। এইবার তুমি তোমার বন্ধুদের সঙ্গে নিজের আস্তানায় ফিরে যাও। চঁদ ডুবে যাচ্ছে, এখন এইখানে যা ঘটবে, তা তোমার দেখা উচিত হবে না।

পাহাড়ের পিছনে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে সঁদ, ভয়ার্ত বাঁদরের দল অট্টালিকার ছাদে আর প্রাচীরে বসে আছে জড়সড় হয়ে আবছা আলো-আঁধারিতে মনে হচ্ছে অনেকগুলো প্রাণহীন জড়পদার্থ পড়ে আছে পরিত্যক্ত নগরীর বুকে। বালু জলাশয়ের দিকে এগিয়ে গেল তৃষ্ণা নিবারণ করতে। বাঘিরা তার সর্বাঙ্গে অবিন্যস্ত রোমরাশি আবার বিন্যস্ত করতে সচেষ্ট হল। কা ছাদের মাঝখানে এসে হাঁ করল, তারপর এত জোরে শব্দ তুলে দুই চোয়াল বন্ধ করল যে, চারদিকের সমবেত বাঁদরের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল তার দিকে।

ওহে বাঁদরের দল, এইবার শুরু হবে নাচ– অজগর কা-এর ক্ষুধিত নৃত্য, কা বলল, তোমরা স্থির হয়ে সেই নৃত্য দর্শন কর।

তারপর কা-এর মাথা দুলতে লাগল ডাইনে আর বাঁয়ে, তার সুদীর্ঘ দেহ কুণ্ডলী পাকিয়ে অনেকগুলি বৃত্ত সৃষ্টি করে আবার মিলিয়ে গিয়ে ত্রিভুজ তৈরি করল এবং ত্রিভুজগুলিও ধীরে ধীরে চতুষ্কোণ হয়ে আবার বৃত্ত ও ত্রিভুজের আকার ধারণ করতে লাগল, কোনো সময়েই সেই দীর্ঘ শরীর স্থির ছিল না, কিংবা কুণ্ডলীর ধীর সঞ্চালন কখনোই দ্রুত হচ্ছিল না। আর সেই ভয়াবহ সৰ্পনৃত্যের সঙ্গে চলছিল অজগরের কণ্ঠনিঃসৃত অবরুদ্ধ গর্জনধ্বনি, অবিরাম অবিরত। অবশেষে কুণ্ডলীগুলি মিলিয়ে গেল, কিন্তু সর্পদেহের শুল্ক বা আঁশগুলির চলাচলের শব্দ শোনা যাচ্ছিল তখনও!

বালু আর বাঘিরা নিশ্চল প্রস্তরমূর্তির মতোই স্থির হয়ে দেখছিল অজগরের সেই ক্ষুধিত নৃত্য, তাদের ঘাড়ের লোম তখন খাড়া হয়ে উঠেছে এবং গলা থেকে বেরিয়ে আসছে চাপা গর্জন– মোগলিও সেই দৃশ্য দেখছে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে।

বাঁদরের দল, হিস হিস করে উঠল কা, আমার হুকুম না পেলে তোমরা হাত-পা নাড়তে পার? বল?

তোমার হুকুম না পেলে আমরা হাত-পা নাড়তে পারি না, কা।

বেশ! বেশ! সবাই এগিয়ে এস!

অসহায়ভাবে এগিয়ে এল বাঁদরের দল। তাদের সঙ্গে এগিয়ে গেল বাঘিরা ও বালু!

আরও কাছে, বলে উঠল কা।

বালু আর বাঘিরাকে টেনে ধরে রাখল মোগলি। তারা দুজনেই চমকে উঠল, মনে হল তারা যেন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিল– এইমাত্র জেগে উঠেছে।

মোগলি! আমার কাঁধে তোমার হাত রাখ, বাঘিরা মৃদুস্বরে বলল, তোমার হাত আমাকে ছুঁয়ে না রাখলে আমি কা-এর কাছে চলে যাব।

বুড়ো অজগর কা ওখানে ধুলোর উপর কুণ্ডলী পাকাচ্ছে, মোগলি বলল, চল, আমরা এখান থেকে চলে যাই।

ওফ! জঙ্গলের মধ্যে অনেক দূরে এসে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে বালু বলে উঠল, আমি আর কখনো কা-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে যাব না। বালু শরীরটাকে ঝাঁকুনি দিল, যেন সে একটা অমঙ্গলকে শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।

কা আমাদের চাইতে অনেক বেশি খোঁজখবর রাখে, বাঘিরা বলল, ওখানে যদি আর একটু সময় থাকতাম, তাহলে আমিও ঢুকে যেতাম কা-এর গলার মধ্যে!

চাঁদ আবার আকাশে দেখা দেওয়ার আগেই আরও অনেক প্রাণী ওই পথে ঢুকে যাবে, বালু বলল, আজ রাতে কা তার পছন্দমতো অনেক শিকার পাবে সন্দেহ নেই।

এসব কথার মানে কী? মোগলি জানত না অজগরের সম্মোহন-শক্তি কতখানি ভয়ংকর, তাই হেসে উঠে বলল, আমি দেখলাম মস্ত বড়ো একটা সাপ মাটির উপর কুণ্ডলীর পর কুণ্ডলী পাকাচ্ছে! ওই সাপটার নাক ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে– হো! হো!

মোগলি, বাঘিরা ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, তোমার জন্যেই ওর নাক ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, তোমার জন্যই আমার আর বালুর সর্বাঙ্গে পড়েছে বাঁদরদের কামড়– আমি আর বালু বেশ কিছুদিন সহজভাবে শিকার করতে পারব না।

ওটা এমন কিছু গুরুতর ব্যাপার নয়, বালু বলল, আমাদের সৌভাগ্য যে, ছোট্ট মোগলিকে আমরা অক্ষতভাবে ফিরে পেয়েছি।

তা সত্যি। তবে আমাদের শরীর নষ্ট হয়েছে, সময় নষ্ট হয়েছে এবং সবচেয়ে দুঃখের বিষয় যে, আমার সম্মান নষ্ট হয়েছে। আমি একটা কালো চিতা, জঙ্গলে সবাই আমাকে সমীহ করে আমিও প্রাণরক্ষার জন্য কা-এর কাছে সাহায্য চাইতে বাধ্য হয়েছি। বালু আর আমি কা-এর ক্ষুধিত নৃত্য দেখে ছোটো পাখির মতন সম্মোহিত হয়ে পড়েছিলাম। কী লজ্জার বিষয়! এই সব বিপর্যয়ের জন্য দায়ী মোগলি। ও যদি বাঁদরদের সঙ্গে খেলা না করত, তাহলে এত সব বিশ্রী ব্যাপার ঘটত না।

সত্যি কথা, মোগলি বিমর্ষভাবে বলল, আমি খুব দুষ্টু একটা মানুষের বাচ্চা। আমি খুবই দুঃখিত।

হুম! এ বিষয়ে জঙ্গলের আইন কী বলে বালু?

মোগলিকে আর কষ্ট দিতে চাইছিল না বালু, কিন্তু তাকেও জঙ্গলের আইন মেনে চলতে হয়। তাই অস্পষ্টস্বরে সে বলল, দুঃখিত হলেও অপরাধীকে শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু বাঘিরা মনে রেখ, ও খুবই ছোটো।

মনে রাখব। কিন্তু ও অন্যায় করেছে। সেইজন্য ওকে শাস্তি পেতেই হবে। এবিষয়ে তোমার কী বলার আছে, মোগলি?

কিছু না। আমি অন্যায় করেছি। আমার জন্যই তুমি আর বালু জখম হয়েছ। আমার প্রাপ্য শাস্তি আমি নিতে প্রস্তুত।

বাঘিরা তাকে ছয়টি থাপ্পড় মারল। চিতাবাঘের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে আঘাতগুলো বিশেষ জোরালো নয়, তবে একটি সাত-আট বছরের মনুষ্যশিশুর পক্ষে আঘাতগুলো ছিল খুবই সাংঘাতিক শাস্তির পালা মিটে গেলে ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে পড়ল মোগলি, তারপর হেঁচে ফেলল।

এবার আমার পিঠে ওঠ, বাঘিরা বলল, এখন আমরা নিজেদের আস্তানায় ফিরে যাব।

অরণ্যে প্রচলিত আইনের একটা চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে যে শাস্তির পালা চুকে গেলে তার কোনো রেশ থাকে না- দণ্ডদাতা এবং দণ্ডিত, দুজনেই মনে করে তারা তাদের কর্তব্যপালন করেছে।

মোগলি বাঘিরার পিঠের উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। গুহার মেঝেতে তাকে শুইয়ে দেওয়ার আগে তার সেই ঘুম আর ভাঙেনি।