[১৮৯৯ খ্রীঃ ২০ জুন তারিখে স্বামীজী দ্বিতীয়বার আমেরিকা যাত্রা করেন। পূর্বদিন ১৯ জুন সন্ধ্যায় বেলুড় মঠে তরুণ সন্ন্যাসী ও শিষ্যগণের একটি সভায় স্বামীজী ইংরেজীতে একটি ক্ষুদ্র বক্তৃতা দেন। মঠের ডায়েরীতে বক্তৃতার সারাংশ রক্ষিত হয়। নিম্নে তাহার বঙ্গানুবাদ দেওয়া হইল।]
ভ্রাতৃগণ ও সন্তানগণ,
এখন দীর্ঘ বক্তৃতা দিবার অথবা বক্তৃতাশক্তি প্রকাশ করিবার সময় নয়। আমি তোমাদিগকে কয়েকটি বিষয় বলিতে ইচ্ছা করি। আশা—তোমরা এইগুলি কার্যে পরিণত করিবে। প্রথমতঃ আমাদের আদর্শ কি, তাহা বুঝিতে হইবে; দ্বিতীয়তঃ উহা কার্যে পরিণত করিবার উপায়গুলি কি, তাহাও বুঝিতে হইবে। তোমাদের মধ্যে যাহারা সন্ন্যাসী, তাহাদিগকে পরের কল্যাণের জন্য চেষ্টা করিতেই হইবে, কারণ সন্ন্যাসী বলিতে তাহাই বুঝাইয়া থাকে। ত্যাগ সম্বন্ধে সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিবার সময় এখন নাই, আমি সংক্ষেপে উহার লক্ষণ নির্দেশ করিতে চাইঃ মৃত্যুকে ভালবাসা। সাংসারিক ব্যক্তি জীবন ভালবাসে, সন্ন্যাসীকে মৃত্যু ভালবাসিতে হইবে। তবে কি আমাদিগকে আত্মহত্যা করিতে হইবে? তাহা কখনই হইতে পারে না। কারণ আত্মহত্যাকারিগণ প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুকে ভালবাসে না। দেখাও যায়—আত্মহত্যা করিতে চেষ্টা করিয়া যদি কেহ তাহাতে অকৃতকার্য হয়, সে পুনরায় ঐ চেষ্টা প্রায় করে না। তবে মৃত্যুকে ভালবাসার অর্থ কি? তাৎপর্য এইঃ আমাদিগকে মরিতেই হইবে, ইহা অপেক্ষা ধ্রুব সত্য কিছুই নাই; তবে আমরা কোন মহৎ সৎ উদ্দেশ্যের জন্য দেহপাত করি না কেন? আমাদের সকল কাজ—আহার, বিহার, অধ্যয়ন প্রভৃতি যাহা কিছু আমরা করি—সব যেন আমাদিগকে আত্মত্যাগের অভিমুখী করিয়া দেয়। তোমরা আহারের দ্বারা শরীর পুষ্ট করিতেছ, কিন্তু শরীর পুষ্ট করিয়া কি হইবে, যদি উহাকে আমরা অপরের কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করিতে না পারি? তোমরা অধ্যয়নাদি দ্বারা মনের পুষ্টি বিধান করিতেছ—ইহাতেই বা কি হইবে, যদি অপরের কল্যাণের জন্য জীবন উৎসর্গ করিতে না পার? কারণ সমগ্র জগৎ এক অখণ্ড-সত্তাস্বরূপ—তুমি তো ইহার নগণ্য ক্ষুদ্র অংশমাত্র; সুতরাং এই ক্ষুদ্র আমিত্বটাকে না বাড়াইয়া তোমার কোটি কোটি ভাইয়ের সেবা করাই তোমার পক্ষে স্বাভাবিক কাজ, না করাই অস্বাভাবিক। উপনিষদের সেই মহতী বাণী কি মনে নাই?—
সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোঽক্ষিশিরোমুখম্।
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি॥৭৭
তোমাদিগকে ধীরে ধীরে মরিতে হইবে। মৃত্যুতেই স্বর্গ—মৃত্যুতেই সকল কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত, আর ইহার বিপরীত বস্তুতে সমুদয় অকল্যাণ ও আসুরিক ভাব নিহিত।
তারপর এই আদর্শটিকে কার্যে পরিণত করিবার উপায়গুলি কি, তাহা বুঝিতে হইবে। প্রথমতঃ এইটি বুঝিতে হইবে, অসম্ভব আদর্শ ধরিয়া থাকিলে চলিবে না। অতিমাত্রায় উচ্চ আদর্শ জাতিকে দুর্বল ও হীন করিয়া ফেলে। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম-সংস্কারের পর এইটি ঘটিয়াছে। অপর দিকে আবার অতিমাত্রায় ‘কাজের লোক’ হওয়াও ভুল। যদি এতটুকুও কল্পনাশক্তি তোমার না থাকে, যদি তোমাকে নিয়ন্ত্রিত করিবার একটা আদর্শ না থাকে, তবে তুমি তো একটা পশুমাত্র। অতএব আমাদিগকে আদর্শও খাটো করিলে চলিবে না, আবার যেন আমরা কর্মকেও অবহেলা না করি। এই দুইটি ‘অত্যন্ত’কে ছাড়িতে হইবে। আমাদের দেশের প্রাচীন ভাব এই—কোন গুহায় বসিয়া ধ্যান করিতে করিতে মরিয়া যাওয়া। কিন্তু এখন এই বিষয়টি ভাল করিয়া বুঝিতে হইবে যে, আমি অপরের পূর্বে তাড়াতাড়ি মুক্তিলাভ করিব—এ-ভাবটিও ভুল। মানুষ শীঘ্র বা বিলম্বে বুঝিতে পারে, যদি সে তাহার নিজ ভ্রাতার মুক্তির চেষ্টা না করে, তবে সে কখনই মুক্ত হইতে পারে না। তোমাদের জীবনে যাহাতে প্রবল আদর্শবাদের সহিত প্রবল কার্যকারিতা যুক্ত থাকে, তাহা করিতে হইবে। তোমাদিগকে গভীর ধ্যান-ধারণার জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে, আবার পরমুহূর্তেই এই মঠের জমিতে চাষ করিবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে। তোমাদিগকে শাস্ত্রীয় কঠিন সমস্যাসমূ্হ সমাধানের জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে, আবার পরমুহূর্তেই এই জমিতে যে ফসল হইবে, তাহা বাজারে বিক্রয় করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। তোমাদিগকে ছোটখাটো গৃহকর্ম, এমন কি পায়খানা পর্যন্ত সাফ করিবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে, শুধু এখানে নয়, অন্যত্রও।
তারপর তোমাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে, এই মঠের উদ্দেশ্য—মানুষ গঠন করা। অমুক ঋষি এই কথা বলিয়াছেন—শুধু এইটি শিখিলেই চলিবে না। সেই ঋষিগণ এখন আর নাই—তাঁহাদের সহিত তাঁহাদের মতামতও চলিয়া গিয়াছে। তোমাদিগকে ঋষি হইতে হইবে। তোমরাও তো মানুষ; মহাপুরুষ, এমন কি অবতার পর্যন্ত যেমন মানুষ, তোমরাও তো সেই মানুষ। তোমাদিগকে নিজের পায়ের উপর দাঁড়াইতে হইবে। কেবল শাস্ত্রপাঠে কি হয়? এমন কি ধ্যানধারণাতেই বা কতদূর হইবে? মন্ত্রতন্ত্রেই বা কি করিতে পারে?তোমাদিগকে এই নূতন প্রণালী—মানুষ গড়িবার নূতন প্রণালী অবলম্বন করিতে হইবে। মানুষ তাহাকেই বলা যায়—যে এত বলবান্ যে, তাহাকে শক্তির অবতার বলা যাইতে পারে, আবার যাহার হৃদয়ে নারীসুলভ কোমলতা আছে, কিন্তু তাহা দুর্বলতা নয়। তোমাদের চারিদিকে যে কোটি কোটি প্রাণী রহিয়াছে, তাহাদের জন্য যেন তোমাদের হৃদয় কাঁদে, অথচ তোমাদিগকে দৃঢ়চিত্ত হইতে হইবে। আবার এইটি বুঝিতে হইবে—স্বাধীনচিন্তা যেমন আবশ্যক, তেমনি আজ্ঞাবহতাও অবশ্য চাই। আপাততঃ এই দুইটি পরস্পর-বিরোধী মনে হইতে পারে, কিন্তু তোমাদিগকে এই দুইটি আপাতবিরুদ্ধ গুণের অধিকারী হইতে হইবে। যদি অধ্যক্ষগণ নদীতে ঝাঁপ দিয়া কুমির ধরিতে বলেন, তবে প্রথমে তোমাকে তাঁহাদের কথামত কাজ করিতে হইবে, তারপর তাঁহাদিগকে কিছু জিজ্ঞাসা করিতে পার। যদি সেই আদেশ অন্যায়ও হয়, তথাপি প্রথমে তাঁহাদের কথানুসারে কাজ কর, তারপর প্রতিবাদ করিও। সম্প্রদায়সমূহের—বিশেষতঃ বাঙলা দেশের সম্প্রদায়গুলির এই এক বিশেষ দোষ যে, যদি তাহাদের মধ্যে কাহারও একটু ভিন্ন মত হয়, অমনি সে একটি নূতন সম্প্রদায় করিয়া বসে, তাহার আর অপেক্ষা করিবার সহিষ্ণুতা থাকে না। অতএব তোমাদিগকে নিজ সম্প্রদায়ের উপর গভীর শ্রদ্ধা রাখিতে হইবে। এখানে অবাধ্যগণের স্থান নাই। যদি কেহ অবাধ্য হয়, তাহাকে মমতাশূন্য হইয়া দূর করিয়া দাও—বিশ্বাসঘাতক কেহ যেন না থাকে। বায়ুর মত মুক্ত ও অবাধগতি হও, অথচ লতা ও কুকুরের মত নম্র এবং আজ্ঞাবহ হও।