বৰ্ণনা
ঋগ্বেদের কবির বিস্ময়বোধ যখন নিবিড় এবং বর্ণনীয় বিষয় সাধারণ গণ্ডীর বহির্ভূত, সেই সব ক্ষেত্রে বর্ণনা বহুলাংশে উদ্দীপক হয়ে উঠেছে। ইন্দ্র, বরুণ, সূৰ্য, অগ্নি, মরুৎ ও আদিত্যগণের বর্ণনায় কবিত্বশক্তি বিশেষভাবে উচ্ছসিত; সোমমণ্ডলে বিশ্বজগতের কেন্দ্ৰবিন্দু্রূপে সোমদেবের বর্ণনায় ঋষিকবি অনুরূপ মুন্ধতার সঞ্চার করেছেন। আবেগ-সমুন্নীত বর্ণনায় অতিশয়োক্তির দ্বারাই কবি রচনা করেছেন। ইন্দ্র এবং সোমদেবতার বর্ণনা প্রসঙ্গে তার বহু প্ৰমাণ পাওয়া যায়। উন্নত আদর্শ যে সমস্ত অংশে অভিব্যক্তি, কাব্যিক সমৃদ্ধির প্রকাশ সেগুলিতে স্পষ্টতর; বিশেষত সৃষ্টিতত্ত্ব ও দর্শনবিষয়ক সমস্ত সূক্তে এই জাতীয় চিন্তার পরিপূর্ণ ও মনোজ্ঞ প্ৰকাশ ঘটেছে। বিখ্যাত মধুসূক্তটি (১ : ১৮ : ৬-৮) সমগ্ৰ বিশ্বজগতের সঙ্গে পরিপূর্ণ একটি হৃদয়ের বিমুগ্ধ উৎসার প্রকাশ করে বৈদিক কবির মানসিক প্রবণতার ধ্রুপদী অভিব্যক্তি হয়ে উঠেছে। বাচনিক পুনরাবৃত্তি, স্বস্তি ও শান্তির আবাহন এবং সূক্তের আঙ্গিক ও কাঠামোর বিশেষ ধরণ এর অন্তর্বস্তুতে আরও শক্তিশালী ও কাব্যিক ফলশ্রুতিকে আরও প্রসারিত করে।
সোমমণ্ডলের কিছু কিছু অংশে কবিরা যেহেতু দৈনন্দিন জীবনের উপাদান ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তাদের চিত্রকল্প ও বিশিষ্ট উল্লেখের মীেল রূপটি আহরণ করেছেন, তাই এই সমস্ত সূক্তে আমরা খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাদের শেষাংশে প্রাচীন ভারতীয় সামাজিক অবস্থার পরিচয় লাভ করি। যখন কোন কবি নিতান্ত প্ৰসঙ্গক্রমেই দারিদ্র্য বর্ণনা করেন তখন তিনি প্ৰত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যেই বিরল এক সাফল্য অর্জন করেন। নবম মণ্ডলের একটি সূক্তে সমাজে অনুসৃত বিভিন্ন বৃত্তিধারী শ্রেণীগুলির বাস্তবনষ্ঠ ও অত্যন্ত আকর্ষণীয় বর্ণনা রয়েছে। মিশরের উনবিংশতিতম রাজবংশের (১৩৫০-১২০০ খ্রিঃ পূঃ) আমলে রচিত বিখ্যাত ‘স্যাটায়ার্স অন দি ট্রেডস’ শীর্ষক রচনার কথা আমাদের মনে পড়বে যা প্ৰহসন হিসাবে যথার্থ সার্থক এবং মিশরের তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতিরও উজ্জ্বল নিদর্শন।
রাত্রি ও অরণ্যানীর প্রতি নিবেদিত সূক্তে নিসর্গের সম্ভ্রম-উৎপাদক মহিমার ও সৌন্দর্যের বর্ণনা উল্লেখযোগ্য। বৈদিক যুগের পরবর্তীকালের দেবী লক্ষ্মীর বর্ণনাও (খিল ২ : ৬ : ৫) উল্লেখের অপেক্ষা রাখে। দেবী উষার প্রতি নিবেদিত বিখ্যাত সূক্তগুলিতে দৈনন্দিন প্রত্যক্ষগোচর জীবনের অভিজ্ঞতার অনুরণন অত্যন্ত স্পষ্ট। অনুরূপভাবে মরুৎদের প্রতি নিবেদিত সূক্তে বাস্তবের সেনাবাহিনীর বর্ণনা প্ৰতিধ্বনি মেলে এবং সুস্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ সেনা অভিযানের বর্ণনার গৌরব অনুভূত হয় এবং একই সঙ্গে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ নৈসৰ্গিক দৃশ্যও বিশেষভাবে অনুভূতিগোচর হয়ে ওঠে। কিছু কিছু সূক্ত আবার উন্নত ভাবনা ও বিশ্বজগতে অন্তনিহিত রহস্যের বোধ প্ৰকাশ করে সাধারণ মানের অনেক উৰ্দ্ধ উঠেছে। শেষ পর্যায়ের রচনা, অর্থাৎ প্রথম ও দশম মণ্ডলে এই জাতীয় অধিকাংশ সূক্ত যজ্ঞানুষ্ঠানের অব্যবহিত নিকটবতী প্রসঙ্গ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে জনসাধারণের অন্তর্লীন স্বল্প ও আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করে তুলেছে। একই সঙ্গে সৰ্বেশ্বরবাদ থেকে একেশ্বরবাদে বিবর্তনের যে পর্যায় কিছু কিছু মন্ত্রে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে তাতে বর্ণনার অভিনবত্ব ও ভাষাগত পরিবর্তন বেশ সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়।
ইন্দো-ইয়োরোপীয় প্রত্ন-পুরাণের একটি গুরুত্বপূৰ্ণ বৈশিষ্ট্য হল এই যে তা দেবতাদের মানুষের চেয়ে সর্বতোভাবে ভিন্ন বা অলঙ্ঘ্য দূরত্বে নির্বাসিত বলে মনে করে না। অন্যভাবে বলা যায়, ইন্দো-ইয়োরোপীয় বিশ্ববীক্ষায় মানুষ দেবতাদের অত্যন্ত নিকট প্রতিবেশী ; এমন কি মানুষ ও দেবতারা পরস্পর অন্যোন্যনির্ভরশীল। তাই বৈদিক কবি উচ্চারণ করেন-‘হে বৃত্ৰঘাতী ইন্দ্ৰ! তুমি আমি একত্রে চেষ্টা করব যতক্ষণ না আমরা ধন লাভ করছি (৮ : ৬২ : ১১)। শেষ পর্যায়ের আরও কিছু সূক্তে ইন্দ্রকে সমস্ত সৃষ্টির মর্মমূলে নিহিত মৌলিক আদিশক্তি রূপে বর্ণনা করা হয়েছে ; পার্থিব ও অতিজাগতিক বহু কীর্তিরই তিনি অধিনায়ক, দেবতাদের মধ্যে তিনি শুধু শ্রেষ্ঠই নন, সর্বদেবের প্রতিনিধিও। স্পষ্টতই ইন্দ্রের এই চরিত্রগত রূপান্তর সৰ্বেশ্বরবাদ থেকে একেশ্বরবাদে বিবর্তিত হওয়ার স্তরেই সম্ভবপর ; কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি বিমূর্ত সৃষ্টির প্রেরণার উৎস ব্রহ্মের প্রায় সমগোত্রীয়। যে বিবৃতিকে নির্লজ্জ আত্মপ্রশস্তি বলে ভ্ৰম হয় ; প্রকৃতপক্ষে তা হ’ল ইন্দ্র যখন চরম বিশ্বসৃষ্টির অন্তনিহিত মূল শক্তিরাপে বন্দিত হন তাঁর সেই চুড়ান্ত রূপান্তরের অব্যবহিত পূর্বে মুহুর্তের ইঙ্গিত বহন করে যখন তাকে সর্বদেবতার প্রতীকরূপে দেখা হচ্ছে। বৈদিক দেবসঙ্ঘে যার বিলম্বিত প্ৰবেশ, সেই বিশ্বকৰ্মাও দশম মণ্ডলে এই গৌরবের অধিকারী। বাস্তবতার প্রকৃতি ও উৎস সম্পর্কে মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি পূজ্য দেবতাদের নিকট উত্থাপিত করা যায় না ; যাঁরা যাজক পুরোহিত রূপে কল্পিত, সংহিতা-রচনার শেষ পর্বে যেসব বিমূর্ত বিশ্বস্রষ্ঠা দেবতার আবির্ভাব হয়েছিল, শুধু তাদের কাছেই গৃঢ় জিজ্ঞাসাগুলি নিবেদন করা চলে। এই পর্যায়েই এল সেই উপলব্ধি যে সত্য বা ঋতই পৃথিবীকে ধারণ করে, সত্যেই বিশ্বজগৎ প্রতিষ্ঠিত। আদিত্যদের (সৌরদেবগণ) সত্ত্বা বিধৃত আছে বিশ্বজগতের মৌল আদর্শ ঋতের মধ্যেই।
অগ্নির প্রতিশব্দ ‘বৈশ্বানর’ পৃথক নাম রূপে সূর্য ও আগুন—এই উভয়ের দ্যোতক বিশ্বজাগতিক আলোক সম্পর্কে প্ৰযুক্ত হয়েছে। এই আলোক যখন প্রথম আবির্ভূত হ’ল–সমগ্র সৃষ্টি, দেবগণ, আকাশ, পৃথিবী, সমুদ্র এবং উদ্ভিদজগৎ আনন্দমুখর হয়ে উঠেছিল কেননা তার পূর্বে সমস্তই ছিল অন্ধকারে আচ্ছন্ন। ঋগ্বেদের চুড়ান্ত পর্যায়ের বহু সূক্ত অনুরূপ উন্নত ভাবনায় পূর্ণ। প্রজাপতিসূক্ত (১০ : ১২১ ; ১০ : ১৩০) ; বাগাস্তৃণীয় বা পরমাত্মা সূক্ত (১০ : ১২৭) এবং মুখ্যত নাসদীয় সূক্তে (১০ : ১২৯) অত্যন্ত উচ্চমানের দার্শনিক কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। সেইসময়ে বিমূর্ত শ্রদ্ধাও সে দৈবীকরণপ্রক্রিয়ায় পৃথক দেবতা হয়ে উঠেছেন, সম্ভবত তার কারণ এই যে, বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ে প্রচলিত ধর্মবিধি সম্পর্কে অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা কালের বাতাবরণে অস্পষ্টভাবে অনুভব করা যাচ্ছিল। এই সময়কার নবেদিত সন্ন্যাসী সম্প্রদায়গুলির মতাদর্শ মানুষকে যজ্ঞের তাৎপর্য ও কার্যকারিতা সম্বন্ধে নতুন করে চিন্তা করতে প্ৰবৃত্ত করছিল। ফলে শ্রদ্ধার নতুন মূল্যায়ণ অনিবাৰ্য হয়ে উঠেছিল।
ঋগ্বেদীয় বহু সূক্ত আবেগ গাঢ় ও বিষয়গৌরবে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ, যদিও অধিকাংশ সূক্তই উৎস ও প্রেরণাগত বিচারে স্পষ্টতই আনুষ্ঠানিক। তবে সূক্তগুলির যথার্থ মানবিক অভিজ্ঞতার উৎসমূলের গভীরে অবগাহন করে আমরা বুঝতে পারি, এ ব্যাপারটাও খুবই স্বাভাবিক। কবি যখনই প্রশস্তি ও প্রার্থনার পরিমার্জনার পূর্ববতী পর্যায়ের শেষ দিকে শিল্প-ক্রিয়ার স্তরে প্রবেশ করেন তখন আপন অভিজ্ঞতাই তিনি প্ৰকাশ করতে চান; তার ব্যবহৃত চিত্রকল্পগুলির মধ্যে সেইসব অভিজ্ঞতার ছাপাই ফুটে ওঠে। ভীতি ও উদ্বেগ ঋগ্বেদের বহু কবিতার উৎস। বিস্তীর্ণ স্থলভাগের উপরে সুদীর্ঘ প্ৰবাস ও পরিক্রমার পরে আর্যরা যখন ভারতে উপস্থিত হলেন তখন সম্পূর্ণ ভিন্নস্বভাবের জনগোষ্ঠী এবং অপরিচিত নৈসৰ্গিক দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে তারা দেখলেন তাদের ভাবী বসতিস্থল আদিম অধিবাসীদের দ্বারা অধ্যুষিত। তাঁদের দৃষ্টিতে তাই এই সব জনগোষ্ঠী, তাদের যজ্ঞানুষ্ঠান পণ্ড করে দিয়ে সর্বপ্রকার ঐহ্যিক কল্যাণলাভের সম্ভাবনাকে বিড়ম্বিত করেছে। এইরকম বিপর্যয় আশঙ্কার সম্মুখীন হয়ে আর্যদের প্রধান মানসিক অবস্থায়ই ছিল ভীতি, অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতায় কন্টকিত। আর্যরা তাঁদের আত্মীয়-পরিজন ও গোসম্পদের জন্য যখন নিরাপত্তার প্রার্থনা করতেন, সেই সব সূক্তে তাই বহুস্থানেই পূর্বোক্ত মানসিকতার স্পষ্ট অভিব্যক্তি দেখা গেছে। শত্রুদের পরাজিত করার জন্য এবং সেই সঙ্গে সমস্ত রকম অমঙ্গল ও বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য যে সমস্ত প্রার্থনা সূক্তগুলি রচিত হয়েছে, গভীরতম আবেগের অন্তঃস্থল থেকে তা উৎসৃত বলে যথার্থ মর্মভেদী আবেগের সৃষ্টি করেছে। সাম্যবোধের জন্য যে প্রার্থনা-অথর্ববেদে মাঝেমাঝেই আছে, ঋগ্বেদের চূড়ান্ত পর্যায়েই তাদের প্রথমবার লক্ষ্য করা যায়। সাম্যবোধ ও সমন্বয়ের জন্য এই যে আকাঙক্ষা ঋগ্বেদ রচনার উপসংহারে আমরা লক্ষ্য করি তা অবশ্যই এক সুদীর্ঘ সংঘাতেরই সমাপ্তি সূচনা করছে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য যে অকথিত অস্পষ্ট প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয়, তারই ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক সংমিশ্রণে ও সমবেত প্রচেষ্টায় বহুবিধ গঠনমূলক পদ্ধতির মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত বহুজাতিক, বহুভাষিক ও বহুগোষ্ঠীভুক্ত ভারতীয় সভ্যতার জন্ম হয়।
পরাজিত আদিম জনগোষ্ঠীর নিরবচ্ছিন্ন প্রচ্ছন্ন শক্ৰতা থেকে পরিত্ৰাণ লাভ করার আকাঙ্ক্ষায় দূরদর্শী ঋষিকবিগণ শক্তির সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। সম্ভবত আদিম জনগোষ্ঠী ছাড়াও অবৈদিক আৰ্যগোষ্ঠী এবং আর্য শ্রেণীভুক্ত বিবদমান শাখাগুলির মধ্যেও শাস্তিস্থাপন বিশেষভাবে জরুরি হয়ে উঠেছিল। তাই এই সমস্ত প্রার্থনাকে নিছক ধর্মীয় আকাঙ্ক্ষারূপে বিচার না করে সেই সময়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের অভিব্যক্তিরূপে গ্ৰহণ করাই সমীচীন; কেননা তখনকার কলহদীর্ণ পরিবেশে যে কোনো জনগোষ্ঠীর বিকাশের পক্ষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অপরিহার্য ছিল। এছাড়াও সূক্তগুলিতে জীবনের অন্ধকার দিকেরও অভিব্যক্তি রয়েছে। সমৃদ্ধির প্রার্থনা তাই প্রায়শই শত্রুর প্রতি ঈর্ষাকাতর আর্যের প্রার্থনা, যাতে তার দেবতা শত্রুর সর্বপ্রকার অমঙ্গল সাধন করেন। ভিন্ন গোত্রজাত ও কৌমসমাজগত প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াও আদিম জনগোষ্ঠীভুক্ত যে সমস্ত মানুষ পরাজিত হয়েও বশ্যতা স্বীকার করে নি বা পর্যুদস্ত হয়ে যায় নি–তারাই ছিল শত্রুপদবাচ্য। বৈদিক কবি শুধু তাদেরই ধ্বংস ও মৃত্যুর জন্যে উদগ্ৰ কামনা ব্যক্ত করেন নি, তাদের আত্মীয় পরিজন এবং শেষ সম্পদের সর্বনাশও চেয়েছেন।
এরই পাশাপাশি সরল সংশয়ও বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। সর্বজনগ্রাহ্য উপাসনাপদ্ধতি রূপে যজ্ঞানুষ্ঠান সমাজে যখন দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হ’ল, জনসাধারণের ধর্মীয় জীবনের ভিত্তিই তা শুধু গঠন করে নি-যজ্ঞের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যও দাবি করেছিল। তখন কিছু কিছু সূক্ষ্মতর অনুভূতি বিদ্রোহী হয়ে উঠে এই জীবনবীক্ষার মৌল বিধিগুলির ভিত্তিভূমিকে অপসারিত করে অর্চনীয় দেবসঙ্ঘের গুরুত্ব খর্ব করে দিতে চাইল। সম্ভবত বিমূঢ় বিস্ময়বোধের প্রকাশই ঘটেছিল দশম মণ্ডলের দুটি সূক্তের অন্তর্গত (১২১ ও ১২৯) কিছু প্ৰখ্যাত মন্ত্রে; এর মধ্যে অন্যতম সেই বহু পরিচিত ধ্রূপদ : ‘কম্মৈ দেবায় হবিবা বিধেম’। মৌলিক সংশয়সূচক মন্ত্রগুলিতে এক ধরনের জরুরি ও আন্তরিক তাড়নার আভাস রয়েছে; এদের মধ্যে আমরা আত্মিক আলোড়ন ও গভীর অন্তর্লীন আন্দোলন অনুভব করি; বুঝতে পারি যে, অনুষ্ঠাননির্ভর জগতে প্ৰচলিত সংস্কারের প্রতি অভ্যন্ত বিশ্বাসের চেয়ে সহজ সংশয়ের যৌক্তিকতা অধিক। ঋগ্বেদের বহু স্থানেই যেহেতু প্রেরণাশূণ্য অনুষ্ঠানমূলক সাহিত্যের নিদর্শন রয়েছে, তাই বেশ কিছু শুষ্ক ও নীরস মন্ত্র খোলাখুলি ও নির্লজভাবে রাজা ও দাতাকে, পুরোহিতদের বদান্যভাবে দান করতে প্ৰবৃত্ত করতে চেয়েছে। এ জন্যে প্রাচীন দাতা ও দানের নজির উল্লেখ করে তারা যুক্তিজাল বিস্তার করেছে। এ সমস্তই ঋগ্বেদের অন্তিম পৰ্যায়ভুক্ত এবং এতেই একটি সমৃদ্ধ কাব্যিক ঐতিহ্যের ক্ষয় ও ধ্বংসের বীজ নিহিত রয়েছে।