পুত্ৰদৰ্শনপর্ব্বাধ্যায়
জনমেজয় কহিলেন, ভগবন্! এইরূপে অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র কুন্তী ও গান্ধারীর সহিত অরণ্যবাস আশ্রয়, মহাত্মা বিদুর সিদ্ধিলাভপূৰ্ব্বক ধৰ্ম্মরাজের দেহমধ্যে প্রবেশ ও পাণ্ডবগণ সেই ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রমে অবস্থান করিলে, ভগবান্ বেদব্যাস স্বীয় প্রতিজ্ঞানুসারে ধৃতরাষ্ট্রকে কিরূপ অদ্ভুত বিষয় দর্শন করাইলেন এবং ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির বা সেইসমুদয় পুরবাসী ও সৈন্যসামন্তগণসমভিব্যাহারে তথায় কিরূপে কত দিন বাস করিলেন, এই সমুদয় পরিজ্ঞাত হইতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে। আপনি ঐ সমস্ত আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর পাণ্ডবগণ কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্রকর্ত্তৃক অনুজ্ঞাত হইয়া তাঁহার আশ্রমে বিবিধ পানীয় ও ভক্ষ্যদ্রব্য পানভোজনপূৰ্ব্বক পরমসুখে বাস করিতে লাগিলেন। এইরূপে এক মাস অতীত হইলে একদা ভগবান্ বেদব্যাস পুনরায় অন্ধরাজের আশ্রমে সমুপস্থিত হইলেন। তখন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডবগণ তাঁহার যথোচিত সৎকারপূর্ব্বক তাঁহাকে উপবেশন করাইয়া আপনারাও উপবেশন করিলেন। ঐ সময় দেবর্ষি নারদ, পর্ব্বত ও দেবল এবং গন্ধৰ্ব্ব বিশ্বাবসু, তুম্বুরু ও চিত্রসেন তথায় সমুপস্থিত হইলেন। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের আদেশানুসারে তাঁহাদিগের যথোচিত সৎকার করিয়া তাঁহাদিগকে পবিত্র আসনসমুদয় প্রদান করিলেন।
মহর্ষিগণ যুধিষ্ঠিরের সৎকারলাভে পরিতুষ্ট হইয়া সেই সমুদয় আসনে উপবিষ্ট হইলে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডবগণ, গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা ও অন্যান্য কৌরববনিতাগণ তাঁহাদিগের চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়া উপবেশন করিলেন। ঐ সময় মহর্ষিগণের দেবতা, অসুর ও পুরাতন মহর্ষি-বিষয়ক বিবিধ ধৰ্ম্মকথার আন্দোলন হইতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে তাঁহাদিগের কথোপকথন সমাপ্ত হইলে, ভগবান্ বেদব্যাস প্রজ্ঞাচক্ষু অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্রকে আশ্চর্য্য দর্শন করাইবার মানসে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! তোমার হৃদয়ের ভাব আমার অবিদিত নাই। তুমি গান্ধারীর সহিত পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইয়াছ এবং কুন্তী, দ্রৌপদী ও সুভদ্রাও পুত্রশোকে নিতান্ত অভিভূত হইয়াছেন। আমি তোমার পরিবারগণের সহিত একত্ৰ বাসের কথা শ্রবণ করিয়া তোমাদিগের সংশয়চ্ছেদন করিবার নিমিত্ত এই স্থানে সমুপস্থিত হইয়াছি। এক্ষণে তুমি আমার নিকট স্বীয় অভিলাষ প্রকাশ কর। আজ এই দেবতা, গন্ধৰ্ব্ব ও মহর্ষিগণ আমার চিরসঞ্চিত তপোবল দর্শন করুন।”
ধৃতরাষ্ট্রাদির স্ব স্ব মৃতসন্তানদর্শনাকাঙ্ক্ষা
অগাধবুদ্ধি মহাত্মা বেদব্যাস এই কথা কহিলে, অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! আজ আমি আপনাদিগের সমাগমলাভে ধন্য ও অনুগৃহীত হইলাম। আজ আমার জীবন সফল হইল। আর আমার ইষ্টগতিলাভে কিছুমাত্র সংশয় ও পরলোকে কিছুমাত্র ভয় নাই। আজ আমি আপনাদিগকে দর্শন করিয়া পরম পবিত্র হইলাম। এক্ষণে কেবল সেই মন্দবুদ্ধি দুৰ্য্যোধনের কুব্যবহার স্মরণ করিয়া আমার নিতান্ত দুঃখ হইতেছে। ঐ পাপাত্মা অকারণে এই নিরপরাধ পাণ্ডবগণকে ক্লেশ প্রদান এবং পৃথিবীর অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যকে কালকবলে নিক্ষেপ করিয়াছে। মহাত্মা ভূপালগণ তাহারই নিমিত্ত কুরুক্ষেত্রে সমাগত হইয়া কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন। হায়! আমার পুত্রপৌত্রগণের এবং যেসমুদয় বীর আমার মিত্রের সাহায্যার্থ পিতা, মাতা ও পুত্ৰকলত্রদিগকে পরিত্যাগ করিয়া ইঁহলোক পরিহার করিয়াছেন, তাঁহাদিগের কি গতিলাভ হইল? আমি মহাবলপরাক্রান্ত মহাত্মা ভীষ্ম ও দ্রোণকে স্মরণ করিয়া কোনরূপেই স্থিরচিত্তে অবস্থান করিতে পারিতেছি না। আমার পুত্র পাপাত্মা দুর্য্যোধন রাজ্যলোভেই কুরুকুল ক্ষয় করিয়াছে। আমি ঐ বৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া দিবারাত্রি দুঃখানলে দগ্ধ হইতেছি; কোনরূপেই আমার শান্তিলাভ হইতেছে না। অতএব আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার শান্তিলাভের উপায়বিধান করুন।”
অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র এইরূপ করুণবাক্য প্রয়োগ করিলে গান্ধারী, কুন্তী, সুভদ্রা ও অন্যান্য বধূগণের শোক পুনৰ্ব্বার নূতন হইয়া উঠিল। তখন পুত্রশোকবিধুরা বদ্ধনয়না [আবৃতনেত্রা—কাপড়ে ঢাকা] গান্ধারী কৃতাঞ্জলিপুটে শ্বশুর বেদব্যাসকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভগবন! অদ্য যোড়শ বর্ষ হইল, অন্ধরাজের পুত্রগণ নিহত হইয়াছে, কিন্তু অদ্যাপি কোনরূপেই ইঁহার শান্তিলাভ হইতেছে না। ইনি সৰ্ব্বদাই পুত্রশোকে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া থাকেন, কখনই নিদ্রাসুখ অনুভব করিতে পারেন না। অতএব আপনি ইঁহার সহিত পুত্রগণের সাক্ষাৎকার করাইয়া ইঁহাকে সুস্থ করুন। আপনি যখন তপোবলে নুতন লোকসমুদয়েরও সৃষ্টি করিতে পারেন, তখন এই অন্ধরাজের সহিত ইঁহার পরলোকগত পুত্রগণের সাক্ষাৎকার করাইবেন, তাহা বিচিত্র কি?
“এই দেখুন, আপনার পুত্রবধূগণের প্রিয়পুত্রবধূ দ্রৌপদী ও সুভদ্রা পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইয়াছেন। ভূরিশ্রবার ভাৰ্য্যা পতিশোকে নিতান্ত অভিভূতা হইয়া নানা প্রকার বিলাপ করিতেছেন। ইঁহার শ্বশুর মহারাজ সোমদত্তও সংগ্রামে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন। আর আপনার যে একশত পৌত্র সংগ্রামে নিহত হইয়াছে, এই দেখুন, তাহাদিগের বনিতাগণ হাহাকারশব্দে রোদন করিয়া পুনঃ পুনঃ আমার ও অন্ধরাজের পুত্রশোক পরিবর্দ্ধিত করিতেছে।হায়! আমার সোমদত্ত প্রভৃতি যে শ্বশুরগণ সংগ্রামে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন, এক্ষণে তাঁহাদিগের কি গতিলাভ হইয়াছে? যাহা হউক, এক্ষণে অন্ধরাজ, আমি ও কুন্তী আমরা আপনার প্রসাদে যাহাতে শোক হইতে বিমুক্ত হইতে পারি, আপনি তাহার উপায়বিধান করুন।”
গান্ধারী ব্যাসের নিকট এই কথা কহিলে, কৃশাঙ্গী কুন্তী স্বীয় প্রচ্ছন্নজাতপুত্র কর্ণকে স্মরণ করিয়া নিতান্ত বিষণ্ন হইলেন। তখন ভগবান বেদব্যাস তাঁহার ব্যাকুলভাব দর্শন করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎসে! এক্ষণে তুমি আপনার অভিপ্রায় ব্যক্ত কর।”