২৯৭তম অধ্যায়
তপোবলে উৎকর্ষ—তপস্যাভাবে অপকর্ষ
“জনক কহিলেন, “ভগবন্! যখন পিতা ও পুত্রে কিছুমাত্র বিশেষ নাই, তখন মানবগণ একমাত্র ব্রহ্মা হইতে সমুদ্ভূত হইয়া কি নিমিত্ত ভিন্ন ভিন্ন বর্ণে বিভক্ত হইল? তাহা অবগত হইতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে, অতএব আপনি আমার নিকট উহা কীৰ্ত্তন করুন।
“পরাশর কহিলেন, ‘রাজর্ষে! পিতাই পুত্ররূপে উৎপন্ন হয়, যথার্থ বটে; কিন্তু তপস্যার অপকর্য্যনিবন্ধন মানবগণের উত্তরোত্তর হীনজাতি প্রাপ্তি হইয়া থাকে। পিতামাতার পুণ্যবলেই সন্তান ধাৰ্ম্মিক ও পিতামাতার পাপেই সন্তান অধাৰ্ম্মিক হয়। ধৰ্ম্মবিদ পণ্ডিতেরা কহেন, সৃষ্টিকর্ত্তা প্রজাপতির মুখ হইতে ব্রাহ্মণ, বাহু হইতে ক্ষত্রিয়, ঊরু হইতে বৈশ্য ও চরণ হইতে শূদ্ৰজাতি সমুৎপন্ন হইয়াছে। যাহারা এই চারি বর্ণ হইতে পৃথক্, তাহাদিগকে সঙ্করজ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। রাজপুত্র, বৈদ্য, উগ্র, বৈদেহক, শ্বপাক, পুক্কশ, স্তেন, নিষাদ, সূত, মাগধ, অযোগ, করণ, ব্রাত্য ও চণ্ডালগণ ব্রাহ্মণাদি চারি বর্ণের পরস্পর সহযোগে সমুৎপন্ন হইয়া থাকে।
“জনক কহিলেন, ‘ভগবন্! মানবগণ সৰ্ব্বলোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা হইতে উৎপন্ন হইয়া কি নিমিত্ত ভিন্ন ভিন্ন গোত্র লাভ করিল এবং যেসকল মুনি অপকৃষ্ট যোনিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদেরই বা কিরূপে ব্রাহ্মণত্বলাভ হইল, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।’
“পরাশর কহিলেন, ‘বিদেহরাজ! জন্মনিবন্ধন মহর্ষিদিগের অপকর্ষ হইবার সম্ভাবনা নাই। তাঁহারা তপোবলেই আত্মার উৎকর্য্যসাধন করিয়া থাকেন। বিশেষতঃ তাঁহাদের পিতারা যেকোন স্থানে তাঁহাদিগকে উৎপাদন করিয়া তপোবলে তাঁহাদিগের ঋষিত্ব বিধান করেন। আমার পিতামহ বশিষ্ঠ, বিভাণ্ডকপুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ, বেদ, তাণ্ড্য, কৃপ, কাক্ষীবান্, কমঠ, যবক্রীত, দ্রোণ, আয়ু, মতঙ্গ, দ্রুমন ও মাৎস্য প্রভৃতি মহর্ষিগণ অপকৃষ্ট যোনিতে জন্মগ্রহণ করিয়াও তপোবলে ঋষিত্ব লাভপূৰ্ব্বক বেদবিদ্গণের অগ্রগণ্য ও দমগুণসম্পন্ন হইয়াছিলেন। প্রথমে অঙ্গিরাঃ, কশ্যপ, বশিষ্ঠ ও ভৃগু এই চারি মহর্ষি হইতেই চারি মূলগোত্র উৎপন্ন হয়। অন্যান্য গোত্র কাৰ্য্যদ্বারা সমুৎপন্ন হইয়াছে। সাধুব্যক্তিগণকর্ত্তৃক অদ্যাপি সেই সমুদয় গোত্র ব্যবহৃত হইতেছে।’
“জনক কহিলেন, ভগবন! আপনি বর্ণসমুদয়ের বিশেষ ও সামান্য ধর্ম্মসমুদয় পরিজ্ঞাত আছেন, এক্ষণে আমার নিকট তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করুন।’
ব্রাহ্মণাদির সাধারণ ও অসাধারণ ধর্ম্ম
“পরাশর কহিলেন, ‘রাজর্ষে! ব্রাহ্মণের প্রতি গ্রহ, যাজন ও অধ্যাপন; ক্ষত্রিয়ের প্রজারক্ষা; বৈশ্যের কৃষিকাৰ্য্য, পশুপালন ও বাণিজ্য এবং শূদ্রের ঐ তিন বর্ণের সেবাই প্রধান ধর্ম্ম। এই আমি তোমার নিকট চারি বর্ণের বিশেষ ধৰ্ম্ম কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে সবিস্তর সাধারণ ধর্ম্ম কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। অনৃশংসতা, অহিংসা, অপ্রমাদ, পোষ্যবর্গকে যথোচিত অংশ প্রদান, শ্রাদ্ধক্রিয়া, অতিথিসেবা, সত্যানুষ্ঠান, অক্রোধ, স্বীয় পত্নীতে অনুরাগ, শৌচ, অসূয়াপরিত্যাগ, আত্মজ্ঞান ও তিতিক্ষা এই কয়েকটি সমুদয় বর্ণের সাধারণ ধৰ্ম্ম। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণকে দ্বিজাতি বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। বেদোক্ত ধর্ম্মে ইহাদিগের অধিকার। আছে। কুকর্ম্মে প্রবৃত্ত হইলে ইহাদিগকে পতিত হইতে হয়। ধার্ম্মিকগণ স্বধর্ম্মনিরত সাধুব্যক্তিকে আশ্রয়পূর্ব্বক উন্নতিলাভ। করিয়া থাকেন। শূদ্রগণ সংস্কারলাভের যোগ্য নহে এবং কুকৰ্ম্মনিবন্ধন তাহাদিগকে পতিত হইতেও হয় না। তাহারা অনৃশংসতাদি ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিতে পারে; কিন্তু ব্রহ্মচর্য্যাদি ধৰ্ম্মে তাহাদিগের অধিকার নাই। বেদবিদ ব্রাহ্মণগণ অনৃশংসতাদি ধর্ম্মপরায়ণ শূদ্রকে ব্রহ্মার তুল্য বলিয়া নির্দ্দেশ করেন এবং আমিও ঐরূপ শূদ্রকে বিষ্ণুতুল্য জ্ঞান করিয়া থাকি। শূদ্রগণ উন্নত হইবার মানসে সাধুবৃত্তি অবলম্বনপূৰ্ব্বক মন্ত্রোচ্চারণ ব্যতীত পুষ্টিজনক কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া সিদ্ধিলাভ করিতে পারে। ইতরব্যক্তিরা যেরূপ সদ্ব্যবহার অবলম্বন করে, ইহলোকে তদনুরূপ সুখলাভ করিতে সমর্থ হয়, সন্দেহ নাই।’
‘জনক কহিলেন, মহর্ষে! মনুষ্য কি কৰ্ম্মপ্রভাবে হীনদশা প্রাপ্ত হয় না, জন্মনিবন্ধন উহার হীনত্বলাভ হইয়া থাকে? তদ্বিষয়ে আমার সংশয় উপস্থিত হইয়াছে, অতএব আপনি উহা বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করুন।’
“পরাশর কহিলেন, ‘রাজর্ষে! কৰ্ম্ম ও জন্ম এই উভয়দ্বারাই লোকের হীনদশা উপস্থিত হয়। ঐ উভয়ের মধ্যে কৰ্ম্মই হীনত্বের প্রধান কারণ। যে ব্যক্তি নীচজাতি হইয়াও পাপকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করে, তাহাকে শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়; কিন্তু যে ব্যক্তি প্রধান বর্ণে উৎপন্ন হইয়াও কুকার্য্যের অনুষ্ঠান করে, তাহাকে হীনদশা প্রাপ্ত হইতে হয়, অতএব কৰ্ম্মকেই হীনত্বের প্রধান সাধন বলিতে হইবে।’
“জনক কহিলেন, ‘ভগবন! কোন্ কোন্ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে মনুষ্য সর্ব্বদা হিংসাবিহীন হইয়া ধৰ্মলাভ করিতে পারে, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।’
“পরাশর কহিলেন, ‘বিদেহরাজ! মনুষ্য যে কাৰ্য্যদ্বারা প্রাণীর হিংসা না করিয়া ধৰ্মলাভ করিতে পারে, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। সন্ন্যাসধর্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক ক্রমে ক্রমে সন্তাপবিহীন ও শ্রেষ্ঠপদে সমারূঢ় হইতে পারিলে অনায়াসে মোক্ষলাভজনক পথ প্রাপ্ত হইতে পারা যায়। শ্রদ্ধাবান, বিনয়ান্বিত, দমগুণসম্পন্ন ও সূক্ষ্মবুদ্ধি মহাত্মারা সৰ্ব্বকৰ্ম্ম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সনাতন ব্রহ্মপদ লাভ করিয়া থাকেন। ফলতঃ অধৰ্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক সম্যকরূপে ধর্ম্মকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান ও সৰ্ব্বদা সত্যবাক্য প্রয়োগ করিলে সকল বর্ণেরই স্বর্গলাভ হইয়া থাকে, সন্দেহ নাই।”