২৯৫. ন্যায়তঃ উপার্জ্জিত অর্থের উৎকর্ষ

২৯৫তম অধ্যায়

ন্যায়তঃ উপার্জ্জিত অর্থের উৎকর্ষ

“পরাশর কহিলেন, “হে রাজর্ষে। ব্রাহ্মণের প্রতিগ্ৰহলব্ধ, ক্ষত্রিয়ের জয়প্রাপ্ত, বৈশ্যের ন্যায়াজ্জিত ও শূদ্রের শুশ্রূদ্বারা উপার্জ্জিত অর্থ যৎকিঞ্চিৎ হইলেও ধৰ্ম্মফলপ্রদ ও প্রশংসনীয় হইয়া থাকে। সৰ্ব্বদা ত্রিবর্ণের সেবা করা শূদ্রেরই পরমধর্ম্ম। ব্রাহ্মণ বিপদগ্রস্ত হইয়া ক্ষাত্রধর্ম্ম বা বৈশ্যধৰ্ম্ম আশ্রয় করিলে পতিত হয়েন না, কিন্তু শূদ্ৰধৰ্ম্ম আশ্রয় করিলে তাঁহাকে নিশ্চয়ই পতিত হইতে হয়। শূদ্র ত্রিবর্ণ-সেবাদ্বারা জীবিকানির্ব্বাহে অসমর্থ হইলে বাণিজ্য, পশুপালন বা শিল্পকৰ্ম্ম করিতে পারে। যে ব্যক্তি কদাপি নাট্য, বহুরূপ প্রদর্শন এবং মদ্যমাংস ও লৌহচৰ্ম্মের ব্যবসার দ্বারা জীবিকানির্ব্বাহ করে নাই, তাহার জীবিকাৰ্থ ঐ সমুদয় অবলম্বন করা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। আর যে ব্যক্তির বহুকালাবধি ঐ সকল কাৰ্য্যদ্বারা জীবিকানির্ব্বাহ হইয়া আসিতেছে, সে যদি ঐ সমুদয় পরিত্যাগ করিতে পারে, তাহা হইলে তাহার পরমধৰ্ম্ম লাভ হয়, সন্দেহ নাই। ইহলোকে মানবগণ ঐশ্বৰ্য্যমদে মত্ত হইয়া বিবিধ পাপকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে; কিন্তু ঐরূপ পাপকার্য্যে প্রবৃত্ত হওয়া কাহারও কর্ত্তব্য নহে। ইহলোকে ধাৰ্ম্মিক লোকেরা প্রশংসনীয় ও নানা গুণের আধার হয়েন।

‘পূৰ্ব্বকালে প্রজাগণ দান্ত, নীতিবিশারদ ও ধর্ম্মপরায়ণ ছিল। তাহাদের মধ্যে কেহ দৈবাৎ কোন কুকর্ম্মে প্রবৃত্ত হইলে তাহাকে ধিক্কার প্রদান করিলেই তাহার সমুচিত দণ্ড করা হইত। কিয়ৎকাল পরে অসুরগণ প্রজাগণকে ধৰ্ম্মে একান্ত অনুরক্ত দেখিয়া ধৰ্ম্মকে নিতান্ত অসহ্য বোধ করিয়া ক্রমে ক্রমে কামাদিরূপে তাহাদের শরীরে প্রবেশ করিল। কামাদি প্রবিষ্ট হওয়াতে প্রজাগণের শরীরে ধৰ্ম্মনাশন দর্পের আবির্ভাব হইল। তৎপরে দর্প হইতে, ক্রোধ সম্ভূত হইয়া ক্রমে ক্রমে তাহাদের সুশীলতা ও লজ্জা বিনষ্ট করিল। তখন প্রজাগণ মোহে একান্ত অভিভূত হইয়া পূৰ্ব্বভাব পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পরস্পর পরস্পরকে নিপীড়িত করিয়া ঐশ্বৰ্য্যবৃদ্ধি এবং দেবতা ও ব্রাহ্মণগণের অপমান করিয়া নিরন্তর বিষয়ভোগ করিতে লাগিল। ঐ সময় কেবল ধিক্কারপ্রদানদ্বারা তাহাদিগকে শাসন করা অসাধ্য হইয়া উঠিল।

‘এইরূপে প্রজাগণ যারপরনাই উচ্ছৃঙ্খল হইলে দেবগণ বহুরূপধারী দেবাদিদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হইয়া তাঁহার নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন। ভগবান্ শূলপাণি দেবগণের মুখে প্রজাদিগের বিপরীত আচরণ শ্রবণ করিয়া ক্রোধভরে স্বীয় তেজঃপ্রভাবে প্রজাগণের শরীরস্থ কামক্রোধাদিকে প্রথমতঃ বিনষ্ট করিয়া পরিশেষে সৰ্ব্বপ্রধান মহামোহকে নিপাতিত করিলেন। মহামোহ বিনষ্ট হইলে মানবগণ পূৰ্ব্বের ন্যায় সদ্ভাবসম্পন্ন হইয়া বেদ ও অন্যান্য ধর্ম্মশাস্ত্রের আলোচনা করিতে লাগিল। অনন্তর সপ্তর্ষিমণ্ডল ইন্দ্রকে দেবরাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া আপনারা মানবগণের শাসনে নিযুক্ত হইলেন। সপ্তর্ষিমণ্ডল কিয়ৎকাল মানবগণের শাসন করিয়া নিরস্ত হইলে বিপৃথু ও অন্যান্য ক্ষত্রিয়গণ ভূমণ্ডলের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের অধিপতি হইয়া প্রজাগণের শাসন করিয়াছিলেন।

‘যে সময় দেবাদিদেব মহাদেব প্রজাগণের কামক্রোধাদি বিনষ্ট করেন, সেই সময় কোন কোন মহাকুলসদ্ভূত বৃদ্ধতম ব্যক্তির হৃদয় হইতে ঐ সমুদয় অসুরভাব অপনীত হয় নাই। সেই সমস্ত ব্যক্তির সংসর্গে অনেকানেক ভীমপরাক্রম ভূপাল অসুরকার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। এক্ষণে মূঢ়ব্যক্তিরা স্বয়ং তাঁহাদের সেই কার্য্যের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইতেছে এবং অন্যকেও উহার অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত করিতেছে। অতএব আমি শাস্ত্রসমালোচনাপূৰ্ব্বক তোমাকে কহিতেছি যে, হিংসাত্মক কাৰ্য্য, পরিত্যাগপূৰ্ব্বক আত্মজ্ঞান অবলম্বন করা মনুষ্যের অবশ্য কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম। ধৰ্ম্মানুষ্ঠানের নিমিত্ত নীতি পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পাপকাৰ্য্যদ্বারা অর্থোপার্জ্জন করিলে কখনই কল্যাণলাভে সমর্থ হওয়া যায় না; অতএব বিদ্বান ব্যক্তি কখন উহাতে প্রবৃত্ত হয়েন না। এক্ষণে তুমি জিতেন্দ্রিয়, ধৰ্ম্মনিরত ও বান্ধবপ্রিয় হইয়া স্বধৰ্ম্মানুসারে পুত্র, ভৃত্য ও প্রজাগণকে প্রতিপালন কর। ইষ্ট ও অনিষ্টের সহযোগেই সৌহার্দ্দ্য ও শত্রুতা উৎপন্ন হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি ইষ্ট ও অনিষ্টকে সমান জ্ঞান না করে, তাহাকে বারংবার জন্মগ্রহণ করিতে হয়। অতঃপর গুণে অনুরক্ত হওয়া ও দোষ পরিত্যাগ করা তোমার নিতান্ত আবশ্যক। নিতান্ত দুর্ব্বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরাও আপনাদের অল্পমাত্র গুণ প্রকাশ, হইলে আহ্লাদিত হয়। ধর্ম্ম ও অধৰ্ম্ম মনুষ্যগণমধ্যেই নিরন্তর পরিভ্রমণ করিতেছে। অন্যান্য প্রাণীতে ধৰ্ম্ম বা অধর্ম্মের লেশমাত্র নাই। কি ধৰ্ম্মশীল, কি বিদ্বান্, কি যাচক, কি অযাচক সকলের হিংসাপরিত্যাগপূৰ্ব্বক সৰ্ব্বভূতে সমদর্শী হইয়া কালযাপন করা উচিত। যখন লোকের মন বাসনাবিহীন ও সত্যনিরত হয়, তখনই তাহার যথার্থ মঙ্গললাভ হইয়া থাকে।”