২৯৪তম অধ্যায়
সত্যবানের সহিত সাবিত্রীর বিবাহ
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! অনন্তর মহারাজ অশ্বপতি কন্যা-সম্প্রদানবিষয়ে কৃতনিশ্চয় হইয়া বিবাহোপযোগী দ্রব্যসম্ভার, আহরণ করিলেন। পরে বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণ, ঋত্বিক ও পুরোহিতগণকে আহ্বানপূর্ব্বক পুণ্যদিনে কন্যা-সমভিব্যাহারে রাজধানী হইতে নিৰ্গত হইয়া পাদচারে সেই অরণ্যমধ্যে দ্যুমৎসেনের আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, অন্ধ রাজা দ্যুমৎসেন এক বিশাল শালবৃক্ষমূলে কুশাসনে উপবিষ্ট আছেন। তখন তিনি যথোচিত উপচারে রাজর্ষিকে অৰ্চনা করিয়া আপনার পরিচয় প্ৰদান করিলেন।
“রাজর্ষি দ্যুমৎসেন অশ্বপতির পরিচয় প্রাপ্ত হইয়া পরমসমাদরে তাঁহাকে অর্ঘ্য, আসন ও গো প্ৰদানপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! কি নিমিত্ত এ স্থলে আগমন করিয়াছেন?” তখন মদ্ররাজ অশ্বপতি সত্যবানকে স্বীয় কন্যা প্ৰদান করিবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া কহিলেন, “হে রাজৰ্ষিসত্তম! আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার এই সাবিত্রী-নামী পরম-শোভনা কন্যাটিকে ধর্ম্মানুসারে স্নুষার্থে প্রতিগ্রহ করুন।”
“দ্যুমৎসেন কহিলেন, “মহারাজ! আমরা রাজ্যচ্যুত হইয়া বনবাসী হইয়াছি। আপনার কন্যা কিরূপে এই বনবাসজনিত দুঃখপরম্পরা সহ্য করিবেন?” অশ্বপতি কহিলেন, “হে রাজর্ষে। আমি ও আমার কন্যা, আমরা উভয়েই উৎপত্তি-বিনাশাত্মক সুখদুঃখ-সমুদয় জ্ঞাত আছি, অতএব আপনি আমাকে আর ও কথা কহিবেন না; আমি আদ্যোপান্ত সমুদয় নিশ্চয় করিয়াই আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। হে রাজন! আমি প্ৰণতিপরতন্ত্র হইয়া প্রীতিপূর্ব্বক আপনার সন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়াছি, আপনি প্রত্যাখ্যান করিয়া আমার বলবতী আশালতা ছেদন করবেন না। বিশেষতঃ আমরা উভয়েই উভয়ের অনুরূপ। অতএব আপনি সুশীল সত্যবানের নিমিত্ত আমার কন্যাকে প্রতিগ্রহ করুন।”
“তখন রাজর্ষি দ্যুমৎসেন কহিলেন, “মহারাজ! আপনার সহিত সম্বন্ধ আমার চিরপ্রার্থনীয়; কিন্তু এক্ষণে আমি রাজ্যচ্যুত হইয়াছি বলিয়া এই অবশ্যকর্ত্তব্যবিষয়ে সবিশেষ বিবেচনা করিতেছিলাম। যাহা হউক, আমি পূর্ব্বাবধি যাহা আকাঙক্ষা করিতেছি, আপনি অদ্য আমার সেই মনোরথ পূর্ণ করুন। আপনি আমার অভীষ্ট অতিথি।”
‘অনন্তর তাহারা আশ্রমবাসী সমুদয় ব্রাহ্মণগণকে আনয়নপূর্ব্বক বিধানানুসারে পুত্রকন্যার বিবাহকাৰ্য্য নির্ব্বাহ করিলেন। মহারাজ অশ্বপতি সালঙ্কৃতা দুহিতাকে পাত্রসাৎ করিয়া পরমসুখে স্বভবনাভিমুখে গমন করিলেন। রাজকুমারী সাবিত্রী ও সশীল সত্যবান ইঁহারারা পরস্পর পরস্পরকে লাভ করিয়া পরমপ্রীত ও প্রফুল্প হইলেন। পতিপরায়ণা সাবিত্ৰী পিতার প্রস্থানানন্তর সর্ব্বাঙ্গ হইতে অলঙ্কার সমস্ত উন্মোচনপূর্ব্বক অরণ্যসুলভ বল্কল ও কাষায়বসন পরিধান করিলেন এবং বিনয়, লজ্জা প্রভৃতি বহুবিধ সদগুণ, সকলের অভিলাষানুরূপ কাৰ্য্যানুষ্ঠান ও পরিচর্য্যদ্বারা আশ্রমবাসীদিগের তুষ্টিসম্পাদন করিতে লাগিলেন। শরীরসংস্কার ও আচ্ছাদনাদি প্ৰদানদ্বারা শ্বশ্রূকে, দেবপূজা ও বাকসংযমদ্বারা শ্বশুরকে এবং প্রিয়োক্তি, নৈপুণ্য, শান্তি ও নির্জ্জনে উপহার-প্রদানদ্বারা ভর্ত্তাকে সন্তুষ্ট করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই আশ্রমে তপানুষ্ঠানদ্বারা তাহাদিগের কিয়ৎকাল অতিক্রান্ত হইল। পতিপরায়ণা সাবিত্রী দেবর্ষি নারদের বাক্য স্মরণ করিয়া দিন দিন নিতান্ত সন্তপ্ত হইতে লাগিলেন।