২৯২. পতিব্ৰতামাহাত্ম্যপর্ব্বাধ্যায়

২৯২তম অধ্যায়

পতিব্ৰতামাহাত্ম্যপর্ব্বাধ্যায়

রাজা যুধিষ্ঠির মার্কণ্ডেয়কে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে মহর্ষে। আমি এই দ্রুপদনন্দিনীর নিমিত্ত যে প্রকার শোকাকুল হইয়াছি, আপনার বা ভ্রাতৃগণের অথবা রাজ্যনাশের নিমিত্ত তাদৃশ পরিতপ্ত নই। যখন দুরাত্মারা দূতক্ৰীড়ায় আমাদিগকে পরাজয় করিয়া নিগ্রহ করে, তৎকালে এই যাজ্ঞসেনী আমাদিগকে পরিত্রাণ করিয়াছিলেন। দুরাত্মা জয়দ্ৰথ বন হইতে ইঁহাকে যখন হরণ করে, ইনি সেই বিষম সময়েও মনে মনে আমাদিগকেই চিন্তা করিয়াছেন। মহর্ষে আপনি কি এই দ্রুপদনন্দিনীর তুল্য পতিব্ৰতা রমণী কুত্ৰাপি দৃষ্টি বা শ্রবণগোচর করিয়াছেন?”

সাবিত্রীর উপাখ্যান

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! কুলকামিনীগণের সৌভাগ্য যতদূর পর্য্যন্ত হইতে পারে, রাজপুত্রী সাবিত্রী তৎসমুদয়ই যেরূপে প্ৰাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ করুন।

“মদ্রদেশে অশ্বপতিনামে এক পরমধার্ম্মিক, সত্যপ্রতিজ্ঞ, জিতেন্দ্ৰিয়, দানশীল নরপতি ছিলেন। তাঁহার সন্তানসন্ততি কিছুই ছিল না। কালক্রমে বয়ঃক্রম অতিক্রান্ত হইলে ভূপতি অনপত্যতা নিবন্ধন দুঃখে পরিতাপিত হইয়া অপত্যোৎপাদনার্থ মিতাহার, ব্ৰহ্মচৰ্য্য ও ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ প্রভৃতি তীব্রতর নিয়ম-সকল অবলম্বনপূর্ব্বক সাবিত্রীদেবীর উদ্দেশে হোম করিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি প্ৰতিদিন লক্ষ আহুতি প্ৰদান করিয়া দিবসের ষষ্ঠভাগে যৎকিঞ্চিৎ আহার গ্রহণ করিতেন।

“এইরূপে অষ্টাদশ বর্ষ অতীত হইলে সাবিত্রীদেবী সুপ্রীত হইলেন এবং দিব্যকলেবর ধারণ করিয়া অগ্নিহোত্ৰ হইতে উত্থানপূর্ব্বক অশ্বপতির নেত্রপথে আবির্ভূত হইয়া কহিলেন, মদ্ররাজ! আমি তোমার ব্ৰহ্মচৰ্য্য, শুচি, দম, নিয়ম ও অকৃত্রিম ভক্তিতে অতীব প্রীত হইয়াছি; এক্ষণে তুমি ধর্ম্মবিষয়ে অপ্ৰমত্ত হইয়া অভীপ্সিত বর গ্রহণ কর।’

“অশ্বপতি কহিলেন, “দেবি! দ্বিজাতিগণ আমাকে কহিয়া থাকেন যে, সন্তানই পরমধর্ম্ম। আমি তাঁহাদের বাক্যে আস্থা করিয়া ধর্ম্মলাভকামনায় অপত্যলাভের নিমিত্ত আপনার আরাধনায় প্রবৃত্ত হইয়াছি। যদি আপনি প্রীত হইয়া থাকেন, তবে আমাকে এই বর প্রদান করুন যে, আমার বহুসংখ্যক সন্তান উৎপন্ন হউক।

“সাবিত্রী কহিলেন, “হে রাজন! আমি পূর্ব্বেই এই অভিপ্ৰায় অবগত হইয়া তোমার পুত্রের নিমিত্ত ভগবান পিতামহকে কহিয়াছিলাম; তাহার প্রসাদে অচিরকালমধ্যেই তোমার এক তেজস্বিনী কন্যা উৎপন্ন হইবে। আমি পিতামহের সৃষ্টিতে সন্তুষ্ট হইয়া কহিতেছি যে, তুমি ইহাতে আর কিঞ্চিম্মাত্র উত্তর প্রদান করিও না।”

“রাজা অশ্বপতি সাবিত্রীর বাক্য স্বীকার করিয়া পুনর্ব্বার তাঁহাকে প্ৰসন্ন করিতে লাগিলেন; তৎপরে সাবিত্রীদেবী অন্তর্হিত হইলে স্বদেশে গমনপূর্ব্বক ধর্ম্মানুসারে প্রজাপালন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎকাল, অতীত হইলে ব্ৰতপরায়ণ রাজার জ্যেষ্ঠা মহিষী গর্ভবতী হইলেন। রাজপুত্রীর গর্ভ সিতপক্ষোদিত [শুক্লপক্ষে উদিত] চন্দ্ৰমার ন্যায় দিন দিন বর্দ্ধিত হইতে লাগিল।

“অনন্তর রাজমহিষী সমুচিত সময়ে এক রাজীবলোচনা কন্যা প্রসব করিলেন। নৃপচূড়ামণি অশ্বপতি প্রীতিপ্ৰফুল্লচিত্তে কন্যার জাতকর্ম্ম সমাধান করিলেন। সাবিত্রীদেবীর উদ্দেশে হোম করাতে তিনি প্রীত হইয়া কন্যাটি প্রদান করিয়াছেন বলিয়া রাজা ও বিপ্রগণ তাঁহার নাম সাবিত্রী রাখিলেন। রাজপুত্রী সাবিত্রী মূর্ত্তিমতী লক্ষ্মীর ন্যায় বর্দ্ধিত হইয়া কালক্রমে যৌবনসীমায় আরোহণ করিলেন। তৎকালে লোকে তাঁহাকে সুমধ্যমা, নিবিড়নিতস্বিনী ও কাঞ্চনময়ী প্ৰতিমার ন্যায় অবলোকন করিয়া বোধ করিতে লাগিল যে, বুঝি দেবকন্যা মানবরূপ ধারণ করিয়া অবনীতালে অবতীর্ণ হইয়াছেন। এই পদ্মাপলাশলোচনা এরূপ তেজস্বিনী ছিলেন যে, সকল পুরুষই তাঁহার তেজঃপ্রভাবে প্রতিহত হইয়াছিল; কেহই তাঁহার পাণিগ্রহণে সাহস করিতে পারে নাই।

পিতা অশ্বপতিকর্ত্তৃক সাবিত্রীর বিবাহ-প্ৰস্তাব

“একদা পর্ব্বদিবসে মূর্ত্তিমতী লক্ষ্মীসদৃশী সাবিত্রী উপবাস, স্নান, দেবাৰ্চন ও অগ্নিতে যথাবিধি আহুতি প্ৰদান করিয়া শেষ গ্রহণপূর্ব্বক মহাত্মা পিতার সমীপে গমন করিলেন এবং তাঁহাকে অভিবাদন ও শেষ দ্রব্য নিবেদন করিয়া অঞ্জলিবন্ধনপূর্ব্বক তাঁহার পাৰ্থে দণ্ডায়মান রহিলেন। মহারাজ অশ্বাপতি দেবরূপিণী স্বীয় কন্যাকে নয়নগোচর করিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, ‘হায়! কন্যাটির যৌবনাবস্থা হইয়াছে, কিন্তু কেহই ইহার পাণিগ্রহণ করিতে প্রার্থনা করে না।” মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া বিষণ্নচিত্তে সাবিত্রীকে কহিলেন, “বৎসে! তোমার সম্প্রদানসময় উপস্থিত হইয়াছে; কিন্তু কেহই তোমার নিমিত্ত আমার নিকট প্রার্থনা করে না; অতএব তুমি স্বয়ং আত্মানুরূপ ভর্ত্তা অন্বেষণ কর। যে ব্যক্তি তোমার অভিলষিত হইবে, আমার নিকটে তাহার পরিচয় প্রদান করিবে; আমি বিবেচনা করিয়া তোমাকে সম্প্রদান করিব। আমি ব্ৰাহ্মণগণের ধর্ম্মশাস্ত্ৰপাঠসময়ে যেরূপ শ্রবণ করিয়াছি, তাহা কহিতেছি, শ্রবণ করা। হে বৎসে! যে পিতা কন্যাকে সম্প্রদান না করে, যে পুরুষ বিবাহ না করে এবং যে ব্যক্তি ভর্ত্তৃহীনা মাতার রক্ষণাবেক্ষণ না করে, এই তিনজন নিন্দনীয় হয়। অতএব তুমি বরান্বেষণে সত্বর হও। আমি যাহাতে দেবগণের নিন্দনীয় না হই, তাহা কর।’

‘রাজা অশ্বপতি কন্যাকে এই প্রকার উপদেশ প্ৰদান করিয়া মন্ত্রিগণকে তাহার অনুযাত্ৰ [অনুগামী] হইতে অনুমতি করিলেন। সাবিত্রী লজ্জিত ও সঙ্কুচিত হইয়া পিতার পদবন্দনপূর্ব্বক বৃদ্ধ সচিবগণসমভিব্যাহারে হৈম-রথে আরোহণপূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন; পিতার আজ্ঞায় কিঞ্চিম্মাত্রও বিচার করিলেন না। নৃপনিন্দিনী প্রথমতঃ রাজর্ষিগণের রমণীয় তপোবনে গমনপূর্ব্বক তত্ৰস্থ মান্যতম স্থবিরগণের পদাভিবান্দন করিলেন; তৎপরে ক্রমে ক্রমে সমুদয় বনে গমনপূর্ব্বক তীর্থে তীর্থে ধন প্রদান করিয়া তত্তদেশে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন।”