২৯২. কঠিন পাপ দুরপনেয়—অকাট্য

২৯২তম অধ্যায়

কঠিন পাপ দুরপনেয়—অকাট্য

“পরাশর কহিলেন, “হে রাজর্ষে! যে ব্যক্তি জ্ঞানরূপ রশ্মিদ্বারা শরীর-রথের শব্দাদিবিষয়রূপ অশ্বসমুদয়কে সংযমিত করিয়া সংসারে পরিভ্রমণ করিতে পারেন, তাঁহাকেই বুদ্ধিমান বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। যে ব্যক্তি বিষয়বাসনাশূন্য হইয়া আচার্য্যের প্রসাদে ঈশ্বরভক্তি লাভ করিতে পারেন, সকলেই তাঁহার প্রশংসা করিয়া থাকে। ইন্দ্রিয়ভোগ্য বস্তুর উপভোগদ্বারা দুর্ল্লভ আয়ু বিনষ্ট হইয়া যায়; অতএব মানবগণ পুণ্যকাৰ্য্যদ্বারা আয়ু বৃদ্ধি করিবার নিমিত্ত যত্নবান্ হইবেন। যে ব্যক্তি উৎকৃষ্ট বর্ণ লাভ করিয়া তামসকৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করে, তাহাকে বর্ণ হইতে পরিভ্রষ্ট ও সম্মানলাভে বঞ্চিত হইতে হয়। পাপাত্মা কখনই পুণ্যোৎপাদ্য [পুণ্যলভ্য] দুল্লভ উৎকৃষ্ট বর্ণ লাভ করিতে সমর্থ হয় না; প্রত্যুত পাপকাৰ্য্যদ্বারা আত্মাকে নরকভোগী করিয়া থাকে। অজ্ঞানকৃত পাপ তপস্যা দ্বারা বিনষ্ট হইয়া যায়; আর জ্ঞানকৃত পাপ দুঃখরূপে পরিগণিত হইয়া থাকে। অতএব দুঃখজনক পাপকার্য্যের অনুষ্ঠান করা কখনই বিধেয় নহে। যেমন পবিত্র পুরুষেরা চণ্ডালকে স্পর্শ করিতে ঘৃণা করেন, তদ্রূপ বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা পাপকাৰ্য্যদ্বারা মহৎ ফললাভ হইলেও উহার অনুষ্ঠানে পরাঙ্মুখ হয়েন। পাপকাৰ্য্যের ফল অতি কুৎসিত। পাপাত্মারা পাপকার্য্যনিবন্ধন বিপরীতদৃষ্ট হইয়া দেহাদিকে আত্মা বলিয়া জ্ঞান করে। যে মূঢ় ব্যক্তি ইহলোকে বৈরাগ্য অবলম্বন না করে, তাহাকে নিশ্চয়ই দেহান্তে নরকজনিত সন্তাপ ভোগ করিতে হয়। যেমন নীলাদিরাগে [নীলাদি বর্ণে] অরঞ্জিত [রং করা নয় এইরূপ] বস্ত্র মলিন হইলে ক্ষারাদিদ্বারা উহার শুভ্রতা সম্পাদন করা যায়, কিন্তু নীলাদিরাগে রঞ্জিত বস্ত্রের কোনরূপেই শুক্লতাসম্পাদন করা যায় না, তদ্রূপ অজ্ঞানকৃত পাপ প্রায়শ্চিত্তাদিদ্বারা বিনষ্ট হয়, কিন্তু জ্ঞানকৃত পাপের কিছুতেই ধ্বংস হয় না। যে ব্যক্তি জ্ঞানপূর্ব্বক পাপকাৰ্য্য করিয়া প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান করে, তাহাকে প্রায়শ্চিত্তজনিত স্বর্গ ও পাপজনিত নরক উভয়ই ভোগ করিতে হয়।

‘ব্রহ্মবাদীরা বেদবিধি দর্শনপূর্ব্বক কহিয়া থাকেন যে, অজ্ঞানকৃত হিংসাজনিত পাপ অহিংসাব্রত দ্বারা বিনষ্ট হয়, কিন্তু জ্ঞানকৃত হিংসাজনিত পাপ ফলভোগ ব্যতীত কদাচ বিনষ্ট হইবার নহে। যাহা হউক, আমার মতে পাপপুণ্য অজ্ঞানকৃত হউক বা জ্ঞানকৃত হউক, ভোগ ব্যতীত কখনই বিনষ্ট হয় না। ইহলোকে জ্ঞানকৃত স্থূল ও সূক্ষ্ম কার্য্যসমুদয় বৃহৎ ও ক্ষুদ্র ফলরূপে পরিণত হয়; কিন্তু জ্ঞানকৃত হিংসাকর উৎকট কাৰ্য্যসমুদয়ও ক্ষুদ্র ফলরূপে পরিণত হইয়া থাকে। দেবতা বা মহর্ষিগণের ন্যায়বিরুদ্ধ কর্ম্ম দর্শন করিয়া তদনুরূপ কার্য্যে প্রবৃত্ত হওয়া বা তাঁহাদের নিন্দা করা ধর্ম্মাত্মাদিগের কর্ত্তব্য নহে। যে ব্যক্তি মনে মনে বিচার করিয়া স্বীয় শক্তি অনুসারে শুভকার্য্যের অনুষ্ঠান করে, সে নিশ্চয়ই মঙ্গল লাভে সমর্থ হয়। যেমন অপক্ক মৃৎপাত্রস্থ [কাঁচা মাটির পাত্রে স্থিত] জল ক্রমে ক্রমে ক্ষীণ হইয়া যায়, কিন্তু পক্ক মৃৎপাত্রস্থ জলের কোন হানি হয় না, তদ্রূপ বুদ্ধিদ্বারা বিচার না করিয়া কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে ঐ কার্য্য ক্রমে ক্রমে হীনদশা প্রাপ্ত হয়, কিন্তু বিচার করিয়া কার্য্যানুষ্ঠান করিলে ঐ কাৰ্য্য সমভাবে অবস্থিত হইয়া ক্রমে ক্রমে সুখ বৃদ্ধি করিয়া থাকে। যেমন কোন পাত্রস্থিত জলে জল প্রদান করিলে সেই জলের বৃদ্ধি হয়, তদ্রূপ পুণ্যকাৰ্য্যের অনুষ্ঠানদ্বারা ধাৰ্ম্মিকদিগের, পুণ্য পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকে।।

‘হে মহারাজ! এই আমি তোমার নিকট সাধারণ ধৰ্ম্ম কীৰ্ত্তন করিলাম, অতঃপর রাজধৰ্ম্ম কহিতেছি, শ্রবণ কর। নরপতি প্রথমতঃ প্রবল শত্ৰুদিগকে পরাজিত করিয়া, যথাবিধি প্রজাপালন ও বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া পরিশেষে বনে গমনপূর্ব্বক ধৰ্ম্মশীল ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া সমুদয় প্রাণীকে আপনার ন্যায় দর্শন, শক্তি অনুসারে গুরুজনদের শুশ্রূষা এবং সত্য ও সৎস্বভাবজনিত বিশুদ্ধ সুখ অনুভব করিবেন।”