সোরাবিয়া ফেলিপিলিও আর তার বাছাই করা সওয়ার দলকে নিয়ে পাহাড়ের গায়ে লুকোনো প্রেত-প্রাসাদের দরজায় এসে নিজেদের ঘোড়া রুখেছে।
জায়গাটা সত্যিই কেমন হানা দেওয়া কবরের রাজ্যের মতো।
মশালের আলোয় পাহাড়ের গায়ে বিরাট খোদাই করা দরজাটা না দেখলে এখানে কোনও লুকোনো পুরী আছে, সোরাবিয়া বিশ্বাসই করতে পারত না।
এখন এটাই হুয়াইনা কাপাক-এর প্রেত-প্রাসাদ কি না তা-ও জানবার কোনও উপায় নেই। ফেলিপিলিও এ বিষয়ে এসপানিওলদের মতোই অজ্ঞ দেখা গেছে। এদেশের ভাষাটা ছাড়া আর কিছুই সে জানে না।
হুয়াইনা কাপাক-এর হোক বা না হোক সন্ধান যখন পাওয়া গেছে তখন এ। প্রেত-প্রাসাদই একটু হাঁটকে না দেখে সোরাবিয়া যাবে না।
ছোটখাটো জিনিসে তার লোভ নেই। তার ভাবখানা হল মারি তো গণ্ডার লুঠি তো ভাণ্ডার।
সওয়ার সেপাইদের সেই মতোই হুকুম সে দিয়েছে। জন-চারেক মিলে মশাল। নিয়ে ভেতরে ঢুকে একবার দেখে আসুক। হুয়াইনা কাপাক-এর প্রেত-প্রাসাদ হলে সাজসজ্জার ঘটা আর ঐশ্বর্যের আড়ম্বর দেখেই বুঝতে পারবে। সূর্যবরণ প্রান্তরে অতক্ষণ ধরে দেখে হুয়াইনা কাপাক-এর রাজবেশটাও চেনা হয়ে গেছে।
সেপাইরা নিজেরা যা খুশি নিতে চায় নিক, তার জন্যে শুধু সিংহাসনটা নিয়ে আসা চাই-ই।
যা খুঁজছে সে জায়গা যদি না হয় তা হলে সোনার সিংহাসন গোছের কিছু না থাকলে সোরাবিয়ার জন্যে আনার দরকার নেই। সেপাইরা যা চায় নিজেরা লুঠ করে আনুক।
সেপাইদের সঙ্গে সোরাবিয়া ফেলিপিলিওকে পাঠিয়েছে। মৃত ইংকা নরেশদের প্রেত-প্রাসাদে যার-তার ঢোকবার অধিকার নেই। সেখানে যাওয়া তাদের ধর্মে বারণ বলে ফেলিপিলিও আপত্তি করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সোরাবিয়া কোনও ওজর আপত্তি শোনেনি।
অত্যন্ত নির্মমভাবে বিদ্রূপ করে বলেছে, মাথাই নেই তার মাথাব্যথা। তোদের দেবতারাই সব আমাদের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, এখন আবার তোদের ধর্ম কীসের? এদের সব দেখিয়ে শুনিয়ে বুঝিয়ে দিতে তুই না গেলে যাবে কে!
বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছে ফেলিপিলিওকে সেপাইদের সঙ্গে।
সওয়ার সেপাইরাও যে প্রেত-প্রাসাদ লুঠ করতে খুব উৎসুক তা মনে হয়নি!
ভেতরে লোভ যতই থাক, এই বিদঘুটে বেমক্কা জায়গায় পাহাড়ের ভেতরে কাটা অজানা প্রেতপুরীতে ঢুকতে তাদের ভয় হয়েছে অনেক বেশি।
কিছুটা লোভ, কিছুটা দলে ভারী থাকার ভরসা, আর খানিকটা দলপতির হুকুমের দরুন শেষ পর্যন্ত সাহস করে মশাল নিয়ে গুটি গুটি তারা দরজা ঠেলে ঢুকেছে।
দরজা তাদের ভাঙতে কি কষ্ট করে খুলতে হয়নি। আধ ভেজানো অবস্থায় খোলাই পেয়েছে।
সোরাবিয়া তখন ঘোড়া ছেড়ে নেমে বাকি সব সওয়ারদের জড়ো করে মশালের আলোয় একরকম ছোটখাটো দরবার বসিয়েছে। এই একদিনে কে কত কী লুঠ করতে পেরেছে তা জিজ্ঞাসাবাদ করবার দরকার।
দু-একজন মাত্র সবে তাদের কথা জানিয়েছে, এমন সময় সোরাবিয়া আর তার সঙ্গীদের শিউরে চমকে উঠে তাকাতে হয়েছে পাহাড়ের গায়ে বসানোে প্রেত-প্রাসাদের দরজার দিকে।
সেখান থেকে আধ ভেজানো দরজার ভেতর দিয়ে কজনের গলায় যেন ভীত চিৎকারের মতো আওয়াজ আর গণ্ডগোল শোনা গেছে।
সবিস্ময়ে দু-চার মুহূর্তের বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। পাহাড়ের গায়ে বসানো। দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে পড়ি কি মরি অবস্থায় বেসামাল মশাল দিয়ে প্রায় নিজেদের পোশাকেই আগুন ধরিয়ে ফেলে এসপানিওল সওয়ার সেপাইরা ছুটে বেরিয়ে এসেছে।
কী, হল কী?যতখানি রাগ, অধৈর্য, ততখানি উদ্বেগ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেছে সোরাবিয়া।
কারও মুখে কোনও কথাই নেই। দিনের আলো হলে দেখা যেত তাদের মুখ থেকে যেন সব রক্ত সরে গেছে। চেষ্টা করেও তারা খানিকক্ষণ গলায় আওয়াজ ফোটাতে পারেনি।
প্রথম জবাব ফেলিপিলিও-ই দিয়েছে।
বলেছে, এ পবিত্র প্রেত-প্রাসাদের অপমান করবার অধিকার যে কারও নেই। পেরুর ইংকাশ্রেষ্ঠ নিজে তা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, মার্কুইস! আঁর আত্মা এখনও এ প্রেত-প্রাসাদ পাহারা দিচ্ছে আমরা স্বচক্ষে দেখে এসেছি।
রাগের মাথায় সোরাবিয়ার মুখে এসেছিল—তোমরা সব ল্যাজ গুটানো খেকি কুকুরের দল! কিন্তু শুধু একা ফেলিপিলিও তো নয়, অন্য এসপানিওল সেপাইদের কথা মনে রেখে তাকে জিভের রাশ টানতে হয়েছে।
তবু তীব্র স্বরে সে বলেছে, কবে মরে মমি হয়ে গেছে, সে বাঁদির বাচ্চার আত্মাকে তোমরা পাহারা দিতে দেখেছ? তোমরা তো সব ভীরু খরগোশের পাল। কাঁপতে কাঁপতে সব ভেতরে গিয়ে ঢুকেছ আর তারপর নিজেদের মশালের ছায়াই নড়তে দেখে ভূত বলে আঁতকে পালিয়ে এসেছ। তোমরা সব এসপানিওল বীর! সাগর ডিঙিয়ে এসেছ রাজ্য জয় করতে!
গালাগাল অনেক সামলে নিয়েছে সোরাবিয়া, কিন্তু রগচটা এসপানিওল সেপাইরা মার্কুইস আর সেই সঙ্গে দলপতির মান রাখতেও এতটা সহ্য করতে প্রস্তুত নয়।
বেয়াদবি জেনেও তাদের একজন এবার বেপরোয়া হয়ে বলেছে, আমরা তো খরগোশের পাল বটেই, মার্কুইস। আপনি সিংহ হয়ে নিজেই একবার দেখে আসুন না, আমরা ছায়া দেখে ভির্মি গেছি কি না!
কেউ এ খোঁচা না দিলেও সোরাবিয়া তাই দেখতে নিজেই যে যেত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর যা-ই হোক, শয়তানি একটা সাহসের আস্ফালন তার আছে।
সে সাহস সম্বন্ধে সন্দেহের ইঙ্গিতে রেগে আগুন হয়ে উঠেছে সোরাবিয়া। ঘৃণা আর অবজ্ঞায় গলাটা যতদূর সম্ভব তিক্ত করে বলেছে, তা নিজে না দেখে। তোমাদের কথাই মেনে নিয়ে এখান থেকে ফিরে যাব ভেবেছিলে! এখুনি আমি যাচ্ছি। একজন শুধু এসো আমার সঙ্গে মশাল নিয়ে।
সোরাবিয়াকে কয়েক পা এগিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছে। তার সঙ্গে মশাল নিয়ে যাবার জন্যে কেউ এগিয়ে আসেনি।
কই, কে আসছে মশাল নিয়ে? সোরাবিয়া চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করেছে।
কারও কাছ থেকেই কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।
সোরাবিয়া দাম্ভিক স্বার্থপর গোঁয়ার, কিন্তু নির্বোধ মোটেই নয়। সেপাই-সওয়ারদের এ অবাধ্যতা এখনই শাসন করতে গেলে ব্যাপারটা বিশ্রী হয়ে দাঁড়িয়ে তার উদ্দেশ্যটাই পণ্ড হতে পারে।
সওয়ার সেপাইদের ছেড়ে দিয়ে তাই সোরাবিয়া এবার ফেলিপিলিওকে হুকুম করেছে, মশাল নিয়ে তার সঙ্গে থাকার জন্যে।
এ আদেশ আমায় করবেন না, মার্কুইস। নিষ্ফল জেনেও ফেলিপিলিও একবার শুধু তার বক্তব্যটা জানিয়েছে—এ প্রেত-প্রাসাদ অপবিত্র করার শাস্তি আমি তো পাবই, আপনিও তা হলে এ অভিশাপ থেকে রেহাই পাবেন না।
আমায় তোদের জুজুর ভয় দেখাচ্ছিস, বাঁদির বাচ্চা!—সোরাবিয়া তার খোলা তলোয়ারের ডগাটা দিয়ে ফেলিপিলিওর পিঠে একটা খোঁচা দিয়েছে—নেহাত দোভাষী হিসেবে তোকে দিয়ে এখনও কিছু করবার আছে। নইলে এই খোঁচাতে এফোঁড় ওফোঁড় করে তোকে তোর জুজুর কাছে বলি দিয়ে যেতাম। চল এখন।
একজন মশালচি সেপাই-এর হাত থেকে একটা মশাল টেনে নিয়ে ফেলিপিলিওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সোরাবিয়া এগিয়ে গেছে পাহাড়ের গায়ে বসানো দরজার দিকে।
কিছুক্ষণ আগেই এসপানিওল সৈনিকেরা সেখান দিয়ে ছুটে পালিয়ে এসেছে। তাদের ধাক্কায় দরজাটা খোলাই ছিল। পেছন থেকে ফেলিপিলিওর হাতের মশালের আলো তখনও তো এসে পড়েনি। ভেতরটা পাহাড়টারই যেন বিরাট অন্ধকার মুখের হাঁ বলে মনে হচ্ছিল।
মশালের লালচে কাঁপা আলো পড়ায় সে অন্ধকার গভীর গহ্বরের চেহারাটা বদলে গেলেও থমথমে রহস্যের ভাবটা আরও যেন গাঢ় হয়েছে।
সোরাবিয়া নিজের একটা ভুল তখন মনে মনে নিজের কাছে স্বীকার করেছে। রাগের মাথায় সওয়ার সৈনিকদের গালাগাল দিতে গিয়ে তারা কী এখানে দেখেছে তা জিজ্ঞাসা করা হয়নি।
ফেলিপিলিওকে এখন অবশ্য জিঞ্জাসা করা যায়। কিন্তু একজন এসপানিওল আর এদেশের কুসংস্কারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো একজন জংলির দেখা তো এক নয়। ওপরে একটু-আধটু পালিশ হলেও ফেলিপিলিও মনে-প্রাণে এখনও এদেশের মুখখু গোঁড়া জংলি। সে যদি কিছু দেখে থাকে তো চোখের চেয়ে মনের কল্পনাতেই দেখেছে। তার কথার কোনও দাম নেই তাই। এসপানিওল সৈনিকদের কাউকেই জিজ্ঞেস করে আসা উচিত ছিল বলে বুঝেছে সোরাবিয়া।
ভেতরের বিরাট গুহাকক্ষের ভেতর এগিয়ে যেতে যেতে মশালের আলোয় সোরাবিয়া যা এখন দেখেছে তা সত্যিই চোখ ধাঁধিয়ে দেবার মত। সূর্যবরণ প্রান্তরের শবসভায় এ ঐশ্বর্য আড়ম্বরের এক শতাংশও নিয়ে গিয়ে দেখানো হয়নি। তা সম্ভবও নয়।
যে ঐশ্বর্য এখানে জমা হয়ে আছে সোরাবিয়া আর হেরাদার সঙ্গে যারা এসেছে। সেই গোটা এসপানিওল সওয়ার বাহিনীর তাতে এক জন্মের মতো লুঠের সাধ মিটে যায়।
আর যে আহাম্মকগুলো এখানে এসেছিল তারা কি না মেয়েছেলের মতো কোথায় কী ছায়া নড়তে দেখে এসপানিওল বীরত্বের মুখে চুনকালি মাখিয়ে ছুটে পালিয়েছে।
এই তো বিরাট গুহাপুরী। মশালের আলো যতুটুকু পৌঁছোচ্ছে তার বাইরে ফিকে থেকে ক্রমশ গাঢ় হওয়া অন্ধকারের একটা বেড় যেন একটু অসাবধান হলেই চেপে ধরবার জন্যে ওত পেতে আছে মনে করা যেতে পারে, কিন্তু সে তো নেহাত অলীক কল্পনা।
এক মশালের আলোর শিখাটা বাদে গুহাপুরীতে যত কিছু সব নিথর নিস্পন্দ। তাদের নিজেদের পায়ের আওয়াজটুকু ছাড়া চারিদিকে তাদের ঘিরে গভীর নিস্তব্ধতা।
মশালের আলোর কম্পিত শিখার ছায়ায় শুধু মাঝে মাঝে যেন চোখের ভুল একটু ঘটছে।
ঠিক আগের মুহূর্তেই রাজবেশ পরিয়ে সোনার সিংহাসনে বসানো ইংকা নরেশের শবদেহটা কেমন একটু যেন নড়ে বসল বলে মনে হয়েছিল।
দৃষ্টিবিভ্রম ছাড়া তা আর কী হতে পারে!
জোরের সঙ্গে নিজেকে একথা বোঝাতে গিয়েই সোরাবিয়ার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে একটা বরফের ধারা নেমে গিয়ে সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।
ফিসফিস করে কে যেন কী বলছে। না, ফেলিপিলিও নয়। সোরাবিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে লক্ষ করেছে। ফিসফিস করে বলার ভাষাটা কিন্তু নিখুঁত কাস্তিলিয়ান। আর যা বলছে তার মানে হল, ফিরে যাও সোরাবিয়া। এ প্রেত-প্রাসাদ অপবিত্র করে আমার
অভিশাপ সাধ করে মাথায় নিও না।
ফেলিপিলিও তো নির্বাক। তা হলে এ অশরীরী ঘোষণা কোথা থেকে আসছে?
এ ঘোষণার ভাষা আবার কাস্তিলিয়ান! তা কী করে সম্ভব হয়? কাস্তিলিয়ান বলবার মতো মানুষ প্রেত-প্রাসাদে এক সোরাবিয়া নিজে আর ফেলিপিলিও।
ফেলিপিলিওর গলার স্বর তার চেনা। তা ছাড়া দোভাষী হিসেবে কাস্তিলিয়ান দিয়ে কাজ সারতে পারলেও তার ভাষায় উচ্চারণে অনেক ভুল।
আর এ তো একেবারে চোস্ত কাস্তিলিয়ান। স্পেনের রাজদরবারে শিক্ষিত বড় ঘরোয়ানারা যা ব্যবহার করে তা-ই!
সারাবিয়া মনে মনে জানে মূর্খ বলে এ নির্ভুল উচ্চারণের ভাষা তার গলা দিয়েও বার হয় না।
এ তা হলে সত্যিই কি ভৌতিক কিছু? অশরীরী দৈববাণী গোছের বলেই যে-ভাষায়-খুশি উচ্চারিত হতে পারে? সোরাবিয়া সারা শরীরে লোমহর্ষ নিয়ে কম্পিত বুকে চারিদিকে চেয়েছে। ফেলিপিলিওর দিকে চোখ পড়েছে তাইতেই। সমস্ত মুখ তার আতঙ্কে রক্তশূন্য হয়ে গেছে, চোখের দৃষ্টি উভ্রান্ত।
তার অসাড় হাত থেকে মশালটা পড়ে গিয়ে একটা অগ্নিকাণ্ডই বুঝি বাধাত এই প্রেত-প্রাসাদের দাউ দাউ করে জ্বলবার নানা উপকরণের মধ্যে।
সোরাবিয়া তাড়াতাড়ি সেটা ফেলিপিলিওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে মেঝের উপর রাখা একটা সরু গলার দীর্ঘ ভৃঙ্গার গোছের রুপোর পাত্রের মুখে বসিয়ে দিয়েছে।
ফেলিপিলিও তখন অর্ধচেতন অবস্থায় সেই ভৃঙ্গারের পাশেই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কোনওরকমে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে।
সে ভৌতিক ঘোষণা এখন থেমে গেছে।
কী করবে সোরাবিয়া?
মানে মানে পালিয়েই যাবে এই অভিশপ্ত প্রেত-প্রাসাদ থেকে? এখন যদি চলে যায় বাইরের তার সওয়ার সৈনিকেরা কেউ সন্দেহ করতে পারবে না যে ভয় পেয়ে সে পালিয়ে এসেছে।
শুধু ফেলিপিলিও থাকবে একমাত্র সাক্ষী! কিন্তু ফেলিপিলিও নিজেই কী হয়েছে। ভাল করে মনে করতে পারবে কি? তা ছাড়া নিজের ভয়ের লজ্জা ঢাকতেই তাকে নীরব থাকতে হবে।
পিছু হটে পালাবার জন্যে পেছনে পা বাড়াতে গিয়ে একটা কথাই সোরাবিয়া এই আতঙ্কের মধ্যেও ভুলতে পারে না। এরকম ভাবে পালালে একটা আফশোশই তার থেকে যাবে। অনুচর সেপাইদের কাছে কৈফিয়তটাও খুব জোরদার হবে না যদি একেবারে শুধু হাতে সে ফেরে!
দৈববাণী থেমে গিয়েছে। শুধু ওই সোনার সিংহাসনটা টেনে নিয়ে গেলেই তো হয়!
ঝলমল পোশাকে যে মড়াটা ওর ওপর বসানো আছে সেটাকে শুধু একটু সরাতে হয় এই যা।
মড়াটাকে খুব তাচ্ছিল্য এখন আর অবশ্য করতে পারে না। যে ভুতুড়ে শাসানিটা সে এই মাত্র শুনেছে সেটা তো ওই সাজানো লাশটা যার সেই কোন মরা ইংকার প্রেতের গলা থেকেই বেরিয়েছে বলে ধরতে হয়। এ প্রেত-প্রাসাদ তো তারই। এ প্রাসাদ অপবিত্র করার বিরুদ্ধে অভিশাপের ভয় সে-ই দেখাতে পারে।
বুকটা সোরাবিয়ার বেশ কেঁপে ওঠে। তবু সোনার লোভে মরিয়া হয়ে একবার শেষ চেষ্টা করবার জন্যে নিজেকে সে জোর করে শক্ত করে রাখে।
সিংহাসনটা টেনে নিয়ে যাবার জন্য মড়াটাকে তার ওপর থেকে ফেলে দিতে হবে। মড়াটাকে তার জন্যে হাত দিয়ে ছোঁবার দরকারই বা কী?
তলোয়ারের খোঁচাতেই সেটাকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে দিলেই তো হয়।
অভিশাপের ভয়? একবার এই ভুতুড়ে গুহা থেকে বার হতে পারলে আর কোনও অভিশাপ তাকে স্পর্শ করতে পারবে কি?
সঙ্গে হেরাদাই তো আছে তাদের পুরুত! তার কাছে গিয়ে একবার ক্রুশ ছুঁয়ে নিজের জন্যে কিছু মানত করলে এ অভিশাপ কেটে যেতে কতক্ষণ।
যা করবার তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে শুধু।
তলোয়ারটা খাপ থেকে খুলে বাগিয়ে ধরে সোরাবিয়া এগিয়ে যায় সিংহাসনে বসানো মড়াটার দিকে।
তলোয়ারটা বাড়িয়ে সেটাকে খোঁচানো কিন্তু আর হয়ে ওঠে না।
খবরদার!
একটা তীক্ষ্ণ ক্রুদ্ধ হুকুম শুনে তাকে থমকে যেতে হয়।
না, এবার অশরীরী ভৌতিক প্রায়-চুপিচুপি বলা কোনও সাবধান বাণী নয়, স্পষ্ট, কুদ্ধ জোরালো উচ্চারণ।
কণ্ঠটা আর কারও নয়, ফেলিপিলিওর।
তার সে ভয়ে বিবর্ণ চেহারা এখনও বদলায়নি, কিন্তু অসাড় আচ্ছন্নতার জায়গায় তার দু-চোখে একটা অস্বাভাবিক আগুন যেন জ্বলছে।
এ প্রেত-প্রাসাদের যিনি অধীশ্বর তাঁর নিষেধবাণী নিজের কানে শোনবার পর এত কালের ফেলিপিলিও সে বুঝি আর নেই!
নিজেকে সে জাতির কুলাঙ্গার বলেই জানে। এই এসপানিওলদের কাছেই নিজেকে বিকিয়ে সে এদের গোলাম হয়ে গেছে একথা মিথ্যা নয়। তা ছাড়া মার্কুইস। কেন, যে কোনও এসপানিওল অসিযযাদ্ধার সঙ্গে যোঝবার মতো শিক্ষা কি শক্তি তার নেই। তবু ঘৃণ্য নীচ বিদেশির হাতে এ পবিত্র প্রেত-প্রাসাদের অপমানের বিরুদ্ধে তাকে দাঁড়াতেই হবে। বিশেষ করে ইংকা-শ্রেষ্ঠ স্বয়ং হুয়াইনা কাপাক-এর মৃতদেহ তলোয়ার দিয়ে এই বিদেশি পাষণ্ড তার চোখের সামনে খোঁচাবে এ সহ্য করা তার পক্ষে অসম্ভব।
তাদের জাতির, তাদের ধর্মের সে-ই এখানে একমাত্র প্রতিনিধি। সে প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা সে রাখবে।
সোরাবিয়া ফেলিপিলিওর চিৎকারে প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়েছে। এমনিতেই তার মনের তখন বেশ একটু অস্বাভাবিক অবস্থা, তার ওপর এই তীক্ষ্ণ কণ্ঠের খবরদার আওয়াজটা তার ভেতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়েছে অদম্য আতঙ্কে।
প্রথম থমকে যাওয়ার পরে ফিরে তাকিয়ে সে আওয়াজের উৎসটা বুঝতে পারে। আর কেউ নয়, ফেলিপিলিওই তাকে এ ধমক দিয়েছে এটা উপলব্ধির পর কয়েক মুহূর্ত আতঙ্কটা বিমূঢ় বিস্ময় হয়ে তাকে বিহ্বল করে রাখে। তারপর সেই বিহ্বলতাটা বোমার বারুদের মতো প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ে।
এ প্রেত-প্রাসাদের বুকের ভেতর পর্যন্ত জমিয়ে দেওয়া হিমেল ভয়ের স্পর্শটা যেন সে রাগের উত্তাপে খানিকক্ষণের জন্যে আর টের পাওয়া যায় না।
হিংস্রভাবে দাঁত খিঁচিয়ে উঠে সোরাবিয়া জিজ্ঞাসা করে, তুই? তোর গলার আওয়াজ শুনলাম? তুই হাঁকলি খবরদার!
হ্যাঁ, আমিই হাঁকলাম। ফেলিপিলিওর গলা এখন আর তীক্ষ্ণ তীব্র নয়। এ প্রতিবাদের পরিণাম জেনে সে শান্ত দৃঢ় স্বরে বলে, আগেই আপনাকে মানা করেছিলাম, মার্কুইস। তা সত্ত্বেও জোর করে আমায় এখানে এনে ভালো করেননি। এ পবিত্র প্রেত-প্রাসাদের রক্ষীরা এখন নেই। কিন্তু আমি আছি। এখানকার অগুনতি সোনা রুপোর দামি জিনিসের মধ্যে দু-চারটে নিতে চান তো নিন। আমি আপত্তি করব না। কিন্তু ইংকা-শ্রেষ্ঠ হুয়াইনা কাপাক-এর পবিত্র শবদেহ স্পর্শ করতে বা তাঁর সিংহাসন এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে আপনি পারবেন না। অন্তত আমার মৃতদেহ না মাড়িয়ে নয়।
তোর মৃতদেহ না মাড়িয়ে? ফেলিপিলিওর কথাগুলো শুনতে শুনতে সোরাবিয়ার মুখে রাগের বদলে একটা ক্রুর পৈশাচিক হাসি এবার দেখা যায়। বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলে, পাপোশ হবার তোর এত শখ তা আগে জানালেই পারতিস। যাক, এখন জানিয়েও ভাল করেছিস। তোর শখ আর আমার সাধ এক সঙ্গেই মিটিয়ে ফেলি, আয়।
সোরাবিয়া বাঁদর নাচাবার মতো অবজ্ঞার ভঙ্গিতে তলোয়ারটা নাড়ে ফেলিপিলিওর মুখের কাছে।
ফেলিপিলিও সরে যায়, কিন্তু ভয় পায় না। চরম নিয়তির জন্যে প্রস্তুত হয়েই সে মরণপণ করে মার্কুইসকে আক্রমণই করে।
তার আক্রমণে বেপরোয়া সাহসই আছে, কিন্তু তাতে নেহাত অক্ষম অজ্ঞ আনাড়ির আড়ষ্টতা নিতান্ত স্পষ্ট। সোরাবিয়ার হিংস্র কৌতুক তাতে আরও তীব্র হয়।
এক আঘাতে এফোঁড়-ওফোঁড় নয়, একটু একটু করে ফেলিপিলিওর গায়ে এখানে ওখানে তলোয়ারের ডগা বিঁধিয়ে রক্তপাত করে সোরাবিয়া তাকে ধীরে ধীরে মারবার নির্মম আনন্দটাই উপভোগ করে।
হঠাৎ আবার সেই অশরীরি ধ্বনি—এখনও ক্ষান্ত হও সোরাবিয়া। অক্ষম দুর্বলকে মৃত্যুযন্ত্রণা দিয়ে আনন্দ পাওয়ার দ্বিগুণ দাম তা হলে তোমায় দিতে হবে। এখনও বলছি, এ প্রেত-প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাও। জেনে রাখো ফেলিপিলিও আমার আশ্রিত–
সোরাবিয়ার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায় ভয়ে বিহ্বলতায়। কিন্তু চরম আতঙ্কই যেন একটা উদ্ধত উন্মত্ততা এনে দেয় তার ভেতরে।
হিংস্রভাবে পাগলের মতো হেসে উঠে সে বলে, ভূত-প্রেত-দানব, কে তুই জানি। সাহস যদি থাকে তা হলে সামনে আয়। তোর আশ্রিত যাকে বলছিস তোর সামনেই তাকে হত্যা করছি দেখ।
সোরাবিয়া নিপুণ অসিযোদ্ধার কৌশলে ডান পা একটু মুড়ে সামনে বাড়িয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে প্রসারিত ডান হাতের তলোয়ারটা চক্ষের নিমেষে কাঁধ থেকে সোজা সামনে চালিয়ে দেয়।
এখনকার ফেনসিং-এর ভাষায় এটা একেবারে নিখুঁত লাঞ্জ। এ মার ঠেকাবার, একমাত্র চাল হল সেই ভাষায়—প্যারা অফ প্রাইম।
ফেনসিং-এর এ সব নামই সে যুগে বানানো হয়নি। তবে কৌশলগুলো একেবারে অজানা ছিল না। নাম না জেনেই সোরাবিয়া তলোয়ারের যে চাল চেলেছিল তা মোক্ষম।
ঠেকাবার পালটা চাল জানা না থাকায় ব্যর্থ প্রতিরোধের চেষ্টায় সোরাবিয়ার সেই এক খোঁচাতেই ফেলিপিলিওর হৃদপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবার কথা।
কিন্তু তা হয় না।
হঠাৎ চরম মুহূর্তে একটা ভারী জিনিস সোরাবিয়া আর ফেলিপিলিওকে ছাড়িয়ে একটু দূরে সশব্দে মেঝের ওপর গিয়ে পড়ে।
পড়বার আগে সোরাবিয়ার তলোয়ারের ডগাটা তাতে একটু নড়ে গিয়ে ফেলিপিলিওকে বাঁচিয়ে দিয়ে যায়।
সোরাবিয়া আর ফেলিপিলিও দুজনেই চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে মেঝের ওপর সশব্দে গিয়ে পড়া বস্তুটা দেখে।
ব্রোঞ্জের তৈরি একটা ভারী এদেশি রণকুঠার। রণকুঠারটা কে কোন দিক থেকে ছুঁড়েছে আর বুঝতে বাকি থাকে না।
এ রণকুঠারটা খানিক আগে পর্যন্ত যার হাতে শোভিত দেখা গেছল ইংকা নরেশ হুয়াইনা কাপাক-এর সেই রাজবেশে সাজানো শবমূর্তিকেই ধীরে ধীরে এবার উঠে দাঁড়াতে দেখা যায়। মুখোশ-ঢাকা তার মুখ, সারা গায়ে সোনা রুপো জড়োয়ার কাজে ঝলমল পোশাক আর হাতে একটা তলোয়ার।
কিন্তু সে ব্রোঞ্জের তৈরি খাটো তলোয়ার তো এসপানিওলদের সরেস ইস্পাতে গড়া লম্বা অসি ফলকের কাছে ছেলেখেলার জিনিস।
সোরাবিয়া প্রথমে নিজেকে সামলাতে না পেরে ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেও সেই কথাই ভাবে। আর ফেলিপিলিও আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় যেন নিশ্চল হয়ে গিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেই মূর্তির দিকে।
ইংকা নরেশ হুয়াইনা কাপাক কি সত্যিই এবার জাগলেন? কিন্তু কী করবেন তিনি ওই সামান্য সেকেলে অস্ত্র নিয়ে এই এসপানিওলদের বিরুদ্ধে, তাদের নিজেদের ধর্মের সবরকম পাপের অধীশ্বর স্বয়ং শয়তানই যাদের সহায়?
সত্যিই যদি জেগে থাকেন তবু ইংকা শ্রেষ্ঠ হুয়াইনা কাপাক তাঁর সঞ্জীবিত শবদেহে কিছুই যে করতে পারছেন না, ফেলিপিলিও সশঙ্ক হতাশায় তা দেখতে পায়।
কেমন করেই বা করবেন!
হাতে তাঁর সামান্য একটা সেকেলে দুর্বল অস্ত্র যা সাধারণ একটা ছোরার একটু দীর্ঘ সংস্করণ ছাড়া আর কিছু নয়। এ দীর্ঘ ছোরা আবার ব্রোঞ্জের। তামা আর টিন মেশাবার অসামান্য কৌশলে এ ব্রোঞ্জ পেরুর ললাকেরা যত কঠিনই করে তুলে থাকুক, ইস্পাতের তলোয়ারের সঙ্গে তার কি তুলনা হয়!
তাও আবার ইউরোপের সেরা অস্ত্রের কাজ তখন যেখানে হয় স্পেনের সেই টোলেডো শহরের বিখ্যাত কারিগরের তৈরি সরেস ইস্পাতের বেঁধবার ও কোপ দেবার সুচোলো আর দু-দিকে সমান ধারালো তলোয়ারের সঙ্গে। এত কথা ফেলিপিলিওর জানা নেই। কিন্তু মার্কুইস যে ক্রমশ জয়ী হচ্ছে তা বুঝতে তার দেরি হয়নি।
রাজবেশ পরা মৃতদেহকে সিংহাসন থেকে উঠে এগিয়ে আসতে দেখে প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়ে সারাবিয়া নিজের অজান্তেই কয়েক পা পিছিয়ে এসেছিল, তারপর তার ওপর সত্যি শয়তানই যেন ভর করেছে মনে হয়েছে। তার মুখটা হিংস্র দেখিয়েছে সেইরকমই।
এ হিংস্র উল্লাস অকারণে হঠাৎ তার মুখে ফুটে ওঠেনি। ভূত প্রেত যা-ই হোক, রাজবেশ-পরা মড়াটা তাঁর সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে যুঝতে আসছে এটুকু বুঝেই সোরাবিয়া তখন বুকে নতুন বল পেয়েছে।
আর অস্ত্রই বা কী! ব্রোঞ্জের একটা খাটো তলোয়ার! ঠিকমতো চালাতে পারলে তার তলোয়ারের এক ঘায়ে ও তলোয়ার দু-টুকরো হয়ে যাবে।
গেছেও প্রায় তাই।
সোরাবিয়া তলোলায়ারের খেলায় ইউরোপের সেরা গুণীদের একজন। তাকে একবার একজন শুধু একটা বড় ছোরা নিয়েই বেশ একটু বেকায়দায় যে ফেলেছিল, সোরাবিয়ার মনের গোপনে সে স্মৃতির জ্বালা এখনও অবশ্য আছে। কিন্তু আর যাই হোক সে ছোরাটা ছিল ইস্পাতের, আর তার নিজের দেশের এক বিশেষ দাঁত কাটা ধরনে তৈরি।
এ ঠুনকো ব্রোঞ্জের হাতিয়ার সে ইস্পাতের ছোরার কাছে খেলনা মাত্র। আর দানোয় পাওয়াও যদি হয় তাহলেও এই জাগানো মড়া, তার স্ত্রী আনার পেয়ারের সেই গোলাম নয়।
সোরাবিয়া অকুতোভয়ে তার তলোয়ার চালিয়েছে। দু-টুকরো না হয়ে গেলেও সে মার ঠেকাতে গিয়ে ব্রোঞ্জের খাটো তলোয়ারের একটা চোলা তাতে উঠে গিয়েছে।
সোরাবিয়া নিজের অস্ত্র প্রাধান্যের এ সুবিধেটুকু ষোলো আনা কাজে লাগাতে ত্রুটি করেনি। নির্মম অমোঘ নিয়তির মতো সে একটু একটু করে কোণঠাসা করে এনেছে সে শবমূর্তিকে।
অস্ত্রবিদ্যায় মৃত ইংকা নরেশ তেমন অপটু যে ছিলেন না তাঁর শবমূর্তির চালনা-কৌশল দেখে ফেলিপিলিও তা ভাল করেই বুঝেছে। কিন্তু দীর্ঘতর অনেক জোরালো ও ভিন্ন জাতের ইস্পাতের অস্ত্রের কাছেই হার মানতে হয়েছে ব্রোঞ্জের খাটো তলোয়ারকে।
মাঝে মাঝে অদ্ভুত ঘোরা-ফেরার কায়দায় কোনওরকমে মার্কুইসকে এড়িয়েও শেষ পর্যন্ত শবমূর্তি উঁচু বেদির ওপর বসানো তাঁর সিংহাসনের পেছনেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
এখান থেকে আর পেছিয়ে যাবার বা এপাশে-ওপাশে পালাবার কোনও উপায় নেই।
মার্কুইস-এর মুখের দিকে চেয়ে ফেলিপিলিও মনে মনে নিরুপায় হতাশ রাগে গুমরেছে। একটা ইঁদুরকে থাবার তলায় চেপে রেখে শেষ মারে নিকেশ করবার জন্যে বেড়ালের মুখে যা ফুটে ওঠে তার চেয়ে অনেক পৈশাচিক একটা হিংসার উল্লাস মার্কুইসের চোখ মুখে তখন জ্বলছে।
মার্কুইস জানে ইস্পাতের তলোয়ারের শুধু একটা কি দুটো কোপ দেওয়ার অপেক্ষা। সে কোপ ঠেকাবার মতো কোনও কিছু ওই ভুতুড়ে মূর্তির হাতে বা ধারে কাছে নেই। তার ভুতুড়ে ক্ষমতার পরিচয় তো এখনও পর্যন্ত কিছু পায়নি। সোরাবিয়ার সাহস সেই জন্যেই এত বেশি। এ বাঁদির বাচ্চাদের দেশের ভূতের জারিজুরিও তার মতো ধনী সভ্য মানুষের কাছে খাটে না বলে তার তখন দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে।
শেষ কোপটা দেওয়া অবশ্য তখনই হয়নি। বাধা পড়েছে আচমকা।
হঠাৎ গুহামুখে বেশ একটু হট্টগোল শোনা গেছে।
সোরাবিয়া একটু অবাক হয়েছে সে গোলমালে। তার সওয়ার সেপাইরা তো ভয়েই কাঠ হয়ে ছিল এর আগে। তারাই শেষ পর্যন্ত ভীরুতার লজ্জায় মরিয়া হয়ে তার সঙ্গে যোগ দিতে আসছে না কি?
কোণঠাসা ভুতুড়ে মূর্তির ওপর কড়া নজর রেখে সোরাবিয়া গুহামুখে যারা ঢুকছে তাদেরও একটু লক্ষ করেছে।
সওয়ার সেপাই-এর কয়েকজন প্রেত-প্রাসাদের দরজা দিয়ে ঢুকেছে বটে, কিন্তু এ তো তার সঙ্গে যারা এসেছিল তাদের কেউ নয়। কোরিকাঞ্চার রাতের আস্তানায় যাদের রেখে এসেছিল এরা তো তাদেরই ক-জন!
তাদের ভেতর থেকে হেরাদাকে এগিয়ে আসতে দেখে আরও অবাক হয়েছে।
হেরাদা উত্তেজিতভাবে সোরাবিয়ার কাছে এসে যা বলেছে তাতে অবশ্য রক্ষীদল। নিয়ে হঠাৎ তার এই প্রেত-প্রাসাদে ছুটে আসার কারণটা আর অস্পষ্ট থাকেনি।
কারণটা সত্যিই যেমন অপ্রত্যাশিত তেমনি অবিশ্বাস্য! এদেশের রাজনীতি সম্বন্ধে বিশেষ কোনও মাথা ব্যথা সারাবিয়ার নেই। তবু হেরাদা যা খবর জানিয়েছে তাতে তাকে বেশ একটু বিচলিত হতে হয়েছে।
চলুন, এখুনি ফিরে চলুন মার্কুইস! প্রথমেই অত্যন্ত উত্তেজিত অস্থিরতার সঙ্গে বলেছে হেরাদা!
কেন, কী, হয়েছে কী? বিস্মিত উদ্বেগের সঙ্গে একটু বিরক্তি নিয়েই জিজ্ঞাসা করেছে সোরাবিয়া। আশ মিটিয়ে হাতের সুখ করবার এমন একটা মুহূর্তে বাধা পড়ায় সে খুশি নয় তখন।
যা হয়েছে তাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের কামালকায় ফেরা দরকার। প্রায় আদেশের স্বরেই যেন বলতে বাধ্য হয়েছে হেরাদা, সেনাপতি পিজারোর কাছে খবরটা পৌঁছে দেবার দায়িত্বও আমাদের।
কিন্তু খবরটা কী সেটা তো এখনও জানতে পারলাম না। সোরাবিয়া মার্কুইস হিসেবে তার অধৈর্যটা একটু মেজাজ দেখিয়েই প্রকাশ করেছে।
উত্তেজিত অবস্থায় আসল কথাটা জানাতেই ভুল হয়ে গিয়েছিল বটে হেরাদার। সে ত্রুটি সংশোধন করে হেরাদা এবার যা জানিয়েছে তা খবর হিসেবে সত্যিই সাংঘাতিক।
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমু সৌসা দুর্গে বন্দি আতাহুয়ালপার বৈমাত্রেয় রাজভ্রাতা পরাজিত ভূতপূর্ব ইংকা হুয়াসকারকে হত্যা করিয়েছে।
হুয়াসকারকে হত্যা করিয়েছে রাজপুরোহিত! এ রাজ্যের বেশি কিছু না জেনেই। চমকে উঠেছে সোরাবিয়া।
চমকটা যে শুধু তার একার নয়, সজাগ থাকলে সোরাবিয়ার তা দৃষ্টি এড়াত না।
ফেলিপিলিওর দৃষ্টি তা এড়ায়নি। নিজের স্তব্ধ বিহ্বলতা নিয়েই শবমূর্তির দিকে সবিস্ময়ে চেয়ে সে হেরাদার পরের ব্যাখ্যাটা শুনেছে।
হ্যাঁ, হেরাদা গম্ভীর স্বরে জানিয়েছে, সৌসা থেকে এইমাত্র এক দূত এসে পৌঁছেছে এই ভয়ংকর খবর নিয়ে! যে সওয়ারদের নিয়ে আপনি এখানে এসেছেন তাদেরই একজন বেশি নেশা করে বেসামাল হয়ে আপনার সঙ্গে এ দলে যোগ দিতে পারেনি। তার কাছেই জায়গাটার হদিস নিয়ে আমি ছুটে আসছি। চলুন, আর দেরি করবার সময় নেই।
আছে! একটু তিক্ত উদ্ধত স্বরেই বলেছে সোরাবিয়া, এই দানোয় পাওয়া মড়াটাকে কয়েক টুকরো করে এ সোনার সিংহাসনটা টেনে নিয়ে যাবার মতো সময় অন্তত আছে।
সোরাবিয়া তার তলোয়ারটিকে বাগিয়ে তুলতে গেছে শেষ কোপ দেবার জন্যে।
কিন্তু ওই পর্যন্তই।
হঠাৎ সমস্ত গুহা একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছে। অন্ধকার হয়ে গেছে দেওয়ালের ধারে ভৃঙ্গারে বসানো মশালটার জ্বলন্ত মাথাটাই কাটা হয়ে মেঝের ওপর ঠিকরে পড়বার দরুন।
মশালের মাথাটা কেটে গেছে তীরবেগে ছোঁড়া অব্যর্থ একটা খাটো তলোয়ারের ঘায়ে। ইস্পাতের বদলে সামান্য ব্রোঞ্জের তৈরি হলেও এ কাজটা তাতে নিপুণভাবেই হয়েছে।
পাথুরে মেঝের ওপর ছেতরে পড়ে মশালের মাথার আগুনটা দুবার একটু যেন খাবি খেয়েছে। তার পর একেবারে গেছে নিভে।
আর সকলের মতো সোরাবিয়ার চোখ আপনা থেকেই ছিটকে পড়া মশালের মাথাটার সঙ্গে মেঝের ওপরেই গিয়ে পড়েছিল। আগুনটা সেখানে নিভে যাবার পর চোখ ফেরাতে গিয়ে সবদিক দিয়েই সে সত্যিকার অন্ধকার দেখেছে।
গুহার ভেতরে একেবারে কালি-ঢালা অন্ধকার। হেরাদার সঙ্গে যে দু-চারজন সেপাই ভেতরে এসে ঢুকেছিল তারা কেউ মশাল সঙ্গে আনেনি।
হঠাৎ এ অন্ধকারে সোরাবিয়া ও হেরাদার সঙ্গে তারাও চমকে হতভম্ব আর দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নিজেদের কারও গায়ে লাগতে পারে জেনেও বেপরোয়া হয়ে সোরাবিয়া তলোয়ার চালিয়েছে সামনের দিকে। কিন্তু বৃথাই।
এরই মধ্যে ফেলিপিলিও তার হাতে একটা হেঁচকা টান টের পেয়েছে। সেই সঙ্গে কুইচুয়া ভাষায় একটা চাপা গলার আদেশ—এসো। ভয় পেয়ো না।
এ আওয়াজটা সোরাবিয়ার কানেও গেছে অস্পষ্টভাবে। কিন্তু আওয়াজ লক্ষ করে যে তলোয়ার সে চালিয়েছে তাতে মশাল রাখবার রুপোর ভৃঙ্গারটাই ঝনঝন শব্দে অন্ধকার গুহা কাঁপিয়ে যেন আর্তনাদ করে উঠেছে।
একটা আর্তনাদের মতো শব্দ কয়েক মুহূর্ত বাদে গুহা মুখেও শোনা গেছে। সেখানকার বিশাল দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।
গুহা মুখের দরজা বন্ধ হল কেমন করে? কে করলে? সোরাবিয়া আর হেরাদা অন্ধকার প্রেত-প্রাসাদকক্ষে চারিদিকে সাজানো নানা মহামূল্য ঐশ্বর্যবিলাসের উপকরণের মধ্যে হোঁচট খেতে খেতে দরজার দিকে ব্যাকুলভাবে ছোটবার চেষ্টা করেছে। দরজার কাছাকাছি যারা ছিল সেই সওয়ারসৈনিকদের কোনও একজনের বন্ধ দরজার ওপর ভীত করাঘাতের শব্দই নিশানা হয়েছে আর সকলের।
প্রেত-প্রাসাদের বাইরেও তখন একটা হুলস্থুল বেধেছে। সোরাবিয়ার সঙ্গে যারা আগে এসেছিল, তারা, হেরাদা ও তার রক্ষীদলের হঠাৎ এমন করে এ জায়গায় উপস্থিত হওয়ায় উৎসুক ও উত্তেজিত হয়ে ব্যাপারটা পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করছিল। হঠাৎ তাদের ভেতর দিয়ে একটা ঘূর্ণিঝড় যেন বয়ে গিয়েছে।
নিজেদের মধ্যে তন্ময় হয়ে আলাপ করতে করতে প্রেত-প্রাসাদের দরজাটা হঠাৎ সশব্দে বন্ধ হওয়াই তাদের চমকে সজাগ করে তুলেছিল। দরজা বন্ধের সে শব্দের পরই কাছাকাছি খুঁটি পুঁতে বেঁধে রাখা তাদের ঘোড়াগুলো যেন খেপে গিয়েছে মনে হয়েছে। ঠিক নেকড়ের পালের সামনে পড়ার মতো আতঙ্কের ডাক ছেড়ে অস্থির হয়ে। লাফালাফি করে তারা যেন দড়িদড়ার বাঁধন ছিঁড়েই সব যেদিকে খুশি অন্ধকারে ছুটে পালিয়েছে।
সেদিকে খোঁজ নিতে যাবে কী, ওদিকে গুহামুখের দরজার ওপর তখন আকুল পরিত্রাহি ঘা পড়ছে ভেতর থেকে!
সেপাইদের ব্যাপারটা ভাল করে বুঝতেই বেশ কিছুটা সময় গেছে। সব গোল মেটাতে আরও অনেক বেশি।
গুহামুখের দরজার বাইরে থেকে দেওয়া হুড়কো খুলে দিয়ে সোরাবিয়া ও হেরাদার সঙ্গে আটকে-পড়া সওয়ার সেপাইদের বার করবার পর ঘোড়াগুলোর খোঁজ পাওয়া সহজ হয়নি। খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেছে ঘোড়াগুলো নিজে থেকে দড়িদড়া ঘেঁড়েনি। খুঁটিতে বাঁধা তাদের দড়িগুলো সব কাটা।
এদিকে ওদিকে পালানো ঘোড়াগুলো প্রায় সবই শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা গেছে। যায়নি শুধু দুটো। মার্কুইসরূপী সোরাবিয়া আর দলপতি হেরাদার সেরা ঘোড়া দুটোই একেবারে নিখোঁজ।
সে ঘোড়ায় চড়ে কারা যে পালিয়েছে তার হদিসও পাওয়া গেছে। সোরাবিয়া আর হেরাদার সঙ্গে যারা এ প্রেত-প্রাসাদে এসেছিল তাদের মধ্যে শুধু ফেলিপিলিওর কোনও পাত্তা নেই। আর হুইয়ানো কাপাক-এর শবদেহে পরানো রাজবেশটা প্রেত-প্রাসাদের বাইরে ঘোড়াগুলো যেখানে বাঁধা ছিল তারই কাছাকাছি ছেড়ে ফেলা খোলসের মতো পড়ে আছে।
পালিয়ে যাওয়া সব ঘোড়া খুঁজে পেতে ধরে এনে জড়ো করতে রাত প্রায় শেষ। হয়ে এসেছিল। ভোরের সেই আবছা আলোতেই হেলায় ফেলে-যাওয়া সোনা-রুপোর কাজে জমকালো রাজবেশটা দেখে সোরাবিয়ার দুচোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরিয়েছে।
রাজবেশের খোলস ফেলে যাওয়ার রহস্য সে তার শয়তানি বুদ্ধিতে কিছু আঁচ করতে পেরেছে কি?