ব্যাসের ধৃতরাষ্ট্র-তপঃপরীক্ষাসূচক প্রশ্ন
বৈশম্পায়ন বলিলেন, অনন্তর পাণ্ডবগণ কুশাসনে সমাসীন হইলে মহর্ষি বেদব্যাস ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “রাজন্! এক্ষণে ত’ নিৰ্বিঘ্নে তোমার তপানুষ্ঠান হইতেছে? এখন ত’ তুমি বনবাসের সুখ অনুভব করিতেছ? আর ত’ এখন তোমার হৃদয়ে পুত্রশোক নাই? তোমার অন্তঃকরণে জ্ঞানসমুদয় ত’ নিৰ্ম্মলরূপে স্ফূৰ্ত্তি পাইতেছে? তুমি ত’ দৃঢ়তর অধ্যবসায়সহকারে অরণ্য-বিধির অনুষ্ঠান করিতেছ? ধর্ম্মার্থতত্ত্বদর্শিনী দুৰ্য্যোধনজননী গান্ধারী ত’ আর শোকে অভিভূত হয়েন না? যিনি গুরুজনের শুশ্রূষার নিমিত্ত পুত্রগণকে পরিত্যাগ করিয়াছেন, সেই দেবী কুন্তী ত’ অহঙ্কারপরিশূন্য হইয়া তোমাদিগের শুশ্রূষা করিতেছেন? তুমি ত’ ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেবকে সান্ত্বনা করিয়াছ? ইঁহাদিগের আগমনে তোমার মন ত’ আহ্লাদিত হইতেছে? আর ত’ তোমার মনের মালিন্য নাই? এখন ত’ তুমি জ্ঞানলাভ করিয়া বিশুদ্ধভাব অবলম্বন করিয়াছ? নিব্বৈর, সত্য ও অক্রোধ এই তিনটি গুণ সমুদয় প্রাণীর পক্ষেই হিতকর। তোমার ত’ ঐ তিন গুণের কোন ব্যাঘাত হয় নাই? এখন ত’ আর তোমার বনবাসজন্য কোন কষ্ট উপস্থিত হয় না? বন্য ফলমূল আহার ও উপবাস করা ত’ সহ্য হইয়াছে?
“সাক্ষাৎ ধৰ্ম্মস্বরূপ মহাত্মা বিদুর যেরূপে ধৰ্ম্মরাজের শরীরে প্রবেশ করিয়াছেন, তাহা তুমি অবগত হইয়াছ। মহাত্মা ধৰ্ম্ম মাণ্ডব্যশাপে নরকলেবর ধারণপূৰ্ব্বক বিদুররূপে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছিলেন। দেবগণমধ্যে বৃহস্পতি ও অসুরগণের মধ্যে শুক্রাচার্য্য যেরূপ বুদ্ধিসম্পন্ন, তোমাদের মধ্যে মহাত্মা বিদুরও তদ্রূপ প্রতিভাসম্পন্ন ছিলেন। মহর্ষি মাণ্ডব্য চিরসঞ্চিত তপোবল নষ্ট করিয়া ধৰ্ম্মকে শাপে অভিভূত করাতেই ঐ মহাত্মার জন্ম হয়। আমি পূৰ্ব্বে ব্রহ্মার আদেশানুসারে বিচিত্রবীর্য্যের ক্ষেত্রে উঁহাকে উৎপাদন করিয়াছিলাম। ঐ মহামতি তোমার ভ্রাতা। উঁহার অসাধারণ ধ্যান ও মনের ধারণানিবন্ধন কবিগণ উঁহাকে ধর্ম্ম বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। উনি সত্য, শান্তি, অহিংসা, দান ও দমগুণদ্বারা বিখ্যাত হইয়াছেন। ঐ অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন মহাত্মা ধর্ম্ম যোগবলে কুরুরাজ যুধিষ্ঠিরকে উৎপাদন করিয়াছেন। অগ্নি, জল, বায়ু, আকাশ, ও পৃথিবী যেমন ইহালোক ও পরলোকে বিদ্যমান আছেন, ধৰ্ম্মও তদ্রূপ উভয়লোকেই বিদ্যমান রহিয়াছেন। উনি এই চরাচর বিশ্বসংসারে ব্যাপ্ত হইয়া অবস্থান করিতেছেন। নিষ্পাপ-কলেবর সিদ্ধগণই উঁহার দর্শনলাভে সমর্থ হয়েন। যিনি ধৰ্ম্ম তিনিই বিদুর এবং যিনি বিদুর তিনিই যুধিষ্ঠির।
“এই দেখ, সেই সাক্ষাৎ ধর্ম্মস্বরূপ যুধিষ্ঠির তোমার নিকট ভৃত্যভাবে অবস্থান করিতেছেন। যোগবলসম্পন্ন ধীমান বিদুর উঁহাকে দর্শন করিয়া উহার শরীরে প্রবিষ্ট হইয়াছেন। ঐ ধৰ্ম্মরাজ অচিরাৎ তোমারও মঙ্গলসাধন করিবেন। আমি কেবল তোমার সংশয়চ্ছেদনার্থ এক্ষণে এ স্থানে উপস্থিত হইয়াছি। পূর্ব্বে কোন মহর্ষি যে অদ্ভুত কার্য্য সম্পাদন করিতে পারেন নাই, আমি স্বীয় তপোবলপ্রভাবে সেই অদ্ভুত কাৰ্য্য সমাধান করিব। অতঃপর আমার নিকট তোমার যে-কোন বিষয় দর্শন বা শ্রবণ করিতে বাসনা হইবে, আমি নিশ্চয়ই তোমাকে তাহা দর্শন বা শ্রবণ করাইব।”
আশ্রমবাসিকপর্ব্বাধ্যায় সম্পূর্ণ