২৮তম অধ্যায়
পাণ্ডব-সংবাদ-সংগ্রহে ভীষ্মের মত
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজা! আচাৰ্য্য দ্রোণ মৌনাবলম্বন করিলে দেশকালকুশল কুরুকুলতিলক শান্তনুনন্দন ভীষ্ম তাঁহার বাক্যের সবিশেষ প্রশংসা করিয়া সাধুসম্মত ও ধর্ম্মার্থসঙ্গত কথা কহিতে লাগিলেন,“পাণ্ডবেরা সর্ব্বসুলক্ষণাক্রান্ত, শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন, সত্যব্রতপরায়ণ ও বৃদ্ধিমতাবলম্বী। সেই ক্ষাত্ৰ-ধর্ম্মানুরত মহাবল-পরাক্রান্ত সমরাভিজ্ঞ বীর পুরুষেরা কৃষ্ণের অনুগত হইয়া কাল প্রতীক্ষা করিতেছেন। তাঁহারা কদাচ অবসন্ন হইবেন না। ঐ মহাত্মারা সতত সৎপথে বিচরণ করিতেছেন এবং ধর্ম্ম ও স্ববীৰ্য্যপ্রভাবে সতত পরিরক্ষিত হইতেছেন; অতএব বোধ হয়, কেহই তাঁহাদিগের অনিষ্টসাধন করিতে পরিবে না। এক্ষণে আমি তাঁহাদিগের বিষয়ে তোমাদিগকে কিছু উপদেশ প্রদান করিতেছি, শ্রবণ করা।
“নীতিজ্ঞের নীতিজাল নিতান্ত দুরবগাহ, তথাচ আমরা পাণ্ডবগণের অবস্থানবিষয় পৰ্য্যালোচনা করিয়া যে কথার উল্লেখ করিতেছি, তাহা যুক্তিসঙ্গত, ঈর্ষামূলক নহে। যাহাতে যুধিষ্ঠিরের অনিষ্টপাতের সম্ভাবনা, তদ্বিষয়ে উপদেশ প্রদান করা মাদৃশ লোকের কর্ত্তব্য নহে; কিন্তু সত্যশীল ধর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তি সভামধ্যে ন্যায়ানুগত যথার্থ উপদেশই প্ৰদান করিবে, এই নিমিত্তই আমি সদুপদেশ-প্রদানে প্রবৃত্ত হইতেছি।
“অন্যান্য ব্যক্তি পাণ্ডবগণের নিবাস-নিরূপণ-বিষয়ে যাহা কহিতেছেন, আমি তাহা স্বীকার করি না। আমার মত এই যে, মহারাজ যুধিষ্ঠির যে পুর বা জনপদে এই ত্ৰয়োদশ বৎসর অতিবাহিত করিতেছেন, তথাকার ভূপতিগণ অন্যায়াচরণে পরাঙ্মুখ হইবেন এবং জনগণ বদান্য, দান্ত, হৃষ্ট-পুষ্ট, প্রিয়বাদী ও লজ্জাশীল হইবে। তথায় অসূয়া, ঈৰ্ষা, অভিমান ও মাৎসৰ্য্যের অধিকার থাকিবে না; অনবরত বেদধ্বনি শ্রুত, পূর্ণাহুতি প্রদত্ত, বহুদক্ষিণ যাগ-যজ্ঞ-সমুদয় সম্পাদিত হইবে; পর্জন্য প্রচুর পরিমাণে বারিবর্ষণ করিবে, পৃথিবী শস্যসম্পন্ন ও আতঙ্কশূন্য হইবেন, ধান্য বহু পরিমাণে জন্মিবে; ফলসমূদয় রসাল ও ধান্যসকল সুগন্ধ হইবে; সকলে সতত সদালাপ করিবে; সমীরণ সুখস্পর্শ হইবে; কোন বস্তুই অপ্রতিকূলদর্শন হইবে না; ভয়ের লেশমাত্র থাকিবে না; তথায় বহুসংখ্যক হৃষ্ট-পুষ্ট ধেনু ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিবে; দধি, দুগ্ধ ও ঘূত প্রভৃতি গব্য এবং সমুদয় পানীয় ও ভোজনীয় দ্রব্যজাত সাতিশয় সুরস ও হিতজনক হইবে; রস, স্পর্শ, গন্ধ ও শব্দসকল মনোহর হইবে, সমুদয় দৃশ্য পদার্থই লোকের নেত্রপথ চরিতার্থকরিবে; দ্বিজাতিগণ স্বধর্ম্ম প্রতিপালন করিবেন এবং সকল লোকই সতত সন্তুপ্ত থাকিবে; দেবপূজা, অতিথিসৎকার, অর্থদান ও যাগ-যজ্ঞ-ব্ৰতানুষ্ঠানে সবিশেষ আদর প্রদর্শন করিবে, মহোৎসাহসম্পন্ন ও স্বধর্ম্মপরায়ণ হইবে, অশুভ বিষয়ে বিদ্বেষ ও শুভবিষয়ে আস্থা প্ৰদৰ্শন করিবে, কদাচ মিথ্যাবাক্য ব্যবহার করিবে না এবং সতত সৎপথেই ধাবমান হইবে।
কীর্ত্তি, লজ্জা, শ্ৰী, তেজ, অনুশংসতা ও সরলতা প্রভৃতি সদগুণের একমাত্র আধার। সামান্য লোকের কথা দূরে থাকুক, দ্বিজাতিগণও তাঁহাকে সম্যক অবগত হইতে সমর্থ নহেন। হে রাজনী! আমি মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের প্রচ্ছন্ন-বাস-নিরূপণ-বিষয়ে এইমাত্র উপদেশ প্রদান করিতে পারি। যদি আমার বাক্যে আস্থা হয়, তবে এই সমুদয় সবিশেষ পৰ্য্যালোচনা করিয়া যাহা শ্রেয়স্কর বিবেচনা হয়, তদবলম্বনে যত্নবান হও।”