[১৮৯৮ খ্রীঃ ১১ মার্চ স্বামীজীর শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা (মিস এম.ই.নোব্ল) কলিকাতার স্টার থিয়েটারে ‘ইংলণ্ডে ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রভাব’ সম্বন্ধে এক বক্তৃতা দেন। স্বামীজী সভাপতি হইয়াছিলেন। তিনি প্রথমেই উঠিয়া ‘সিস্টার’কে সর্বসাধারণের নিকট পরিচয় করিয়া দিবার জন্য নিম্নলিখিত কথাগুলি বলেনঃ]
সম্ভ্রান্ত মহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ,
আমি যখন এশিয়ার পূর্বভাগে ভ্রমণ করিতেছিলাম, একটি বিষয়ে আমার দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হইয়াছিল। আমি দেখিলাম, ঐ-সকল স্থানে ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তা বিশেষভাবে প্রবেশ করিয়াছে। চীন ও জাপানী মন্দিরসমূহের প্রাচীরে কতকগুলি সুপরিচিত সংস্কৃত মন্ত্র লিখিত দেখিয়া আমি যে কিরূপ বিস্ময়াবিষ্ট হইয়াছিলাম, তাহা আপনারা অনায়াসে অনুমান করিতে পারেন। সম্ভবতঃ আপনারা অনেকেই জানিয়া সুখী হইবেন যে, ঐগুলি সবই প্রাচীন বাঙলা অক্ষরে লিখিত। আমাদের বঙ্গীয় পূর্বপুরুষগণের ধর্মপ্রচারকার্যে মহোৎসাহের কীর্তিস্তম্ভস্বরূপ ঐগুলি আজ পর্যন্ত বিরাজমান।
এশিয়ার অন্তর্গত এই-সকল দেশ ছাড়িয়া দিলেও ভারতের আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রভাব এত সুদূরপ্রসারী ও স্পষ্ট যে, এমন কি পাশ্চাত্যদেশেও ঐ-সকল স্থানের আচার-ব্যবহারাদির গভীর মর্মস্থলে প্রবেশ করিয়া আমি সেখানেও উহার প্রভাবের চিহ্ন দেখিতে পাইলাম। ভারতবাসীর আধ্যাত্মিক ভাবসকল ভারতের পূর্বে ও পশ্চিমে—উভয়ত্রই গমন করিয়াছিল। ইহা এখন ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে। সমগ্র জগৎ ভারতের অধ্যাত্মতত্ত্বের নিকট কতদূর ঋণী এবং ভারতের আধ্যাত্মিক শক্তি মানবজাতির অতীত ও বর্তমান জীবনগঠনে কিরূপ শক্তিশালী উপাদান, তাহা এখন সকলেই অবগত আছেন। এ-সব তো অতীতের ঘটনা।
আমি আর একটি অদ্ভুত ব্যাপার দেখিতে পাই। তাহা এই যে, সেই আশ্চর্য অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতি সামাজিক উন্নতি এবং সভ্যতা ও মনুষ্যত্বের বিকাশরূপ অত্যদ্ভুত শক্তির বিকাশ করিয়াছে। শুধু তাই কেন, আমি আরও একটু অগ্রসর হইয়া বলিতে পারি, অ্যাংলো-স্যাক্সনের শক্তির প্রভাব ব্যতীত—আজ আমরা যেমন ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রভাব আলোচনা করিবার জন্য এই সভায় সমবেত হইয়াছি, সেরূপ হইতে পারিতাম না। আর পাশ্চাত্যদেশ হইতে প্রাচ্যে—আমাদের স্বদেশে ফিরিয়া দেখিতে পাই, সেই অ্যাংলো-স্যাক্সন শক্তি সমুদয় দোষসত্ত্বেও তাহার বিশিষ্ট সুনির্দিষ্ট গুণগুলি লইয়া এখানে কাজ করিতেছে। আমার বিশ্বাস, এতদিনে অবশেষে এই উভয় জাতির সম্মিলনের সুমহৎ ফল সিদ্ধ হইয়াছে। ব্রিটিশ জাতির বিস্তার ও উন্নতির ভাব আমাদিগকে বলপূর্বক উন্নতির পথে ধাবিত করিতেছে এবং ইহাও আমাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, পাশ্চাত্য সভ্যতা গ্রীকদিগের নিকট হইতেই প্রাপ্ত; এবং গ্রীক সভ্যতার প্রধান ভাব—প্রকাশ বা বিস্তার। ভারতে আমরা মননশীল বটে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সময়ে সময়ে আমরা এত অধিক মননশীল হই যে, ভাব-প্রকাশের শক্তি আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকে না। ক্রমে এইরূপ হইল যে, পৃথিবীর নিকট আমাদের ভাব ব্যক্ত করিবার শক্তি আর প্রকাশিত হইল না, এবং তাহার ফল কি হইল? ফল হইল এই যে, আমাদের যাহা কিছু ছিল, সবই গোপন করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। ব্যক্তিবিশেষের ভাবগোপনেচ্ছায় উহা আরম্ভ হইল এবং শেষে ভাব গোপন করাটা জাতীয় অভ্যাস হইয়া দাঁড়াইল। এখন আমাদের ভাবপ্রকাশের শক্তির এত অভাব হইয়াছে যে, আমরা মৃত জাতি বলিয়াই বিবেচিত হইয়া থাকি। ভাবপ্রকাশ ব্যতীত আমাদের বাঁচিবার সম্ভাবনা কোথায়? পাশ্চাত্য সভ্যতার মেরুদণ্ড—বিস্তার ও অভিব্যক্তি। ভারতে অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতির কাজগুলির মধ্যে এই যে-কাজের প্রতি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করিলাম, তাহা আমাদের জাতিকে জাগাইয়া আবার নিজের ভাবপ্রকাশে প্রবর্তিত করিবে, এবং এখনই উহা সেই শক্তিশালী জাতি কর্তৃক আয়োজিত ভাব-বিনিময়ের উপযোগী উপায়গুলির সাহায্য পৃথিবীর নিকট নিজ গুপ্ত রত্নসমূহ বাহির করিয়া দিবার জন্য ভারতকে উৎসাহিত করিতেছে। অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতি ভারতের ভাবী উন্নতির পথ খুলিয়া দিয়াছে। আমাদের পূর্বপুরুষগণের ভাবসমূহ এখন যেরূপ ধীরে ধীরে বহু স্থানে তাহার প্রভাব বিস্তার করিতেছে, তাহা বাস্তবিকই বিস্ময়কর। যখন আমাদের পূর্বপুরুষগণ প্রথমে সত্য ও মুক্তির মঙ্গল-বার্তা ঘোষণা করেন, তখন তাঁহাদের কত সুযোগ-সুবিধা ছিল। মহান্ বুদ্ধ কিভাবে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব-রূপ অতি উচ্চ মতবাদ প্রচার করিয়াছিলেন? তখনও এই ভারতে— যে-ভারতকে আমরা প্রাণের সহিত ভালবাসিয়া থাকি—প্রকৃত আনন্দ লাভ করিবার যথেষ্ট সুবিধা ছিল এবং আমরা সহজেই পৃথিবীর একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত আমাদের ভাব প্রচার করিতে পারিতাম। এখন আমরা অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতির মধ্যেও আমাদের ভাব-প্রচার করিতে অগ্রসর হইয়াছি।
এই প্রকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এখন চলিতেছে এবং আমরা দেখিতেছি যে, আমাদের দেশ হইতে প্রেরিত বার্তা তাহারা শুনিতেছে, আর শুধু যে শুনিতেছে তাহা নহে, উহার উত্তরও দিতেছে। ইতোমধ্যেই ইংলণ্ড তাহার কয়েকজন মহামনীষীকে আমাদের কাজে সাহায্যের জন্য প্রেরণ করিয়াছে। সকলেই আমার বন্ধু মিস মূলারের কথা শুনিয়াছেন এবং বোধ হয় অনেকে তাঁহার সহিত পরিচিতও আছেন—তিনি এখন এখানে এই বক্তৃতা-মঞ্চে উপস্থিত আছেন। এই সম্ভ্রান্তবংশীয়া সুশিক্ষিতা মহিলা ভারতের প্রতি অগাধপ্রীতিবশতঃ তাঁহার জীবন ভারতের কল্যাণে নিযুক্ত করিয়াছেন এবং ভারতকে তাঁহার স্বদেশ ও ভারতবাসীকে তাঁহার স্বজন বলিয়া মনে করিয়াছেন। আপনাদের মধ্যে প্রত্যকেই সেই সুপ্রসিদ্ধ উদারস্বভাবা ইংরেজ মহিলার নামের সহিত পরিচিত আছেন—তিনিও ভারতের কল্যাণ ও পুনরুজ্জীবনের জন্য তাঁহার সমগ্র জীবন নিয়োজিত করিয়াছেন। আমি মিসেস বেসাণ্টকে লক্ষ্য করিয়া এ-কথা বলিতেছি। ভদ্রমহোদয়গণ, আজ এই মঞ্চে দুইজন মার্কিন মহিলা রহিয়াছেন—তাঁহারাও তাঁহাদের হৃদয়ে সেই একই উদ্দেশ্য পোষণ করিতেছেন; আর আমি আপনাদিগকে নিশ্চিতভাবে বলিতে পারি যে, তাঁহারাও আমাদের দরিদ্র দেশের সামান্য কল্যাণের জন্য তাঁহাদের জীবন উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত। আমি এই সুযোগে আপনাদের নিকট আমাদের জনৈক শ্রেষ্ঠ স্বদেশবাসীর নাম স্মরণ করাইয়া দিতে চাই—তিনি ইংলণ্ড ও আমেরিকা দেখিয়াছেন, তাঁহার প্রতি আমার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে, তাঁহাকে আমি বিশেষ শ্রদ্ধা ও প্রীতির চক্ষে দেখিয়া থাকি, তিনি আধ্যাত্মিক রাজ্যে অনেকটা অগ্রসর ও মহামনীষী, দৃঢ়ভাবে অথচ নীরবে আমাদের দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করিতেছেন; অন্যত্র বিশেষ কাজ না থাকিলে তিনি আজ এই সভায় নিশ্চয়ই উপস্থিত থাকিতেন—আমি শ্রীযুক্ত মোহিনী মোহন চট্টোপাধ্যায়কে লক্ষ্য করিয়া এ-কথা বলিতেছি। আর এখন ইংলণ্ড আর একটি উপহার-রূপে মিস মার্গারেট নোব্ল্কে প্রেরণ করিয়াছেন—ইঁহার নিকট হইতে আমরা অনেক কিছু আশা করি। আর বেশী কিছু না বলিয়া আমি মিস নোব্ল্কে আপনাদের সহিত পরিচয় করিয়া দিলাম—আপনারা এখনই তাঁহার বক্তৃতা শুনিবেন।
সিস্টার নিবেদিতার মনোজ্ঞ বক্তৃতার পর স্বামীজী আবার উঠিয়া বলিতে লাগিলেনঃ
আমি আর দুই-চারটি কথা বলিতে চাই। আমরা এই মাত্র এই ভাব পাইলাম যে, ভারতবাসী আমরাও কিছু করিতে পারি। আর ভারতবাসীদের মধ্যে বাঙালী আমরা এই কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারি, কিন্তু আমি তাহা করি না। তোমাদের মধ্যে একটা অদম্য উৎসাহ, অদম্য চেষ্টা জাগ্রত করিয়া দেওয়াই আমার জীবনব্রত। তুমি অদ্বৈতবাদী, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী বা দ্বৈতবাদী হও, তাহাতে বড় কিছু আসে যায় না। কিন্তু একটি বিষয়, যাহা আমরা দুর্ভাগ্যক্রমে সর্বদা ভুলিয়া যাই, সেদিকে আমি তোমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করিতে চাই—হে মানব, নিজের উপর বিশ্বাসী হও। এই উপায়েই কেবল আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী হইতে পারি। তুমি অদ্বৈতবাদী হও বা দ্বৈতবাদী হও, তুমি যোগশাস্ত্রে বিশ্বাসী হও বা শঙ্করাচার্যে বিশ্বাসী হও, তুমি ব্যাস বা বিশ্বামিত্র যাঁহারই অনুবর্তী হও না কেন, তাহাতে বড় কিছু আসে যায় না, কিন্তু বিশেষ প্রণিধানের বিষয় এই যে, পূর্বোক্ত ‘আত্মবিশ্বাস’ ব্যাপারে ভারতীয় ভাব সমগ্র পৃথিবীর অন্যান্য জাতির ভাব হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্। এক মুহূর্তের জন্য ভাবিয়া দেখ—অন্যান্য ধর্মে ও অন্যান্য দেশে আত্মার শক্তি সম্পূর্ণরূপে অস্বীকৃত হইয়া থাকে—আত্মাকে তাহারা একরূপ শক্তিহীন দুর্বল নিশ্চেষ্ট জড়বৎ বিবেচনা করিয়া থাকে; আমরা কিন্তু ভারতে আত্মাকে শাশ্বত বলিয়া মনে করি, আর আমাদের ধারণা—উহা চিরকাল পূর্ণ থাকিবে। আমাদিগকে সর্বদা উপনিষদের শিক্ষা মনে রাখিতে হইবে।
তোমাদের জীবনের মহান্ ব্রত স্মরণ কর। ভারতবাসী আমরা, বিশেষতঃ বাঙালীরা বহু পরিমাণে বৈদেশিক ভাবের দ্বারা আক্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি—উহা আমাদের জাতীয় ধর্মের অস্থিমজ্জা পর্যন্ত চর্বণ করিয়া ফেলিতেছে। আমরা আজকাল এত পিছনে পড়িয়া গিয়াছি কেন? আমাদের মধ্যে শতকরা নিরানব্বই জন কেন সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্য ভাব ও উপাদানে গঠিত হইয়া পড়িয়াছে? যদি আমরা জাতীয় গৌরবের উচ্চ শিখরে আরোহণ করিতে চাই, তবে পাশ্চাত্য অনুকরণ দূরে ফেলিয়া দিতে হইবে; যদি আমরা উঠিতে চাই, তবে ইহাও আমাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, পাশ্চাত্যদেশ হইতে আমাদের অনেক কিছু শিখিবার আছে। পাশ্চাত্যদেশ হইতে আমাদিগকে তাহাদের শিল্পবিজ্ঞান—বহিঃপ্রকৃতি-সম্বন্ধীয় বিজ্ঞানসমূহ শিখিতে হইবে, আবার পাশ্চাত্যবাসীদিগকে আমাদের নিকট আসিয়া ধর্ম ও অধ্যাত্মবিদ্যা শিক্ষা ও আয়ত্ত করিতে হইবে। আমাদিগকে—হিন্দুগণকে বিশ্বাস করিতে হইবে যে, আমরাই জগতের আচার্য। আমরা এখানে রাজনীতিক অধিকার ও এইরূপ অন্যান্য অনেক বিষয়ের জন্য চীৎকার করিয়া আসিতেছি। বেশ কথা; কিন্তু অধিকার, সুবিধা—এ-সকল কেবল বন্ধুত্বের ফলেই লাভ করা যায়, আর বন্ধুত্বও কেবল দুইজন সমান সমান ব্যক্তির ভিতর আশা করা যাইতে পারে। এক পক্ষ যদি চিরকালই ভিক্ষা করিতে থাকে, তবে আর উভয়ের মধ্যে কি বন্ধুত্ব হইতে পারে? ও-সব কথা মুখে বলা সহজ, কিন্তু আমি বলিতেছি যে, পরস্পর সাহায্য ব্যতীত আমরা কখনও শক্তিশালী হইতে পারিব না। এইজন্য আমি তোমাদিগকে ভিক্ষুকভাবে নয়, ধর্মাচার্যরূপে ইংলণ্ড ও আমেরিকায় যাইবার জন্য আহ্বান করিতেছি। কার্যক্ষেত্রে আদান-প্রদানের নিয়ম যথাসাধ্য প্রয়োগ করিতে হইবে। যদি আমাদিগকে পাশ্চাত্যের নিকট ইহজীবনে সুখী হইবার উপায় ও প্রণালী শিখিতে হয়, তবে কেন তাহার বিনিময়ে আমরা তাহাদিগকে অনন্তকালে সুখী হইবার উপায় ও প্রণালী না শিখাইব?
সর্বোপরি সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য কাজ করিতে থাক। তোমরা যে নিজদিগকে ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখিয়া খাঁটি হিন্দু বলিয়া পরিচয় দিতে গর্ব অনুভব করিয়া থাক, উহা ছাড়িয়া দাও। মৃত্যু সকলের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছে, আর এই অতি বিস্ময়কর ঐতিহাসিক সত্যটি বিশেষরূপে লক্ষ্য করিও যে, পৃথিবীর সকল জাতিকে ভারতীয় সাহিত্যে নিবদ্ধ সনাতন সত্যসমূহ শিক্ষা করিবার জন্য ভারতের পদতলে ধৈর্যের সহিত বসিতে হইবে। ভারতের বিনাশ নাই, চীনের নাই, জাপানেরও নাই; অতএব আমাদিগকে সর্বদা মনে রাখিতে হইবে, আধ্যাত্মিকতাই আমাদের জাতীয়-জীবনের মেরুদণ্ড এবং ঐ উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য আমাদের এমন একজন পথপ্রদর্শক চাই, যিনি আমাদিগকে সেই পথ দেখাইয়া দিবেন—ঐ-পথের বিষয় এইমাত্র তোমাদিগকে বলিতেছিলাম। যদি তোমাদের মধ্যে এমন কেহ থাকে, যে ইহা বিশ্বাস করে না, যদি আমাদের মধ্যে এমন কোন হিন্দুবালক থাকে, যে বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নয় যে, তাহার ধর্ম শুদ্ধ আধ্যাত্মিকতা, আমি তাহাকে ‘হিন্দু’ বলিব না। আমার মনে পড়িতেছে, কাশ্মীরের কোন পল্লীগ্রামে জনৈক বৃদ্ধা মুসলমান মহিলার সহিত কথাপ্রসঙ্গে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, আপনি কোন্ ধর্মাবলম্বী? তিনি তাঁহার নিজ ভাষায় সতেজে উত্তর দিলেন, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ; তাঁহার দয়ায় আমি মুসলমানী।’ তারপর একজন হিন্দুকেও ঐ প্রশ্ন করাতে সে সাদাসিধা ভাষায় বলিয়াছিল—‘আমি হিন্দু।’
কঠোপনিষদের সেই মহাবাক্যটি মনে পড়িতেছে—‘শ্রদ্ধা’ বা অপূর্ব বিশ্বাস। নচিকেতার জীবনে শ্রদ্ধার একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত দেখিতে পাওয়া যায়। এই ‘শ্রদ্ধা’ বা যথার্থ বিশ্বাস প্রচার করাই আমার জীবনব্রত। আমি তোমাদিগকে আবার বলিতেছি যে, এই বিশ্বাস সমগ্র মানবজাতির জীবনের এবং সকল ধর্মের একটি প্রধান অঙ্গ। প্রথমতঃ নিজের প্রতি বিশ্বাসসম্পন্ন হও। জানিও, একজন ক্ষুদ্র বুদ্বুদ-মাত্র বিবেচিত হইতে পারে এবং অপরে পর্বততুল্য বৃহৎ তরঙ্গ হইতে পারে, কিন্তু উভয়েরই পশ্চাতে অনন্ত সমুদ্র রহিয়াছে। অতএব সকলেরই আশা আছে, সকলেরই জন্য মুক্তির দ্বার উন্মুক্ত, সকলেই শীঘ্র বা বিলম্বে মায়ার বন্ধন হইতে মুক্ত হইবে। ইহাই আমাদের প্রথম কর্তব্য। অনন্ত আশা হইতে অনন্ত আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টার উৎপত্তি হয়। যদি সেই বিশ্বাস আমাদের ভিতরে আবির্ভূত হয়, তবে উহা আমাদের জাতীয় জীবনে ব্যাস ও অর্জুনের যুগ লইয়া আসিবে, যে-যুগে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণকর উচ্চ মতবাদসমূহ প্রচারিত হইয়াছিল। আজকাল আমরা অন্তর্দৃষ্টি ও আধ্যাত্মিক- চিন্তায় অনেক পিছনে পড়িয়া গিয়াছি, কিন্তু এখনও ভারতে যথেষ্ট আধ্যাত্মিকতা আছে, এত অধিক আছে যে, আধ্যাত্মিক মহত্ত্বই ভারতকে জগতের বর্তমান জাতিসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতি করিয়াছে। যদি জাতীয় ঐতিহ্য ও আশার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা যায়, তবে সেই গৌরবময় দিনগুলি আমাদের আবার ফিরিয়া আসিবে, আর উহা তোমাদের উপরেই নির্ভর করিতেছে। বঙ্গীয় যুবকগণ, তোমাদের ধনী ও বড় লোকের মুখ চাহিয়া থাকিও না; দরিদ্রেরাই পৃথিবীতে চিরকাল মহৎ ও বিরাট কার্যসমূহ সাধন করিয়াছে।
হে দরিদ্র বঙ্গবাসিগণ, ওঠ, তোমরা সব করিতে পার, আর তোমাদিগকে সব করিতেই হইবে। যদিও তোমরা দরিদ্র, তথাপি অনেকে তোমাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিবে। দৃঢ়চিত্ত হও; সর্বোপরি পবিত্র ও সম্পূর্ণ অকপট হও; বিশ্বাস কর যে, তোমাদের ভবিষ্যৎ অতি গৌরবময়। বঙ্গীয় যুবকগণ, তোমাদের দ্বারাই ভারতের উদ্ধার সাধিত হইবে। ইহা তোমরা বিশ্বাস কর বা না কর, উহা বিশেষভাবে লক্ষ্য করিও। মনে করিও না—আজ বা কালই উহা হইয়া যাইবে। আমি যেমন আমার দেহ ও আমার অস্তিত্বে বিশ্বাসী, সেইরূপ দৃঢ়ভাবে উহাও বিশ্বাস করিয়া থাকি। সেইজন্য হে বঙ্গীয় যুবকগণ, তোমাদের প্রতি আমার হৃদয় আকৃষ্ট। তোমাদের টাকাকড়ি নাই; তোমাদেরই উপর ইহা নির্ভর করিতেছে; যেহেতু তোমরা দরিদ্র, সেইজন্যই তোমরা কাজ করিবে। যেহেতু তোমাদের কিছুই নাই, সেহেতু তোমরা অকপট হইবে। অকপট বলিয়াই তোমরা সর্বত্যাগের জন্য প্রস্তুত হইবে। এ-কথাই আমি তোমাদিগকে এইমাত্র বলিতেছিলাম। আবার তোমাদিগের নিকট উল্লেখ করিতেছি—ইহাই তোমাদের জীবনব্রত, ইহাই আমার জীবনব্রত। তোমরা যে দার্শনিক মতই অবলম্বন কর না কেন, তাহাতে কিছু আসে যায় না। আমি শুধু এখানে প্রমাণ করিতে চাই, সমগ্র ভারতে ‘মানবজাতির পূর্ণতায় অনন্ত বিশ্বাস-রূপ প্রেমসূত্র’ ওতপ্রোতভাবে বর্তমান, আর আমি স্বয়ং ইহা বিশ্বাস করিয়া থাকি; ঐ বিশ্বাস সমগ্র ভারতে বিস্তৃত হউক।