২৮তম অধ্যায়
অর্জ্জুনযুদ্ধে শত্ৰুঞ্জয়প্রমুখ বহু বীর বধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময়ে শ্বেতবাহন অর্জ্জুন বায়ু যেমন ইতস্ততঃ তুলারাশি বিকীর্ণ করে, তদ্রূপ তিনি আপনার সৈন্যগণকে বিদ্রাবিত করিতে লাগিলেন। তখন কৌরব, ত্রিগৰ্ত্ত, শিবি, শাল্ব, সংশপ্তক ও অন্যান্য নারায়ণীসেনাগণ এবং সত্যসেন, চন্দ্রদেব, মিত্রদেব, শত্ৰুঞ্জয়, সৌতি, চিত্রসেন, মিত্রবৰ্মা, সুশৰ্মা, বসুধর্ম্মা, সুবৰ্মা ও মহাধনুৰ্ধর অস্ত্রবিশারদ পুত্র ও ভ্রাতৃগণে পরিবেষ্টিত ত্রিগর্ত্তাধিপতি অর্জ্জুনের উপর শরধারা বর্ষণ করিয়া জলরাশি যেমন সাগরাভিমুখে গমন করে, তদ্রূপ তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। হে মহারাজ! তাক্ষ্যদর্শনে পন্নগগণ যেমন নিশ্চেষ্ট হয়, তদ্রূপ সেই যোধগণ অর্জ্জুনকে দর্শন করিয়া জড়ীভূত [ম্রিয়মান] হইতে লাগিল। তাহারা ধনঞ্জয়ের শরে নিয়ত নিহন্যমান হইয়াও হুতাশনে পতনোন্মুখ পতঙ্গের ন্যায় তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল না। অনন্তর সত্যসেন তিন, মিত্রদেব ত্রিষষ্টি, চন্দ্রসেন সাত, মিত্ৰবর্ম্মা ত্রিসপ্ততি, সৌতি সাত, শত্ৰুঞ্জয় বিংশতি ও সুশৰ্মা নয়শরে ধনঞ্জয়কে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন এইরূপে সেই বীরগণকর্ত্তৃক বিদ্ধ হইয়া সৌশ্রুতিকে সাত, সত্যসেনকে তিন, শত্রুঞ্জয়কে বিংশতি, চন্দ্রদেবকে আট, মিত্রদেবকে শত, শ্রুতসেনকে তিন, মিত্রবর্ম্মাকে নয় ও সুশর্ম্মাকে আটশরে বিদ্ধ করিয়া শিলানিশিত শরনিকরে শত্ৰুঞ্জয়, সৌতি ও চন্দ্রবর্ম্মাকে যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণপূর্ব্বক পাঁচ পাঁচ বাণে অন্যান্য মহারথগণকে নিবারণ করিলেন। তখন মহাবীর সত্যসেন রোষাবিষ্টচিত্তে কৃষ্ণকে উদ্দেশ করিয়া তোমর নিক্ষেপপূর্ব্বক সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। সেই লৌহদণ্ড সুবর্ণময় তোমর মহাত্মা বাসুদেবের বাহু বিদীর্ণ করিয়া ধরাতলে নিপতিত হইল। সেই আঘাতেই বাসুদেবের হস্ত হইতে প্রতোদ [চাবুক] ও অশ্বরশ্মি স্বলিত হইয়া পড়িল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় হৃষীকেশকে বিকলাঙ্গ দর্শন করিয়া ক্রোধভরে কহিলেন, হে মহাবাহো! তুমি সত্বর সত্যসেনের নিকট রথসঞ্চালন কর, আমি অবিলম্বেই উহাকে সংহার করিব।’ মহাত্মা হৃষীকেশ অর্জ্জুনের বাক্যশ্রবণে পূর্ব্ববৎ প্রতোদ ও রথরশ্মি গ্রহণপূর্ব্বক সত্যসেনের নিকট রথসঞ্চালন করিলেন; মহারথ ধনঞ্জয়ও তীক্ষশরনিকরে সত্যসেনকে নিবারণ করিয়া শাণিতভল্লে তাঁহার কুণ্ডলালঙ্কৃত মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তৎপরে তিনি শাণিত বাণদ্বারা মিত্ৰবর্ম্মাকে ও বৎসদন্তদ্বারা তাঁহার সারথিকে নিপাতিত করিয়া পুনরায় শত শত দ্বারা অসংখ্য সংশপ্তককে ভূতলশায়ী করিতে লাগিলেন এবং পরক্ষণেই সেই রজতপুঙ্খ ক্ষুরপ্রদ্বারা মহাত্মা মিত্রসেনের মস্তকচ্ছেদনপুর্ব্বক সুশৰ্মার জত্রুদেশে মহা আঘাত করিলেন। অনন্তর সংশপ্তকগণ ধনঞ্জয়কে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক ক্রোধভরে দশদিক প্রতিধ্বনিত করিয়া শরনিকরদ্বারা তাঁহাকে নিপীড়িত করিতে লাগিল। তখন ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী মহারথ অর্জ্জুন নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া ইন্দ্রাস্ত্রের আবির্ভাব করিলে সেই অস্ত্র হইতে সজস্র সহস্র শর প্রাদুর্ভূত হইল। রাশি রাশি ধ্বজ, পতাকা, রথ, কাক, তূণীর, যুগ, অক্ষ, চক্র, যোক্ত্র, রশ্মি, কূবর, বরূথ, প্রাস, ঋষ্টি, গদা, পরিঘ, শক্তি, তোমর, পট্টিশ, চক্রযুক্ত শতঘ্নী, ভুজ, উরু, কণ্ঠসূত্র, অঙ্গদ, কেয়ূর, হার, নিষ্ক, বর্ম্ম, ছত্র, ব্যজন ও মুকুটসকল ছিন্ন হইয়া নিপতিত হওয়াতে রণস্থলে মহাশব্দ শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। সুন্দর নেত্রযুক্ত কুণ্ডলালঙ্কৃত পূর্ণচন্দ্রসদৃশ ছিন্নমস্তকসকল অম্বরতলস্থিত তারকাজালের ন্যায় লক্ষিত হইল। নিহত বীরগণের মাল্যাম্বরধারী চন্দনদিগ্ধ [চন্দনমাখা] দেহসকল ধরাতলে নিপতিত রহিল। তৎকালে সংগ্রামস্থল অতি ঘোরতর হইয়া উঠিল। মহাবলপরাক্রান্ত ক্ষত্রিয় রাজপুত্রগণ এবং অসংখ্য হস্তী ও অশ্ব নিপতিত হওয়াতে রণভূমি পৰ্বতাকীর্ণ ভূভাগের ন্যায় অতিশয় দুর্গম হইল। ঐ সময় শত্রুঘাতন অর্জ্জুনের রথচক্রের গতিরোধ হইয়া গেল। বোধ হইতে লাগিল যেন, মহাবীর ধনঞ্জয়ের রথচক্র তাঁহাকে সেই শোণিতজাত কর্ম্মসমাকীর্ণ সংগ্রামস্থলে বিচরণপূর্ব্বক অসংখ্য শত্রু, হস্তী ও অশ্বসমুদয় সংহার করিতে দেখিয়া অবসন্ন হইয়াছে। তখন মহাবেগগামী অশ্বগণ প্রাণপণে সেই কর্দ্দমমগ্ন চক্র আকর্ষণ করিতে লাগিল। হে মহারাজ! পাণ্ডুতনয় অর্জ্জুন এইরূপে সৈন্যগণকে বিনাশ করিলে তাহারা প্রায় সকলেই রণবিমুখ হইল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় সেই বহুসংখ্যক সংশপ্তকগণকে পরাজিত – করিয়া ধূমবিরহিত প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন।”