২৮৮. শাস্ত্রজ্ঞানে সর্ব্বার্থসিদ্ধি—গালব-নারদসংবাদ

২৮৮তম অধ্যায়

শাস্ত্রজ্ঞানে সর্ব্বার্থসিদ্ধি—গালব-নারদসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যাহারা শাস্ত্রের যথার্থ তত্ত্বনিরূপণে একান্ত অসমর্থ, সৰ্ব্বদা সংশয়ারূঢ় ও শমদমাদির অনুষ্ঠানবিহীন, তাহাদিগের কর্ত্তব্য কি, কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! গুরুপূজা, জ্ঞানবৃদ্ধদিগের উপাসনা ও সতত শাস্ত্র শ্রবণ করাই ঐ সমুদয় ব্যক্তির অবশ্য কর্ত্তব্য। আমি এই উপলক্ষে গালব-নারদসংবাদ নামে এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা গালব শ্ৰেয়োলাভার্থী হইয়া মোহপরিশূন্য, জ্ঞানতৃপ্ত, জিতেন্দ্রিয়, দেবর্ষি নারদকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘দেবর্ষে! পুরুষ যে সমুদয় গুণে বিভূষিত হইলে লোকসমাজে সমাদৃত হয়, আপনি সেই সকল গুণে সমলঙ্কৃত ও বিদ্বান্। আমি লোকতত্ত্ববিষয়ে নিতান্ত অনভিজ্ঞ ও একান্ত মূঢ়; অতএব আমার সন্দেহভঞ্জন করা আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য। শাস্ত্রে যে সকল কার্য্য কর্ত্তব্য বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে, তৎসমুদয়ের মধ্যে কোন্ কোন্ কাৰ্য্য আমাদের শ্রেয়স্কর, তাহা আমি কিছুই স্থির করিতে সমর্থ নহি; অতএব আপনি তদ্বিষয় সবিশেষ কীৰ্ত্তন করুন। সমুদয় আশ্রমেরই আচার ব্যবহার ভিন্ন ভিন্ন। সকল আশ্রমী স্ব স্ব আশ্রমানুযায়ী মতানুসারে বিবিধ প্রকার কর্ত্তব্য নিরূপণ করিয়া থাকেন। এইরূপে মানবগণকে স্বীয় স্বীয় শাস্ত্রে একান্ত পরিতুষ্ট হইয়া বিবিধ মার্গে গমন করিতে অবলোকন করিয়া আমি কি কৰ্ত্তব্য, তাহা কিছুই অবধারণ করিতে সমর্থ হইতেছি না। শাস্ত্র যদি একরূপ হইত, তাহা হইলে কর্ত্তব্য বিষয়ে আর কোন সংশয় থাকিত না। উহা নানাপ্রকার হওয়াতে কর্ত্তব্য নিরূপণ করা আমার পক্ষে নিতান্ত দুরূহ হইয়া উঠিয়াছে। কর্ত্তব্য অবধারণবিষয়ে আমার নানাপ্রকার আশঙ্কা উপস্থিত হওয়াতে আমি আপনার নিকট সমুপস্থিত হইয়াছি; অতএব আপনি আমার সংশয় অপনোদন করুন।

বর্ণাশ্রমধর্ম্মের বিস্তৃত উপদেশ

‘নারদ কহিলেন, বৎস! চারি আশ্রম যেমন পৃথক্‌ পৃথক্‌ নির্দ্দিষ্ট রহিয়াছে, তদ্রূপ ঐ চারি আশ্রমের ধর্ম্মও যথাক্রমে পৃথরূপে নিরূপিত আছে। তুমি ঐ সকল আশ্ৰমধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া আচার্য্যসন্নিধানে উহার তত্ত্বানুসন্ধান করিলেই অনায়াসে ঐ সমুদয়ের বিশুদ্ধভাব অবগত হইতে পারিবে। যাঁহারা সামান্যভাবে ঐ সকল আশ্ৰমধৰ্ম্ম অবলোকন করে, ধর্ম্মনিরূপণবিষয়ে কখনই তাঁহাদিগের সন্দেহ দূর হয় না। আর যাঁহারা সরলভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আশ্রমধর্ম্মসমূহের যথার্থ তত্ত্ব পর্য্যালোচনা করেন, তাঁহারাই মুক্তিকে সমুদয় আশ্রমধৰ্ম্মের যথার্থ ফল বলিয়া অবগত হইতে সমর্থ হয়েন।

‘মিত্রের প্রতি অনুগ্রহ, অমিত্রের নিগ্রহ, ত্রিবর্গ-সংগ্রহ, পাপ কৰ্ম্ম হইতে নিবৃত্তি, সতত পুণ্যসঞ্চয়, সাধুদিগের সহিত সদ্ব্যবহার, সৰ্ব্বভূতে দয়াপ্রকাশ, সরল ব্যবহার, মধুর বাক্যপ্রয়োগ, দেবতাগণ, পিতৃগণ ও অতিথির অর্চ্চনা, ভৃত্যগণের প্রতি নিরহঙ্কার ব্যবহার, সত্যবাক্য প্রয়োগ, সত্যজ্ঞান অবলম্বন, অহঙ্কারপরিত্যাগ, সাবধানতা, সন্তোষ, ঈশ্বরোপাসনা, ধৰ্ম্মানুসারে বেদ ও বেদান্ত অধ্যয়ন এবং জ্ঞানোপার্জ্জনের নিমিত্ত শাস্ত্ৰজিজ্ঞাসা শাস্ত্রানভিজ্ঞ ব্যক্তিদিগের নিতান্ত শ্রেয়ঃ। যাঁহারা শ্রেয়োলাভের অভিলাষ করেন, শব্দ, রূপ, রস ও গন্ধাদি সেবনে অনুরাগ, রাত্রিকালে বিচরণ, দিবানিদ্রা, আলস্য, শঠতা ও অহঙ্কার পরিত্যাগ করা তাঁহাদের অবশ্য কর্ত্তব্য। তাঁহারা যোগে নিতান্ত আসক্ত বা এককালে অনাসক্ত হইবেন না। অন্যের নিন্দার দ্বারা আপনার উন্নতি করিবার চেষ্টা করা তাঁহাদের কদাপি বিধেয় নহে। আপনার গুণদ্বারাই নির্গুণদিগকে পরাজিত করা তাঁহাদের অবশ্য কর্ত্তব্য। এরূপ অনেক আত্মাভিমানী নির্গুণ ব্যক্তি বিদ্যমান আছে যে, তাহারা গুণবান্‌ ব্যক্তিদিগের তুল্য হইতে মানস করিয়া তাঁহাদের দোষারোপ করে। তাহারা মহাজনগণকর্ত্তৃক শিক্ষিত হইলেও একান্ত দর্পিত হইয়া আপনাদিগকে যথার্থ গুণবান্ ব্যক্তি অপেক্ষা সমধিক গুণশালী বলিয়া বোধ করিয়া থাকে। গুণবান্ বিদ্বান্ ব্যক্তিরা স্বমুখে স্বীয় গুণকীৰ্ত্তন বা নিন্দাবাদে একান্ত পরাঙ্মুখ বলিয়া জনসমাজে ভূয়সী কীৰ্ত্তি লাভ করিয়া থাকেন। পুষ্পসমুদয় যেমন আত্মশ্লাঘা না করিয়া সুগন্ধদ্বারা দশ দিক্‌ সুবাসিত করে, সূর্য্য, যেমন স্বমুখে আত্মগুণ কীৰ্ত্তন না করিয়া স্বীয় কিরণজাল প্রভাবে অম্বরতলে দেদীপ্যমান হয়েন, তদ্রূপ, মহদ্‌ব্যক্তি আত্মশ্লাঘা না করিয়া স্বীয় যশঃপ্রভাবে ভূমণ্ডলমধ্যে শোভা পাইয়া থাকেন। মূর্খেরা কেবল আত্মপ্রশংসানিবন্ধন সৰ্ব্বত্র অকীৰ্ত্তি লাভ করে।

‘কৃতবিদ্য ব্যক্তিরা প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করিলেও লোকসমাজে তাঁহাদের খ্যাতি প্রকাশিত হয়। মূঢ়েরা উচ্চৈঃস্বরে বাক্য প্রয়োগ করিলেও অসারতানিবন্ধন উহা ব্যর্থ হইয়া যায়, আর বিদ্বান্ ব্যক্তিরা অতি মৃদুস্বরে বাক্যোচ্চারণ করিলেও সারনিবন্ধন উহা সমধিক শোভমান্ হইয়া থাকে। সূর্য্য যেমন সূৰ্য্যকান্ত মণিসংযোগে আপনার তেজ প্রদর্শন করেন, তদ্রূপ মূঢ়ব্যক্তিরা কুবাক্যপ্রয়োগ দ্বারা আপনাদের নীচাশয়তা প্রদর্শন করিয়া থাকে। এই নিমিত্তই শ্রেয়োলাভার্থী ব্যক্তিরা বিধিজ্ঞানলাভার্থ সম্পূর্ণ যত্নবান হয়েন। আমার মতে সকলের পক্ষে জ্ঞানলাভই সৰ্ব্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট। জিজ্ঞাসা না করিলে বা অন্যায় প্রশ্ন করিলে জ্ঞানবান্ ব্যক্তিরও জড়ের ন্যায় নিস্তব্ধ হইয়া থাকা অবশ্য কর্ত্তব্য। যাহারা শ্ৰেয়োলাভের বাসনা করে, স্বধৰ্ম্ম-নিরত বদান্য ব্যক্তিদিগের মধ্যে অবস্থান করিতে বাসনা করাই তাহাদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। যে স্থলে বর্ণসঙ্কর বিদ্যমান থাকে, সে স্থলে কখনও বাস করা তাহাদিগের কোনরূপেই বিধেয় নহে। ইহলোকে যে যেরূপ ব্যক্তিকে আশ্রয় করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করে, তাহাকে তদনুরূপ পুণ্যপাপে লিপ্ত হইতে হয়। জল ও অগ্নির ন্যায় পুণ্য ও পাপের স্পর্শে সুখ ও দুঃখলাভ হইয়া থাকে। বিঘসাশী ব্যক্তিরা দ্রব্যের আস্বাদ-বিচার না করিয়া কেবল উদরপূরণার্থ ভোজন করিয়া থাকেন, সুতরাং তাঁহাদিগকে ভোগাদিবিষয়ে লিপ্ত হইতে হয় না। আর যাহারা দ্রব্যের রস পরীক্ষা করিয়া আহার করে, তাহাদিগকে কপাশে বদ্ধ হইতে হয়।

‘যে স্থলে শিষ্য জ্ঞানলাভার্থ গুরুর নিকট গমন কারয়া অবজ্ঞাপূৰ্ব্বক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে, গুরু তাহাকে ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করেন, সে স্থান পরিত্যাগ করা জ্ঞানবান্ ব্যক্তির অবশ্য কর্ত্তব্য। যে স্থানে শাস্ত্রানুসারে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা হইয়া থাকে, সে স্থান পরিত্যাগ করা বিধেয় নহে। যে জনপদের লোকেরা প্রতিষ্ঠালাভার্থ যথার্থ বিদ্বান্ ব্যক্তিদিগের উপর মিথ্যা দোষারোপ করে, সে সমাজে বাস করা পণ্ডিত ব্যক্তির নিতান্ত অনুচিত। লোভপরতন্ত্র মূঢ়ব্যক্তিকর্ত্তৃক যে দেশের ধর্ম্মসেতু বিলোড়িত হয়, প্রজ্বলিত বস্ত্রান্তের [একাংশ প্রজ্বলিত বস্ত্রের] ন্যায় সেই দেশ পরিত্যাগ করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। মাৎস্যবিহীন মহাত্মারা যে দেশে বাস করিয়া নিঃশঙ্কচিত্তে নিরন্তর ধর্ম্মানুষ্ঠান করেন, সেই দেশে পুণ্যশীল সাধুদিগের নিকট বাস করা অবশ্য কর্ত্তব্য।

‘অর্থোপার্জ্জনের নিমিত্ত ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিলে পাপ জন্মে; অতএব যে দেশের মনুষ্যেরা অর্থোপার্জ্জনের নিমিত্ত ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করে; সসৰ্প গৃহের ন্যায় অবিলম্বে সেই দেশ পরিত্যাগ করা আবশ্যক। মনুষ্য পূৰ্ব্ববাসনাপ্রভাবে যে কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া দুঃখভোগ করে, শ্ৰেয়োলাভার্থী ব্যক্তির সেই কাৰ্য্য একেবারে পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য। যে দেশের রাজা ও রাজপুরুষগণ কুটুম্বদিগের ভোজন না হইতে অগ্রে ভোজন করে, জিতচিত্ত ব্যক্তি সেই রাজ্যে কদাচ বাস করিবেন না। যে রাজ্যে যাজন ও অধ্যাপনে নিযুক্ত ধর্ম্মপরায়ণ শ্রোত্রিয়গণ সর্ব্বাগ্রে ভোজন করেন, সেই রাজ্যে বাস করাই সাধুদিগের কর্ত্তব্য। যে দেশে স্বাহা, স্বধা ও বষট্‌কার শব্দ নিরন্তর উচ্চারিত হয়, সাধুগণ অবিচারিতচিত্তে সেই দেশে বাস করিবেন। যে রাজ্যের ব্রাহ্মণগণ আচারভ্রষ্ট ও অপবিত্র, বিষমিশ্রিত আমিষের ন্যায় সেই রাজ্য পরিত্যাগ করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। যে দেশের মানবগণ অযাচিত হইয়া প্রীতমনে দান করিয়া থাকেন, জিতচিত্ত মহাত্মারা সেই দেশে সুস্থচিত্তে বাস করিবেন। যে দেশে অবিনীত ব্যক্তিদিগের দণ্ড ও সাধু ব্যক্তিদিগের সৎকারলাভ হয়, সেই দেশে পুণ্যবান মহাত্মাদিগের সহিত সমবেত হইয়া বাস করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। যে দেশের নরপতি বিষয়লোভ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক জিতেন্দ্রিয়দিগের প্রতি ক্রুদ্ধ, সাধুদিগের অত্যাচারনিরত, লোভপরতন্ত্র, অবিনীত ব্যক্তিদিগের কঠিন দণ্ড করিয়া ধৰ্ম্মনানুসারে রাজ্য পালন করেন, অবিচারিতচিত্তে সেই রাজ্যে বাস করা উচিত। ঐরূপ সৎস্বভাবসম্পন্ন ভূপালগণ নিরন্তর অধিকারস্থ প্রজাগণের হিতানুষ্ঠান করিয়া থাকেন।

‘এই আমি তোমার নিকট শ্রেয়েলাভের উপায় কীৰ্ত্তন করিলাম। যে ব্যক্তি স্বধৰ্ম্মনিরত ও সমাহিত হইয়া পূর্ব্বোক্ত নিয়মানুসারে জীবিকা নির্ব্বাহ করে, তাহার কতদূর অভ্যুদয়লাভ হয়, তাহা বর্ণনা করা যায় না। ফলতঃ ধৰ্ম্মবলেই পরমার্থ মোক্ষপদার্থ লাভ হইয়া থাকে।”