২৮৭তম অধ্যায়
যোগজ্ঞানে সুখদুঃখের অতীত অবস্থাপ্রাপ্তি
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! প্রাণীগণ সর্ব্বদাই দুঃখ ও মৃত্যু হইতে ভীত হইয়া থাকে; অতএব আমরা যেরূপে ঐ উভয় হইতে পরিত্রাণ পাইতে পারি, আপনি তাহার উপায় কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি এই উপলক্ষে তপোধনাগ্রগণ্য নারদ ও সমঙ্গের পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা দেবর্ষি নারদ মহাত্মা সমঙ্গকে কহিয়াছিলেন, ‘মহর্ষে! তোমাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিতে দেখিয়া আমার বোধ হইতেছে যেন, তুমি বাহুযুগলদ্বারা ভবনদী সন্তরণপূৰ্ব্বক পার হইতে উদ্যত হইয়াছ। আমি তোমাকে নিরন্তর সন্তুষ্টচিত্ত ও শোকবিহীন দেখিতেছি। তোমাতে অণুমাত্রও উদ্বেগ লক্ষিত হয় না। তুমি বালকের ন্যায় নিত্যতৃপ্ত ও রাগদ্বেশূন্য হইয়া অবস্থান করিতেছ। ইহার কারণ কি?
“সমঙ্গ কহিলেন, ‘ভগবন্! ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান এই ত্রিকালের সমুদয় বস্তুই অলীক এবং কার্য্যের আরম্ভ ও কৰ্ম্মফল দুঃখের কারণ। আমি এই সমুদয় সবিশেষ পরিজ্ঞাত হইয়া উদ্যোগ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক হৃষ্টচিত্তে কালযাপন করিতেছি। প্রাক্তন অদৃষ্টই জীবনধারণের কারণ। লৌকিক উদ্যোগ কখনই উহার কারণ নহে। দেখ, কি মূর্খ, কি বিদ্বান, কি ধনবান, কি নিৰ্দ্ধন, কি জড়, কি অন্ধ, কি বলবান, কি দুৰ্ব্বল, সকলেই আমাদিগের ন্যায় জন্মান্তরীণ কাৰ্য্যদ্বারা জীবিত রহিয়াছে। দেবগণ প্রাচীন অদৃষ্টদ্বারাই রোগবিহীন হইয়া জীবনধারণ করিতেছেন। দেখ, কেহ সহস্র মুদ্রার অধিপতি, কেহ বা শতমুদ্রার অধিপতি এবং কেহ বা শোকসন্তপ্ত হইয়া জীবিত রহিয়াছে। যাহা হউক, আমি যখন অজ্ঞানমূল শোক পরিত্যাগ করিয়াছি, তখন আমার ধর্ম্ম ও যজ্ঞাদিকাৰ্য্যে প্রয়োজন কি? সুখদুঃখ যে অনিত্য, ইহা আমার বিলক্ষণ বোধগম্য হইয়াছে, এই নিমিত্তই আমি উহাতে অভিভূত এই নাই। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা কহেন যে, প্রজ্ঞাই ইন্দ্রিয়ের প্রসন্নতার মূল কারণ। মূঢ়েন্দ্রিয় ব্যক্তিরা কখনই প্রজ্ঞা লাভ করিতে সমর্থ হয় না। এই নিমিত্ত তাহাদিগের ইন্দ্রিয়সমুদয় সৰ্ব্বদাই মুগ্ধ ও শোকসন্তপ্ত হইয়া থাকে। মূঢ়েরা মোহবশতঃই আপনাদিগকে ধনী ও মানী বোধ করিয়া গর্ব্ব করে। তাহারা কোন লোকেই মঙ্গললাভ করিতে সমর্থ হয় না।
“সুখদুঃখ কখনই চিরস্থায়ী নহে; অতএব সুখী হইয়া গৰ্ব্ব ও দুঃখী হইয়া খেদ করা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। দেহাভিমানশূন্য মাদৃশ ব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত পরিবৰ্ত্তমান, মূৰ্ত্তিমান, সন্তাপস্বরূপ এই সংসার স্বীকার করেন না। তাঁহারা ইষ্টবস্তুর ভোগাভিলাষ ও উপস্থিত দুঃখের চিন্তা পরিত্যাগ করিয়া থাকেন। যোগারূঢ় মহাত্মারা কখনই অন্যের মুখদর্শনে সুখাভিলাষী, অনুপস্থিত বিষয় লাভের চিন্তা করিয়া আনন্দিত, বিপুলার্থলাভে পরিতুষ্ট বা অর্থনাশে বিষণ্ন হয়েন না। বান্ধব, ঐশ্বৰ্য্য, কুল, শাস্ত্রজ্ঞান, মন্ত্র, বা বীৰ্য্যদ্বারা পারলৌকিক দুঃখের শান্তি হয় না। একমাত্র শীল দ্বারাই পরলোকে শান্তি লাভ করিতে পারা যায়। যোগবিহীন ব্যক্তিদিগের মোক্ষবিষয়িণী বুদ্ধি নাই। যোগ ব্যতীত কেহই সুখলাভে সমর্থ হয় না। দুঃখত্যাগ ও ধৈৰ্য্যই সুখোদয়ের কারণ। প্রিয়বস্তুদ্বারা হর্ষ ও হর্ষদ্বারা গৰ্ব্ব জন্মে এবং গৰ্ব্ব জন্মিলেই লোককে নরকে গমন করিতে হয়। আমি এই নিমিত্তই প্রিয়বস্তু, হর্ষ ও দর্প পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সুখদুঃখে নির্লিপ্ত হইয়া সাক্ষীর ন্যায় প্রাণীগণের শোক, ভয় ও গর্ব্ব অবলোকন এবং রাগদ্বেষশূন্য ও শোকবিহীন হইয়া অর্থ, কাম, বিষয়তৃষ্ণা ও মোহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক এই পৃথিবীতে বিচরণ করিতেছি। আমার ইহলোকে ও পরলোকে মৃত্যু, অধর্ম্ম ও লোভাদি হইতে কিছুমাত্র ভয় নাই। আমি অতি কঠোর যোগানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক এইরূপ জ্ঞানলাভ করিয়াছি; এই নিমিত্ত শোক আমাকে ব্যথিত করিতে সমর্থ হয় না।”