২৮৬তম অধ্যায়
যোগবিজ্ঞানানুসারে অধিকারিনির্ণয়
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! ইহলোকে মানবগণ যে অধ্যাত্মশাস্ত্রের আলোচনা করেন, তাহা কিরূপ ও কোথা হইতে উৎপন্ন হইল, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তুমি যে শাস্ত্ৰ সৰ্ব্বজ্ঞানসাধন ও সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছ, আমি তোমার নিকট সেই শাস্ত্র কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, সলিল ও জ্যোতিঃ এই পাঁচ মহাভূতই সমুদয় প্রাণীর উৎপত্তি ও নাশের কারণ। যেমন উর্ম্মিমালা সাগরে উদ্ভূত ও সাগরেই বিলীন হইয়া থাকে, তদ্রূপ প্রাণীগণের শরীর পঞ্চভূতের সমষ্টি হইতেই উৎপন্ন হয় এবং পঞ্চভূতেই বিলীন হইয়া থাকে। কূৰ্ম্মের অঙ্গসমুদয় যেমন একবার তাহার শরীর হইতে বহির্গত হইয়া পুনরায় তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হয়, তদ্রূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূতসমুদয় মহাভূত হইতে উদ্ভূত হইয়া পুনরায় মহাভূতেই লয় প্রাপ্ত হইয়া থাকে। আকাশ হইতে শব্দ, পৃথিবী হইতে কঠিনাংশ, বায়ু হইতে প্রাণ, জল হইতে রস ও তেজ হইতে রূপ সমুদ্ভূত হয়। স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় প্রাণীই শব্দাদিগুণসম্পন্ন। উহারা বার বার ভূতকৰ্ত্তা পরব্রহ্ম হইতে সমুৎপন্ন ও প্রলয়কালে তাহাতে বিলীন হইয়া থাকে। ভূতভাবন পরমেশ্বর পাঁচমহাভূতদ্বারাই শরীরের সমুদয় অংশ কল্পিত করিয়া দিয়াছেন। শব্দ, শ্রোত্র ও ছিদ্রসমুদয় আকাশের গুণ; রস, মেদ ও জিহ্বা জলের গুণ; রূপ, চক্ষু ও জঠরানল তেজের গুণ; দ্রেয় বস্তু, ঘ্রাণ। ও শরীর ভূমির গুণ এবং প্রাণ, স্পর্শ ও চেষ্টা বায়ুর গুণ। এই আমি তোমার নিকট পাঞ্চভৌতিক গুণসমুদয় কীৰ্ত্তন করিলাম।
“জগদীশ্বর ঐ সমুদয় শব্দাদিগুণের সৃষ্টি করিয়া সত্ত্ব, রজ ও তমোগুণ এবং কাল, ধর্ম্ম, বুদ্ধি ও মনের সহিত উহাদের সম্বন্ধ নিরূপিত করিয়া দিয়াছেন। বুদ্ধি মনুষ্যদেহের পদতল হইতে মস্তক পৰ্য্যন্ত সমুদয় স্থানের অভ্যন্তরে অবস্থান করিতেছে। মনুষ্যশরীরে পাঁচ ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি ও জীব অবস্থান করিতেছে, সত্ত্ব, রজ ও তমোগুণসমুদয় ইন্দ্রিয়কে আশ্রয় করিয়া থাকে; অতএব ইন্দ্রিয়সমুদয় কোন্ গুণের বশীভূত হইয়াছে, তাহা সৰ্ব্বতোভাবে বিচার করা কর্ত্তব্য। মানবগণ চক্ষুদ্বারা দ্রব্য অবলোকন, মনদ্বারা তাহাতে সংশয় ও বুদ্ধিদ্বারা তাহার নিশ্চয় করে। আত্মা কেবল সাক্ষিস্বরূপ হইয়া অবস্থান করিয়া থাকেন। কাল, কৰ্ম্ম এবং সত্ত্ব, রজ ও তমোগুণ ইহারা বুদ্ধিকে ও ইন্দ্রিয়সমুদয়কে বিষয়ের প্রতি প্রেরণ করে। বুদ্ধি না থাকিলে পাঁচ ইন্দ্রিয় ও মন নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর হইত। বুদ্ধিই চক্ষুদ্বারা দর্শন, কর্ণদ্বারা শ্রবণ, নাসিকাদ্বারা গন্ধঘ্রাণ, জিহ্বাদ্বারা আস্বাদন ও ত্বক্দ্বারা স্পর্শ করিয়া থাকে। যখন বুদ্ধি কোন বস্তু প্রার্থনা করে, তখন তাহাকে মন বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। পাঁচ ইন্দ্রিয় ও মন বুদ্ধির আশ্রয়। অতএব ইন্দ্রিয়সমুদয় ও মন দূষিত হইলে বুদ্ধিও দৃষিত হইয়া উঠে। বুদ্ধি সাক্ষিস্বরূপ জীবে অধিষ্ঠিত হইয়া সাত্ত্বিকাদি ভাবত্রয় অবলম্বনপূৰ্ব্বক কখন প্রীতিযুক্ত, কখন শোকসম্পন্ন ও কখন সুখদুঃখ এই উভয়বিরহিত হইয়া থাকে। সরিৎপতি সাগর যেমন বেলা অতিক্রম না করিয়া অবস্থান করে, তদ্রূপ বুদ্ধি সত্ত্বাদি ভাবত্রয় অতিক্রম না করিয়া তাহাতে অবস্থান করিয়া থাকে। সত্ত্বগুণ সমুদিত হইলে হর্ষ, প্রীতি, আনন্দ, সুখ ও বিশুদ্ধচিত্ততা; রজোগুণ উপস্থিত হইলে খেদ, শোক, সন্তাপ, মূর্চ্ছা ও অক্ষমা এবং তমোগুণ উপস্থিত হইলে অজ্ঞান, রাগ, মোহ, প্রমাদ, স্তব্ধতা, ভয়, অসমৃদ্ধি, দৈন্য, প্রমোহ, স্বপ্ন ও তন্দ্রাদি সমুৎপন্ন হয়। মনুষ্যের মনে যে প্রীতিযুক্ত ভাবের উদয় হয়, তাহাকে সাত্ত্বিক, যে দুঃখযুক্ত প্রীতিকর ভাবের উদয় হয়, তাহাকে রাজসিক এবং যে মোহমুক্ত অপ্রতর্ক অবিজ্ঞেয় ভাবের উদয় হয়, তাহাকে তামসিক ভাব বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। এই আমি তোমার নিকট সমুদয় বুদ্ধির গতি কীৰ্ত্তন করিলাম। যিনি এই সমুদয় অবগত হইতে সমর্থ হয়েন, তিনিই যথার্থ বুদ্ধিমান্ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন।
“দেহ ও জীবাত্মা এই উভয়ের মধ্যে এইমাত্র বিভেদ যে, দেহ হইতে বিষয়সমুদয়ের সৃষ্টি হয়; জীবাত্মা হইতে তাহা হয় না। দেহ ও আত্মা স্বভাবতঃ পৃথক্; কিন্তু মৎস্য যেমন সলিল হইতে স্বতন্ত্র হইয়াও নিয়ত জলমধ্যে অবস্থান করে, তদ্রূপ পরমাত্মা দেহ হইতে পৃথক হইয়াও সৰ্ব্বদা দেহমধ্যেই অবস্থান করিয়া থাকে। বিষয়সকল আত্মাকে অবগত হইতে সমর্থ হয় না; কিন্তু আত্মা সৰ্ব্বতোভাবে বিষয়সমুদয় অবগত হইয়া থাকে। লোকে আত্মাকে বিষয়সমুদয়ের সৃষ্টিকর্ত্তা বলিয়া অনুমান করে; কিন্তু বস্তুতঃ তাহা নহে; আত্মা বিষয়সমুদয়ের পরিদর্শক মাত্র। চেতনাযুক্ত দেহ ভিন্ন বুদ্ধির অন্য কোন আশ্রয়স্থান নাই। কারণভূত সত্ত্বাদিগুণ হইতেই দেহের সৃষ্টি হইয়া থাকে। ঐ সমুদয় কারণভূত গুণের স্বরূপ অবগত হওয়া কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। আত্মা ও দেহে এইরূপ নিত্যসিদ্ধ সম্বন্ধ নিরূপিত আছে যে, দেহ বিষয়সমুদয়ের সৃষ্টি এবং আত্মা ঐ সমুদয়ের তত্ত্বাবধারণ করিয়া থাকে। অচেতন ইন্দ্রিয়সমুদয় বুদ্ধিসহকারে প্রদীপের ন্যায় পদার্থসমুদয়কে প্রকাশ করিয়া থাকে। যিনি ইন্দ্রিয়সমুদয়ের এইরূপ তত্ত্ব অবগত হইয়া কিছুতেই শোক বা হর্ষ প্রকাশ না করেন, তিনি যথার্থ নিরহঙ্কারী।
ঊর্ণনাভ হইতে যেমন সুত্রের সৃষ্টি হয়, তদ্রূপ দেহ হইতে বিষয়সমুদয়ের সৃষ্টি হইয়া থাকে। কেহ কেহ কহিয়া থাকেন যে, দেহনাশ হইলে গুণের ধ্বংস হয় না; উহা লিঙ্গশরীরমধ্যে অতিসূক্ষ্মরূপে অবস্থান করে বলিয়া উহার কিছুমাত্র উপলব্ধি হয় না। আর কেহ কেহ কহেন যে, শরীরনাশ হইলে গুণসমুদয়েরও নাশ হইয়া যায়। এই উভয় মতের মধ্যে শেষোক্ত মত দূষণীয়। কারণ, গুণের একবার নাশ হইলে পুনরায় উহার উৎপত্তির সম্ভাবনা নাই। লোকে এইরূপে সমুদয় সংশয় অপনোদন করিয়া শোক পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পরমসুখে অবস্থান করিবে। অজ্ঞানান্ধ মূঢ় ব্যক্তিরা এই সুবিস্তীর্ণ মোহজলপরিপূর্ণ অগাধ সংসারনদীতে নিপতিত হইয়া যেরূপ কষ্ট ভোগ করে, বিদ্বান ব্যক্তিরা কখনই সেরূপ কষ্ট ভোগ করেন না। বিদ্বানেরা জ্ঞানাপ্লব অবলম্বনপূর্ব্বক অনায়াসেই ঐ নদী উত্তীর্ণ হইতে পারেন। মূঢ়ব্যক্তিরা যাহাতে নিতান্ত ভীত হয়, বিদ্বান ব্যক্তিদিগের তাহাতে ভয়ের লেশমাত্রও থাকে না। মূঢ় ব্যক্তির ন্যায় বিদ্বাদিগের ভিন্ন ভিন্ন গতিলাভ হয় না; তাঁহারা নির্দ্দিষ্ট নিয়মে সকলেই তুল্যগতি লাভ করিয়া থাকেন। তাঁহারা আপনাদিগের পূর্ব্বানুষ্ঠিত কৰ্ম্মসমুদয়ে দোষারোপ করেন এবং কর্মীরা যাহা কৰ্ত্তব্য ও যাহা অকর্ত্তব্য বলিয়া স্থির করে, সেই উভয়ই অপ্রিয় বোধ করিয়া তাহার অনুষ্ঠানে বিরত হয়েন।”