২৮৫তম অধ্যায়
প্ৰহস্তাদি সেনাপতি নিধনে রাবণের বিলাপ
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “তখন প্ৰহস্ত-রক্ষস সহসা বিভীষণসমীপে আগমন করিয়া গভীর গর্জ্জনপূর্ব্বক তাহাকে গদাঘাত করিল। মহাবল পরাক্রান্ত বিভীষণ সেই দারুণ গদাঘাতেও কিঞ্চিম্মাত্র ব্যথিত বা কম্পিত না হইয়া হিমাচলের ন্যায় স্থিরপদে দণ্ডায়মান রহিলেন এবং সুবিপুল শত-ঘণ্টাযুক্ত শক্তি মন্ত্রপূত করিয়া প্ৰহস্তের মস্তকে নিক্ষেপ করিলেন। শক্তি অশনিবেগে নিপতিত হইয়া মস্তকচ্ছেদন করাতে সে বাতরুগ্ন বৃক্ষের ন্যায় দৃষ্ট হইতে লাগিল। রজনীচর প্রহস্ত রণে নিহত হইলে ধূম্রাক্ষ-রাক্ষস মহাবেগে কপিগণের প্রতি ধাবমান হইল। প্রধান ।
প্রধান বানরগণ মেঘসদৃশ ভীমদৰ্শন ধূম্রাক্ষের সেনাগণকে আগমন করিতে দেখিয়া রণ পরিত্যাগপূর্ব্বক ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিল ।
“পবননন্দন মহাবীর হনুমান সহসা বানরগণকে পলায়ন করিতে দেখিয়া রণক্ষেত্রে গমন করিলেন। বানরগণ মহাবল পরাক্রান্ত মারুততনয়কে সমরক্ষেত্রে সমাগত নিরীক্ষণ করিয়া সত্বর চতুর্দ্দিক হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিতে লাগিল। তখন রাম ও রাবণের সৈন্যগণ পরস্পরের প্রতি ধাবমান হওয়াতে লোমহর্ষণ তুমুল কোলাহল সমুখিত হইল। উভয়পক্ষে ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল; হতাহত সেনাগণের রুধিরধারায় রণক্ষেত্ৰ পঙ্কিল হইয়া উঠিল। নিশাচর। ধূম্রাক্ষ ঐ সময় শরনিকর-নিক্ষেপদ্বারা কপিগণকে তাড়িত করিতে লাগিল। পবননন্দন তদর্শনে তৎক্ষণাৎ রাক্ষসের সম্মুখীন হইলেন। পূর্ব্বে ইন্দ্র ও প্ৰহাদের যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, এক্ষণে হনুমান ও ধূম্রাক্ষের তদুপ তুমুল সংগ্রাম হইতে লাগিল। রাক্ষস গদা ও পরিঘদ্বারা হনুমানকে প্রহার করিলে হনুমানও শাখাপল্লবসমবেত বৃক্ষদ্বারা তাহাকে প্রহার করিতে লাগিলেন। পরিশেষে পবননন্দন সাতিশয় ক্ৰোধাপরবশ হইয়া এককালে ধূম্রাক্ষ এবং তাহার অশ্বগণ, রথ ও সারথিকে বিনষ্ট করিয়া ফেলিলেন।
“বানরগণ ধূম্রাক্ষকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া অশঙ্কিতচিত্তে রাক্ষসসেনাগণকে বিনাশ করিতে লাগিল। হতাবিশিষ্ট রাক্ষসগণ বানরদিগের প্রহারে সাতিশয় ব্যথিত ও ভগ্নসঙ্কল্প হইয়া ভয়ে লঙ্কামধ্যে পলায়নপূর্ব্বক রাবণসমীপে সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিল। রাক্ষসাধিপতি রাবণ মহাধনুৰ্দ্ধর প্রহস্ত ও ধূম্রাক্ষ সংগ্রামে বানরহস্তে প্ৰাণ পরিত্যাগ করিয়াছে শ্রবণ করিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক সিংহাসন হইতে সমুখিত হইয়া কহিলেন, “এইবার কুম্ভকর্ণের কাৰ্য্যকাল সমুপস্থিত হইয়াছে।” এই কথা বলিয়া মহানিস্বন বিবিধ বাদ্য বাদনপূর্ব্বক অতিশয় নিদ্ৰালু কুম্ভকর্ণের নিদ্ৰাভঙ্গ করিলেন।
যুদ্ধে প্রেরণার্থ কুম্ভকর্ণের নিদ্ৰাভঙ্গ “এইরূপে বহুপ্রযত্নে মহাবলপরাক্রান্ত কুম্ভকৰ্ণ জাগরিত হইয়া অব্যগ্রচিত্তে সমুপবিষ্ট হইলে পর মহাবীর দশানন র্ত্তাহাকে কহিলেন, “হে কুম্ভকৰ্ণ৷ তুমি ধন্য, তোমার নিদ্ৰাও আশ্চৰ্য্য, তুমি এরূপ অভিভূত হইয়াছিলে যে, এই দারুণ ভয় উপস্থিত হইয়াছে, উহার অণুমাত্ৰও তোমার জ্ঞানগোচর হয় নাই। হে ভ্ৰাতঃ! আমি রামের ভাৰ্য্যা জানকীকে হরণ করিয়া আনিয়াছি, সে তাহাকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত বানর গণ-সমভিব্যাহারে সেতুবন্ধনপূর্ব্বক পারাবার পার হইয়া আমাদিগকে অপমান করিয়া রাক্ষসগণকে সংহার করিয়াছে। ঐ দুরাত্মা প্ৰহস্ত প্রভৃতি আমাদিগের স্বজনগণকে নিহত করিয়াছে। হে অরতিনিপাতন! তোমা ব্যতীত আর কেহই ঐ দুৰ্দ্ধর্ষ শত্রুর নিহন্তা নাই; অতএব তুমি মহতী সেনা-সমভিব্যাহারে সমর-সাগরে অবতীর্ণ ও বদ্ধপরিকর হইয়া শত্ৰুগণকে সংহার করা। বীজবেগ ও প্ৰমাখীনামে গমন করিবে।”
“রাক্ষসাধিপতি দশানন কুম্ভকৰ্ণকে এইরূপ আদেশ করিয়া বজবেগ ও প্ৰমাখীকে কর্ত্তব্যবিষয়ে নিযুক্ত করিলেন; তাহারা ‘যে আজ্ঞা মহারাজ!” বলিয়া কুম্ভকৰ্ণকে অগ্রসর করিয়া সত্বরে পুরমধ্য হইতে বহির্গত হইল।”