২৮৫তম অধ্যায়
দক্ষের শিব-সহস্রনাম স্তব
অনন্তর যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “পিতামহ! প্রজাপতি দক্ষ যে যে নাম উচ্চারণপূৰ্ব্বক দেবাদিদেব মহাদেবকে স্তব করিয়াছিলেন, আমি সেই সকল নাম শ্রবণ করিতে একান্ত উৎসুক হইয়াছি; অতএব আপনি উহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি অদ্ভুতকৰ্ম্মা মহাদেবের গুপ্ত ও প্রকাশিত নামসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। প্রজাপতি দক্ষ যজ্ঞাবসানে মহাদেবকে স্তব করিয়া কহিলেন, “হে দেবদেবেশ! তুমি অসুরগণের দর্প চূর্ণ করিয়াছ। তোমা হইতেই বলদৈত্য নিহত হইয়াছে। দেবতা ও দানবগণ প্রতিনিয়ত তোমাকে পূজা করিয়া থাকেন। তুমি সহস্রাক্ষ, বিরূপাক্ষ, ত্র্যম্বক ও যজ্ঞেশ্বর। তোমার হস্ত, পদ, মস্তক, চক্ষু, কর্ণ ও মুখ সর্ব্বত্র বিরাজিত হইতেছে। তুমি সৰ্ব্বত্রই বিদ্যমান রহিয়াছ। তুমি শঙ্কুকর্ণ, মহাকর্ণ, কুম্ভকর্ণ, গজেন্দ্রকর্ণ, গোকর্ণ ও পাণিকৰ্ণ। তুমি অর্ণবমধ্যে অবস্থান করিয়া থাক। তুমি শতোদর, শতাবৰ্ত্ত, শতজিহ্ব; তোমাকে নমস্কার। গায়ত্রী ও সূর্য্যের উপাসকগণ তোমাকেই গায়ত্রী ও সূৰ্য্যরূপে অর্চ্চনা করেন। মনীষিগণ তোমাকেই ব্রহ্মা, ইন্দ্র ও আকাশবৎ নির্লিপ্ত বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকেন। তুমি সমুদ্র ও আকাশের ন্যায় মহামূৰ্ত্তি। গোকুল যেমন গোষ্ঠমধ্যে অবস্থান করে, তদ্রূপ দেবগণ তোমারই মূৰ্ত্তিমধ্যে অবস্থান করিতেছেন। আমি তোমার শরীরমধ্যে চন্দ্র, সূৰ্য্য, অগ্নি, বরুণ, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও বৃহস্পতিকে অবলোকন করিতেছি। তুমি কাৰ্য্য, কারণ, ক্রিয়া ও করণ। তুমিই স্থূল-সূক্ষ্মর উৎপত্তি ও নাশের হেতু। তুমি ভব, সৰ্ব্ব, রুদ্র, বরদ, পশুপতি, অন্ধকঘাতী [আন্ধকনামক অসুরের নিহন্তা], ত্রিজট, ত্ৰিশীর্ষ, ত্রিশূলপাণি, ত্র্যম্বক, ত্রিনেত্র ও ত্রিপুরহন্তা। তুমি চণ্ড, কুণ্ড, অণ্ড, অণ্ডধারী, দণ্ডী, সমকৰ্ণ, দণ্ডিমুণ্ড, ঊৰ্দ্ধদংষ্ট্র, ঊর্দ্ধকেশ, বিশুদ্ধ, বিশ্বময়, বিলোহিত, ধূম্র ও নীলগ্রীব; তোমাকে নমস্কার। তোমার তুল্য আর কেহই নাই। তোমার রূপ নানা প্রকার। তুমি পরম কল্যাণময়। তুমি সূর্য্যমণ্ডল, তুমি সূৰ্য্যমণ্ডলমধ্যবর্তী নারায়ণ এবং তুমিই সূর্য্যধ্বজ ও সূৰ্য্যপতাকাসম্পন্ন। তুমি প্রমথনাথ, বৃষস্কন্ধ, ধনুর্দ্ধর, শত্রুমর্দ্দন ও দণ্ড। তুমি পর্ণচীর [পাতার বস্ত্র] পরিধান করিয়া থাক। তুমি হিরণ্যগর্ভ, হিরণ্যকবচ, হিরণ্যচূড় ও হিরণ্যপতি; তোমাকে নমস্কার। তুমি স্তুত, স্তুত্য ও স্তূয়মান। তুমি শৰ্ব্ব, সভক্ষ ও সৰ্ব্বভূতের অন্তরাত্মা। তুমি হোত্র, মন্ত্র ও শুক্লবর্ণ ধ্বজপতাকাযুক্ত, তুমি আকাশস্বরূপ, জীবগণের নাভিম্বরূপ ও কিলকিলাস্বরূপ। তুমি আবরকদিগের আবরক, কুশনাস, কৃশাঙ্গ, কৃশ ও সংহৃষ্ট। তুমি শয়ান, উত্থিত, অবস্থিত, ধাবমান, মুণ্ড, জটিল এবং নৃত্য ও গালবাদ্যনিরত। তোমার সর্ব্বাগ্রে পূজালাভ করিবার অভিলাষ নাই। তুমি সৰ্ব্বদা গীতবাদ্যে আসক্ত রহিয়াছ। তুমি জ্যেষ্ঠ, বলনিসূদন, কালনাথ এবং কল্প, প্রলয় ও উপপ্রলয়স্বরূপ। তুমি দুন্দুভিনিস্বনের ভীষণ শব্দের ন্যায় হাস্য করিয়া থাক। তুমি ভীমব্রতধারী, উগ্র, দশবাহুযুক্ত ও কপালপাণি। তুমি চিতাভস্মৃপ্রিয় ভীষণ ও ভীষ্ম। তুমি বিকৃতবক্ত্র, খড়গজিহ্বা, দংষ্ট্রী, যজ্ঞীয় পক্ক ও অপক্ক মাংসলুব্ধ [যজ্ঞীয় দ্রব্যে সন্তুষ্ট] এবং তুম্বীযুক্ত-বীণাপ্রিয়। তুমি সৃষ্টিকর্ত্তা, ধৰ্ম্মের
হিতকারী
, বৃষশ্রেষ্ঠ ও ধৰ্ম্মস্বরূপ। তুমি বায়ুর ন্যায় শীঘ্রগামী, নিয়ন্তা, প্রাণীগণের পাককর্ত্তা, সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বরস্বরূপ ও বরদ। তুমি বিচিত্র গন্ধ, মাল্য ও বস্ত্রে সমলঙ্কৃত। তুমি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে উৎকৃষ্ট বরপ্রদান কর। তুমি রাগবান, রাগবিহীন, ধ্যানকর্ত্তা ও অক্ষমালাধারী। তুমি মিলিত ও পৃথক্। তুমি ছায়া, আতপ, উম্মা ও গন্ধস্বরূপ। তুমি অঘোর ও ঘোররূপ এবং অতিশয় ঘোরতর। তুমি শিব, শান্ত ও শান্ততম। তুমি একচরণ, বহুনেত্র, একমস্তক, ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রবস্তুতে লুব্ধ [অল্পে তুষ্ট] ও সংবিভাগপ্রিয়। তুমি বিশ্বকৰ্ম্মা, শিখণ্ড, শমগুণান্বিত, অরাতিকুলভীষণ, ঘণ্টাধারী এবং ঘন্টানাদ ও অনাহতধ্বনিস্বরূপ। তুমি শত সহস্র ঘণ্টাধারী, ঘণ্টামালাপ্রিয় ও ঘণ্টার ন্যায় শব্দায়মান প্রাণবায়ুস্বরূপ। তুমি হুহুঙ্কারস্বরূপ, হুহুঙ্কারপ্রিয়, দেবশ্রেষ্ঠ, শমদমাদিগুণসম্পন্ন ও গিরিবৃক্ষনিবাসী। তুমি শৃগালের ন্যায় হৃদয়াদির মাংসপ্রিয়, পাপমোচনের কারণ এবং যজ্ঞ, যজমান, হুত ও প্রহুতস্বরূপ। তুমি ঋত্বিক্, জিতেন্দ্রিয়, সত্ত্ব ও রজোগুণসম্পন্ন এবং তট, নদী ও সমুদ্রস্বরূপ। তুমি অন্নপ্রদ, অন্নপতি ও অন্নভোক্তা। তুমি সহস্ৰশীর্ষ, সহস্রচরণ, সহস্রশূলধারী, বালানুচরগুপ্ত ও বালক্রীড়নক। তুমি বৃদ্ধ, লুব্ধ, ক্ষুব্ধ ও লোভন। তুমি তরঙ্গাঙ্কিতকেশ, মুঞ্জকেশ, ষট্কর্ম্মপরিতুষ্ট ও ত্ৰিকৰ্ম্মনিরত। তুমিই সমুদয় বর্ণাশ্রমবাসীর কাৰ্য্য ভিন্ন ভিন্নরূপে নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিয়াছ। তুমি শব্দিত, শব্দ ও কোলাহলস্বরূপ। তুমি শ্বেত, পিঙ্গল, কৃষ্ণ ও রক্তবর্ণ নয়নসম্পন্ন। তুমি জিতশ্বাস, কৃশ এবং আয়ুধ ও বিদারণস্বরূপ। তুমি ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়া থাক। তুমি সাংখ্য, সাংখ্যযুক্ত ও সাংখ্যযোগ প্রকাশকৰ্ত্তা। তুমি চতুস্পদনিকেত ও চতুস্পদনিরত। তোমার অঙ্গে কৃষ্ণাজিন উত্তরীয়রূপে ও ভুজঙ্গম যজ্ঞোপবীতরূপে শোভা পাইতেছে। তুমি ঈশান, বজ্রের ন্যায় কঠিন দেহসম্পন্ন, পিঙ্গল কেশযুক্ত, ত্র্যম্বক, অম্বিকাপতি এবং ব্যক্ত ও অব্যক্তস্বরূপ। তুমি কাম, কামদ ও কামঘ্ন। তুমি তৃপ্ত ও অতৃপ্তের বিচারকর্ত্তা। তুমি সৰ্ব্ব, সৰ্ব্বদ, সৰ্ব্বঘ্ন ও সন্ধ্যারাগস্বরূপ। তুমি মহাবল, মহাবাহু, মহাসত্ত্ব, মহাদ্যুতি ও মহামেঘসমূহের সদৃশ। তুমি স্থূল, জীর্ণাঙ্গ, জটিল ও বল্কলাজিনধারী, তুমি সূৰ্য্য ও অনলের ন্যায় প্রদীপ্ত জটাধারী, সহস্রসূৰ্য্যসদৃশ, নিত্য তপানুষ্ঠাননিরত ও উন্মাদন। আবৰ্ত্তসঙ্কুল গঙ্গাসলিলে তোমার জটাজুট আর্দ্র হইয়াছে! তুমি বারংবার চন্দ্র, যূগ ও মেঘসমুদয়ের পরিবর্ত্তন করিতেছ। তুমি অন্ন, অন্নভোক্তা, অন্নদাতা, অন্নপালক ও অন্নস্রষ্টা। তুমি পাককৰ্ত্তা, পক্কভুক্ এবং পবন ও অনলস্বরূপ। তুমি জরায়ুজ, অণ্ডজ, স্বেদজ ও উদ্ভিজ্জ। তুমি সৰ্ব্বদেবের ঈশ্বর এবং সমুদয় চরাচরের সৃষ্টি ও সংহারকর্ত্তা। ব্রহ্মবিদ পণ্ডিতেরা তোমাকে ব্রহ্মবিদগ্রগণ্য, মনের উৎপত্তিস্থান এবং আকাশ, বায়ু, জ্যোতি, ঋক্বেদ, সামবেদ ও ওঙ্কারস্বরূপ বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। ব্রহ্মজ্ঞ সামবেদী মহাত্মারা সামগানসময়ে ‘হায়ি হায়ি হুবা হোয়ি’ ইত্যাদি স্তোত্ৰদ্বারা নিরন্তর তোমার স্তব করিয়া থাকেন। তুমি ঋক্, যজুঃ ও আহুতিস্বরূপ। তুমি বেদ, উপনিষৎ ও শ্রুতিতে গীত হইয়া থাক। তুমি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র ও অধম জাতি সমুদয়স্বরূপ। তুমি মেঘ, বিদ্যুৎ, মেঘনির্ঘোষ এবং সংবৎসর, ঋতু, মাস, পক্ষ, যুগ, নিমেষ, ক্ষণ, নক্ষত্র, গ্রহ ও কলা বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাক। তুমি বৃক্ষসমুদয়ের মূল, গিরিসমুদয়ের শিখর, মৃগগণমধ্যে ব্র্যাঘ্র, পক্ষিগণমধ্যে গরুড়, সর্পগুণমধ্যে বাসুকি, সমুদ্রমধ্যে ক্ষীরোদ, যন্ত্রমধ্যে ধনু, অস্ত্রমধ্যে বজ্র এবং ব্ৰতমধ্যে সত্যস্বরূপ। তুমি দ্বেষ, ইচ্ছা, রোষ, মোহ, ক্ষমা, অক্ষমা, চেষ্টা, ধৈৰ্য্য, কাম, ক্রোধ, লোভ, জয় ও পরাজয়স্বরূপ। তুমি গদা, শর, শরাসন, খট্টাঙ্গ ও ঝর্ঝরধারী। তুমি ছেদ, ভেদ ও প্রহারকর্ত্তা। তুমি অহিংসাদি দশবিধ লক্ষণযুক্ত ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কামস্বরূপ। তুমি গঙ্গা, সমুদ্র, নদী, পল্বল, সরোবর, লতা, বল্লী, তৃণ, ওষধি, মৃগ, পক্ষী ও পশুস্বরূপ। তোমা হইতেই পৃথিব্যাদি ও অন্যান্য কার্য্যসমুদয় সদ্ভূত হইয়া থাকে। তুমি যথাকালে ফল-পুষ্প প্রদান করিয়া থাক। তুমি বেদের আদি ও অন্ত এবং গায়ত্রী ও ওঙ্কারস্বরূপ। তুমি হরিৎ, লোহিত, নীল, কৃষ্ণ, রক্ত, অরুণ, অশ্রু, কপিল, কপোত ও মেচকাদিবৰ্ণস্বরূপ। তুমি বর্ণবিহীন, তুমি উত্তম বর্ণ এবং তুমিই বৰ্ণকৰ্ত্তা। তোমার উপমা নাই। তোমার নাম উৎকৃষ্ট বর্ণ এবং তুমি উৎকৃষ্ট বর্ণে অতিশয় ভক্তিমান। তুমি যম, ইন্দ্র, বরদ, কুবের, অনল, গ্রহণ, রাহু, সূৰ্য্য, অগ্নি, হোত্র, হোতা ও হবনীয় দ্রব্যস্বরূপ। তুমি সামবেদের ত্রিসুপর্ণ ও যজুৰ্ব্বেদের রুদ্রাধ্যায়স্বরূপ। তুমি পবিত্রদিগের পবিত্র ও মঙ্গলের মঙ্গল রূপ, তুমি অচেতন পদার্থকে সচেতন কর। তুমি জীবাত্মা, দেহ, প্রাণ এবং সত্ত্ব, রজ ও তমোগুণস্বরূপ। তুমি আয়ুঃ ও হর্ষ এবং প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান, উন্মেষ, নিমেষ, ক্ষুধা ও জৃম্ভাস্বরূপ। তোমার নেত্র লোহিতবর্ণ, আস্যদেশ ও উদর বিস্তীর্ণ, লোমসমুদয় সূচির ন্যায়, শ্মশ্রু হরিৎ বর্ণ। তুমি ঊর্দ্ধকেশ ও অত্যন্ত চঞ্চল। তুমি গীতবাদ্যে নিতান্ত অনুরক্ত ও উহার সবিশেষ তত্ত্বজ্ঞ। তুমি জলচর মৎস্য, জালস্থিত মৎস্য, সম্পূর্ণ, কেলিপ্রিয় ও কলহপ্রিয়। তুমি কাল, অকাল, অতিকাল ও দুষ্কালস্বরূপ। তুমি মৃত্যুক্ষুর, ক্ষৌরকর্ম্মপারগ, মিত্র ও অমিত্রহন্তা। তুমি মেঘমালী, মহাদংষ্ট্র এবং সংবৰ্ত্তক ও বলাহক মেঘস্বরূপ। তুমি প্রকাশবান্, অপ্রকাশ, অন্তর্য্যামী, ঘণ্টাধারী ও রুদ্র। তুমি স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় পদার্থের সহিত মিলিত হইয়া ক্রীড়া করিয়া থাক। তুমি অগ্নি, স্বাহা, পরমহংস ও ত্ৰিদণ্ডধারী। তুমি চারি যুগ, চারি বেদ ও চারি অগ্নিস্বরূপ। তুমি চারি আশ্রমবাসীদিগের উপদেষ্টা। তোমা হইতে চারি বর্ণের সৃষ্টি হইয়াছে। তুমি অক্ষপ্রিয় ও ধূর্ত্ত ভূতগণের ঈশ্বর, রক্তমাল্যাম্বরধারী গিরিশ ও কষায়প্রিয়। তুমি প্রচণ্ড, শিল্পী, শিল্পীদিগের অগ্রগণ্য ও সমুদয় শিল্পকর্ম্মের সৃষ্টিকর্ত্তা। তুমিই ভগের নেত্র ও সূৰ্য্যের দন্ত উৎপাটন করিয়াছ। তুমি স্বাহা, স্বধা, বষট্কার ও নমস্কারস্বরূপ। তুমি গৃঢ়ব্রতধারী, গৃঢ়তপস্বী এবং প্রণব ও আকাশস্বরূপ। তুমি সমুদয়ের আদিকর্ত্তা। তুমিই সমুদয় একত্র স্থাপন ও সমুদয়ের সংহার করিয়া থাক। তুমি সকলেরই আশ্রয়স্থান; তোমার আশ্রয় কেহই নাই। তুমি ব্রহ্মা, তপস্যা, সত্য, ব্রহ্মচর্য্য ও সরলতাস্বরূপ। তুমি জীবের আত্মা এবং তোমা হইতে আকাশাদি পদার্থসমুদয়ের সৃষ্টি হইয়াছে। তুমি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমানের আদি-কারণ। তুমি ভুঃ ভুবঃ স্বঃ শাশ্বত, জিতেন্দ্রিয় ও মহেশ্বর। তুমি দীক্ষিত, অদীক্ষিত, ক্ষমাশীল, দুর্দান্ত ও দুর্দান্তদিগের শাসনকর্ত্তা। তুমি মাস, কল্প, সংবৰ্ত্ত ও সৃষ্টির আদিকারণ। তুমি কাম, রেতঃ, সূক্ষ্ম, স্থূল ও কর্ণিকারমালাপ্রিয়। তুমি নন্দিমুখ, ভীমমুখ, সুমুখ, দুর্ম্মুখ, চতুর্ম্মুখ ও নির্ম্মুখ। তুমি নারায়ণ, নির্লিপ্ত, অনন্ত ও বিরাট। তোমা হইতে অধর্ম্ম নিরাকৃত হইয়া থাকে। তুমি মহাপার্শ্ব, প্রচণ্ডমূৰ্ত্তিধারী ও ভূতগণের অধিপতি। কৃষ্ণাবতারসময়ে গোধনরক্ষাকালে গোনাদ পরিত্যাগ এবং গোবর্দ্ধন ধারণপূৰ্ব্বক গোকুল রক্ষা করিয়াছিলে। মহাবৃষ তোমার বাহন। তুমি ত্রিলোকের রক্ষাকর্ত্তা, গোবিন্দ ও ইন্দ্রিয়সমুদয়ের পরিচালক। ইন্দ্রিয়াদিদ্বারা তোমাকে লাভ করা যায় না। তুমি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, অচল, ত্রিলোকধারণের স্তম্ভ, নিষ্কম্প ও কম্পনস্বরূপ। তুমি দুর্নিবার, দুঃসহ ও দুরতিক্রম্য। তুমি দুর্দ্ধর্ষ ও দুষ্পকম্প। কেহই তোমাকে আয়ত্ত করিতে পারে না। তুমি জয়, দুর্জ্জয়, শীঘ্রগামী, মনোব্যথানাশক এবং চন্দ্র, যম, শীত, উষ্ণ, ক্ষুধা ও জরাস্বরূপ। তুমি আধি, ব্যাধি ও ব্যাধিনাশক। তুমি মৃগরূপধারী যজ্ঞের ব্যাধস্বরূপ। তোমা হইতেই ব্যাধিসমুদয়ের গমনাগমন হইয়া থাকে। শিখণ্ডী, পুণ্ডরীকাক্ষ, পুণ্ডরীকবনবাসী। তুমি দণ্ডধারী, এ্যম্বক, উগ্ৰদণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ডের বিনাশকর্ত্তা। তুমি জগন্নাথ, সুরশ্রেষ্ঠ ও মরুৎপতি। তুমি বিষাগ্রগণ্য কালকূট পান করিয়াছ এবং তুমিই সোমরস, ক্ষীর, অমৃত, মধু ও আজ্য পান করিয়া থাক। তুমি মৃত্যু হইতে রক্ষা ও ব্রহ্মানন্দ অনুভব কর। তুমি হিরণ্যরেতাঃ; তুমি স্ত্রী, পুরুষ ও নপুংসক; তুমি বালক, যুবা ও গলিতদন্ত বৃদ্ধ; তুমি নাগেন্দ্র, ইন্দ্র, বিশ্বস্রষ্টাদিগ শ্রেষ্ঠ; তুমি বিশ্বরূপ, বিশ্বমুখ ও বিশ্ববাহু; চন্দ্রসূৰ্য্য তোমার চক্ষুদ্বয়, ব্রহ্মা তোমার বুদ্ধি, সরস্বতী তোমার বাক্য, অনল ও অনিল তোমার বল, দিবারাত্রি তোমার চক্ষের নিমেষ ও উন্মেষ। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও প্রাচীন মহর্ষিগণ তোমার মাহাত্ম সম্যক অবগত হইতে সমর্থ নহেন। তোমার সূক্ষ্মমূৰ্ত্তিসমুদয় আমাদিগের দৃষ্টির বিষয়ীভূত নহে। অতঃপর পিতা যেমন ঔরসজাত পুত্রকে রক্ষা করেন, সেইরূপ তুমি আমাকে নিরন্তর রক্ষা কর। তোমাকে বারংবার নমস্কার।
দক্ষের কবচপাঠরূপ শিবস্তুতি—ক্ষমাপ্রার্থনা
‘তুমি ভক্তের প্রতি সাতিশয় কৃপা প্রদান করিয়া থাক। আমি তোমার একান্ত ভক্ত; সুতরাং আমার প্রতি অনুকম্পা করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। যিনি নিতান্ত দুর্লভ হইয়া বহুসংখ্যক লোককে আবরণপূৰ্ব্বক সমুদ্রপারে অবস্থান করিতেছেন, তিনি আমাকে সতত রক্ষা করুন। যোগিগণ সত্ত্বগুণাবলম্বী, নিদ্রাশূন্য, জিতশ্বাস ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া যাঁহাকে জ্যোতিঃস্বরূপে নিরীক্ষণ করেন, সেই যোগাত্মাকে নমস্কার। যিনি জটাজুটমণ্ডিত, দণ্ডধারী, সম্বোদর এবং যিনি সতত কমণ্ডলুরূপ তূণীর ধারণ করিতেছেন, সেই ব্রহ্মাত্মাকে নমস্কার। যাঁহার কেশপাশে জলধর, অঙ্গসন্ধিমধ্যে নদীসমুদয় এবং জঠরে চারি সমুদ্র বিরাজিত রহিয়াছে, সেই সলিলাত্মাকে নমস্কার। যিনি যুগান্তকাল উপস্থিত হইলে জীবগণকে বিনাশ করিয়া সলিলমধ্যে শয়ন করিয়া থাকেন, আমি সেই সলিলশায়ীর শরণাপন্ন হইলাম। যিনি রাহুমূৰ্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া রজনীযোগে কুমুদিনীনাথকে এবং দিবাভাগে দিবাকরকে গ্রাস করিয়া থাকেন, তিনি আমাকে রক্ষা করুন। ব্রহ্মাদি দেব ও পিতৃগণ তোমা হইতে উৎপন্ন হইয়া প্রফুল্লমনে স্বধা, স্বাহা প্রভৃতি মন্ত্রোচ্চারণ সহকারে প্রদত্ত যজ্ঞভাগসমুদয় গ্রহণ করিয়া থাকেন, আমি তাঁহাদিগকে নমস্কার করি। যে সমস্ত অঙ্গুষ্ঠমাত্র পুরুষ সকল দেহীর দেহে অবস্থান করিতেছেন, সেই সকল জীবরূপী রুদ্র প্রতিনিয়ত আমার রক্ষা ও তৃপ্তিসাধন করুন। যাঁহারা দেহমধ্যে অবস্থানপূর্ব্বক স্বয়ং রোদন না করিয়া দেহীদিগকে রোদন করাইয়া থাকেন, সেই সকল অহঙ্কাররূপী রুদ্রকে আমি প্রতিনিয়ত নমস্কার করি। যাঁহারা নদী, সমুদ্র, পৰ্ব্বত, গিরিগুহা, বৃক্ষমূল, গোষ্ঠ, নিবিড় অরণ্য, চতুষ্পদ, রথ্যা, চত্বর, নদীতট, হস্ত্যশ্বরথশালা, জীর্ণোদ্যান, পঞ্চভূত, দিক, বিদিক্, চন্দ্র, সূর্য্য, চন্দ্ৰসূর্য্যের রশ্মিজাল, রসাতল ও রসাতলের অতীতস্থানে অবস্থান করিতেছেন এবং যাঁহাদের সংখ্যা, প্রমাণ ও রূপ নাই, সেই রুদ্রগণকে সহস্র সহস্র নমস্কার।
‘হে রুদ্র! তুমি সৰ্ব্বভূতস্রষ্টা, সৰ্ব্বভূতের পতি ও সকলের অন্তরাত্মা। এই নিমিত্ত আমি তোমাকে নিমন্ত্রণ করি নাই। ভূরিদক্ষিণ বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক তোমারই অৰ্চ্চনা করিতে হয়। তুমি সকলের কর্ত্তা; এই নিমিত্তই আমি তোমাকে নিমন্ত্রণ করি নাই। অথবা আমি তোমার দুরবগাহ [দুষ্প্রবেশ্য—দুর্ব্বোধ্য] মায়াপ্রভাবে একান্ত বিমোহিত হইয়াছিলাম; এই নিমিত্তই তোমাকে নিমন্ত্রণ করিতে বিস্মৃত হইয়াছি। এক্ষণে তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও। আমি রজোগুণাবলম্বী; এই নিমিত্তই তোমাকে অবগত হইতে সমর্থ হই নাই। এক্ষণে আমি হৃদয়, মন ও বুদ্ধি তোমাতেই সমর্পণ করিয়াছি।’ প্রজাপতি দক্ষ মহাদেবকে এইরূপে স্তব করিয়া তৃষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন।
দক্ষের প্রতি শিববর—পাশুপতমত উপদেশ
“তখন ভগবান রুদ্র দক্ষের প্রতি সাতিশয় প্রীত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘ব্রহ্মন্! আমি ত্বৎকৃত স্তুতিবাদশ্রবণে যারপরনাই সন্তোষ লাভ করিয়াছি। এক্ষণে আর স্তব করিবার আবশ্যকতা নাই। আমি কহিতেছি, তুমি আমার প্রসাদে সহস্র অশ্বমেধ ও শত বাজপেয়যজ্ঞের ফল এবং সকল লোকের আধিপত্য লাভ করিয়া পরিশেষে আমার সমীপে অবস্থান করিতে সমর্থ হইবে। আমি যে পূৰ্ব্ব পূৰ্ব্ব কল্পে তোমার যজ্ঞের বিঘ্রানুষ্ঠান করিয়াছি, তাহা তুমি বারংবার প্রত্যক্ষ করিয়াছ। অতএব এই কল্পে আমাকর্ত্তৃক তোমার যজ্ঞের বিঘ্ন জন্মিয়াছে বলিয়া তুমি কিছুমাত্র দুঃখিত হইও না। আমি পুনরায় তোমাকে আর একটি বর প্রদান করিতেছি, তুমি প্রসন্নমনে তাহা শ্রবণ কর। আমি যড়ঙ্গ বেদ, সাংখ্য ও যোগশাস্ত্র হইতে যুক্তি অনুসারে পাশুপতধৰ্ম্ম উৎপাদন করিয়াছি। ঐ ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করা সুরাসুরগণেরও দুঃসাধ্য। উহার প্রভাবে সৰ্ব্বকালে শুভফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। সকল আশ্রমীরই উহাতে অধিকার আছে। অতি অল্পকালমধ্যেই উহাতে সিদ্ধিলাভ হইয়া থাকে। উহা সদ্যোজাতাদি পঞ্চমসংযুক্ত ও একান্ত গূঢ়। উহাতে অজ্ঞানীদিগের প্রবৃত্তি জন্মে না। বর্ণ ও আশ্রমধর্ম্মের সহিত উহার অনেকাংশেই সাদৃশ্য নাই; কেবল কোন কোন অংশে সাদৃশ্য নিরীক্ষিত হইয়া থাকে। যাঁহারা সিদ্ধান্তশাস্ত্রে পারদর্শী হইয়াছেন, তাঁহারাই উহার উপযোগিতা অনুধাবন করিতে পারেন। সর্ব্বাশ্রমত্যাগী পরমহংসাদিই উহা অবলম্বনের উপযুক্ত পাত্র। ঐ পাশুপতধৰ্ম্ম অনুষ্ঠান করিলে প্রভূত ফললাভ হয়। তুমি মৎপ্রদত্ত বরপ্রভাবে সেই পাশুপতধৰ্ম্মের সমগ্র ফললাভ কর। তোমার মানসিক সন্তাপ অপনীত হউক।’ অমিতপরাক্রম ভগবান্ মহাদেব দক্ষকে এইরূপ বর প্রদান করিয়া দেবী পার্ব্বতী ও অনুচরগণসমভিব্যাহারে অন্তর্দ্ধান করিলেন।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! যে ব্যক্তি এই দক্ষপোক্ত দেবসম্মত রুদ্ৰস্তব শ্রবণ ও কীৰ্ত্তন করিবে, সে নির্ব্বিঘ্নে বহুকাল জীবিত থাকিবে। যেমন ভগবান্ শিব সকল দেবগণের শ্রেষ্ঠ, সেইরূপ এই দক্ষকৃত শিবস্তুবও সমস্ত স্তব অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। যে ব্যক্তি যশ, রাজ্য, সুখ, ঐশ্বৰ্য্য ও ব্ৰহ্মলাভের অভিলাষ করে, সে ভক্তিপূৰ্ব্বক এই স্তব শ্রবণ করিবে। যাহারা ব্যাধিপীড়িত, দুঃখিত, তস্করোপত, ভীত ও রাজকার্য্যে নিযুক্ত হয়, তাহারা এই স্তব শ্রবণ করিলে অনায়াসে নির্ভয় হইতে পারে। এই স্তব পাঠ করিলে এই দেহেই রুদ্রানুচরগণের সাদৃশ্যলাভ এবং অসাধারণ তেজ ও যশঃপ্রাপ্তি হইয়া থাকে। যাহাদিগের গৃহে এই স্তবপাঠ হয়, রাক্ষস, ভূত, পিশাচ বা বিনায়কগণ তাহাদিগের কোন উপদ্রব করিতে সমর্থ হয় না। যে কামিনী শিবভক্তিপরায়ণা ও ব্রহ্মচারিণী হইয়া এই স্তব শ্রবণ করেন, তাঁহার পিতৃকুল ও মাতৃকুলে দেবতুল্য সম্মানলাভ হয়, সন্দেহ নাই। যিনি সমাহিতচিত্তে এই স্তব শ্রবণ ও কীৰ্ত্তন করেন, তাঁহার সতত সমুদয় কাৰ্য্য সুসম্পন্ন ও অভিলাষ সফল হয়। যে ব্যক্তি ভক্তিপূৰ্ব্বক যথানিয়মে দেবাদিদেব মহাদেব, কার্ত্তিকেয়, ভগবতী ও নন্দীকে বলি প্রদান করিয়া একাগ্রচিত্তে যথাক্রমে ইঁহাদিগের নাম স্মরণ করে, তাহার সমুদয় অভিলাষ পরিপূর্ণ হয়; সে পরকালে বহুকাল স্বর্গে বাস করে এবং তাহাকে কখনই তির্য্যগ্যোনিতে জন্মপরিগ্রহ করিতে হয় না। হে ধৰ্ম্মরাজ! পরাশরপুত্র ভগবান্ বেদব্যাস স্বয়ং এইরূপ ফলশ্রুতি কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন।”