২৮২তম অধ্যায়
যুদ্ধে উদ্যত বৃত্রের দুর্নিমিত্তাদি সদর্শন
“হে ধৰ্ম্মরাজ! অসুররাজ বৃত্র জ্বরাবিষ্ট হইলে তাঁহার শরীরে যে-যে চিহ্ন দৃষ্ট হইয়াছিল, তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ঐ সময় দানবরাজের মুখ প্রজ্জ্বলিত এবং সব্বশরীর বিবর্ণ, বিকম্পিত ও রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল; শ্বাসপ্রশ্বাস ঘন ঘন প্রবাহিত হইতে লাগিল। স্মরশক্তি অশিব[অমঙ্গল]দর্শনা শিবারূপে দৈত্যশ্বরের মুখ হইতে বিনির্গত হইল; উল্কাসমুদয় প্রজ্জ্বলিত হইয়া তাঁহার পার্শ্বে নিপতিত হইতে লাগিল এবং গৃধ্র, কঙ্ক ও বকসমুদয় একত্র মিলিত হইয়া ভয়ঙ্কর চীৎকার করিতে করিতে চক্রের ন্যায় তাঁহার মস্তকোপরি পরিভ্রমণ করিতে লাগিল।
বৃদেহনিঃসৃত ব্ৰহ্মহত্যার ইন্দ্রানুসরণ
“তখন দেবরাজ রথোপরি আরোহণপূৰ্ব্বক বজ্ৰ সমুদ্যত করিয়া সংগ্রামস্থ বৃত্রকে নিরীক্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় তীব্রজ্বরসমন্বিত অসুররাজ বৃত্র জৃম্ভণ ও ভীষণ সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। মহাতেজা ইন্দ্র বৃত্রকে জ্বম্ভণপরায়ণ অবলোকন করিয়া অবিলম্বে কালানলসদৃশ [যুগধ্বংস অগ্নিতুল্য—প্রলয়াগ্নিতুল্য] বজ্র পরিত্যাগপূৰ্ব্বক তাঁহাকে নিপাতিত করিলেন। বৃহদকায় বৃত্র সমরাঙ্গনে নিপতিত হইলে দেবগণ চতুর্দ্দিক হইতে হর্ষধ্বনি করিতে লাগিলেন। দৈত্যদলন দেবরাজ বৃত্রাসুরকে এইরূপে নিপাতিত করিয়া বিষ্ণুযুক্ত বজ্র গ্রহণপূৰ্ব্বক স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। দেবরাজ প্রস্থান করিলে পর দানবরাজ বৃত্রের শরীর হইতে কপালমালিনী, রুধিরার্দ্রা, ভীমদর্শনা ব্রহ্মহত্যা বিনির্গত হইল। উহার বর্ণ কৃষ্ণপিঙ্গল, কেশপাশ আলুলায়িত, নেত্র অতি ভীষণ, অঙ্গ কৃশ ও পরিধান চীরবল্কল। ব্রহ্মহত্যা বৃত্রাসুরের দেহ হইতে বহির্গত হইয়া বজ্রধারী ইন্দ্রকে অন্বেষণ করিতে লাগিল। কিয়ৎকাল পরে একদা বৃত্রহস্তা দেবরাজ পুরন্দর লোকের হিতাকাঙ্ক্ষী হইয়া স্বর্গ হইতে বহির্গত হইয়াছেন, এমন সময় ব্রহ্মহত্যা তাঁহাকে ধারণ করিবার নিমিত্ত তাঁহার সম্মুখীন হইল। দেবরাজ তদ্দর্শনে ভীত হইয়া মৃণালতন্তুমধ্যে গমনপূৰ্ব্বক বহুবৎসর লুক্কায়িত হইয়া রহিলেন। পরিশেষে তিনি তথা হইতে বিনির্গত হইবামাত্র ব্রহ্মহত্যা তাঁহাকে আক্রমণ করিল। তখন দেবরাজ ব্রহ্মহত্যার, বিনাশার্থ বিশেষরূপে যত্ন করিতে লাগিলেন, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। পরিশেষে তিনি ব্রহ্মহত্যাকে নিরাকৃত করিবার উপায়ান্তর না দেখিয়া সৰ্ব্বলোকপিতামহ, ব্রহ্মার নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহার চরণে নিপতিত হইলেন। তখন ভগবান্ কমলযোনি ইন্দ্রকে ব্রহ্মহত্যায় লিপ্ত দেখিয়া ব্ৰহ্মহত্যাকে মধুরবাক্যে সান্ত্বনা করিয়া কহিলেন, ‘সুশীল! তুমি অনুগ্রহপূর্ব্বক দেবরাজকে পরিত্যাগ কর। তাহা হইলে আমি তোমার প্রতি যারপরনাই প্রীত হইব এবং তুমি আমার নিকট যাহা প্রার্থনা করিবে, আমি তাহাই পূর্ণ করিব।’
“তখন ব্রহ্মহত্যা কহিল, ‘পিতামহ! আপনি ত্রিলোকপূজিত ও ত্রিলোকের সৃষ্টিকর্ত্তা; আপনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হওয়াতেই আমি কৃতকাৰ্য্য হইয়াছি। আপনার নিকট আমার অন্য কোন প্রার্থনা নাই। কেবল এক্ষণে আমি কোথায় বাস করিব, আপনি তাহা নির্দ্দেশ করিয়া দিন। আপনিই লোকসকলকে রক্ষা করিবার বাসনায় “লোকে ব্রাহ্মণ বিনাশ করিলেই ব্রহ্মহত্যাপাপে লিপ্ত হইবে” এই নিয়ম স্থাপনপূৰ্ব্বক লোকমধ্যে প্রচার করিয়া দিয়াছেন। এই নিমিত্তই আমি ইন্দ্রকে আক্রমণ করিয়াছি। এক্ষণে আমি আপনাকে প্রীত ও প্রসন্ন দেখিয়া ইন্দ্রের দেহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইতেছি, আপনি আমার বাসস্থান নির্দ্দেশ করিয়া দিন।
ব্রহ্মাকর্ত্তৃক ব্রহ্মহত্যা-নিবাস ব্যবস্থা
“তখন পিতামহ ব্রহ্মা ব্রহ্মহত্যার বাক্যে অঙ্গীকার করিয়া উপায় উদ্ভাবনপূর্ব্বক ইন্দ্রের দেহ হইতে তাহাকে নিষ্কাশিত করিলেন। অনন্তর তিনি অগ্নিকে স্মরণ করিবামাত্র হুতাশন তাঁহার সন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি আপনার নিকট সমাগত হইয়াছি, এক্ষণে আজ্ঞা করুন, আমাকে কোন্ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে হইবে?’ ব্রহ্ম কহিলেন, ‘হুতাশন! আমি অদ্য সুরপতির মুক্তিসাধনের নিমিত্ত এই ব্রহ্মহত্যাকে চারিভাগে বিভক্ত করিব। তুমি ইহার এক অংশ গ্রহণ কর।’ অগ্নি কহিলেন, ‘পিতামহ! আমি এই ব্রহ্মহত্যা হইতে কিরূপে মুক্তিলাভ করিব, আপনি তাহার উপায় ব্যক্ত করুন।’ ব্রহ্মা কহিলেন, ‘হুতাশন! যে ব্যক্তি তোমাকে প্রজ্জ্বলিত দেখিয়া তমোগুণপ্রভাবে বীজ, ওষধি ও রস লইয়া তোমাতে আহুতি প্রদান না করিবে, এই ব্রহ্মহত্যা নিশ্চয়ই তাহাকে আশ্রয় করিবে। তুমি সন্তপ্ত হইও না।’ প্রজাপতি এই কথা কহিলে হুতাশন তাঁহার বাক্যে সম্মত হইয়া ব্রহ্মহত্যার চতুর্থ-অংশ গ্রহণ করিলেন।
“অনন্তর প্রজাপতি বৃক্ষ, ওষধি ও তৃণসমুদয়কে আহ্বান করিয়া ব্রহ্মহত্যার একাংশ গ্রহণ করিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিতে লাগিলেন। তাহারা বিধাতার বাক্য শ্রবণ করিয়া বহ্নির ন্যায় ব্যথিতমনে তাঁহাকে কহিল, ‘পিতামহ! আমাদিগের এই পাপ কিরূপে ধ্বংস হইবে? দেখুন, আমরা প্রতিনিয়ত শীত, উত্তাপ ও বায়ু সহ্য করিতেছি, আবার মনুষ্যগণ আমাদিগকে সতত ভেদ ও ছেদন করিয়া থাকে। এইরূপে আমরা দৈবকর্ত্তৃক অভিহত হইয়া রহিয়াছি। অতএব যদি আপনি আমাদের ঐ পাপনাশের উপায় বিধান করিয়া দিতে পারেন, তাহা হইলে আমরা আপনার নির্দ্দেশানুসারে উহা গ্রহণ করিব।’ তখন ব্রহ্মা কহিলেন, ‘হে উদ্ভিদগণ! পৰ্ব্বকাল উপস্থিত হইলে যদি কেহ মোহক্রমে তোমাদিগকে ছেদন করে, তাহা হইলে এই ব্রহ্মহত্যা-পাপ তাহাকে আশ্রয় করিরে।’ ব্রহ্মা এই কথা কহিলে, ‘তরুগুল্মাদি উদ্ভিদগণ তাঁহার বাক্যে অঙ্গীকার করিয়া তাঁহাকে সৎকারপূর্ব্বক স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিল।
“অনন্তর ভগবান্ প্রজাপতি অগ্রাদিগকে আহ্বান করিয়া মধুরবাক্যে কহিলেন, ‘হে অপ্সরাগণ! এই ব্রহ্মহত্যা ইন্দ্র হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছে। এক্ষণে আমি তোমাদিগকে অনুরোধ করতেছি, তোমরা ইহার একাংশ গ্রহণ কর।’ তখন অপ্সরাগণ কহিল, ‘পিতামহ! আমরা আপনার নির্দ্দেশানুসারে ব্রহ্মহত্যার একাংশ গ্রহণ করিতেছি; কিন্তু আমরা যাহাতে সময়ক্রমে উহা হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারি, আপনি তাহার উপায় অবধারণ করুন।’
“ব্রহ্মা কহিলেন, ‘হে বরবর্ণিনীগণ! যে ব্যক্তি ঋতুমতী স্ত্রীতে গমন করিবে, এই ব্রহ্মহত্যা অবিলম্বে তাহাকেই আশ্রয় করিবে। তোমরা দুঃখ পরিত্যাগ কর।’ প্রজাপতি এই কথা কহিলে, অপ্সরাগণ প্রফুল্লমনে তাঁহার বাক্যে অঙ্গীকার করিয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিল।
সলিলকর্ত্তৃক ব্রহ্মহত্যার শেষাংশ ধারণ
“অনন্তর ভগবান্ প্রজাপতি সলিলকে স্মরণ করিলেন। সলিল স্মরণমাত্রই তথায় সমুপস্থিত হইয়া পিতামহকে অভিবাদনপূর্ব্বক কহিল, ‘ভগবন্! এই আমি আপনার নিকট সমুপস্থিত হইয়াছি। এক্ষণে আজ্ঞা করুন, আমি কোন্ কার্য্য অনুষ্ঠান করিব?’ ব্রহ্মা কহিলেন, ‘এই ভয়ঙ্করী ব্রহ্মহত্যা বৃত্রাসুর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া ইন্দ্রকে প্রাপ্ত হইয়াছিল। এক্ষণে তুমি ইহার একাংশ গ্রহণ কর।’ তখন সলিল কহিল, ‘ভগবন্! আপনি যেরূপ অনুমতি করিতেছেন, আমি তাহা প্রতিপালন করিতে সম্মত আছি। কিন্তু আমি যাহাতে সময়ানুসারে উহা হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারি, আপনি তাহার উপায় নির্দ্দেশ করিয়া দিন। আপনি এই সমস্ত জগতের একমাত্র আশ্রয়; সুতরাং এই পাপ হইতে মুক্তিলাভের নিমিত্ত আপনাকে ভিন্ন আর কাহাকে প্রসন্ন করিব?’ তখন ব্রহ্মা কহিলেন, ‘হে সলিল! যে ব্যক্তি তোমাকে সামান্য জ্ঞান করিয়া তোমার উপর মূত্র বা পুরীষ নিক্ষেপ করিবে, এই ব্রহ্মহত্যা তাহাকেই আশ্রয় করিবে।’ তাহা হইলেই তোমার উহা হইতে মুক্তিলাভ হইবে, সন্দেহ নাই।
ব্রহ্মা এইরূপ উপায়বিধান করিলে ব্রহ্মহত্যা দেবরাজকে পরিত্যাগ করিয়া বিধাতৃনির্দ্দিষ্ট বাসস্থানসমুদয়ে গমন করিল।
তৎপরে সুররাজ ব্রহ্মার নির্দ্দেশানুসারে অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া ব্রহ্মহত্যা হইতে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি লাভ করিলেন এবং পুনরায় আপনার সম্পদলাভ ও অসংখ্য শত্রুকে পরাজিত করিয়া অতিশয় প্রীতি প্রাপ্ত হইলেন। শিখণ্ড [তন্নামখ্যাত বৃক্ষবিশেষ] নামক উদ্ভিদ ঐ সময় বৃত্রাসুরের শোণিত হইতে উৎপন্ন হয়। উহা দীক্ষিত তপোধন ও ব্রাহ্মণগণের অভক্ষ্য।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! ব্রাহ্মণ সৰ্ব্বাপেক্ষা প্রধান; অতএব তুমি সকল অবস্থাতেই ব্রাহ্মণগণের প্রিয়ানুষ্ঠান করিবে। ইঁহারাই ভূদেব বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। দেবরাজ ইন্দ্র এইরূপে সূক্ষ্মবুদ্ধিপ্রভাবে উপায় উদ্ভাবন করিয়া বৃত্রাসুরকে সংহার করিয়াছিলেন। তুমি ইন্দ্রের ন্যায় পৃথিবীতে সকলের অজেয় হইবে। যাঁহারা প্রতি পৰ্ব্বে ব্রাহ্মণসন্নিধানে এই ইন্দ্রের বৃত্রাসুর জয়বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিবেন, তাঁহাদিগকে কখনও পাপভোগ করিতে হইবে না। এই আমি তোমার নিকট ইন্দ্রের অদ্ভুত কার্য্য কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে তোমার আর কি শ্রবণ করিতে অভিলাষ আছে, প্রকাশ কর।”