২৮০তম অধ্যায়
রাবণের কুপ্রস্তাবে তৎপ্রতি সীতার তিরস্কার
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “ভর্ত্তৃবিরহবিধুরা, অতি দীনা, মলিনবাসনা, মণিমাত্ৰ-ভূষণা পতিপরায়ণা জনকনন্দিনী শিলাতলে উপবেশন করিয়া রোদন করিতেছেন ও রাক্ষসাধিকৃত রক্ষোরমণীগণ সমীপে দণ্ডায়মান রহিয়াছে, এমন সময়ে রাজা দশানন দিব্যবসন, মনোহর মণিকুণ্ডল, বিচিত্ৰ মাল্য ও মুকুট ধারণ করিয়া মূর্ত্তিমান বসন্তের ন্যায়, রত্নবিভূষিত কল্পপাদপের ন্যায় কন্দপশরে আহত হইয়া জনকনন্দিনীসমীপে সমুপস্থিত হইলেন। তাঁহার মূর্ত্তি নানা অলঙ্কারে অলঙ্কৃত হইলেও শ্মাশানারোপিত চৈত্যকৃক্ষের ন্যায়,রোহিণীসমীপবর্ত্তী শনৈশ্চর গ্রহের ন্যায় অতি ভয়ঙ্কর বোধ হইতে লাগিল।
“অনন্তর রাবণ জনকনন্দিনীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, অয়ি জনকনন্দিনি! শ্ৰীরামচন্দ্রের প্রতি যথেষ্ট অনুগ্রহ প্ৰদৰ্শন করা হইয়াছে, এক্ষণে প্ৰসন্ন হও, বেশবিন্যাস করিয়া দিতেছি। হে বরারোহে! আমাকে ভজনা কর, আমার রমণীগণের শিরোমণি হও। আমার গৃহে বহুসংখ্যক দেব, গন্ধর্ব্ব, দানব ও দৈত্যকন্যা বাস করিতেছে। হে কল্যাণি! চতুর্দ্দশ কোটি পিশাচ, অষ্টবিংশতিকোটি ভীমকর্মী রাক্ষস এবং রাক্ষসের তিনগুণ যক্ষ আমার আজ্ঞাকারী। কত শত লোক আমার ধনাধ্যক্ষ ভ্ৰাতা কুবেরকে উপাসনা করিতেছে, আমি আপানে [মদ্যপানস্থান-অনেকে একত্র হইয়া যে স্থানে মদ্যপান করে] উপবেশন করিলে কত শত গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরা আমার ভ্রাতার ন্যায় আমাকে সেবা করে। আমি বিপ্ৰর্ষি বিশ্রাবার পুত্র; কুবেরের ন্যায় আমার যশ সর্ব্বত্র প্রথিত। হে ভাবিনি! ত্ৰিদশালয়ে যেরূপ বিবিধ ভক্ষ্য, ভোজ্য, পানীয় বিদ্যমান আছে, আমার আলয়েও সেইরূপ আছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। হে নিতস্বিনি! এক্ষণে বনবাসজনিত দুষ্কৃত ক্ষয় কর; তুমি মন্দোদরীর ন্যায় আমার প্রণয়িনী হও।”
“পতিপরায়ণী জানকী রাবণের বাক্য শ্রবণপূর্ব্বক মুখমণ্ডল পরিবর্ত্তিত করিয়া তৃণরাশিমধ্যে অন্তরিত করিলেন; তাঁহার নয়নযুগল হইতে অনবরত অশ্রুধারা বিগলিত হইতে লাগিল। তিনি দুরাশয় রাক্ষসরাজকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে রাক্ষসরাজ! তুমি বারংবার বিষাদকর দুর্ব্বাক্য-সকল প্রয়োগ করিতেছ, এই অভাগিনীও উহা শ্রবণ করিতেছে; আর কেন, যথেষ্ট হইয়াছে, অতঃপর তোমার কল্যাণ হউক, তুমি এই দুরভিলাষ পরিত্যাগ কর। আমি পতিব্ৰতা, পরপত্নী, তোমার গ্রহণীয় নহি, কৃপাপাত্ৰ মানুষী তোমার উপযুক্ত প্রেয়সী নহে। তুমি অবশীভূত কামিনীর প্রতি বলপ্রকাশ করিয়া কি প্রীতি লাভ করিবে? তুমি প্রজাপতিসম ব্রাহ্মণের সন্তান এবং স্বয়ং লোকপালসদৃশ হইয়া কি নিমিত্ত আপন ধর্ম্ম প্রতিপালন করিতেছ না। তুমি মহেশ্বরের সখা ধনেশ্বরকে ভ্রাতা বলিয়া পরিচয় দিয়াও কি লজ্জিত হইতেছে না?”
“জনকনন্দিনী রাবণকে উক্তপ্রকার উপদেশ প্ৰদান করিয়া বসনদ্বারা গ্ৰীবা ও মুখমণ্ডল আচ্ছাদনপূর্ব্বক হৃৎকম্পসহকারে রোদন করিতে লাগিলেন; তখন তাঁহার মস্তকশোভিনী সুসংযতা বেণী নিশ্বসিতা কলসর্পীর ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল। দুবুদ্ধি দশানন তাঁহার নিষ্ঠুরবাক্য-শ্রবণে আপনার দুরাশা-পরিপূরণে হাতশ্বাস হইয়াও পুনরায় কহিল, ‘হে জনকনন্দিনি, মকরধ্বজ [মদন] আমাকে যারপরনাই ব্যথিত করিতেছে, কিন্তু তুমি স্পৃহাবতী না হইলে কখনও আত্মস্পৃহা চরিতার্থ হইবে না, তুমি যখন অদ্যাপি আমাদের আহারস্বরূপ মনুষ্য রামচন্দ্রের অনুরোধ করিতেছ, তখন আর আমি তোমার কি করিতে পারি? রাক্ষসরাজ রাবণ এই কথা কহিয়া সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইয়া অভিমত দিকে প্রস্থান করিলে রাক্ষসীগণ-পরিবৃতা শোকাভিভূতা জনকদুহিতা বৈদেহী সেই স্থানে বাস করিতে লাগিলেন।”