গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

২৭. মানবের কাহিনী

সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ – মানবের কাহিনী

গতকল্য ঊষাকালে চাতক ঠাকুর দক্ষিণের দহে পদ্মফুল তুলিতে গিয়াছিলেন। কিন্তু অতদূর যাইতে হইল না, পথেই তিনি দেখিলেন অসংখ্য অস্ত্রধারী পুরুষ নদী পার হইতেছে। মৌরী নদী এখানে অগভীর; কোথাও হাঁটু জল, কোথাও কোমর পর্যন্ত।

দেখিয়া চাতক ঠাকুর ছুটিতে ছুটিতে গ্রামে ফিরিলেন। গ্রামে সংবাদ রাষ্ট্র হইল। প্রথমে গ্রামবাসীরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল; ঠাকুর ঠিক দেখিয়াছেন তো? বুড়া মানুষ, হয়তো কি দেখিতে কি দেখিয়াছেন। কয়েকজন যুবক আগ বাড়িয়া দেখিতে গেল।

চাতক ঠাকুর রঙ্গনার কুটিরে গিয়া বলিলেন— ‘রাঙা বৌ, গ্রামে দস্যু আসছে, তোমরা এই বেলা পালাও, নইলে পরে আর পালাতে পারবে না। যা পারো সঙ্গে নিয়ে যাও, পলাশবনের মধ্যে লুকিয়ে থাকো। আমি এদিকে রইলাম, যদি ভালয় ভালয় বিপদ কেটে যায়, তোমাদের ডেকে আনব।’

ওদিকে যাহারা দেখিতে গিয়াছিল তাহারা একদণ্ড পরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ফিরিয়া আসিল। গ্রামে ভয়ার্ত হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেল। মেয়েরা যে যেদিকে পাইল পলাইতে লাগিল; পুরুষেরাও তাহাদের পিছু লইল। ছেলে বুড়া স্ত্রী পুরুষ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া ছুটিতে শুরু করিল। দুই চারিজন বেতসকুঞ্জে লুকাইল; অনেকে নদী সাঁতরাইয়া পরপারে চলিয়া গেল।

কেবল মুষ্টিমেয় পুরুষ গ্রাম ছাড়িল না, লাঠি ভল্ল মুদ্‌গর যাহা পাইল হাতে লইয়া দাঁড়াইল। চিরদিনই পৃথিবীতে এক জাতীয় লোক আছে যাহারা নিজের বিপদ চিন্তা করে না; মৃত্যু নিশ্চয় জানিয়াও রুখিয়া দাঁড়ায়। অকারণে বা তুচ্ছ কারণে মৃত্যু বরণ করিয়া তাহারা চিরঞ্জীব হইয়া আছে। তাহাদের লইয়া কোনও কবি মহাকাব্য লেখেন নাই; তাহারা যুগে যুগে মৃত্যুঞ্জয়, তাই তাহাদের লইয়া মহাকাব্য লেখার প্রয়োজন হয় না।

‘মার্’ ‘মার্’ শব্দ করিয়া দস্যুদল গ্রামে প্রবেশ করিল। ক্ষুধাক্ষিপ্ত সশস্ত্র জনতা; যুক্তিহীন, বিবেকহীন; আপন উদগ্র প্রয়োজন ছাড়া তাহারা কিছুই বোঝে না। সম্মুখে কয়েকজন অস্ত্রধারী পুরুষ দেখিয়া হিংস্র তরক্ষুপালের মত তাহাদের উপর লাফাইয়া পড়িল; প্রত্যেক গ্রামবাসীকে পঞ্চাশজন দস্যু আক্রমণ করিল। এই যুদ্ধের প্রহসন অধিকক্ষণ স্থায়ী হইল না, গ্রামের সকলেই মরিল। কেবল চাতক ঠাকুর নিরস্ত্র ছিলেন বলিয়া তৎক্ষণাৎ মরিলেন না, মরণাহত হইয়া পড়িয়া রহিলেন, তারপর অতিকষ্টে দেবস্থানে ফিরিয়া গেলেন।

দস্যুগণ গ্রামে সঞ্চিত সমস্ত খাদ্যদ্রব্য লুণ্ঠন করিয়া কুটিরগুলিতে অগ্নিসংযোগ করিল। আপন দুষ্কৃতির চিহ্ন আগুন দিয়া মুছিয়া দিয়া চলিয়া গেল।

পলাশবনের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র স্থান ঘন তরুশ্রেণীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। এত ঘন এই তরুবেষ্টন যে রাত্রিকালে আগুন জ্বালিলে বাহির হইতে দেখা যায় না।

আজ এই স্থানে আগুন জ্বলিতেছিল। চুল্লীর আগুন; তিনটি প্রস্তর খণ্ডের মাঝখানে থাকিয়া ক্বচিৎ শিখা-প্রক্ষেপ করিয়া জ্বলিতেছিল। চুল্লীর উপর মৃৎপাত্রে অন্ন সিদ্ধ হইতেছে, তাই কোনও দিক দিয়াই আগুন বাহির হইতে পারিতেছিল না, পিঞ্জরাবদ্ধ বন্দীর মত ছিদ্রপথে অঙ্গুলি বাহির করিয়া আবার টানিয়া লইতেছিল।

আবদ্ধ আগুনের শিখায় স্থানটি অস্পষ্টভাবে আলোকিত। বৃক্ষের কাণ্ডগুলি স্তম্ভের মত ঊর্ধ্বে উঠিয়া গিয়াছে, ইহারাই যেন এই বনগৃহের প্রাচীর।

বনগৃহে দুইটি মানুষ রহিয়াছে। ইহাদের দেখিয়া সাধারণ মানুষ বলিয়া মনে হয় না; যেন ইহারা কোন্ অবাস্তব স্বপ্নলোকের অধিবাসী। এই মানুষ দুটি রঙ্গনা ও মানব। দস্যুর আক্রমণে পলাইয়া আসিয়া এই স্থানে আশ্রয় লইয়াছে।

রঙ্গনা উনানের উপর নত হইয়া হাঁড়িতে কাঠি দিতেছে। তাহার মুখের উপর মুগ্ধ আলোর খেলা। মুখখানি তেমনি মধুর-সুন্দর, কিন্তু যেন ইহলোকের নয়, পরীরাজ্যের স্বপ্নাতুর মুখ, রূপকথার বিস্ময়মুকুলিত মুখ। রঙ্গনার দেহ-মন যেন বাস্তবলোক ছাড়িয়া কল্পলোকে চলিয়া গিয়াছে।

মানব কিছুদূরে একটা গাছের স্তম্ভে ঠেস দিয়া বসিয়া আছে। তাহাকে ভাল দেখা যাইতেছে না; দেহের অস্থিপঞ্জরের উপর অস্পষ্ট আলোক ক্রীড়া করিতেছে; দীর্ঘ রুক্ষ চুল মুখের উপর পড়িয়া মুখের অধিকাংশ ঢাকিয়া দিয়াছে। মানব স্থির হইয়া বসিয়া আছে, নড়িতেছে না। যেন উৎকর্ণ হইয়া কিছু শুনিবার যত্ন করিতেছে।

‘রাঙা!’

রঙ্গনা মানবের পাশে গিয়া বসিল, একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিল। মানব তাহার একটি হাত নিজের মুঠির মধ্যে লইল, বলিল— ‘গুঞ্জা অনেকক্ষণ জল আনতে গেছে, এখনও ফিরল না কেন?’

রঙ্গনা বলিল— ‘এখনি ফিরবে। নদী তো কাছে নয়।’

‘ভাবনা হচ্ছে।’

‘তুমি ভেব না। গুঞ্জা এল বলে।’

‘খুব অন্ধকার হয়ে গেছে কি?’

‘হাঁ। কিন্তু গুঞ্জা পথ চেনে।’

দুইজন কিছুক্ষণ হাত ধরাধরি করিয়া নিশ্চল বসিয়া রহিল। তারপর মানব কথা কহিল— ‘বজ্র যদি ফিরে আসে, সে কি করে জানবে আমরা বনে লুকিয়ে আছি?’

রঙ্গনার চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল— ‘চাতক ঠাকুর আছেন।’

‘চাতক ঠাকুর কি আছেন? থাকলে আমাদের খবর নিতেন না?’

সহসা মানব খাড়া হইয়া উঠিয়া বসিল, একাগ্র হইয়া শুনিল। বলিল— ‘কারা আসছে! দু’জন—’

পদধ্বনি রঙ্গনা শুনিতে পায় নাই। সে সত্রাসে নতজানু হইয়া মানবকে দুই বাহু দিয়া বেষ্টন করিয়া লইল। এবার মানব তাহাকে আশ্বাস দিল— ‘ভয় পেও না। হয়তো গুঞ্জা আর চাতক ঠাকুর—’

কয়েকটা স্পন্দিত মুহূর্ত কাটিয়া গেল। যাহারা আসিতেছে তাহাদের পদশব্দ এখন স্পষ্ট শুনা যাইতেছে। তারপর গুঞ্জা আর বজ্র তরুস্তম্ভের আড়াল হইতে আলোকচক্রের মধ্যে প্রবেশ করিল। গুঞ্জার বাষ্পোচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর শুনা গেল— ‘মা, দেখ কে এসেছে!’

তীরবিদ্ধা হরিণীর ন্যায় রঙ্গনা উঠিয়া দাঁড়াইল। তারপর অশ্রুবিকৃত স্বরে নাম ধরিয়া ডাকিতে ডাকিতে ছুটিয়া গিয়া পুত্রকে জড়াইয়া ধরিল।

রঙ্গনার সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা এতদিনে শেষ হইল।

মাতাপুত্র কিছুক্ষণের জন্য জগৎ ভুলিয়া গেল। ক্রমে বজ্রের কর্ণে একটি কণ্ঠস্বর বারবার প্রবেশ করিয়া তাহাকে সচেতন করিয়া তুলিল— ‘বজ্র! পুত্র! পুত্র!’

পুরুষের কণ্ঠস্বর, গভীর আবেগে অবরুদ্ধ। বজ্র চক্ষু ফিরাইয়া দেখিল তরুতলের অস্পষ্ট ছায়ায় এক দীর্ঘকায় পুরুষ দাঁড়াইয়া আছে। দুই বাহু বাড়াইয়া ভগ্নস্বরে ডাকিতেছে— ‘পুত্র! পুত্র!’

বজ্র মাতার দেহ এক হাতে জড়াইয়া পুরুষের দিকে অগ্রসর হইল। কাছে গিয়া চিনিতে পারিল, এ সেই অন্ধ ভিক্ষুক, যাহাকে সে কর্ণসুবর্ণ যাত্রার পথে বনের অন্তিকে দেখিয়াছিল! ভিক্ষুকের অক্ষি-কোটর হইতে অশ্রু বিগলিত হইয়া পড়িতেছে।

বজ্রের কণ্ঠেও প্রবল বাষ্পোচ্ছ্বাস উঠিয়া তাহার কণ্ঠরোধ করিয়া দিল। সে ব্যাকুল চক্ষে মায়ের পানে চাহিয়া বলিল— ‘এ কে?’

রঙ্গনা কম্পিত অধরে অস্ফুট স্বরে বলিল— ‘তোমার পিতা— মহারাজ মানবদেব।’

বজ্রের সর্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল। সে নতজানু হইয়া পিতার জানু আলিঙ্গন করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।

সে-রাত্রে চারিজনের কেহই ঘুমাইল না, চুল্লীর আগুনের প্রভায় পরস্পর হাত ধরিয়া জাগিয়া রহিল; যে হারানিধি তাহারা ফিরিয়া পাইয়াছে তাহা আবার হারাইয়া না যায়। অতীত আতঙ্কের স্মৃতি, বর্তমানের পরিপূর্ণতা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা মিলিয়া চারিটি হৃদয়কে এক করিয়া দিল।

বজ্র তাহার কর্ণসুবর্ণ প্রবাসের কাহিনী বলিল। ধীরে ধীরে সন্তর্পণে বলিল, যেন কেহ আঘাত না পায়। শুনিয়া মানব নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল— ‘আমার পুত্র গৌড়ের সিংহাসনে বসেছে— হোক একদিনের জন্য— আমার আর দুঃখ নেই। কিন্তু আর্য শীলভদ্র যথার্থ বলেছেন, আজ থেকে ও-কথা ভুলে যেতে হবে। আমরা গৌড়দেশের সামান্য গ্রামবাসী, এই আমাদের পরিচয়। আমাদের রক্ত জনসাধারণের রক্তের সঙ্গে মিশে এক হয়ে যাবে, এই আমাদের গৌরব। রাজৈশ্বর্য চিরন্তন নয়, মনুষ্যত্ব চিরন্তন। আমাদের নাম লোকে ভুলে যাক ক্ষতি নেই, আমাদের মনুষ্যত্ব যেন যুগ-যুগান্তর ধরে গৌড়বঙ্গের অন্তরে বেঁচে থাকে।’

তারপর মানব আপন কাহিনী বলিল। দীর্ঘ বিংশ বৎসরের কাহিনী। একটা মানুষ কী দুঃসহ দুঃখভোগ করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে পারে তাহারই ইতিহাস।

রঙ্গনাকে ফিরিয়া আসিবার আশ্বাস দিয়া মানব কর্ণসুবর্ণে উপনীত হইল। রাজধানী রক্ষার জন্য নূতন সৈন্যদল গঠন করিবার পূর্বেই ভাস্করবর্মা বিজয়ী সেনাদল লইয়া কর্ণসুবর্ণ আক্রমণ করিলেন। নগর রক্ষা হইল না। মানব রাজপুরী সুরক্ষিত করিয়া শেষবার যুদ্ধ করিল।

ভাস্করবর্মা দুই দিন রাজপুরী অবরোধ করিয়া তৃতীয় দিনে নদীর ঘাটের পথে পুরীতে প্রবেশ করিলেন। পুরী অধিকৃত হইল; মানব রক্তাক্ত-কলেবরে যুদ্ধ করিতে করিতে বন্দী হইল।

মানব যদি যুদ্ধে মরিত তাহা হইলে ভাস্করবর্মা নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেন, কিন্তু সে জীবন্ত বন্দী হইয়া ভাস্করবর্মাকে বিব্রত করিয়া তুলিল। পরাজিত শত্রু-রাজাকে হত্যা করা রাজধর্ম নয়, তাহাতে সকল রাজার জীবনই সংশয়ময় হইয়া পড়ে। অথচ শত্রুর শেষ রাখিতে নাই। ভাস্করবর্মা এক কূটকৌশল অবলম্বন করিলেন। গভীর রাত্রে মানবের চক্ষু অন্ধ করিয়া তাহাকে প্রাকার হইতে ভাগীরথীর জলে নিক্ষেপ করা হইল। প্রকাশ্যে রটনা করা হইল, যুদ্ধকালে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্তির ফলে মানবের মৃত্যু হইয়াছে। প্রকৃত তত্ত্ব চারি পাঁচজন ব্যতীত কেহ জানিল না।

অন্ধ অবস্থায় ক্ষতবিক্ষত দেহে নদীতে নিক্ষিপ্ত হইয়াও মানব মরিল না। একদল বেদিয়া ভেলায় নদীপার হইতেছিল, তাহারা সন্তরমান মানবকে তুলিয়া লইল।

ভাগীরথীর পূর্বতীরে বন-বাদাড়ের মধ্যে বেদিয়ারা কিছুদিনের জন্য ডেরাডাণ্ডা ফেলিল। তাহাদের যত্ন ও শুশ্রূষায় মানবের দেহক্ষত জোড়া লাগিল। সে সারিয়া উঠিয়া বিপদের বন্ধু বেদিয়াদের নিকট আত্ম-পরিচয় প্রকাশ করিল।

পরিচয় শুনিয়া বেদিয়ারা ভয় পাইয়া গেল। তাহারা অতি দীনপ্রকৃতি, সকল সমাজের অপাংক্তেয়, রাষ্ট্রনীতি-ঘটিত কোনও ব্যাপারে তাহারা থাকে না। তাহারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করিয়া মানবকে স্নানের ছলে গঙ্গাতীরে লইয়া গেল এবং উচ্চ পাড় হইতে ঠেলিয়া জলে ফেলিয়া দিল। *

অন্ধ মানব ভাগীরথীর স্রোতে ভাসিয়া চলিল। সমস্ত দিন ভাসিয়া চলিবার পর সন্ধ্যার সময় অর্ধমৃত অবস্থায় সে কূল পাইল। বহুদূর দক্ষিণে একটি ক্ষুদ্র গ্রাম, তাহারই ঘাটে সারারাত্রি পড়িয়া রহিল।

পরদিন হইতে মানবের দীর্ঘ পরিব্রজন আরম্ভ হইল। যষ্টি হস্তে অন্ধ ভিক্ষুক দেশে দেশান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। কত নদী পার হইয়া কত রাজ্যে গেল, বঙ্গাল, সমতট, পুণ্ড্রবর্ধন, প্রাগ্‌জ্যোতিষ। বৎসরের পর বৎসর কাটিয়া গেল, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বারবার ফিরিয়া আসিল। কিন্তু মানবের প্রব্রজ্যা শেষ হইল না।

মানব একবার যে ভুল করিয়াছিল তাহা আর দ্বিতীয়বার করিল না, কাহাকেও নিজের পরিচয় দিল না। এখন তাহার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বেতসগ্রামে ফিরিয়া আসা।

সে সসংকোচে পথচারীদের জিজ্ঞাসা করিত— ‘ভাই, বেতসগ্রাম কত দূর?’ কিন্তু বেতসগ্রামের উদ্দেশ কেহ দিতে পারিত না। অন্ধ ভিক্ষুককে অনেকেই দয়া করিত; কেহ অন্ন দিত, কেহ ছিন্ন কন্থা দান করিত, কিন্তু বেতসগ্রামের সন্ধান কেহ দিতে পারিত না। মানব অধিক প্রশ্ন করিতেও সাহস করিত না। কি জানি যদি কিছু সন্দেহ করে!

এইভাবে বিশ বছর কাটিয়াছে। ভাগীরথী যে কতবার মানব পারাপার করিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। দণ্ডভুক্তি বর্ধমানভুক্তি কঙ্কগ্রামভুক্তি, সর্বত্র সে বিচরণ করিয়াছ, কিন্তু বেতসগ্রামের সন্ধান পায় নাই।

তারপর একদিন নদীতটে বজ্রের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল। বজ্র তাহাকে নিজ অন্নের ভাগ দিল, বেতসগ্রামের পথ দেখাইয়া দিল—

বিশ বছর পরে রঙ্গনার নিকট মানবের শপথ উদ্‌যাপন হইল।

রঙ্গনা এ কাহিনী পূর্বে শুনিয়াছিল, দ্বিতীয়বার শুনিয়া তাহার চোখে আবার অশ্রুর নীরব ধারা নামিল। কাহারও চক্ষু শুষ্ক রহিল না; চারিজন একসঙ্গে কাঁদিল।

পরিশিষ্ট

পরদিন বজ্র চাতক ঠাকুরের দেহ মৌরীর তীরে দাহ করিল। শুদ্ধ শান্ত নিরীহ ঠাকুরের দেহ ভস্ম হইয়া গৌড়বঙ্গের আকাশে বাতাসে ছড়াইয়া পড়িল।

বাকি দেহগুলি মৌরীর জলে বিসর্জন দিতে হইল। সকলকে দাহ করিবার মত ইন্ধন নাই।

তারপর তাহাদের নূতন জীবনযাত্রা আরম্ভ হইল। নূতন জীবনযাত্রার মধ্যে নূতনত্ব কিছু নাই; পুরাতন রথের যে চক্র ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল তাহাই সংস্কৃত হইয়া আবার চলিতে আরম্ভ করিল। সেই পথ, সেই রথ। পুরাতনের সহিত যোগসূত্র ছিন্ন হইল না।

দস্যুর ভয়ে যাহারা পলাইয়াছিল তাহার কেহ কেহ ফিরিয়া আসিল, কিন্তু ভস্মাবশেষ গ্রামের অবস্থা দেখিয়া অধিকাংশই আবার চলিয়া গেল। দুই চারিজন রহিল।

বজ্র পুরাতন গৃহের ভিত্তি পরিষ্কার করিয়া আবার কুটির বাঁধিল। পূর্বে দুইজনের উপযোগী কুটির ছিল, এখন চারিজনের উপযোগী কুটির হইল। রঙ্গনা নদী হইতে জল আনিয়া মাটিতে ঢালিয়া কাদা করিল, অন্ধ মানব পা দিয়া কাদা দলিয়া পিণ্ড করিল; গুঞ্জা বেতসবন হইতে বেতের চঞ্চারী কাটিয়া আনিয়া দিল। সকলে মিলিয়া কুটির নির্মাণ করিল।

বর্ষা নামিল। ধান্য ও ইক্ষুর ক্ষেত্র আর্দ্র হইয়া নূতন শস্য উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হইল। কিন্তু কে বপন করিবে? বীজ কোথায়? গুঞ্জা অতি যত্নে কয়েক মুঠি ধান্য সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছিল, বজ্র তাহাই ক্ষেত্রে ছড়াইয়া দিল। যে কয়টি গাভী বাথানে অবশিষ্ট আছে তাহাদের দুগ্ধই এখন এই কয়টি প্রাণীর প্রধান আহার্য-পানীয়।

বর্ষা কাটিয়া শরৎ আসিল। ধানের শীষ লক্ লক্ করিয়া বাড়িতে লাগিল। ইক্ষুক্ষেত্রে পুরাতন মূল হইতে আপনি অঙ্কুর বাহির হইল।

বজ্র বনে গিয়া হরিণ ময়ূর শিকার করিয়া আনে; সুযোগ পাইলে গুঞ্জা তাহার সঙ্গে যায়। রঙ্গনা আর মানব কুটির-দেহলিতে হাত-ধরাধরি করিয়া বসিয়া থাকে। মানব রঙ্গনার মুখ অঙ্গুলি বুলাইয়া অনুভব করে, তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে।

কর্মহীন মধ্যাহ্নে বজ্র বেতসকুঞ্জে গিয়া একাকী শুইয়া থাকে; অতীতের কথা ভাবে। কি বিচিত্র এই জীবন! কখনও নিষ্কম্প নিস্তরঙ্গ, কখনও উত্তাল তরঙ্গসংকুল। …কুহু এখন কী করিতেছে?…রানী শিখরিণীর কি পরিণাম হইল?…আর্য শীলভদ্র ও বন্ধু মণিপদ্ম কি এতদিনে নালন্দায় পৌঁছিয়াছেন;…তাহার দিবাস্বপ্ন শেষ হইতে পাইত না। গুঞ্জা আসিয়া তাহার বুকের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িত; গদ্‌গদ্‌ কণ্ঠে বলিত— ‘আমাদের চেয়ে সুখী আর কি কেউ আছে?’

পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা। পথ এখনও শেষ হয় নাই। হে চির-সারথি, যে-পথে তোমার রথ লইয়া চলিয়াছ কোথাও কি তাহার শেষ আছে?

—–

* বাথানিয়া গাই— যৌবনতপ্তা গাভী

* কুকুরের অস্ট্রিক প্রতিশব্দ ‘চুচু’।

* সপ্তম অষ্টম শতাব্দীর ভূমিমাপ = ৫ কুল্যবাপ

* শীলভদ্র সমতটের এক ব্রাহ্মণ রাজবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।

* নদীতে জলযুদ্ধ করিতে নৌ-সাধনোদ্যত বাঙ্গালী পটু ছিল, কালিদাসের রঘুবংশে (৪/৩৬) তাহার প্রমাণ আছে।

* গোপা বেদেনীর মুখে এই সংবাদ শুনিয়া মরিয়াছিল।