২৭তম অধ্যায় – ভীমকরে দুর্ম্মর্ষণাদি ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণবধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় কুরুরাজ দুর্য্যোধন অদৃশ্য হইলে এবং পাণ্ডুপুত্র বৃকোদর গজানীক নিহত ও কৌরববল নিপীড়িত করিয়া, প্রাণঘাতন দণ্ডধারী ক্রুদ্ধ কৃতান্তের ন্যায় সমরাঙ্গনে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলে, মহাবীর দৰ্ম্মর্ষণ, শ্রুতান্ত, জৈত্র, ভরিবল, রবি, জয়ৎসেন, সজাত, দুর্বিষহ, অরিহা, দুর্বিমোচন, দুধর্ষ ও তা আপনার এই কয়েকটি হতাবশিষ্ট যুদ্ধবিশারদ পুত্র ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইয়া তাঁহার চতুর্দ্দিক অবরোধ করিলেন। তখন মহাবীর মধ্যম পাণ্ডব পুনৰ্ব্বার রথারূঢ় হইয়া আপনার পুত্রগণের মৰ্ম্মদেশে নিশিতশরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। কুমারগণ ভীমশরে সমাকীর্ণ হইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইলেন। তখন মহাবীর বৃকোদর কোপাবিষ্ট হইয়া ক্ষুর দ্বারা দুৰ্ম্মর্ষণের শিরচ্ছেদন ও সর্বাবরণভেদী [সৰ্ব্বপ্রকার বর্ম্মভেদকারী] ভল্ল দ্বারা মহারথ তান্তের প্রাণ সংহারপূর্ব্বক অম্লানমুখে নারাচ দ্বারা জয়ৎসেনকে বিদ্ধ করিয়া রথ হইতে নিপাতিত করিলেন। মহাবীর জয়ৎসেন ভূতলে নিপতিত হইয়াই পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলেন। মহাবীর শ্রুতর্বা তদ্দর্শনে কোপপূর্ণ হইয়া নতপৰ্ব্ব শতবাণে ভীমসেনকে বিদ্ধ করিলেন। বৃকোদর তৎকালে তাঁহার উপর নিক্ষেপ করিয়া বিষাগ্নিসদৃশ তিন বাণে জৈত্র, গজসৈন্য ভূরিবল ও রবি এই তিনজনকে নিপাতিত করিলেন। বীরত্রয় রথ হইতে ভূতলে পতিত হইয়া বসন্তকালে ছিন্ন কিংশুকপাদপত্রয়ের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন অরাতিঘাতন ভীমসেন এক সুতীক্ষ্ণ ভল্লে দুর্বিমোচনের জীবননাশ করিলে তিনি রথ হইতে নিপতিত হইয়া, বায়ুভগ্ন গিরিকূটজাত [পর্বতশৃঙ্গে জাত] পাদপের ন্যায় শোভমান হইলেন। অনন্তর মহাবীর বৃকোদর দুই দুই বাণে দুধর্ষ ও সুজাতকে নিহত করিয়া ভূতলশায়ী করিলেন। তখন মহাবীর দুর্বিষহ মহাবেগে ভীমের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর বৃকোদর তাঁহাকেও ধনুর্ধরগণসমক্ষে ভল্লের আঘাতে যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণ করিলেন। “ঐ সময় মহাবীর শ্রুতৰ্ব্বা ভ্রাতৃগণকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া ক্রোধভরে সুবর্ণভূষিত শরাসনে টঙ্কার প্রদান ও বিষাগ্নিতুল্য বিবিধ শরবর্ষণ করিয়া ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইলেন, এবং অবিলম্বে তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া তাঁহাকে বিংশতি বাণে বিদ্ধ করিলেন। তখন ভীমপরাক্রম ভীমসেন সত্বর অন্য চাপ গ্রহণপূর্ব্বক শ্রুতর্ব্বাকে ‘থাক থাক’ বলিয়া তর্জ্জন করিয়া শরজালে সমাকীর্ণ করিয়া ফেলিলেন। পূৰ্ব্বকালে জম্ভাসুর ও বাসবের যেমন যুদ্ধ হইয়াছিল, তদ্রূপ এক্ষণে সেই বীরদ্বয়ের অতি বিচিত্র ভয়ানক সংগ্রাম উপস্থিত হইল। তাঁহাদিগের যমদণ্ডসদৃশ নিশিত শরজালে ভূমণ্ডল, দিঙ্মণ্ডল ও নভোমণ্ডল সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। অনন্তর মহাবীর শ্রুতা কোপান্বিত হইয়া শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক ভীমসেনের বাহুদ্বয় ও বক্ষঃস্থলে শর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর তাঁহার শরে অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া পৰ্ব্বকালীন সাগরের ন্যায় নিতান্ত অস্থির হইলেন এবং রোষাবিষ্টচিত্তে শ্ৰতৰ্ব্বার চারি অশ্ব ও সারথির প্রাণ সংহারপূর্ব্বক তাঁহাকে অনবরত নিক্ষিপ্ত শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর শ্রুতৰ্ব্বা ভীমসেনের প্রভাবে বিরথ হইয়া খড়্গচর্ম ধারণপূর্ব্বক সমরে বিচরণ করিতে লাগিলেন। তখন বীরবরাগ্রগণ্য বৃকোদর ক্ষুর দ্বারা সেই খড়্গচর্মধারী মহাবীরের শিরচ্ছেদন করিলেন; তার মস্তকবিহীন কলেবর রথ হইতে নিপতিত হওয়াতে বসুধাতল শব্দায়মান হইল। তখন আপনার পক্ষীয় ভয়মোহিত যোধগণ যুদ্ধার্থ ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইলেন। প্রতাপান্বিত বৃকোদরও হতশেষ বলার্ণব [সৈন্যরূপ সাগর] হইতে সমাগত বৰ্মধারী যোধগণকে আক্রমণ করিলেন। তখন কৌরবগণ তাঁহার চতুর্দ্দিক অবরোধ করিতে লাগিলেন। ভীমসেন কৌরবপক্ষীয় যোধগণ কর্ত্তৃক সমন্তাৎ [সৰ্ব্বদিক হইতে] পরিবৃত হইয়া সুররাজ যেমন অসুরগণকে নিপীড়িত করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তাঁহাদিগকে শরনিকরে নিপীড়িত করিলেন এবং অবিলম্বে পাঁচ শত মহারথ, সাত শত কুর, এক লক্ষ পদাতি ও আট শত অশ্ব নিপাতিত করিয়া সমরাঙ্গনে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তাঁহার হস্তে আপনার পুত্রগণ নিহত হওয়াতে তিনি আপনাকে কৃতার্থ ও আপনার জন্ম সার্থক বলিয়া বোধ করিলেন। ঐ সময় আপনার পক্ষীয় যোধগণ সেই কৌরবনিসূদন মহাবীরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেও সমর্থ হইলেন না। মহাবীর ভীমসেন এইরূপে কৌরবগণকে বিদ্রাবিত ও তাঁহাদের সৈন্যগণকে নিপাতিত করিয়া বাহ্বাস্ফোটনে করিগণকে বিভ্রাসিত করিতে লাগিলেন। তখন সেই অল্পমাত্রাবশিষ্ট কৌরবসৈন্য নিতান্ত দীনভাবাপন্ন হইয়া রহিল।”