২৭. টেবিলে কাচের জারে

টেবিলে কাচের জারে ডুবিয়ে রাখা মস্তিষ্কটিতে এক ধরনের বিবর্ণ রংয়ের ছোপ পড়েছে। লাল চুলের মেয়েটি সেদিকে তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারল মস্তিষ্কটিতে এক ধরনের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। গত কিছুদিন সে নিয়মিত তার বাসায় আসে নি, মস্তিষ্কটিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিতে পারে নি, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে নি। তারা ভেবেছিল রবোমানবেরা সারা পৃথিবীকে দখল করতে যাচ্ছে—আসলে হয়েছে ঠিক তার উল্টো। বনের পশুর মতো এখন রবোমানবেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

বিজ্ঞান আকাদেমীর সভাপতি ঠিকই বলেছিল, ভয়ানক বিপদে রবোমানবেরা একে অন্যকে হত্যা করতে থাকে। এক ঘণ্টাও হয় নি তারা তাদের দলপতিকে হত্যা করেছে। নতুন দলপতি কে হবে সেটা নিয়ে বিরোধ হয়েছে, আরেকটু হলেই তাকেও হত্যা করে ফেলতো। অনেক কষ্ট করে সে বেঁচে এসেছে। সময় খুব কঠিন, নিজে বেঁচে আসার জন্যে তাকে অন্য সবাইকে খুন করে আসতে হয়েছে। সে নিজেও গুলি খেয়েছে, আঘাতটা কতোটুকু গুরুতর বুঝতে পারছে না, কোনো হাসপাতালেও যেতে পারছে না—নিজের বাসায় এসে আশ্রয় নিয়েছে।

লাল চুলের মেয়েটি ওঠে দাঁড়িয়ে যন্ত্রণার একটা শব্দ করে মস্তিষ্কের সুইচটি অন্য করে দিল। জিজ্ঞেস করল, তুমি জেগে আছ?।

মস্তিষ্কটি বলল, হ্যাঁ জেগে আছি। আমি আসলে জেগেই থাকি।

আমি কয়েকদিন আসতে পারি নি। তোমার পুষ্টি দিতে পারি নি।

আমি জানি। আমি বুঝতে পারছি আমার মাঝে এক ধরনের প্রদাহ শুরু হয়েছে। আমি খুব আশা করে আছি এখন আমি মারা যাব।

লাল চুলের মেয়েটি যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে বলল, আমি তোমাকে মারা যেতে দেব না। আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন তোমাকে বাঁচিয়ে রাখব।

মস্তিষ্কটি বলল, তুমি এমন করে কেন কথা বলছ? তোমার কী কোনো যন্ত্রণা হচ্ছে?

হ্যাঁ।

কেন?

আমি গুলি খেয়েছি। আমার রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

তোমাকে কে গুলি করেছে? মানুষ?

না। লাল চুলের মেয়েটি বলল, আমাকে অন্য রবোমানব গুলি করেছে। যেই রবোমানবকে আমি হত্যা করেছি তারা আমাকে গুলি করেছে।

মস্তিষ্কটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন রবোমানব হয়ে রবোমানবকে হত্যা করতে গিয়েছ?

লাল চুলের মেয়েটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি সেটা বুঝবে না।

তোমরা কি পৃথিবী দখল করে নিয়েছ?

লাল চুলের মেয়েটি প্রশ্নের উত্তর দিল না। মস্তিষ্কটি আবার জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি পৃথিবী দখল করে নিয়েছ?

লাল চুলের মেয়েটি এবারেও প্রশ্নের উত্তর দিল না। মস্তিষ্কটা তখন একটু হাসির মতো শব্দ করল। বলল, তার মানে তোমরা পৃথিবী দখল করতে পার নি! আমি জানতাম তোমরা পারবে না।

লাল চুলের মেয়েটি এবারেও কোনো কথা বলল না। মস্তিষ্কটি নরম গলায় বলল, তোমার জন্যে আমার খুব মায়া হচ্ছে। তোমার সাথে প্রতিদিন আমি কথা বলেছি, আমি জানি তুমি অসম্ভব নিঃসঙ্গ একটি মেয়ে। রবোমানবের কোনো বন্ধু নেই। কোনো প্রিয়জন নেই। কোনো আপনজন নেই। আমি যেরকম অসম্ভব নিঃসঙ্গ—আমার যেরকম কোনো অস্তিত্ব নেই। আমার যেরকম শুরু নেই, শেষ নেই, আমি যেরকম অন্ধকার একটা জগতে থাকি, তুমি এবং তোমার মতো রবোমানবেরাও সেরকম অন্ধকার বোধহীন অনুভূতিহীন একটা জগতে থাক। তোমার জন্যে আমার মায়া হয়। মায়া হয় আর করুণা হয়। অসম্ভব করুণা হয়।

লাল চুলের মেয়েটি টলতে টলতে এগিয়ে গিয়ে তার ব্যাগ থেকে বেঢপ একটা রিভলবার বের করে এনে ফিসফিস করে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু তোমার মতো বোধশক্তিহীন অনুভূতিহীন অঙ্গপ্রত্যঙ্গহীন একটা মস্তিষ্ক আমাকে করুণা করবে সেটি হতে পারে না।

তুমি কী করবে?

লাল চুলের মেয়েটি কোনো উত্তর দিল না। মস্তিষ্কটি আবার জিজ্ঞেস করল, কী করবে? তুমি কী করবে?

লাল চুলের মেয়েটি খুব ধীরে ধীরে রিভালবারটি নিজের মাথায় স্পর্শ করে। একবার চারিদিকে তাকাল তারপর ট্রিগারটি টেনে ধরে। ছোটঘরটিতে গুলির শব্দটি প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে।

মস্তিষ্কটি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কী হয়েছে এখানে?

কেউ তার কথার উত্তর দিল না। মস্তিষ্কটির চেতনা ধীরে ধীরে অবশ হতে শুরু করেছে। কেউ তাকে বলে দেয়নি কিন্তু সে জানে তার সময় শেষ হয়ে আসছে। নিজের ভেতরে সে তীব্র একটি প্রশান্তি অনুভব করে। আর কিছুক্ষণ তারপরই সে এই অন্ধকার বোধশক্তিহীন চেতনহীন, আদি-অন্তহীন, মমতাহীন জগৎ থেকে মুক্তি পাবে।

সেই তীব্র আনন্দের জন্যে এই হতভাগ্য মস্তিষ্কটি অপেক্ষা করতে থাকে।

 

 

২৮.

খুব ধীরে ধীরে নীহার ঘুম ভেঙ্গে যায়। পঞ্চম ঘাত কিনিস্কা রাশিমালা নিয়ে চিন্তা করতে করতে সে ঘুমিয়েছিল, ঠিক যখন সমাধানটা তার মাথায় উঁকি দিতে শুরু করেছে তখন তার চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল। যখন সে চোখ খুলেছে তখন হঠাৎ করে সমাধানটা সে পেয়ে গেছে। নিজের অজান্তেই নীহার মুখে হাসি ফুটে উঠল।

ক্যাপসুলের ভেতর মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। একটা মৃদু সংগীতের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে সেটি ভেসে আসছে কিন্তু নীহা জানে এটি ঠিক ক্যাপসুলের ভেতরেই তার জন্যে তৈরি করা সংগীতের ধ্বনি। নীহা তার হাতটি নাড়ানোর চেষ্টা করল, দুর্বলভাবে সেটি একটু নাড়াতে পারল। এখনো তার শরীরে শক্তি ফিরে আসে নি। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।

নীহা তার চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে। সে অনুভব করে সারা শরীরে এক ধরনের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। এই উষ্ণতাটুকু তার শরীরটাকে জাগিয়ে তুলছে। কতোদিন পর সে জেগে উঠছে? শেষবার যখন জেগে উঠেছিল তখন সেটি ছিল একটি ভয়ংকর দুঃসংবাদের মতো। এবারে? এবারে নিশ্চয়ই ওরকম কিছু নয়। যদি সেরকম কিছু হতো তাহলে ক্যাপসুলের ভেতর এরকম মিষ্টি একটা সংগীতের ধ্বনি তাকে শোনানো হতো না। ক্যাপসুল থেকে বাইরে বের হওয়ার জন্যে সে আর অপেক্ষা করতে পারছে না।

শেষ পর্যন্ত ক্যাপসুলের ঢাকনাটি ধীরে ধীরে খুলে গেল। নীহা ভেতরে ওঠে বসে তারপর সাবধানে ক্যাপসুল থেকে নেমে আসে। একটু দূরে স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালার পাশে নুট দাঁড়িয়েছিল, নীহার পায়ের শব্দ শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। নীহা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, নুট! কেমন আছ তুমি?

নীহা ভেবেছিল মুট কোনো কথা বলবে না, মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দেবে সে ভালোই আছে। কিন্তু তাকে অবাক কয়ে নুট কথা বলল, আমি ভালোই আছি নীহা! তুমি কেমন আছ?

আমিও ভালো আছি! কিনিস্কা রাশিমালার সমাধানটা মনে হয় পেয়ে গেছি!

চমৎকার। শীতলঘরে তোমার ঘুম কেমন হল?।

নীহা অবাক হবার ভান করে বলল, কী আশ্চর্য নুট! তুমি পর পর দুটি কথা বললে! প্রশ্ন করলে! এমনটি তো আগে কখনো হয় নি।

নুট হেসে ফেলল, বলল, আসলে কোয়ার্টজের এই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে গ্রহটাকে দেখে মনটা ভালো হয় গেছে। তাই কথা বলার ইচ্ছে করছিল। তোমাকে দেখে কথা বলে ফেলছি।

গ্রহ? নীহা অবাক হয়ে বলল, আমরা একটি গ্রহে এসেছি? কেপলার টুটুবি?

মনে হয়।

নীহা টলমলে পায়ে এগিয়ে গিয়ে কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বিস্ময়ের একটা শব্দ করল, বলল, কী সুন্দর! ঠিক যেন পৃথিবী।

কেপলার টুটুবি গ্রহটি তোমাদের পছন্দ হয়েছে জেনে ভালো লাগছে।

ট্রিনিটির কণ্ঠস্বর শুনে দুজনেই ঘুরে তাকাল। ট্রিনিটি বলল, এটি আমার খুঁজে পাওয়া তৃতীয় গ্রহ।

তৃতীয় গ্রহ? তুমি এর আগে আরো দুটি গ্রহে গিয়েছ? নীহা অবাক হয়ে বলল, আমাদের ডেকে তোলনি কেন?

গ্রহগুলিকে ঠিক করে উজ্জীবিত করতে পারিনি তাই তোমাদের ডাকিনি।

উজ্জীবিত? গ্রহকে উজ্জীবিত করে কেমন করে?

মানুষ প্রাণী গাছপালা বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরি করাকে বলি উজ্জীবিত করা।

এই গ্রহটিকে পেরেছ?

সহ্য সীমার ভেতরে নিয়ে এসেছি।

সেটা কী, বলবে আমাদের?

বলব। অবশ্যই বলব। তোমাদের আরো তিনজন জেগে উঠুক, তখন এক সাথে বলব।

ট্রিনিটির কথা শেষ হবার আগেই অন্য তিনটি ক্যাপসুলের ঢাকনা খুলে যায়। ভেতর থেকে টলমলে পায়ে ইহিতা, টুরান আর টর একজন একজন করে বের হয়ে আসে।

নীহা আনন্দের মতো শব্দ করে বলল, এসো তোমরা। দেখে যাও। আমরা কেপলার টুটুবি গ্রহে এসেছি। আমাদের গ্রহ।

শীতলঘর থেকে সদ্য ওঠা তিনজন টলমল পায়ে এগিয়ে এসে কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, নিজের অজান্তেই তাদের মুখে দিয়ে আনন্দের একটা ধ্বনি বের হয়ে আসে।

ইহিতা বলল, দেখেছ, গ্রহটা ঠিক পৃথিবীর মতো!

ট্রিনিটি বলল, পুরোপুরি নয়। কিছু পার্থক্য রয়েছে, তোমাদের অভ্যস্ত হয়ে যেতে হবে।

কী পার্থক্য? টর জিজ্ঞেস করল, কোনো ভয়ংকর প্রাণী?

না। কোনো ভয়ংকর প্রাণী নেই।

তাহলে?

সূর্যটা বড়। দিনগুলো লম্বা। রাতের আকাশে চাঁদ দুটি।

সেগুলো খুব কঠিন কিছু নয়। দুটি চাঁদ ভালোই লাগবে মনে হয়।

আবহাওয়াতে বৈচিত্র্য কম। মাধ্যাকর্ষণ একটু বেশি, বাতাসে অক্সিজেনও একটু কম। আমি পৃথিবীর প্রাণীগুলো পাঠিয়েছি তারা বেশ মানিয়ে নিয়েছে। তোমরাও নিশ্চয়ই মানিয়ে নিতে পারবে।

টর বলল, আমি আর অপেক্ষার করতে পারছি না। আমি গ্রহটাতে নামতে চাই।

একটু প্রস্তুত হয়ে নাও, এই গ্রহটা হবে তোমাদের নতুন পৃথিবী। আমি সেটাকে তোমাদের জন্যে পাঁচশ বছর থেকে প্রস্তুত করেছি। দেখো তোমাদের পছন্দ হয় কি না।

 

স্কাউটশিপটা পুরো গ্রহটাকে একবার প্রদক্ষিণ করে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে। সমুদ্রের বালুবেলায় স্কাউটশিপটা স্থির হয়ে দাঁড়াল। নিরাপত্তা বন্ধনী থেকে নিজেদের মুক্ত করে সবাই স্কাউটশিপের দরজায় এসে দাঁড়াল।

ইহিতা বলল, সবাই প্রস্তুত?

হ্যাঁ।

দরজাটি খুলব?

খোলো।

ইহিতা দরজার একটি বোতাম স্পর্শ করতেই মৃদু একটা শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল, সাথে সাথে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস স্কাউটশিপে প্রবেশ করে। সেই নোনা বাতাসে সজীব এক ধরনের ঘ্রাণ। ঠিক তখন একটা বুনো পাখি তারস্বরে ডাকতে ডাকতে স্কাউটশিপের উপর দিয়ে উড়ে গেল।

ইহিতা সবার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা সবাই কী এখন নামার জন্যে প্রস্তুত?

সবাই মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, প্রস্তুত।

চল তাহলে নামি।

চল।

নীহা জিজ্ঞেস করল, কে আগে নামবে?

তুমি। ইহিতা বলল, তোমার পদচিহ্ন দিয়েই এই নতুন পৃথিবী শুরু হোক। নীহা চোখ বড় বড় করে বলল, আমার পদচিহ্ন দিয়ে?

সবাই মাথা নাড়ল। টর বলল, হ্যাঁ তোমার। নতুন পৃথিবীটা শুরু হোক সবচেয়ে নিস্পাপ মানুষের পদচিহ্ন দিয়ে।।

নীহা একটু হাসল, তারপর বলল, ঠিক আছে। তাহলে আমি নামি।

নীহা তখন স্কাউটশিপের সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। শেষ ধাপে পৌঁছে সে হঠাৎ থেমে গেল। পিছনে ফিরে তাকিয়ে বলল, আমি কি আরেকজনের সাথে তার হাত ধরে নামতে পারি?

ইহিতা হাসিমুখে বলল, অবশ্যই পার নীহা।

নীহা তখন লাজুকমুখে বলল, নুট তুমি কী আমার হাত ধরবে? তুমি আর আমি কী হাত ধরে একসাথে কেপলার টুটুবির এই নতুন পৃথিবীতে নামতে পারি?

নুট বলল, অবশ্যই নামতে পারি নীহা। অবশ্যই।

 

স্কাউটশিপের ভেতরে দাঁড়িয়ে সবাই দেখল নুট আর নীহা হাত ধরাধরি করে বালুবেলায় পা দিয়েছে। নরম বালুতে পায়ের ছাপ রেখে দুজন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

ইহিতা ফিসফিস করে বলল, দ্বিতীয় পৃথিবীর প্রথম মানব ও মানবী। তারপর সে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে তার চোখ দুটো মুছে নেয়।

কে জানে কেন তার চোখে পানি এসেছে?