২৭তম অধ্যায়
কৌরবগণের গঙ্গায় শ্মশানান্ত স্নানতৰ্পণাদি
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! অনম্ভর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও অন্যান্য ব্যক্তিরা পুণ্যতোয়া [পবিত্রসলিলা] প্রসন্নসলিলা [স্বচ্ছতোয়া] ভগবতী ভাগীরথীতে সমুপস্থিত হইয়া ভূষণ ও উত্তরীয়সকল পরিত্যাগ করিলেন। তখন কৌরবকুলকামিনীগণ দুঃখিত মনে গলদশ্রুনয়নে কেহ কেহ পিতা, কেহ কেহ ভ্রাতা, কেহ কেহ পুত্র, কেহ কেহ পৌত্র, কেহ কেহ শ্বশুর, কেহ কেহ পতি এবং কেহ কেহ বা অন্যান্য বন্ধুবান্ধবের উদ্দেশ্যে জলাঞ্জলি প্রদান করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই বীরপত্নীগণ বীরগণের উদককাৰ্য্য সম্পাদনে প্রবৃত্ত হইলে গঙ্গার অবতরণপথ সাতিশয় সুশোভিত হইল। ভাগীরথীর তীর এককালে বীরপত্নীগণে সমাকীর্ণ, নিরানন্দ ও উৎসবশূন্য হইয়া উঠিল।
ঐ সময় আৰ্য্যা কুন্তী শোকাকুলিতচিত্তে গলদশ্রুনয়নে পাণ্ডবগণকে কহিলেন, “পুত্রগণ! যে বীরলক্ষণলাঞ্ছিত মহাবীর অর্জুনের হস্তে নিহত হইয়াছে, যাহাকে তোমরা রাধাগৰ্ভসম্ভূত সূতপুত্র বলিয়া নির্দেশ করিতে, যে সৈন্যগণমধ্যে দিবাকরের ন্যায় বিরাজিত হইত, যে তোমাদিগের ও তোমাদের অনুচরগণের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিয়াছিল, যে দুর্য্যোধনের সৈন্যসমুদয়কে পরিচালিত করিত, এই পৃথিবীতে যাহার তুল্য বলবীৰ্য্যসম্পন্ন আর কেহই নাই, যে জীবনপ্রদান করিয়াও যশোলাভের বাসনা করিত, সেই সত্যসন্ধ, সমরে অপরাঙ্মুখ, মহাবীর কর্ণের উদককাৰ্য্য সম্পাদন কর। সেই সহজকবচকুণ্ডলধারী মহাবীর তোমাদের জ্যেষ্ঠভ্রাতা। সে দিবাকরের ঔরসে আমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল।”
কুন্তীকর্ত্তৃক কর্ণপরিচয়ে যুধিষ্ঠিরের শোক
মনস্বিনী কুন্তী এই কথা কহিলে পাণ্ডবগণ কর্ণের নিমিত্ত যারপরনাই শোকপ্রকাশ করিতে লাগিলেন। অনন্তর ধর্ম্মরাজ ভুজঙ্গের ন্যায় দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক জননীকে কহিলেন, “আৰ্য্যে! যে সমুদ্রসদৃশ বীরের শরজাল তরঙ্গস্বরূপ ধ্বজ আবর্ত্তস্বরূপ, ভুজযুগল গ্রাহস্বরূপ এবং রথ হ্রদস্বরূপ ছিল, ধনঞ্জয় ব্যতিরেকে আর কোন বীরই যাঁহার শরবেগ সহ্য করিয়া রণস্থলে অবস্থান করিতে পারিত না, তিনি দেবতার ঔরসে আপনার গর্ভে কিরূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন? যাঁহার বাহুবলে আমরা সকলেই পরিতাপিত হইয়াছিলাম, আপনি তাঁহাকে বস্ত্রাচ্ছাদিত বহ্নির ন্যায় কিরূপে তিরোহিত করিয়া রাখিয়াছিলেন? আমরা যেমন অর্জুনের ভুজবল অবলম্বন করিয়া আছি তদ্রূপ ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ যাঁহার বলবীৰ্য্য আশ্রয় করিয়াছিল, যাঁহা ব্যতিরেকে আর কেহই সমস্ত ভূপালগণের সৈন্যসমুদয়ের তেজ সহ্য করিতে সমর্থ হয় নাই, সেই ধনুর্দ্বরাগ্রগণ্য মহাবল কর্ণ কি আমাদিগের জ্যেষ্ঠভ্রাতা ছিলেন? আপনি সেই অদ্ভুতবিক্ৰম মহাবীরকে কিরূপে অগ্রে প্রসব করিয়াছিলেন? আপনি এই বিষয় গোপন রাখিয়াছিলেন বলিয়াই আমরা এক্ষণে কর্ণের বিনাশনিবন্ধন বন্ধুবান্ধবগণ সমভিব্যাহারে বিপন্ন হইয়া যারপরনাই দুঃখভোগ করিতেছি। আমি অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র এবং পাঞ্চাল ও কৌরবগণের বিনাশে যেরূপ পরিতাপিত হইয়াছি, আজ কর্ণের বিনাশে তদপেক্ষা শতগুণ পরিতাপিত হইলাম; এক্ষণে কর্ণবিরহ হুতাশনের ন্যায় আমাকে দগ্ধ করিতেছে। হায়! আপনি পূর্বে এই গূঢ়বৃত্তান্ত প্রকাশ করিলে আমাদিগের স্বর্গীয় বস্তুও দুর্লভ হইত না এবং এই কৌরবকুলক্ষয়কর ঘোরতর ক্ষয়কাণ্ডও সমুপস্থিত হইবার সম্ভাবনা থাকিত না।”
হে মহারাজ। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এইরূপ নানা প্রকার বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া দুঃখে দগ্ধপ্রায় হইয়া কর্ণের উদকক্রিয়া নির্বাহ করিলেন। তখন যেসমস্ত মহিলারা উদকক্রিয়াসমাধানাথ আগমন করিয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই আর্ত্তনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির জ্যেষ্ঠভ্রাতা কর্ণের প্রতি প্রীতিনিবন্ধন তাঁহার ভাৰ্য্যাদিগকে তথায় আনয়ন করাইলেন এবং তাঁহাদিগের সহিত মিলিত হইয়া কর্ণের ঔর্দ্ধদেহিক ক্রিয়া সমাধানপূর্ব্বক ব্যাকুলিতচিত্তে ভাগীরথীর সলিল হইতে উত্থিত হইলেন।
শ্রাদ্ধপর্বাধ্যায় সমাপ্ত
।। স্ত্রীপর্ব্ব সম্পূর্ণ ।।