কী করছেন তখন গানাদো? কোথায় তখন তিনি?
আর কোথাও নয়, হুয়াইনা কাপাক-এর প্রেত-প্রাসাদেই তখনও তিনি আছেন। আছেন নিজের ইচ্ছাতেই। কোনও কিছুর সঠিক খবর না পেয়ে এ অবস্থায় কী তাঁর করা উচিত তখনও স্থির করে উঠতে পারেননি বলেই প্রেত-প্রাসাদ ছেড়ে বার হতে তিনি দেরি করেছেন।
ইতিপূর্বে প্রেত-প্রাসাদ থেকে বার হওয়া খুব কঠিন হয়তো তাঁর পক্ষে হত না।
এসপানিওল সওয়ারদের চড়াও হওয়ার দরুন সূর্যবরণ প্রান্তর ফাঁকা হয়ে যাবার পরও হুয়াইনা কাপাক-এর রক্ষীরা কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করেছে।
রেইমির উৎসবের সারা সপ্তাহের মধ্যে ইংকা নরেশের রাজবেশে সজ্জিত। শবদেহ সূর্যবরণ প্রান্তর থেকে সরাবার কোনও নজির তাদের ইতিহাসে নেই বলেই তারা যে কোনও মুহূর্তে শত্রুরা সব লুঠপাট করতে পারে বুঝেও শব-সভা ভেঙে প্রেত-প্রাসাদে ফিরে যেতে প্রথমটা চায়নি। কিন্তু কোথায় আর উৎসব!
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুর দেখা নেই।
রেইমি উৎসবের যারা প্রধান পাণ্ডা কোরিকাঞ্চার সেই ছোট বড় পুরোহিতদেরও প্রান্তর ছেড়ে চলে যেতে দেখবার পর আর দ্বিধা না করে ইংকা নরেশের শবদেহের সঙ্গে শব-সভার আর সব উপকরণ সাজসজ্জা প্রেত-প্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা তারা করেছে।
গানাদো ইচ্ছে করলে সে সময়ে হয়তো নিজেকে মুক্ত করতে পারতেন।
কিন্তু ব্যাপারটা নিঃশব্দে সারা যেত না। হুয়াইনা কাপাক-এর নব জাগরণের কোনও তাৎপর্যও দেওয়া যেত না সে ঘটনায়। অস্বাভাবিক যে চাঞ্চল্য তাতে সৃষ্টি হত তাঁর নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির তা বাধা হতে পারত।
গানাদো তাই শবদেহের মতোই নিথর নিস্পন্দ হয়ে হুয়াইনা কাপাক-এর রক্ষীদের তাঁকে ভক্তিভরে বয়ে নিয়ে যেতে দিয়েছেন।
নিথর নিস্পন্দ তিনি তখন অবশ্য শুধু দেহে। মনের ভেতরটা তুফানের সমুদ্রের চেয়ে অস্থির।
ঘটনা কোথায় কী ঘটেছে তার বিন্দুমাত্র আভাস না পাওয়ার জন্যেই তাঁর উদ্বেগ দুর্ভাবনা আরও বেশি। সত্যি কথা বলতে গেলে সব কিছুই এখন তাঁর কাছে হেঁয়ালি।
কামালকা থেকে এসপানিওল সওয়ার দল নিয়ে সোরাবিয়ার কুজকো পর্যন্ত হানা দেওয়ার লক্ষ্য যে তিনি, এটুকু বুঝলেও কেমন করে এমনসব যোগাযোগ সম্ভব হল তা তিনি ভেবে পাননি।
সৌসার খবরের জন্যেই তাঁর আকুলতা উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি। কী হয়েছে সৌসায়? যেখান থেকে একটা বিস্ফোরণ সমস্ত পেরুকে কাঁপিয়ে তুলবে সে সৌসা হঠাৎ যেন পেরুর মানচিত্র থেকেই মুছে গেছে!
একটা সামান্য সাড়াশব্দও সেখান থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভূমু ব্যস্ত হয়ে সেখানে ছুটেছেন। সে ছোটার কারণটা অতি স্পষ্ট।
গানাদোকে ধরতে না পেরে আর কয়ারও কোনও সন্ধান না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি সৌসা ছুটে গেছেন হুয়াসকারকে মুক্ত করার সমস্ত আয়োজন পণ্ড করার জন্যে।
কিন্তু কয়া যদি সেখানে পৌঁছোতে পেরে থাকে তা হলে রাজপুরোহিতের সাধ্য কী যে গানাদোর সাজানো চাল এক চুল এদিক-ওদিক করেন।
কয়া অবশ্য যদি বিফল হয়ে থাকে—
ভাবতেই শিউরে ওঠেন গানাদো। কয়া বা ভিলিয়াক ভমু একজন তো সফল হবেই। হয় মুক্ত হুয়াসকার না হয় সাফল্যগর্বিত ভিলিয়াক ভমুকে তো দেখা যাবে কুজকোর সূর্য-বরণ প্রান্তরে রেইমি উৎসবের প্রথম শুভ লগ্নে?
রেইমি উৎসবের প্রথম দিনের সূর্য পশ্চিমে ড়ুবতে চলেছে, তবু সৌসা থেকে দুপক্ষের কারওই কোনও বার্তা এসে পৌঁছয়নি।
কী এমন সৌসায় ঘটে থাকতে পারে যা সেখানকার এই অদ্ভুত অস্বাভাবিক নীরবতা সম্ভব করে তুলেছে?
কয়ার ভাবনাতেই সবচেয়ে কাতর হয়ে ওঠেন গানাদো।
কন্যাশ্রমের অলঙ্ঘ্য প্রাচীরের আড়ালে সূর্যসেবিকারূপে বাইরের সংসারের সঙ্গে কোনও সাক্ষাৎ পরিচয় যার হয়নি সেই অবলা অসহায় সদ্যকৈশোর-পার-হওয়া একটি মেয়েকে তিনি অসাধ্যসাধন করতে পাঠিয়েছেন।
পাঠিয়ে অবশ্য উপায় ছিল না।
কিন্তু ব্যর্থ যদি সে হয়ে থাকে তা হলে যে অবস্থা তার হয়েছে তা তো শোচনীয় বললেও কিছুই বলা হয় না।
সে অবস্থা যদি তার হয়ে থাকে তা হলে প্রতিকারে কিছুই অবশ্য করা গানাদোর পক্ষে সম্ভব নয়। তবু নির্বিকার হয়ে এই কুজকো শহরে আটকে থাকার যন্ত্রণা যে অসহ্য।
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসবার আগেই প্রেত-প্রাসাদের প্রহরীরা ইংকা নরেশের শবদেহের সমস্ত পরিচর্যার ব্যবস্থা করে দিয়ে বিদায় নিয়েছে। একজন প্রহরীর রাত্রের জন্যও এ প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত থাকবার কথা। কিন্তু এ নিয়ম নিষ্প্রয়োজন বলেই আর পালিত হয় না।
গানাদো প্রেত-প্রাসাদ থেকে বার হবার জন্যে তৈরি হয়েছেন। তৈরি হবার আর কী আছে? এ প্রেত-প্রাসাদে লটবহর নিয়ে তো আর ঢুকতে পারেননি। কাক্সামালকা থেকে বার হবার সময়ই এসপানিওল সৈনিকের ধড়াচূড়ার সঙ্গে খাপে-ভরা তলোয়ারও সেখানে ফেলে আসতে হয়েছে।
সঙ্গে যা নিতে পেরেছিলেন তা একটা ছোরা আর তার চেয়েও যা দামি সেই একপ্রান্ত ফুটো করা পাথরের ছোট গোলা পরানো আশ্চর্য দড়ির অস্ত্র-বোলাস।
এই প্রেত-প্রাসাদে গোপনে আশ্রয় নেবার সময়ে পেরুবাসীর সাধারণ পোশাক বাদে সেই বোলাস আর ছোরাটাই সঙ্গে এনে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। সেই লুকোনো সম্বল বার করে এনে বাইরে যাবার জন্যে ইংকা নরেশের রাজবেশ ছেড়ে সাধারণ পোশাক পরতে গিয়ে বাধা পেয়েছেন গানাদো!
বাইরে কীসের একটা গণ্ডগোল শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
প্রেত-প্রাসাদের এ এলাকা একান্ত নির্জন ও নিস্তব্ধ। এ দেশের কেউ এ এলাকার পবিত্র নির্জনতা ও স্তব্ধতা সহজে ভঙ্গ করে না।
এ ধরনের অস্বাভাবিক গোলমালে তাই বিস্মিত হয়ে গুপ্ত ছিদ্রপথে গানাদো বাইরে কী হচ্ছে দেখতে গেছেন।
যা দেখেছেন তাতে একটু অস্বস্তিই বোধ করেছেন।
এ সেই এসপানিওল সওয়ারদের নিরীহ নিরস্ত্র কুজকোবাসীদের তাড়া করে প্রথম প্রেত-প্রাসাদের খোঁজ পাওয়ার ঘটনা।
তখনও সন্ধ্যা ভাল করে নামেনি। বাইরের আলো ম্লান হয়ে এলেও তার মধ্যে এসপানিওল সওয়ারেরা যে একজন কুজকোবাসীকে ধরে পাহাড়ের গায়ে বসানোে প্রেত-প্রাসাদের দরজার রহস্য জানবার চেষ্টা করছে তা তিনি বুঝেছেন।
কুজকোবাসীর কাছে কিছু জানতে না পারলেও নিজেদের কৌতূহলে ও লুঠের লোভে সওয়ার সৈনিকরা দরজা ওধারে কী আছে সন্ধান করবার চেষ্টা করতে পারে বলে গানাদোর সন্দেহ হয়েছে।
সাধারণ এদেশি পোশাক তখন পরা হয়ে গিয়েছিল। লুঠেরা সওয়াররা হয়তো তখনই হানা দিতে পারে। পোশাক বদলাবার সময় সুতরাং আর নেই। সে ঝক্কি না নিয়ে গানাদো যা পরেছিলেন তারই ওপর ইংকা নরেশের শবদেহের রাজবেশ তাড়াতাড়ি চাপিয়ে রাজপালঙ্কে গিয়ে মমির মতো শয্যা নিয়েছেন।
সেপাইরা যদি কোনও কারণে সন্দেহ করে ইংকার শবদেহের রহস্য ধরে ফেলে তা হলে সে চরম সংকটে ব্যবহারের জন্যে হুয়াইনা কাপাক-এরই মণিমাণিক্যখচিত তলোয়ারটা শুধু লুকিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করেছেন শয্যার ভেতরে।
সওয়ার সেপাইরা শেষ পর্যন্ত সাহস করে অবশ্য পাহাড়ের গায়ে বসানো রহস্যময় দরজা ঠেলে ভেতরে যেতে সাহস করেনি। কিছুক্ষণ বাদে বাইরে তাদের গোলমাল থেমে গেছে।
বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেও গানাদো তবু নিশ্চিন্ত হয়ে প্রেত-প্রাসাদ ছেড়ে তখনই বার হওয়া সমীচীন মনে করেননি।
সওয়ার সৈনিকদের ভয়েই যে তিনি বার হতে দ্বিধা করেছেন তা নয়। দরকার হলে একসঙ্গে ও রকম কয়েকজন সওয়ারের মওড়া নেবার ক্ষমতা তিনি রাখেন।
কিন্তু এখন তাঁর যা উদ্দেশ্য তা সিদ্ধ করতে হলে সবার আগে দরকার সম্পূর্ণ গোপনতা।
বীরত্ব দেখাতে গিয়ে তাঁর পরিচয় জানাজানি হয়ে গেলে তিনি যা করতে চান তার সব আশা এখানেই নিমূল হয়ে যাবে।
ভীরুর মতোই অতি সাবধানে সওয়ার সৈনিকদের চোখে পড়বার বিপদ সম্পূর্ণ কেটে যাবার জন্যে ধৈর্য ধরে তিনি অপেক্ষা করেন। লুঠের নেশায় মত্ত এইসব পাষণ্ড এসপানিওলদের কোনও বিশ্বাস নেই। একবার ভয় পেয়ে এ অঞ্চল ছেড়ে গেলেও আবার দল ভারী করে খেয়ালের মাথায় এখানে হানা দিতে তারা আসতে পারে।
তখন তাদের সামনে পড়তে গানাদো চান না।
একটু বেশি রাত হবার জন্যে তাই তিনি অপেক্ষা করেন। রাতের অন্ধকারে সব। দিক দিয়েই তাঁর সুবিধে।
শুধু যে এসপানিওল সেনারা তখন খাবার আর সুরা নিয়ে মেতে থাকবে তা নয়, আঁধারে আঁধারে কুজকো ছেড়ে সৌসার পথে বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাওয়াও তাঁর সহজ হবে।
গানাদো যা আশা করে অপেক্ষা করেছেন ঘটনা ঘটেছে ঠিক তার বিপরীত।
রাত গভীর হলে প্রেত-প্রাসাদ ছেড়ে বার হওয়া তাঁর পক্ষে নিরাপদ হবে ভেবেছিলেন গানাদো।
সেই অনুসারে রাত্রির প্রথম প্রহর শেষ হবার পর প্রেত-প্রাসাদের দরজা তিনি যখন খুলতে যাচ্ছেন হঠাৎ সেই মুহূর্তে সচকিত হয়ে উঠেছে চারিধারের নিস্তব্ধ অন্ধকার প্রান্তর লুব্ধ হিংস্র সওয়ার সৈনিকদের চিৎকারে আর ঘোড়ার পায়ের শব্দে। সেই সঙ্গে বহু মশালের কম্পিত শিখার আলো ঈষৎ খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে যেন ভয়ংকর কোনও অশুভ সম্ভাবনার ছায়া কাঁপিয়েছে ভেতরের দেয়ালে।