২৭৯. কৰ্ম্মফলানুসাধিনী গতি

২৭৯তম অধ্যায়

কৰ্ম্মফলানুসাধিনী গতি

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! সকল ব্যক্তিই আমাদিগকে ধন্য বলিয়া নির্দ্দেশ করে; কিন্তু বস্তুতঃ এই জীবলোকে আমাদিগের অপেক্ষা অসুখী আর কেহই নাই। দেখুন, সকলের পূজনীয় ধৰ্ম্মাদি দেবগণের ঔরসে জন্মপরিগ্রহ করিয়াও আমাদিগকে যারপরনাই কষ্ট সহ্য করিতে হইতেছে; অতএব এক্ষণে বোধ হইতেছে, শরীরধারণই দুঃখের কারণ। হায়! আমরা কবে দুঃখনাশক সন্ন্যাসধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিব? মহর্ষিগণ পাঁচ প্রাণ, মন, বুদ্ধি, পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ কৰ্ম্মেন্দ্রিয়, মুক্তিবিরোধী কামক্রোধাদি, শব্দাদি ইন্দ্রিয়ার্থ ও সত্ত্বাদি গুণ হইতে বিমুক্ত হইয়া সংসারপাশ হইতে মুক্তিলাভ করিয়া থাকেন। তাঁহাদিগকে পুনরায় জন্মগ্রহণ করিতে হয় না। হায়! আমরা কবে রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া মহর্ষিদিগের ন্যায় সন্ন্যাসশ্রম অবলম্বন করিব?”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! দুঃখের অবশ্যই অন্ত আছে। কোন পদার্থই সীমাশূন্য নাই। মুক্তিই পুনর্জ্জন্মের অন্ত। ফলতঃ সমস্ত বিষয়েরই এক-একটি নির্দ্দিষ্ট সীমা আছে। ঐশ্বৰ্য্য সংসারানুরাগের কারণ বলিয়া বস্তুতঃ দূষণীয় বটে; কিন্তু উহাদ্বারা তোমাদের কোন অপকার হইবে না। তোমরা ধাৰ্ম্মিক; সুতরাং শমদমাদির অভ্যাসদ্বারা কিয়ৎকালের মধ্যেই মোক্ষলাভ করিতে পারিবে। মনুষ্য পুণ্যপাপের নিয়ন্তা নহে; প্রত্যুত পুণ্যপাপসমুত্থিত অজ্ঞানদ্বারা তাহাকে অভিভূত হইতে হয়। বায়ু যেমন কৃষ্ণ, পীত ও রক্তবর্ণ ধূলিজালে মণ্ডিত হইয়া নানা রূপ ধারণ করে, সেইরূপ জীব কৰ্ম্মফলযুক্ত ও অজ্ঞানদ্বারা অভিভূত হইয়া স্বয়ং বর্ণশূন্য হইয়াও গৌরত্বাদি দেহধৰ্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক দেহে দেহে সঞ্চরণ করিতেছেন। মনুষ্য জ্ঞানপ্রভাবে অজ্ঞানসমুৎপন্ন অন্ধকার নিরাস করিতে পারিলেই নিত্যব্রহ্মলাভে সমর্থ হয়। দেবগণের সাক্ষাৎকারলাভ হইলেও প্রতিনিয়ত জীবন্মুক্ত মহাদিগের উপাসনা করা আবশ্যক। ব্রহ্মকে লাভ করা নিতান্ত যত্নসাধ্য; এই নিমিত্ত মহর্ষিগণ ব্রহ্মোপাসনা হইতে কদাচ বিরত হয়েন না। এই স্থলে শত্ৰুনির্জ্জিত রাজ্যপরিভ্রষ্ট অসহায় দানবরাজ বৃত্র শক্ৰমধ্যে একমাত্র বুদ্ধি অবলম্বনপূর্ব্বক অবস্থান করিয়া যাহা কহিয়াছিলেন, তাহা অনন্যমনে শ্রবণ কর।

বিষ্ণুভক্ত বৃত্রের বিচিত্র বৃত্তান্ত—বৃত্র-শুক্ৰসংবাদ

“পূৰ্ব্বে দৈত্যগুরু উশনাঃ [শুক্রাচার্য্য] বৃত্রাসুরকে ঐশ্বৰ্য্যপরিভ্রষ্ট দেখিয়া কহিয়াছিলেন, ‘দানবরাজ! তুমি শক্তহস্তে পরাজিত হইয়া কি দুঃখিত হও নাই?’ তখন বৃত্র কহিলেন, ভার্গব! আমি তপস্যা ও বেদবাক্য প্রভাবে প্রাণীগণের সংহার ও মুক্তির বিষয় নিঃসংশয়রূপে জ্ঞাত হইয়াছি; সুতরাং আমাকে কখনই শোকাকুল বা হর্ষে অভিভূত হইতে হয় না। কতকগুলি জীব কালপ্রেরিত হইয়া নরকে নিমগ্ন হয়, আর কতকগুলি দেবলোকে গমনপূর্ব্বক প্রফুল্লমনে কালযাপন করিয়া থাকে। জীবগণ স্বর্গে ও নরকে নির্দ্দিষ্টকাল নিঃশেষিত প্রায় করিয়া অবশিষ্ট পুণ্যপাপপ্রভাবে বারংবার জন্মপরিগ্রহ করে। উহাদিগকে সহস্র সহস্রবার তির্য্যাগ্‌যোনিতে জন্মগ্রহণ ও নরকে বাস করিতে হয়। আমি জীবগণের বিষয় এইরূপ অবগত হইয়াছি। শাস্ত্রে নির্দ্দিষ্ট আছে। যে, যাহার যেমন কৰ্ম্ম, তাহার সেইরূপ গতি হইয়া থাকে। মনুষ্য কার্য্যানুসারেই তির্য্য, মনুষ্য ও দেবযোনি প্রাপ্ত হয় এবং কৰ্ম্মফলেই সে বার বার নরকযন্ত্রণা সহ্য করিয়া থাকে। পূৰ্ব্বকৃত কৰ্ম্মানুসারেই তাহাকে মৃত্যুর পর সুখদুঃখ এবং প্রিয় ও অপ্রিয় লাভ করিতে হয়। সকল প্রাণীই পরলোকে কৰ্ম্মফল ভোগ করিয়া পুনরায় ভূতলে আগমন করে।’

“ভগবান্ শুক্র বৃত্রাসুরের মুখে এইরূপ সজ্জনোচিত বাক্যশ্রবণে তাঁহাকে সৃষ্টিস্থিতির একমাত্র আশ্রয় পরমাত্মার প্রতি দৃঢ়ভক্তিপরায়ণ অবগত হইয়া কহিলেন, ‘দানবরাজ! তোমার মুখ হইতে কি নিমিত্ত অসুরবিরোধী বাক্য নিঃসৃত হইতেছে?’ বৃত্র কহিলেন, ‘ভগবন্! পূৰ্ব্বে আমি জিগীষাপরবশ হইয়া অতি কঠোর তপানুষ্ঠান করিয়াছিলাম। ইহা আপনি ও অন্যান্য লোকসকলেই অবগত আছেন। আমি প্রাণীগণের পুষ্পোদ্যান [ফুলের বাগান] ও অন্যান্য ভোগ্যবস্তু অধিকার করিয়া স্বীয় তেজঃপ্রভাবে লোকত্রয়কে অতিক্রম ও অভ্যুদয় [উন্নতি] লাভ করিয়াছিলাম। আমি প্রভামণ্ডলে [তেজোরাশিতে] পরিব্যাপ্ত হইয়া নির্ভয়ে অন্তরীক্ষে বিচরণ করিতাম। তৎকালে আমাকে কেহই পরাজিত করিতে সমর্থ হয় নাই। আমি তপোবলে এইরূপ ঐশ্বৰ্য্য লাভ করিয়াছিলাম; আবার স্বীয় কৰ্ম্মদোষেই উহা হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়াছি। এক্ষণে আমি কেবল স্বীয় ধৈৰ্য্যবলে তদ্বিষয়ে আর শোকপ্রকাশ করিতেছি না।

‘পূৰ্বে আমি মহাত্মা ইন্দ্রের সহিত যুদ্ধার্থী হইয়া সৰ্ব্বলোকপিতামহ বৈকুণ্ঠনাথ সনাতন বিষ্ণুকে নিরীক্ষণ করিয়াছিলাম। এক্ষণে নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে যে, আমার সেই বিষ্ণুদর্শনস্বরূপ তপস্যাজনিত শুভাদৃষ্টের ফলভোগ অবশিষ্ট আছে। আমি সেই শুভদৃষ্টপ্রভাবে আপনাকে কৰ্ম্মফলের বিষয় জিজ্ঞাসা করিতেছি, শ্রবণ করুন। ব্রহ্মরূপ মহৎ ঐশ্বৰ্য্য কোন বর্ণে অবস্থান করে এবং লোকে কি প্রকারেই ঐশ্বৰ্য্য হইতে পরিভ্রষ্ট হয়? কাহা হইতে প্রাণীগণ উদ্ভূত হইয়া জীবিত থাকে? জীব কোন্ ফলপ্রভাবে ব্রহ্মস্বরূপ হইয়া অবস্থান করে, আর যে ফলদ্বারা ব্রহ্মলাভ হয়, সেই ফলই বা কোন্ কৰ্ম্ম বা জ্ঞানদ্বারা লাভ করা যায়? আপনি ইহা সবিস্তর কীৰ্ত্তন করুন।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! অতঃপর দানবরাজ বৃত্র ঐ কথা কহিলে মহর্ষি উশনা যাহা কহিয়াছিলেন, তুমি অনুজগণসমভিব্যাহারে অনন্যমনে তাহা শ্রবণ কর।”