২৭৭তম অধ্যায়
ভগিনীর অবমাননায় ক্রুদ্ধ রাবণের সীতাহরণ সঙ্কল্প
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! মারীচ রাক্ষসাধিপতি রাবণকে সমাগত দেখিয়া সসম্ভ্রমে ফলমূলাদি দ্বারা তাঁহার সৎকার করিল। রাবণ তথায় সমাসীন হইয়া কিছুকাল বিশ্রাম করিলে মারীচ তাঁহাকে কহিতে লাগিল, “হে রাক্ষসেন্দ্র! আপনার নগরী লঙ্কা ও প্ৰজাগণের কুশল ত’? প্ৰজাগণ ত’ পূর্ব্বের ন্যায় আপনাকে ভক্তি করিয়া থাকে? কি মনে করিয়া এখানে আগমন করিয়াছেন? আপনি আমাকে যাহা আদেশ করিবেন অতি দুষ্কর হইলেও আমি তাহা অবশ্যই সম্পাদন করিব।”
“রাবণ মারীচের বাক্য-শ্রবণানন্তর তাহার সমীপে রামের সমুদয় বৃত্তান্ত সংক্ষেপে কহিলেন। মারীচ রাবণের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে কহিল, “হে মহারাজ! আপনি রামের সহিত বিরোধ করিবেন না। আমি তাঁহার পরাক্রম বিশেষরূপে জ্ঞাত আছি। এই ভূমণ্ডলে এমন কোন ব্যক্তি নাই যে, দাশরথির বাণবেগ সহ্য করিতে পারে। তিনি আমার এই প্ৰব্ৰজ্যার একমাত্র হেতু। কোন দুরাত্মা আপনাকে মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে উপদেশ প্ৰদান করিয়াছে?”
“দশানন মারীচের বাক্য-শ্রবণে একেবারে ক্ৰোধে অধীর হইয়া তাহাকে ভৎসনাপূর্ব্বক কহিলেন, “যদি তুমি আমার আদেশানুসারে কাৰ্য্য না কর, তাহা হইলে অবশ্যই তোমাকে সংহার করিব। তখন মারীচ মনে মনে চিন্তা করিল, “রামের হস্তে হউক বা রাবণের হস্তে হউক, আমার মরণ অবশ্যই হইবে, সন্দেহ নাই। কিন্তু দুরাত্মার হস্তে প্ৰাণত্যাগ করা অপেক্ষা সাধুলোকের হস্তে মৃত্যু হওয়াই শ্ৰেয়ঃ, অতএব আমি দুরাত্মা রাবণের বাক্যানুসারে কাৰ্য্য করিব।” মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া রাবণকে কহিল, “হে রাক্ষসরাজ! আপনার কি অভিলাষ সম্পাদনা করিতে হইবে, বলুন, আমার ইচ্ছা না থাকিলেও আমি তাহা সম্পন্ন করিব।”
“রাবণ কহিলেন, “হে মারীচ! তুমি রত্নশৃঙ্গ ও রত্নরোমসম্পন্ন মৃগরূপ ধারণপূর্ব্বক সীতার সমীপে গমন করিয়া তাহাকে প্রলোভিত কর। সীতা তোমাকে দেখিয়া অবশ্যই তোমার আনয়নার্থ রামকে প্রেরণ করবে। রাম দূরপ্রদেশে গমন করিলে আমি অনায়াসেই সীতাকে বশীভূত করিয়া আনয়ন করিতে পারিব। রাম সীতার বিয়োগে অবশ্যই প্ৰাণত্যাগ করিবে। হে মারীচ! তুমি আমার এই অভিলাষ সম্পাদন কর।”
মারীচের স্বর্ণমৃগরূপধারণ—সীতার অনুরোধে রামের মৃগানুসরণ
“মারীচ রাবণের বাক্য-শ্রবণানন্তর স্বীয় ঔর্দ্ধদেহিক কাৰ্য্য সমাপনপূর্ব্বক রাবণের অনুগমন করিল। পরে তাঁহারা দুইজনে রামের আশ্ৰম-সমীপে গমনপূর্ব্বক পূর্ব্বকৃত মন্ত্রণারূপ কাৰ্য্য করিতে লাগিলেন। রাবণ কুণ্ডল ও ত্ৰিদণ্ডধারী মুণ্ডিতমুণ্ড যতির বেশ ধারণ করিলেন। মারীচ রাবণের আদেশানুরূপ মৃগরূপ ধারণপূর্ব্বক বৈদেহী-সন্নিধানে গমন করিল। দৈবনির্ব্বন্ধ অখণ্ডনীয়, সীতা সেই অপূর্ব্ব মৃগরূপ-সন্দর্শনে মুগ্ধ হইয়া তাহার আনয়নার্থ রামকে বারংবার অনুরোধ করিতে লাগিলেন। ভগবান রুদ্র যেমন তারামৃগের প্রতি ধাবমান হইয়াছিলেন, তদ্রূপ রাম সীতার প্রিয়কার্য্যানুষ্ঠানের নিমিত্ত লক্ষ্মণকে তাঁহার রক্ষণে নিযুক্ত করিয়া শর, শরাসন, তূণীর ও অঙ্গুলিত্র গ্রহণপূর্ব্বক সেই মায়ামৃগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। মৃগরূপী মারীচ ক্ষণে ক্ষণে অন্তর্হিত ও ক্ষণে ক্ষণে রামের নয়ন-গোচর হইতে লাগিল। “মহাবীর দাশরথি এইরূপে মায়ামৃগের অনুসরণপূর্ব্বক ক্ৰমে ক্ৰমে অতিদূরতর প্রদেশে উপনীত হইলেন। অনন্তর তিনি ঐ মৃগকে নিশাচর বলিয়া বোধ করিয়া অমোঘ অস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক ঐ দুষ্ট নিশাচরের প্রাণসংহার করিলেন। নিশাচর মারীচ মরণসময়ে রামের স্বরসদৃশ স্বরে উচ্চৈঃস্বরে ‘হা সীতে! হা লক্ষণ!’ বলিয়া ক্ৰন্দন করিতে লাগিল।
“বৈদেহী রাক্ষসের করুণস্বর-শ্রবণে রামের অনিষ্টাশঙ্কা করিয়া সাতিশয় ব্যাকুলিতচিত্তে সেই শব্দানুসারে ধাবমান হইলেন। তখন লক্ষ্মণ তাঁহাকে কহিলেন, “ভীরু! কোন শঙ্কা করিও না; রামকে প্রহার করা কাহার সাধ্য? তুমি মুহুর্ত্তকালমধ্যে পুনরায় ভৰ্ত্তার মুখচন্দ্র নিরীক্ষণ করিবে।”
“সীতা লক্ষ্মণের বাক্য-শ্রবণানন্তর রোদন করিতে লাগিলেন এবং স্ত্রী-স্বভাবসুলভ লঘুতাপ্রভাবে লক্ষ্মণের দুরভিসন্ধি সন্দেহ করিয়া পরুষবাক্যে কহিতে লাগিলেন, ‘রে মূঢ়! তুই মনে মনে যে অভিলাষ করিয়াছিস, তাহা কখনই সিদ্ধ হইবে না। আমি বরং অস্ত্রাঘাতে, কি গিরিশৃঙ্গ হইতে পতনপূর্ব্বক অথবা হুতাশনে প্ৰবেশ করিয়া প্ৰাণপরিত্যাগ করিব, তথাপি জীবিতনাথকে পরিত্যাগ করিয়া তোর বশীভূত হইব না। অরে মূর্খ। ব্যাঘ্রী কি কখন শৃগালকে ভজনা করে?”
“পরমধার্ম্মিক রামপ্রিয় লক্ষ্মণ বৈদেহীর তাদৃশ্য অসদৃশ বাক্যশ্রবণে কর্ণদ্বয় আচ্ছাদনপূর্ব্বক রামসন্নিধানে প্রস্থান করিলেন। তিনি রামের চরণচিহ্ন অনুসারে গমন করিয়া ক্রমে ক্রমে জানকীর দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলেন।
কপটসন্ন্যাসিরূপী রাবণের সীতাহরণ
“এদিকে যতিবেশধারী দশানন সময় বুঝিয়া সীতাকে হরণ করিবার মানসে ভস্মাচ্ছন্ন হুতাশনের ন্যায় তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। ধর্ম্মপরায়ণা বৈদেহী তাঁহাকে অৰলোকন করিয়া ফলমূলাদি ভক্ষণ করিতে আমন্ত্ৰণ করিলেন। রাবণ তৎসমুদয় পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বকীয় রূপ গ্ৰহণ করিয়া সীতাকে সাত্ত্বনাবাক্যে কহিলেন, “অয়ি সীতে! আমি রাক্ষসকুলের অধিপতি, আমার নাম রাবণ; পয়োনিধিপারে লঙ্কানামী পরমরমণীয় পুরী আমার রাজধানী। তুমি তথায় গমন করিয়া নরনারীগণের মধ্যে আমার সহিত শোভিত হইবে। হে সুশ্রোণি! তুমি আমার প্রণয়িনী হও; তপস্বী রাঘবকে পরিত্যাগ কর।”
“পতিব্ৰতা জানকী রাবণের মুখে ঐ সমুদয় বাক্য-শ্রবণে কর্ণে হস্তপ্রদান করিয়া কহিলেন, যদি নক্ষত্ৰসমবেত স্বৰ্গ ভূতলে পতিত হয়, যদি পৃথিবী খণ্ড খণ্ড হইয়া যায়। আর, যদি অগ্নি শীতল হয়, তথাপি আমি রঘুনন্দনকে পরিত্যাগ করিব না। করেণু মদস্রাবী হস্তীকে ভজনা করিয়া কি শূকরকে স্পর্শ করিতে পারে? যে কামিনী মাধ্বীকে মধুমাধ্বী পান করিয়া থাকে তাহার কি কখন কাঞ্জিকে শ্রদ্ধা হয়?”
“সীতা রাবণকে এই কথা বলিয়া ক্ৰোধাভরে স্ফুরিতাধর হইয়া করদ্বয় কম্পন করিতে করিতে আশ্রমমধ্যে প্রবেশ করিলেন। রাবণ দ্রুতবেগে তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া অতি রুক্ষবাক্যে ভৎসনা করিয়া তাঁহার কেশকলাপ গ্রহণপূর্ব্বক উৰ্দ্ধমার্গে গমন করিলেন। সীতা রাক্ষসের হস্তে পতিত ও তৎকর্ত্তৃক সাতিশয় নিপীড়িত হইয়া “রাম রাম” বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। সেই সময় গিরিনিবাসী গৃধ্ররাজ জটায়ু তাঁহাকে তদবস্থাপন্ন অবলোকন করিলেন।”