২৭৭তম অধ্যায়
কালগতিপ্রদর্শনে ধৰ্ম্মের উপাসনার উদ্বোধ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! এই সৰ্ব্বলোকভয়াবহ কাল ক্রমশঃ অতীত হইতেছে, অতএব এক্ষণে কর্ত্তব্য কি, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! এই উপলক্ষে আমি পিতাপুত্র সংবাদ নামে এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। এক স্বাধ্যায়সম্পন্ন ব্রাহ্মণের মেধাবীনামে এক অতিশয় মেধাবী পুত্র ছিলেন। একদা মোক্ষধৰ্ম্মকুশল মেধাবী স্বাধ্যায়নিরত স্বীয় পিতাকে মোক্ষলাভে অক্ষম বিবেচনা করিয়া তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “তাত! মানবগণের সহিত কাল অতি সত্বর অতিবাহিত হইতেছে। বিদ্বান ব্যক্তিরা ইহা অবগত হইয়া কিরূপ অনুষ্ঠান করিবেন? আমি তদনুসারে ধর্ম্মানুষ্ঠান করিব।
“পিতা কহিলেন, বৎস! মানবগণ প্রথমতঃ ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমে অবস্থানপূর্ব্বক বেদাধ্যয়ন, পিতৃলোকের পরিত্রাণার্থ পুত্রোৎপাদন ও তৎপরে বহ্নিসংস্থাপনপূর্ব্বক যথানিয়মে যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া পরিশেষে বনে গমন ও মুনিবৃত্তি অবলম্বন করিবেন।‘
“পুত্র কহিলেন, “তাত! যখন লোকসমুদয় নিহত ও সৰ্ব্বতোভাবে সমাক্রান্ত হইতেছে এবং অবিনাশিনী [বিনাশধৰ্ম্মহীনা দিবারাত্রি—দিবার পর রাত্রি ও রাত্রির পর দিবা [বিনাশধৰ্ম্মহীনা দিবারাত্রি—দিবার পর রাত্রি ও রাত্রির পর দিবা] প্রতিনিয়ত গতায়াত করিতেছে, তখন আপনি কিরূপে কিছুমাত্র উদ্বিগ্ন না হইয়া নিশ্চিন্তের ন্যায় বাক্যবিন্যাস করিতেছেন?’
“পিতা কহিলেন, ‘বৎস! কে মানবগণকে নিধন আর কেই বা উহাদিগকে আক্রমণ করিতেছে? যে অবিনাশিনী নিয়ত গমনাগমন করিতেছে, সেই বা কে?
“পুত্র কহিলেন, ‘পিতঃ! মৃত্যু মানবগণকে নিধন, জরা তাহাদিগকে আক্রমণ, আর দিবারাত্রি অবিনাশিনী, উহা নিয়ত গমনাগমন করিতেছে। আপনি কি নিমিত্ত উহা অনুধাবন করিতেছেন না? যখন আমি নিশ্চয় জানিতেছি যে, মৃত্যু কখন কাহাকে পরিত্যাগ করে না, তখন কি নিমিত্ত অজ্ঞানান্ধ হইয়া কালপ্রতীক্ষা করিবে? যখন দিন দিন মানবগণের পরমায়ু ক্ষয় হইতেছে, তখন অল্পসলিলস্থ মৎসের ন্যায় কাহারও সুখপ্রত্যাশা নাই। লোকে যেমন বনমধ্যে একতানমনে পুষ্পচয়ন করিতে আরম্ভ করিয়া পুষ্পচয়ন সমাপ্ত না হইতে হইতেই হিংস্ৰজন্তুকর্ত্তৃক সমাক্রান্ত হয়, তদ্রূপ মনুষ্য অনন্যমনে বিষয়ভোগে প্রবৃত্ত হইয়া ভোগবাসনা পরিতৃপ্ত না হইতে হইতেই মৃত্যুকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া থাকে। যে কাৰ্য্য পরদিনে সম্পন্ন হইতে পারে, তাহা অদ্যই সম্পন্ন করা কর্ত্তব্য এবং যাহা অপরাহ্ণে সম্পন্ন হইতে পারে, তাহা পূর্ব্বাহেই সম্পন্ন করা উচিত। কারণ, কাৰ্য্যসম্পাদন হউক বা না হউক, মৃত্যু কখনই তাহার প্রতীক্ষা করে না। কাহার কোন্ সময়ে মৃত্যু হইবে, তাহা কেহই অবগত নহেন। কার্য্য শেষ না হইলেও মৃত্যু মানবগণকে আক্রমণ করিয়া থাকে; অতএব যাহা কৰ্ত্তব্য, তাহা অদ্যই সম্পাদন করা বিধেয়। বৃদ্ধাবস্থা পর্য্যন্ত অপেক্ষা না করিয়া যৌবনাবস্থাতে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করা উচিত। ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিলে উভয় লোকেই শাশ্বতী প্রীতিলাভ হইয়া থাকে। মানবগণ নিতান্ত মোহাবিষ্ট হইয়াই পুত্ৰদারাদির নিমিত্ত একান্ত যত্নবান হয় এবং অকার্য্য অনুষ্ঠান করিয়া তাহাদিগের সন্তোষসাধন করে। কিন্তু নদী যেমন স্বীয় বেগবলে সুপ্ত ব্যাঘ্ৰকে প্রবাহিত করে এবং বৃকী যেমন মেষকে বলপূৰ্ব্বক লইয়া যায়, তদ্রূপ মৃত্যু সেই বিষয়াসক্ত স্ত্রীপুত্ৰাদিসম্পন্ন মানবগণকে তাঁহার বন্ধুবর্গের নিকট হইতে গ্রহণপূর্ব্বক প্রস্থান করিয়া থাকে। মনুষ্য এই কাৰ্য্য সম্পন্ন করা হইয়াছে, এই কাৰ্য্য করিতে হইবে এবং এই কাৰ্য্যের কিয়দ্দংশ সম্পন্ন হইয়াছে, এই চিন্তা করিতে করিতেই মৃত্যুকর্ত্তৃক সমাক্রান্ত হয়। কাল কি অপ্রাপ্তফল, কি ক্ষেত্র, আপণ ও গৃহকর্ম্মে নিরত, কি দুৰ্ব্বল, কি বলবান, কি প্রাজ্ঞ, কি শূর, কি মূর্খ, কি পণ্ডিত কাহাকেও পরিত্যাগ করে না। যখন মানবগণ প্রতিনিয়ত মৃত্যু, জরা, ব্যাধি এবং বিবিধ কারণসম্ভূত দুঃখকে অতিক্রম করিতে অসমর্থ হইতেছে, তখন আপনি কিরূপে নিশ্চিন্তের ন্যায় অবস্থান করিতেছেন?
‘মনুষ্য জন্মপরিগ্রহ করিবামাত্র জরা ও মৃত্যু তাহাকে আশ্রয় করে। ফলতঃ স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় পদার্থই ঐ উভয়ের বশীভূত। মৃত্যুসৈন্য সমাগত হইলে একমাত্র সত্যবল ব্যতীত কেহই তাহাকে নিবারণ করিতে সমর্থ হয় না। সত্যই অমৃতের আশ্রয়, আর জনপদমধ্যে অবস্থান করিবার অভিলাষই মৃত্যুর আবাসস্বরূপ। এইরূপ শ্রুতি আছে যে, অরণ্যই দেবগণের বাসভূমি এবং নগরমধ্যে অবস্থান করিবার অভিলাষই বন্ধনীরজ্জু [বাঁধিবার দড়ি] স্বরূপ। পুণ্যবান্ ব্যক্তিরা অনায়াসে ঐ বন্ধনীরজ্জুচ্ছেদন করিয়া দেবসেবিত অরণ্য আশ্রয় করিয়া থাকেন; কিন্তু পাপাত্মারা কখনই উহা ছেদন করিতে সমর্থ হয় না। যিনি কায়মনোবাক্যে প্রাণীগণের অনিষ্টাচরণ না করেন এবং যিনি কাহারও জীবিকা অপহরণে প্রবৃত্ত নহেন, তাঁহাকে কখনই কোন প্রাণী হইতে উদ্বেজিত হইতে হয় না। সত্যব্রতপরায়ণ ও শমদমাদি-গুণসম্পন্ন হইয়া কেবল সত্যবলে মৃত্যুকে পরাজয় করা অবশ্য কর্ত্তব্য।
‘এই অনিত্য দেহমধ্যে মৃত্যু ও অমৃত উভয়ই প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। মোহান্ধ হইলেই মৃত্যুলাভ হয় এবং সত্যপথ অবলম্বন করিলেই অমৃতলাভ হইয়া থাকে; অতএব আমি হিংসা ও কামক্রোধপরিশূন্য হইয়া একমাত্র সুখকর সত্যকে অবলম্বনপূৰ্ব্বক অমরের ন্যায় মৃত্যুকে উপহাস করিব এবং দিবাকরের উত্তরায়ণসময়ে শান্তিমার্গ অবলম্বন, বেদাধ্যয়ন এবং কৰ্ম্ম, মন ও বাক্যের সংযমে প্রবৃত্ত হইব। মাদৃশ ব্যক্তির অতি হিংস্র পশুযজ্ঞ অথবা পিশাচের ন্যায় বিনাশকর ক্ষত্রিয়যজ্ঞে দীক্ষিত হওয়া কদাপি বিধেয় নহে। আমি আপনা হইতে আপনি সম্ভূত হইয়াছি; আমার সন্তান নাই। এক্ষণে আমি পুত্রোৎপাদনবাসনা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক আত্মনিষ্ঠ হইয়া পরমাত্মায় জীবাত্মাকে আহুতি প্রদান করিব। পুত্র হইতে কখন আমার পরিত্রাণের সম্ভাবনা নাই। যাঁহার বাক্য ও মন সতত সংযত থাকে এবং তপস্যা, দান ও যজ্ঞই যাঁহার পরমধর্ম্ম, তিনি অনায়াসে ঐ সকল সৎকৰ্ম্মপ্রভাবে সমুদয় মঙ্গললাভ করিতে সমর্থ হয়েন। বিদ্যার সমান চক্ষুঃ ও ফলত্যাগের তুল্য সুখ এবং বিষয়স্পৃহার সমান দুঃখ আর কিছুই নাই। একাগ্রতা, সৰ্ব্বভূতে সমভাব, সত্য, স্বধৰ্ম্মে অবস্থান, দণ্ড পরিত্যাগ, সরলতা ও কার্য্যবিরতি এই সমুদয় ব্রাহ্মণের পরম ধন। হে তাত! যখন আপনাকে নিশ্চয়ই কালকবলে নিপতিত হইতে হইবে, তখন আপনি কি নিমিত্ত বৃথা ধন, বন্ধুবান্ধব ও পুত্ৰদারাদির নিমিত্ত অভিলাষ করিতেছেন? এক্ষণে এই দেহমন্দির প্রবিষ্ট আত্মাকে অনুধ্যান করুন। আপনার পিতা ও পিতামহ প্রভৃতি পুরুষগণ কোথায় গিয়াছেন?”
“হে ধৰ্ম্মরাজ! জ্ঞানবান পুত্র এই কথা কহিলে তাঁহার পিতা তাঁহার বাক্যে আস্থা প্রদর্শনপূৰ্ব্বক সত্যধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, এক্ষণে তুমিও সেইরূপ সত্যধর্ম্মপরায়ণ হইয়া পরমসুখে কালাতিপাত কর।”