২৭৬তম অধ্যায়
রামের রাজ্যাভিষেক-মন্ত্রণা
রাজা যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভগবন্! আপনি রামচন্দ্র প্রভৃতি ভ্ৰাতৃচতুষ্টয়ের জন্মবৃত্তান্ত কীর্ত্তন করিলেন, এক্ষণে রাম, লক্ষণ ও জনকদুহিতা সীতা কি কারণে অরণ্যে গমন করিয়াছিলেন, তাহারও আনুপূর্ব্বিক বর্ণন করুন।”
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! ধর্ম্মনিরত বৃদ্ধিজনমতাবলম্বী রাজা দশরথ অপত্যলাভ করিয়া পরামপ্রীত ও প্রফুল্ল হইলেন। তাঁহার পুত্রেরা বিমল শশিকলার ন্যায় দিন দিন পরিবর্দ্ধিত হইয়া সমুদয় বেদ ও সরহস্য ধনুর্ব্বেদ সম্পূর্ণ অধিকার লাভ করিলেন। তাঁহারা ব্ৰহ্মচৰ্য্যব্রত সাধন করিলে রাজা দশরথ তাঁহাদিগের বিবাহ-সংস্কার নির্ব্বাহ করিয়া যৎপরোনাস্তি সুখী হইলেন। অনন্তর সর্ব্বজ্যেষ্ঠ রাম রমণীয় গুণগ্রামে প্রজাপুঞ্জের মনোরঞ্জন করিতে লাগিলেন।
“মত্তমাতঙ্গগামী কমললোচন রামের বাহুযুগল আজানুলম্বিত; কেশ্যকলাপ নীল ও কুঞ্চিত; বক্ষঃস্থল অতি বিশাল। তিনি সর্ব্বশাস্ত্রবিশারদ, সর্ব্বধর্ম্মবেত্তা, অসতের নিয়ন্তা, ধার্ম্মিকের রক্ষক, বৃহস্পতিতুল্য বুদ্ধিমান এবং শক্রগণেরও প্রিয়দর্শন ছিলেন। রাজা দশরথ সেই অধৃষ্য ও অপরাজিত রঘুনাথকে নিরীক্ষণ ও তাঁহার গুণসমূহ চিন্তা করিয়া পরমপ্রীতি লাভ করিতে লাগিলেন।
“এইরূপে কিয়ৎকাল অতীত হইলে রাজা দশরথ আপনাকে জরাজীর্ণ বৃদ্ধ বিবেচনা করিয়া ধর্ম্মপরায়ণ মন্ত্রী ও পুরোহিতগণের সহিত রামের যৌবরাজ্যাভিষেকের নিমিত্ত মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন। মন্ত্রিগণ পরস্পর পরামর্শ করিয়া রাজ্যাভিষেকের সমুচিত অবসর উপস্থিত হইয়াছে, ইহা অবধারণ করিলেন।
“অনন্তর রাজা দশরথ প্রীতমনে পুরোহিতকে কহিলেন, “অদ্য পুষ্যানক্ষত্র ও পবিত্ৰ যোগযুক্ত রজনী; অতএব আপনি রামকে এই বিষয় অবগত করিয়া অভিষেকোপযোগী দ্রব্যসম্ভার আহরণ করুন।” মন্থরা ভূপালমুখে এই সংবাদ শ্রবণমাত্র সত্বর কৈকেয়ীর নিকট উপস্থিত হইয়া কহিল, “দেবি! তোমার নিতান্ত দূরদৃষ্ট; ভীষণ অজগর ক্রুদ্ধ হইয়া এখনই তোমাকে দংশন করুক। কৌশল্যার অদৃষ্ট প্রসন্ন হইয়াছে; তাহার পুত্র অনতিকালমধ্যেই যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইবে। মহারাজ তোমার পুত্ৰকে কখন রাজ্যাধিকারী করিবেন না; সুতরাং তোমার সৌভাগ্য আর কোথায় রহিল? উহা এককালে বিলুপ্ত হইয়া গেল।”
পিতৃসত্যপালনে রামের বনগমন
“কৈকেয়ী এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র বিচিত্ৰ বসনভূষণে বিভূষিত হইয়া দ্রুতগমনে নির্জ্জনে ভূপাল-সন্নিধানে উপনীত হইলেন এবং সহাস্যমুখে প্রণয় প্রকাশপূর্ব্বক মধুর-বাক্যে কহিলেন, ‘মহারাজ! তুমি পূর্ব্বপ্রতিশ্রুত বরদ্বয় প্রদান করিয়া আমাকে মহাসঙ্কট হইতে পরিত্ৰাণ কর।” রাজা দশরথ কহিলেন, ‘হে সুন্দরি! আমি এক্ষণে বরপ্রদানে সম্মত আছি। তুমি অবিলম্বেই স্বাভিলষিত বর প্রার্থনা কর। আমি পৃথিবীর রাজাধিরাজ এবং বর্ণচতুষ্টয়ের রক্ষক; বল, কোন অবধ্যকে বধ বা কোন বধ্যকে বিমুক্ত করিব? আমার যে কিছু ধন আছে, বল, কাহাকে প্ৰদান করিব অথবা ব্ৰহ্মস্ব ব্যতিরেকে কাহার ধন অপহরণ করিয়া লইব?”
“তখন কৈকেয়ী রাজার প্রসন্নভাব নিরীক্ষণ করিয়া স্বীয় ক্ষমতানুসারে কহিলেন, “মহারাজ! তুমি রামের রাজ্যাভিষেকসাধনাৰ্থ যে দ্রব্যসম্ভার আহরণ করিয়াছ, তাহাদ্বারা আমার পুত্র ভরতের অভিষেক হউক আর রাম অরণ্যে প্রস্থান করুক।” রাজা কৈকেয়ীমুখে এই নিদারুণ দুর্ব্বিষহ বাক্য শ্রবণপূর্ব্বক একান্ত দুঃখিত হইয়া কিছুমাত্র বলিলেন না।
“অনন্তর মহানুভব রাম, পিতা এইরূপ বচনবদ্ধ হইয়াছেন, ইহা সবিশেষ বিদিত হইয়া তাঁহার সত্যরক্ষাৰ্থ বনপ্রস্থান করিলেন। ধনুৰ্দ্ধর লক্ষ্মণ ও জনকদুহিতা সীতা তাঁহার অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলেন। পরে রাজা দশরথ পুত্ৰবিরহে নিতান্ত কাতর হইয়া কলেবর পরিত্যাগ করিলেন।
“অনন্তর কৈকেয়ী ভারতকে নন্দীগ্রাম হইতে আনয়ন করিয়া কহিলেন, “বৎস! রাজা তনুত্যাগপূর্ব্বক স্বৰ্গে গমন করিয়াছেন; রাম ও লক্ষ্মণ বনপ্রস্থান করিয়াছেন; এক্ষণে ভরত কহিলেন, ‘কুলপাংসনে তুমি কি কুকর্ম্মই করিয়াছ! ধনলাভ-লোভে ভর্ত্তৃবিনাশ ও সূৰ্য্যবংশ উৎসন্ন করিলে। লোকে এ বিষয়ে আমারই অযশ ঘোষণা করিবে; এক্ষণে তোমার বাসনাসকল সম্যক সফল হইল।” এই বলিয়া ভরত অবিরল বাষ্পাকুললোচনে রোদন করিতে লাগিলেন।
“পরে তিনি প্ৰজাদিগের নিকট আপনার নির্দেষিতা সপ্রমাণ করিয়া জ্যেষ্ঠভ্রাতা রামকে প্রত্যায়ন করিবার অভিলাষে কৌশল্যা, সুমিত্রা ও কৈকেয়ীকে সুসজ্জিত যানে অগ্ৰে প্রেরণ করিলেন; পশ্চাৎ বশিষ্ঠ ও বামদেব প্রভৃতি শতসহস্র ব্রাহ্মণ, পৌর ও জনপদবৰ্গপরিবৃত হইয়া শত্রুঘ্নের সহিত স্বয়ং যাত্রা করিলেন; চিত্ৰকূটপর্ব্বতে তাপস বেশধারী ধনুৰ্দ্ধর রঘুনাথকে নিরীক্ষণ করিয়া প্রত্যানয়নাৰ্থ বারংবার অনুরোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু রাম পিতার আদেশে বনবাসই শ্রেয়ষ্কর বিবেচনা করিয়া ভ্রাতা ভরতকে প্ৰতিগমনে অনুমতি প্ৰদান করিলেন।
“অনন্তর ভরত নন্দিগ্রামে তদীয় পাদুকাযুগল পুরষ্কৃত করিয়া স্বয়ং সমস্ত রাজকাৰ্য্য পৰ্য্যালোচনা করিতে লাগিলেন। রামও তথায় পৌরগণের পুনরাগমন আশঙ্কা করিয়া এক মহারণ্যে প্রবেশপূর্ব্বক মহর্ষি শরভঙ্গের আশ্রমে উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে সৎকার করিয়া দণ্ডকারণ্যে গমন করিলেন ও তথায় গোদাবরী নদী নিরীক্ষণ করিয়া পরমসুখে বাস করিতে লাগিলেন। তথায় জনস্থান-নিবাসী রাক্ষস খরের সহিত রামের শূৰ্পণখামূলক ঘোরতর সংগ্রাম উপস্থিত হইল। ধর্ম্মবৎসল রাম তাপসাগণের রক্ষার্থ চতুর্দ্দশ সহস্র রাক্ষসকে সংহার ও মহাবলপরাক্রান্ত খরদূষণকে বিনাশ করিয়া সেই ধর্ম্মরণ্য নিষ্কণ্টক করিলেন।
রামের দণ্ডকারণ্যবাস-শূৰ্পণখার নাসিকাকর্ত্তন
“অনন্তর শূৰ্পনখা ছিন্ননাসা ও ছিন্নোষ্ঠী হইয়া লঙ্কাধিনাথ রাবণের নিকট গমনপূর্ব্বক দুঃখে নিতান্ত বিহ্বল হইয়া তাঁহার চরণে নিপতিত হইল। বীর্যবর রাবণ ভগিনীকে তাদৃশ বিরূপীকৃত অবলোকনপূর্ব্বক ক্ৰোধে প্ৰজ্বলিত হইয়া দশনে দশন নিপীড়নপূর্ব্বক সত্বর সিংহাসন হইতে উত্থিত হইলেন এবং অমাত্যবৰ্গকে পরিত্যাগ করিয়া নির্জ্জনে শূৰ্পণখাকে কহিলেন, “হে শূৰ্পনখে! আমাকে অবমাননা করিবার জন্য কে তোমাকে এরূপ বিরূপ করিল? কোন ব্যক্তি তীক্ষ্ন শূলদ্বারা আপনার শরীর বিদ্ধ করিয়াছে? কোন ব্যক্তি মস্তকে বহ্নি সংস্থাপনপূর্ব্বক বিশ্বস্তমনে শয়ন করিয়া আছে? কোন ব্যক্তি মহাঘোর ভুজঙ্গকে চরণদ্বারা স্পর্শ করিতেছে? কোন ব্যক্তিই বা মহাবলপরাক্রান্ত কেসারীর দর্শন স্পর্শ করিয়া নিঃশঙ্কচিত্তে অবস্থান করিতেছে?”
“নিশাকালে বৃক্ষরন্ধ্র যাদৃশ তেজ নির্গত হইয়া থাকে, তদ্রূপ সেই সময়ে রাবণের চক্ষুরাদি ইন্দ্ৰিয়দ্বার হইতে অনবরত অগ্নিকণা নিৰ্গত হইতে লাগিল। তখন শূৰ্পণখা খরদূষণবধ প্রভৃতি রাক্ষসগণের পরাভব পৰ্যন্ত আদ্যোপান্ত রামবিক্রমবৃত্তান্ত বর্ণন করিতে লাগিল। অনন্তর রাবণ কর্ত্তব্যাধারণপূর্ব্বক ভগিনীকে সাত্ত্বনা ও মন্ত্রিহস্তে নগরের রক্ষাভার সমর্পণ করিয়া অন্তরীক্ষে উত্থিত হইলেন। পরে ত্ৰিকূট ও কালপর্ব্বত অতিক্রম করিয়া অতি গভীর তিমিমকরসঙ্কুল সাগর নিরীক্ষণপূর্ব্বক অনায়াসে উল্লঙ্ঘন করিয়া ভগবান শূলপাণির প্রিয়তর গোকৰ্ণস্থানে উপস্থিত হইলেন। যে স্থানে তদীয় পূর্ব্বামাত্য মারীচ রামভয়ে নিতান্ত ভীত হইয়া অতি কঠোর তপানুষ্ঠান করিতেছিল, রাবণ সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।”