২৭৪. মোক্ষলাভের উপায়

২৭৪তম অধ্যায়

মোক্ষলাভের উপায়

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি কহিলেন যে উপায়দ্বারাই মোক্ষলাভ করা যায়; অতএব এক্ষণে আপনি মোক্ষলাভের উপায় আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তুমি সতত উপায় অবলম্বন করিয়া সকল বিষয় সম্পন্ন করিতে বাসনা করিয়া থাক; অতএব এই প্রশ্ন করা তোমার উচিত হইয়াছে। যেমন ঘটনির্ম্মাণের সময় লোকের চিকীর্ষাবুদ্ধি [নির্ম্মাণেচ্ছার জ্ঞান—নির্ম্মাণ করিতে যতটুকু বুদ্ধির আবশ্যক] উহার কারণ হয় এবং ঘট নির্ম্মিত হইলে বুদ্ধি তিরোহিত হইয়া যায়, তদ্রূপ ধৰ্ম্মসাধনের সময় চিকীর্ষ বুদ্ধি উহার কারণ হইয়া পরিশেষে যোগাদিনিষ্ঠ মোধৰ্ম্মের সিদ্ধিলাভ হইলে সেই বুদ্ধি অন্তর্হিত হয়। যেমন পূৰ্ব্বমহাসাগরে গমন করিবার পথ অবলম্বন করিয়া পশ্চিমসাগরে গমন করা যায় না, তদ্রূপ অন্যান্য ধর্ম্মের পথ অবলম্বন করিলে কখনই মোক্ষ ধর্ম্মলাভে সমর্থ হওয়া যায় না। ঐ ধৰ্ম্মের একমাত্র পথ বিদ্যমান আছে। এক্ষণে সেই পথ বিস্তারিতরূপে কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

“ক্ষমাবলে ক্রোধ, সঙ্কল্প পরিত্যাগদ্বারা কামনা, সত্যগুণের অনুশীলনদ্বারা নিদ্রা, সাবধানতাদ্বারা লজ্জা, আত্মচিন্তাপ্রভাবে নিশ্বাস-প্রশ্বাস, ধৈৰ্য্যগুণে কাম ও দ্বেষ, তত্ত্বজ্ঞানপ্রভাবে ভ্রমপ্রমাদ ও বিষয়বাসনা, জ্ঞানাভ্যাসপ্রভাবে অনুসন্ধান ও অকাৰ্য্য পর্য্যালোচনা, পরিমিত পরিমাণে হিতকর ও লঘুপাক বস্তুর ভোজনদ্বারা শারীরিক ক্লেশ, সন্তোষপ্রভাবে লোভ ও মোহ, দয়াপ্রভাবে অধৰ্ম্ম, নিয়ত অনুষ্ঠানদ্বারা ধৰ্ম্ম, অদৃষ্টপৰ্য্যালোচনা দ্বারা আশা, স্পৃহাপরিত্যাগদ্বারা অর্থ সমুদয় বস্তু অনিত্য বিবেচনা করিয়া স্নেহ, যোগপ্রভাবে ক্ষুধা, কারুণ্যদ্বারা আত্মাভিমান, উদ্যোগদ্বারা তন্দ্রা, বেদপ্রত্যয়দ্বারা আশঙ্কা পরাজয় করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। প্রথমতঃ বুদ্ধিবলে বাক্য ও মনকে সংযত করিয়া জ্ঞানচক্ষুদ্বারা সেই বুদ্ধিকে বশীভূত করিবে। তৎপরে আত্মজ্ঞানপ্রভাবে সেই জ্ঞানকে আয়ত্ত করিয়া পরিশেষে জীবাত্মাকে পরমাত্মা বলিয়া জ্ঞান করিবে। শান্তি ও নিষ্কামধৰ্ম্মদ্বারা পরমাত্মাকে পরিজ্ঞাত হওয়াই সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। পণ্ডিত ব্যক্তিরা কাম, ক্রোধ, লোভ, ভয় ও স্বপ্ন এই পাঁচটিকে যোগানুষ্ঠানের অন্তরায় বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। অতএব ঐ সমুদয় পরিত্যাগ, যোগসাধনের উপায়ভূত দান, ধ্যান, অধ্যয়ন, সত্য, লজ্জা, সরলতা, ক্ষমা, চিত্তশুদ্ধি, আহারশুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়সংযমকে অবলম্বন করাই বিধেয়। ঐ সমুদয় অবলম্বন করিলে তেজ পরিবর্দ্ধিত, পাপ নিহত [দূরীভূত], সঙ্কল্পসমুদয় সুসিদ্ধ এবং বিবিধ বিজ্ঞান সমুৎপন্ন হইয়া থাকে। নিষ্পাপ, তেজস্বী, অল্পাহারনিরত, জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা কামক্রোধকে বশীভূত করিয়া ব্রহ্মপদলাভের বাসনা করেন। ফলতঃ কায়, মন ও বাক্যের সংযম এবং মূঢ়তা, বিষয়স্পৃহা, কাম, ক্রোধ, দীনতা, অহঙ্কার, উদ্বেগ এবং গৃহাবস্থানস্পৃহাপরিত্যাগ [গৃহবাসের আসক্তিত্যাগ], এই সমুদয় মোক্ষলাভের প্রধান উপায়।”