২৭২. অহিংস যজ্ঞের প্রশংসা

২৭২তম অধ্যায়

অহিংস যজ্ঞের প্রশংসা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! বিবিধ যজ্ঞের মধ্যে যে যত কেবল বিশুদ্ধ ধর্ম্মলাভাৰ্থ অনুষ্ঠিত হয়, আপনি আমার নিকট তাহার স্বরূপ কীৰ্ত্তন করুন। স্বর্গাদিফলসাধক অন্যান্য যজ্ঞের : বিষয় শ্রবণ করিতে আমার অভিলাষ নাই।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! পূর্ব্বে তপোধনাগ্রগণ্য মহাত্মা নারদ যজ্ঞবিষয়ে উঞ্ছবৃত্তি সত্যনামা ব্রাহ্মণের যে পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, এক্ষণে তোমার নিকট তাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। ধৰ্ম্মপ্রধান বিদর্ভনগরে সত্যনামে এক উঞ্ছবৃত্তি ব্রাহ্মণ অবহিতচিত্তে যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতেন। তিনি শ্যামাক [শ্যামাধান্য], সূৰ্য্যপর্ণী [আকনপাতা], সুবর্চ্চলা ও অন্যান্য তিক্ত ও বিরস শাকসমুদয় ভক্ষণ করিতেন; কিন্তু তাঁহার তপোবলে ঐ সমুদয় অতি সুস্বাদু হইত। তিনি বানপ্রস্থাশ্রমী ছিলেন এবং দরিদ্রতানিবন্ধন পশ্বাদি লাভ করিতে না পারিয়া ফলমূলকে পশ্বাদির স্বরূপ করিয়া তদ্বারাই হিংসাপ্রধান স্বর্গসাধন যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতেন। পুষ্করধারিণীনামে তাঁহার এক পবিত্রস্বভাবা উপবাসাদিব্রতকৃশা পত্নী ছিলেন, তিনি গলিত[স্বয়ংস্থালিত] ময়ূরপুচ্ছ পরিধান করিতেন। যদিও ঐ কামিনী স্বীয় ভর্ত্তার মানসিক বৃত্তি হিংসাময় অবগত হইয়া তাঁহার কার্য্যের আনুকুল্য করিতে নিতান্ত অনিচ্ছুক ছিলেন, তথাপি তাঁহাকে শাপভয়ে স্বামীর স্বভাবের অনুবর্ত্তিনী হইয়া হিংসাময় যজ্ঞে লিপ্ত হইতে হইত।

“একদা এই ব্রাহ্মণ যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলে তাঁহার সহচর ধৰ্ম্ম মৃগরূপ ধারণপূৰ্ব্বক সমীপস্থ হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, সত্য! তুমি অঙ্গহীন যজ্ঞের অনুষ্ঠানপূৰ্ব্বক অতি দুষ্কৰ্ম্ম করিতেছ। এক্ষণে আমাকে অনলে আহুতি প্রদান কর, তাহা হইলেই অনায়াসে স্বর্গারোহণ করিতে সমর্থ হইবে।’ মৃগ এই কথা কহিবামাত্র সাবিত্রী মূর্ত্তিমতী হইয়া তথায় আগমনপূৰ্ব্বক সেই ব্রাহ্মণকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! ইনি তোমার সহচর, ইহাকে বিনাশ করা তোমার কখনই কর্ত্তব্য নহে। হায়! যজ্ঞে কি অকাৰ্য্যই অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে।’ দেবী সাবিত্রী এই বলিয়া পাতালতল অবলোকন করিবার নিমিত্ত যজ্ঞীয় হুতাশনে প্রবেশ করিলেন। তখন সেই মৃগ কৃতাঞ্জলিপুটে সত্যের নিকট বারংবার আপনার বধপ্রার্থনা করিতে লাগিল; কিন্তু সত্য তাহার বাক্যে সম্মত না হইয়া তাহাকে আলিঙ্গনপূৰ্ব্বক কহিলেন, তুমি অবিলম্বে এ স্থান হইতে প্রস্থান কর। তখন সেই মৃগ অষ্টপদমাত্র গমনপূর্ব্বক পুনরায় প্রতিনিবৃত্ত হইয়া কহিল, ‘ব্রহ্মন্! আপনি আমাকে বিনাশ করুন। আমি যজ্ঞে নিহত হইয়া অনায়াসেই সদ্‌গতি লাভ করিতে পারি। এক্ষণে আপনি মৎপ্রদত্ত দিব্যচক্ষুদ্বারা ঐ অম্বরস্থিত গন্ধৰ্ব্বগণের বিচিত্র বিমান ও অপ্সরাদিগকে অবলোকন করুন।’ মৃগ এই কথা বলিলে, ব্রাহ্মণ সতৃষ্ণনয়নে অপ্সরা ও বিমানসকল নিরীক্ষণপূৰ্ব্বক স্বর্গভোগে নিতান্ত অভিলাষী হইয়া মৃগকে বধ করাই শ্রেয়ঃ বলিয়া অবধারণ করিলেন। তখন সেই মৃগরূপী ধৰ্ম্ম ব্রাহ্মণের সেই কুপ্রবৃত্তি পরিবর্ত্তিত করিবার মানসে তাঁহাকে কহিলেন, ‘ব্ৰহ্মন্‌! হিংসা করিয়া যজ্ঞানুষ্ঠান করা শ্রেয়স্কর নহে।’ মৃগ এই কথা কহিবামাত্র ব্রাহ্মণের হিংসাপ্রবৃত্তি তিরোহিত হইল; কিন্তু তিনি যে ইতিপুর্ব্বে মনে মনে মৃগবধ চিন্তা করিয়াছিলেন, সেই নিমিত্ত তাঁহার বিস্তর তপঃক্ষয় হইল। অতএব যজ্ঞে পশুহিংসা করা কখনই কৰ্ত্তব্য নহে।

“অনন্তর ভগবান ধৰ্ম্ম মৃগরূপ পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বয়ং সেই ব্রাহ্মণকে যজ্ঞানুষ্ঠান করাইলেন। ব্রাহ্মণও তপঃপ্রভাবে সহধর্ম্মিণীর সহিত একমতাবলম্বী হইলেন। হে ধৰ্ম্মরাজ! আমি তোমাকে সত্য কহিতেছি যে, অহিংসা অতি উৎকৃষ্ট ধর্ম্ম এবং হিংসা অপেক্ষা পাপ আর কিছুই নাই। সত্যবাদীরা অহিংসা ধর্ম্মকেই সাদরে প্রতিগ্ৰহ করিয়া থাকেন।”