সুব্রতকে টেলিফোন করার পর গোপীনাথ সারা ফ্ল্যাটটা ঘুরে বেড়াল আর ভাবল। এই ফ্ল্যাট বা আর কোথাও সে নিরাপদ নয়। তবু রোমে সে যে বিপদের মধ্যে ছিল এখানে সে ততটা বিপদে হয়তো নেই। কারণ, মাফিয়ারা কলকাতায় এসে তেমন কিছু সুবিধে করতে পারবে না। এটা অচেনা শহর। তাদের ভাড়া করতে হবে কলকাতার খুনিয়াদের। সেইটেই হয়তো তার ভরসা। কলকাতার খুনেরা মাফিয়াদের মতো সংগঠিত নয় এবং হয়তো ততটা বুদ্ধিমানও নয়। কাল রাতে যারা হানা দিয়েছিল তারা তো রীতিমতো বোকা। তবে বারবার বোকা বানানো সহজ হবে না। তবু তার ততটা ভয় করছে না, যতটা রোমে হয়েছিল।
ফ্ল্যাটটা তার নিরাপদ মনে হচ্ছে না একটাই কারণে। তার ঠিকানাটা কোনও ভাবে প্রতিপক্ষের জানা হয়ে গেছে। তার কি পালানো উচিত?
গোপীনাথ ফ্রিজ খুলে দেখল, খাবারদাবার বিশেষ কিছু নেই। ব্রেকফাস্টের জন্য পাঁউরুটি, মাখন এবং কিছু ফলটল জাতীয় জিনিস দরকার। কফি এবং চাও কিনতে হবে।
গোপীনাথ পোশাক পরে বেরিয়ে পড়ল। আগে সে রাস্তায় হাঁটত ভাবতে ভাবতে। বরাবরই সে একটু চিন্তাশীল এবং অন্যমনস্ক লোক। কিন্তু জীবনে বিপদ শুরু হওয়ার পর তার অন্যমনস্কতা পালিয়েছে, চিন্তাশীলতায় এসেছে নিয়ন্ত্রণ। সে এখন চারপাশকে লক্ষ করে।
দোকান অবশ্য বেশি দূরে নয়। ফ্ল্যাট ছাড়িয়ে বড় রাস্তার দিকে গেলে পর পর কয়েকটা ভাল দোকান। দু’মিনিটের হাঁটাপথ। এই পথটুকু পেরোনোই আজ কত শক্ত আর সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে। একটা লাল জামা আর কালো প্যান্ট পরা ছোকরা একটা রোগা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে তার দিকে বার দুই তাকাল। গোপীনাথ উলটে ছেলেটির দিকে এমন কঠিন চোখে তাকাল যে, সত্যযুগ হলে ছোকরা ভস্মীভূত হয়ে যেত। দু’জন কৃষ্ণভক্ত গেরুয়াধারী সাহেব তাকে পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত পায়ে। গোপীনাথ খুব ঠাহর করে দেখল তাদের, পিছন থেকে যতটা দেখা যায়।
মাখন পাঁউরুটির দোকান পর্যন্ত আর কিছু ঘটল না বটে, কিন্তু সহজ কাজগুলো যে কত কঠিন হয়ে উঠেছে তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারল সে।
ঘণ্টা দুয়েক বাদে সুব্রত যখন এল তখনও সে সেই কথাটাই বলল।
সুব্রত বলল, কাজ কি আপনার এখানে থাকার? আমার বাড়িতে চলুন।
না রে, আমি এখন বিপজ্জনক মানুষ।
কী যে বলেন। চলুন তো, এমনি লুকিয়ে রাখব যে, কেউ টের পাবে না।
ওরা সব টের পায়।
যাক গে, আমি ভয় খাই না। আপনি চলুন।
ও কথা থাক রে সুব্রত, এখন কাজের কথা বল। রোজমারি আমার ঠিকানা চায় কেন?
স্বার্থেই চায়। তবে মুখে বলছে, আপনাকে সিকিউরিটি দেবে।
কীরকম সিকিউরিটি?
তা জিজ্ঞেস করিনি।
ওর কি কোনও সিকিউরিটি এজেন্সি আছে চেনাজানা?
থাকতেই পারে। ঘ্যামা লোকদের কত কী থাকে।
আমি যে কলকাতায় এসেছি এ খবর রোজমারি পেল কোথায়?
তা তো জানি না।
খোঁজ নে।
নেব। তবে সোমবারের আগে হবে না।
আর একটা কথা। রোজমারির প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হলে আমি ভেবে দেখব।
কেন গোপীদা?
ওর ল্যাবরেটরিটা আমার দরকার।
আপনার বডিগার্ড লাগবে বলছিলেন, সত্যি নাকি?
গোপীনাথ একটু ভেবে বলল, বডিগার্ড ব্যাপারটাই হাস্যকর।
অস্বস্তিকরও। কিন্তু দরকার হলে ব্যবস্থা করতে হবে।
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, আফটার এ সেকেন্ড থট, বডিগার্ডের প্রস্তাব বাতিল করছি।
কেন গোপীদা?
বাঙালি বা ভারতীয় বডিগার্ডের ওপর আমার ভরসা নেই। দ্বিতীয় কথা, বডিগার্ড রাখলে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।
কিন্তু আপনার তো বিপদ।
গোপীনাথ চিন্তিত মুখে বলল, বিপদটাও ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। চিন্তা করিস না। মনে হচ্ছে ক্রাইসিসটা সামলে নিতে পারব।
আপনি রিস্ক নিচ্ছেন গোপীদা।
গোপীনাথ একটু হেসে বলল, একটা নিরাপদ নিশ্চিত জীবন যাপন করার পর এই বিপদের জীবনটা খারাপ লাগছে না কিন্তু। জীবনের একঘেয়ে সাকসেস স্টোরিতে একটা নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। নট ব্যাড।
আপনি খুব অদ্ভুত মানুষ গোপীদা।
গোপীনাথ শুধু একটু হাসল।
সুব্রত বলল, আপনি সোনালিদির কথা কিছু জানতে চাইলেন না তো!
গোপীনাথের মুখখানা উদাস হয়ে গেল, কী-ই বা জানার আছে! আর জেনে হবেটাই বা কী?
সুব্রত একটু রাগের গলায় বলল, অথচ এই তো কিছুদিন আগে আপনি সোনালিদিকে নিজের বিষয়সম্পত্তি দিয়ে দিতে চাইছিলেন।
তখন উপায় ছিল না। আমার তো উত্তরাধিকারী কেউ নেই। সোনালি একসময়ে তো আমার স্ত্রী ছিল, সেই সুবাদে যা একটু সম্পর্কের ছায়া আছে। তা সে তো রিফিউজই করেছে।
সুব্রত মৃদু স্বরে বলল, সোনালিদি রিফিউজ না করলে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা থাকত না। ভদ্রমহিলার আত্মমর্যাদার বোধ খুব টনটনে।
তা হবে। ওসব আলোচনায় আর লাভ কী? ও আমার অফার রিফিউজ করায় আই ফেল্ট ইনসাল্টেড।
কেন গোপীদা, আপনাকে অপমান করার জন্য তো করেননি। ওঁর আত্মমর্যাদায় লেগেছিল বলে নেননি।
হঠাৎ তুই সোনালির সাউকার হয়ে উঠলি কেন? তোকে কি ও উকিল রেখেছে?
সুব্রত হাসল না। গম্ভীর হয়ে বলল, আপনাদের দুজনের মধ্যে কী ঘটেছিল জানি না, কিন্তু আপনাকে বা সোনালিদিকে কাউকেই আমার খারাপ মনে হয় না।
আমিই খারাপ।
কথা এড়িয়ে যাবেন না গোপীদা। কী হয়েছিল বলুন।
গোপীনাথ সামান্য বিরক্ত হল। বলল, এটা কি সেসব কথা বলার সময়? দেখছিস তো কী অবস্থায় আমি আছি।
সুব্রত একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? আমার মনে হচ্ছে আপনার এই বিপদের দিনে আপনার একজন বিশ্বস্ত ও বুদ্ধিমান সঙ্গী দরকার।
গোপীনাথ একটু ব্যঙ্গের সুরে বলল, সেই সঙ্গী কি সোনালি?
নয় কেন?
নয় এই কারণে যে, আমার সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়ে, ব্যস্ততার সময়ে সোনালি আমাকে অপমান করে ছেড়ে চলে এসেছিল। অ্যান্ড শি নেভার লুকড ব্যাক।
কিন্তু কেন এসেছিল গোপীদা?
বোধহয় সে নারীবাদী বা আর কিছু।
আপনি সোনালিদিকে ভাল করে জেনেছেন কি?
চেষ্টা করেছি। স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম বোঝার মতো এলেম আমার নেই।
এটা একটা ক্লিশে।
সোনালি তোকে কত করে ফি দিচ্ছে বল তো।
সোনালিদি ফি দেবেন কেন? তিনি কি আপনার সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করার জন্য লালায়িত?
গোপীনাথ হেসে বলল, লালায়িত কথাটা বেশ বলেছিস। না হয় মানলাম সে লালায়িত নয়। কিন্তু তুই হামলা মাচাচ্ছিস কেন?
আপনার কথা ভেবে।
আমার কথা বেশি ভাবিস না। দুঃখ পাবি। আমাকে খরচের খাতায় ধরে রাখ।
সেটা পেরে উঠছি না। ছেলেবেলা থেকে আপনাকে দেখে আসছি। আপনি আমার আইডল ছিলেন।
গোপীনাথ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, তুই আমার ভাল চাস জানি। কিন্তু সোনালির সঙ্গে আমাকে আর জুড়বার চেষ্টা করিস না, কারণ, স্বামী হিসেবে আমি কোনও মেয়েরই যোগ্য নই। মেয়েদের একটা পারিবারিক জীবন চাই, তাদের কিছু সেন্টিমেন্টাল চাহিদাও থাকে, যেটা একেবারেই অন্যায্য নয়। কিন্তু আমি ভেবে দেখেছি, ওসব আমার দ্বারা হওয়ার নয়। কিছু মানুষ থাকে যাদের ঘরে সেট করা যায় না, তারা অ্যাডজাস্টমেন্টে আসতে জানেই না।
সুব্রত মৃদু হেসে বলল, যার নিজের সম্পর্কে অ্যাসেসমেন্ট এত ক্লিয়ারকাট সে তো ইচ্ছে করলেই এই অসুবিধেটা টপকে ফেলতে পারে।
গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পারলাম কই?
একটু চেষ্টা করলে পারতেন না?
গোপীনাথ ম্লান হেসে বলল, তুই হয়তো জানিস না সোনালির সন্দেহবাতিক ছিল সাংঘাতিক। তার ধারণা হয়েছিল আমার সঙ্গে বিভিন্ন মেয়েমানুষের সম্পর্ক আছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। ইউরোপে একা ব্যাচেলর মানুষ থাকতাম, মহিলাসংসর্গ হয়নি বলি কী করে? কিন্তু সেগুলো প্রাক-বিবাহ যুগে। পরে কাজের চাপে আর নেশায় আমার অন্য সব বোধই চলে যায়।
সোনালিদির সন্দেহ কি অমূলক?
মাথা নেড়ে গোপীনাথ বলল, তাও বলছি না। তবে এ প্রসঙ্গটা বাদ দিলেই ভাল করবি। দেয়ার ওয়াজ এ হেল অফ মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিংস। আমি কাউকে দোষ দিই না।
সোনালিদি কিন্তু অত্যন্ত রিজার্ভড মহিলা, উইথ পারসোনালিটি।
জানি।
আমার মনে হয় আপনি সোনালিদিকে খুব ভাল করে এখনও জানেন না। তাও হতে পারে। কিন্তু ডোন্ট ট্রাই রিকনসিলিয়েশন। ইট মে হার্ট ইউ। এখন রোজমারি আর মনোজের কথা বল। এরা কেমন লোক?
রোজমারি বুদ্ধিমতী।
আর মনোজ কি গাধা?
তা বলছি না। তবে মনোজ ক্রাইসিস ম্যান নন। বিজনেস ব্রেনও নেই।
খুব স্বাভাবিক। সেটা আমারও নেই।
আর একটা কথা।
বল।
শুভ নামে রোজমারির একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে। বাচ্চা ছেলে। সে আমার ঘরে এসে মাঝে মাঝে আড্ডা মারে।
সে কিছু বলেছে?
হ্যাঁ। সে বলেছে রোজমারি নাকি প্রায়ই সিঙ্গাপুরে যায়।
সেখানে কী আছে?
একজন আত্মীয় থাকে। বোধহয় বোনটোন হবে। কিন্তু সেটা কথা নয়। কথা হল, শুভ দেখেছে একটা লোক রোজমারির সঙ্গে একই ফ্লাইটে যায় এবং আসে। কিন্তু রোজমারির চেনা লোক নয়।
বটে!
লোকটা বেঁটে, ফরসা এবং স্বাস্থ্যবান। শুভ তাকে বশ্বের নাম দিয়েছে। লোকটাকে শুভ একদিন ফলোও করে। কিন্তু চিৎপুরের একটা বাড়িতে ঢুকে লোকটা গায়েব হয়ে যায়।
কিন্তু এ ঘটনার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী?
সম্পর্কটা শুভ না জানলেও আমি জানি। আমি কোম্পানির পিআরও। শুভ যে বাড়িটার ঠিকানা দেয় সেই বাড়িতেই লুলু নামে একটা লোক থাকে। লুলু আমাদের কোম্পানির সিকিউরিটির চার্জে আছে। কিন্তু সে কখনও অফিসে আসে না। কোম্পানির অ্যাকাউন্টসে খোঁজ নিয়ে জেনেছি লুলুর নামে একটা বেশ মোটা টাকার বরাদ্দ আছে।
গোপীনাথ বিরক্ত হয়ে বলল, তার সঙ্গেই বা আমাদের কী সম্পর্ক?
আমাদের নয়। রোজমারির।
তুই কি বলতে চাস রোজমারির সঙ্গে ওর এক্সট্রা ম্যারিটাল রিলেশন আছে।
ডিডাকশন তাই সাজেস্ট করে।
তাতেও আমাদের কিছু যায়-আসে না।
আমার ধারণা রোজমারি লুলুকেই আপনার সিকিউরিটির ভার দেবে।
দিক না।
সুব্রত মাথা নাড়ল, আমার কিছু হোমওয়ার্ক করা আছে।
সেটা আবার কী?
পুলিশ রেকর্ড।
লুলু কি ক্রিমিন্যাল?
ড্রাগ ট্রাফিকার। জার্মানিতে ওর বেস। বেশির ভাগ ব্যাবসাই বে-আইনি।
সেটা কি রোজমারি জানে না?
বোধহয় না।
রোজমারি কি বোকা?
বোকা নয়। অজ্ঞানতা। লুলু ইজ এ ব্যাড নিউজ।
তা হলে কী করতে বলিস?
সাবধান হতে বলি।
তুই তো সকালেই আমাকে জিজ্ঞেস করছিলি আমার ঠিকানা রোজমারিকে দিবি কি না। তা হলে আবার একথা বলছিস কেন? লুলু যে ব্যাড নিউজ এটা তো তোর জানাই ছিল।
সুব্রত মাথা নেড়ে বলল, না জানা ছিল না। লুলু সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য পুলিশের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের কাছে বলা ছিল। তিনি আমার সম্পর্কে কাকা হন। তিনি ঘণ্টাখানেক আগে আমাকে টেলিফোন করে জানালেন।
লুলুকে তা হলে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে না কেন?
প্রমাণাভাব। তা ছাড়া পুলিশ সব ক্রিমিন্যালকে অ্যারেস্ট করেও না, যতক্ষণ না ঘটনা ঘটছে।
গোপীনাথ কাধটা ঝাঁকিয়ে বলল, টোস্ট খাবি? আমার খিদে পেয়েছে।
টোস্ট! এখন এইসব কথার মাঝখানে হঠাৎ টোস্টের কথা কেন?
বিপদ যেমন সত্য, খিদেও তেমন সত্য। কলা আর আপেল আছে, টোস্টের সঙ্গে মন্দ লাগবে না।
সুব্রত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আপনি খান। আমি খেয়ে এসেছি।
গোপীনাথ উঠে গিয়ে টোস্ট সেঁকে মাখন লাগিয়ে নিয়ে এল। সঙ্গে কলা আর আপেল। খেতে খেতে বলল, লুলু যে বা যা-ই হোক রোজমারির ল্যাবরেটরিতে একটা অ্যাকসেস আমার দরকার।
কেন গোপীদা? কোনও এক্সপেরিমেন্ট করতে চান?
হ্যাঁ। অ্যান্ড এ ভাইট্যাল ওয়ান।
সুব্রত কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বলল, গোপীদা, আঁদ্রে যখন খুন হয়, অর্থাৎ যখন তাকে বিষ দেওয়া হয় তখন আমি স্পটে ছিলাম, জানেন?
গোপীনাথ অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ গোপীদা। আঁদ্রে যখন বিয়ারটা খাচ্ছিল তখন আমি তার দিকেই চেয়ে ছিলাম।
বলিসনি তো!
বলে কী হবে! তখন কি জানতাম যে বিয়ারে বিষ আছে?
কে দিয়েছিল জানিস?
যদি বলি জানি?
জানিস! সত্যিই জানিস?
সুব্রত একটু হাসল।
২৭.
সোমবার দুপুরের দিকে সোনালি রোজমারির ফোন পেল।
সোনালি, একবার আমার ঘরে আসবেন?
সোনালি একটু অবাক হল। সে মনোজের সেক্রেটারি। রোজমারির সঙ্গে তার প্রয়োজন খুবই কম। সে বলল, হ্যাঁ, ম্যাডাম আসছি।
সোনালি একটা গোটা উইং পেরিয়ে আর-একটা উইং-এ রোজমারির দফতরে পৌঁছোতে একটু সময় নিল। এবং এই সময়টুকু সে ভাবল। কয়েকদিন আগে মনোজ সেন তাকে ডেকে গোপীনাথ সম্পর্কে কিছু কৌতূহল প্রকাশ করে। তাতে সে মোটেই সন্তুষ্ট হয়নি। বিরক্ত হয়েছে এবং সেটা প্রকাশও করেছে। রোজমারিও আবার সেই একই প্রসঙ্গ তুলবে নাকি?
রোজমারির ঘরে যখন সে ঢুকল তখন রোজমারির মুখে হাসি এবং আপ্যায়ন। সোনালি এই আন-অফিশিয়াল ভাবভঙ্গি পছন্দ করে না বসদের কাছ থেকে।
রোজমারি পরিষ্কার বাংলায় বলল, বসুন সোনালি।
সোনালি বসল। এবং সে হাসল না।
রোজমারি তবু মুখের হাসিটা বজায় রেখে বলল, আপনাকে কয়েকটা কনফিডেনশিয়াল কথা বলতে চাই, সোনালি।
সোনালি ভ্রু একটু কুঁচকে বলল, কী ব্যাপারে?
আমাদের কারখানার ব্যাপারে।
সোনালির ভ্রু কেঁচকানোই রইল, অফিসের ব্যাপারে! কিন্তু সেটা আমাকে কেন? আমি তো সামান্য একজন কর্মচারী।
রোজমারি তবু হাসিমুখেই বলল, আপনার এই কারখানা সম্পর্কে অনেক কথাই জানা আছে। সুতরাং আপনি আমাদের ঘনিষ্ঠ কর্মচারীদের একজন। আমরা সম্প্রতি কিছু সমস্যায় পড়েছি। আপনি কি শুনবেন?
ঠান্ডা গলায় সোনালি বলল, ইচ্ছে করলে বলুন।
রোজমারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গা এলিয়ে বসল। তারপর খুব ধীর গলায় বলল, আমরা যে অ্যালয়টা তৈরি করি সেটা সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা ছিল। বিভিন্ন অত্যাধুনিক ইন্ডাস্ট্রিতে অ্যালয়টা দরকার হয়।
জানি ম্যাডাম।
খুব সম্প্রতি এই অ্যালয়টা কোনও কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমার কারখানাটা অনেকেই কিনে নিতে চেয়েছিল, আমরা দিইনি। এখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আমাদের ওপর নজর পড়েছে। আমরা বুঝতে পারছি না কী করব। আপনি তো জানেন, আঁদ্রে মারা গেছে এবং ইন্টারপোলের একজন এজেন্ট সুধাকর দত্ত এসে আমাদের যথেষ্ট বিভ্রান্ত করে দিয়ে যায়।
এ সবই আমি জানি ম্যাডাম।
এর একটা রি-অ্যাকশন হয়েছে সাক্কি ইনকরপোরেটেডেও। আপনি হয়তো জানেন না, সেখানকার একটা প্রোজেক্টের চিফ গোপীনাথ বসুকে অপহরণ করা হয় এবং খুন করারও চেষ্টা হয়েছে।
সোনালি চুপ করে রইল। তার বুক কাঁপছিল।
রোজমারি অত্যন্ত নরম গলায় বলল, আমি আপনাদের সম্পর্কের কথা জানি। গোপীনাথ আপনার প্রাক্তন স্বামী।
সোনালি হঠাৎ মুখটা তুলল। তার দুটো চোখ ছলছল করছে এবং নিজেকে সংযত রাখতে পারছে না সে।
সোনালি বলল, গোপীনাথের কী হয়েছে?
রোজমারি মাথা নেড়ে বলল, যতদূর জানি, এখনও কিছু হয়নি।
সোনালি একটা শ্বাস ছেড়ে চুপ করে রইল।
রোজমারি গলাটা আরও নরম করে বলল, সোনালি, আপনি কি জানেন যে, গোপীনাথের বিপদ এখনও কাটেনি?
আমি কিছুই জানি না। ও কোথায় আছে?
রোজমারি মৃদু স্বরে বলল, বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি গোপীনাথ বসু এখন কলকাতায় রয়েছেন।
ভীষণ চমকে উঠল সোনালি। গত মাসখানেক যাবৎ সে প্রতি মুহূর্তে গোপীনাথের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার আশঙ্কা করছে। ঠিক বটে গোপীনাথ এখন তার কেউ নয়। কিন্তু গোপীনাথ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পুরুষ সোনালির জীবনে কখনও আসেনি। হয়তো গোপীনাথই পুরুষ সম্পর্কে তার যাবতীয় আগ্রহকে নষ্ট করে দিয়েছিল। একজন কঠিন, আত্মসর্বস্ব, কাজপাগল মানুষ ছিল গোপীনাথ। স্ত্রী সম্পর্কে যার না ছিল ভাবাবেগ, না ভালবাসা, না কোনও আগ্রহ। নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যে সে বরাবর এড়িয়ে গেছে সোনালিকে। বিদেশে একা সোনালির কীভাবে যে দিন কাটত সে-ই জানে। গোপীনাথ সারা পৃথিবী চষে বেড়াত নিজের কাজে। গোপীনাথ সম্পর্কে আজ সোনালির কোনও ভাবাবেগ নেই ঠিক কথা, কিন্তু একটু স্মৃতি আছে। সুখস্মৃতি না হলেও স্মৃতি। গোপীনাথের করুণ পরিণতি ঘটলে সে দুঃখ পাবে।
সোনালি বলল, কলকাতায়! কবে এল?
খুব সম্প্রতি।
ও। বলে চুপ করে গেল সোনালি।
রোজমারি নরম গলায় বলল, কলকাতায় এলেও যে তিনি রেহাই পাবেন, এমন নয়। আপনি হয়তো জানেন না, বেশ কয়েকটা আন্তর্জাতিক মাফিয়া গোষ্ঠী তাকে খুঁজছে।
কেন খুঁজছে?
গোপীনাথ একজন মন্ত বিশেষজ্ঞ। হয়তো আমাদের অ্যালয় সম্পর্কে সত্যিকারের বিজ্ঞানসম্মত সত্যভাষণটা তিনিই করতে পারবেন। কিন্তু কেউ কেউ চায় না যে গোপীনাথ সেটা করুন।
তা হলে কী হবে?
রোজমারি অত্যন্ত সমবেদনার গলায় বলল, গোপীনাথকে বাঁচানো দরকার।
সোনালি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। কিন্তু কিছু বলল না।
রোজমারি বলল, আমাদেরও একটু স্বার্থ আছে। আমরাও তার কাছ থেকে সত্যটা জানতে চাই। জানলে আমাদের অ্যালয় অনেক বেশি মূল্যবান হয়ে উঠবে।
ও। সোনালির নিস্পৃহ জবাব।
শুনুন সোনালি, স্বার্থ থাকলেও আমরা গোপীনাথের মতো একজন কাজের লোককে হারাতে এমনিতেই চাই না। তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের কিছু করা উচিত। আপনিও কি তা চান না?
সোনালি অভিভূতের মতো চেয়ে থেকে বলল, আপনি কী বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন।
আমরা গোপীনাথের ফ্ল্যাটের ঠিকানাটা জানি না।
জেনে কী করবেন?
তার সিকিউরিটির ব্যবস্থা করব।
সোনালি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এ ব্যাপারে আমি এখনই কিছু বলতে পারি না।
ভেবে বলবেন?
হ্যাঁ, তার আগে ঠিকানাটা উনি দিতে রাজি কি না সেটাও আমার জানা দরকার।
তবে তাই হোক। যদি গোপীনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তা হলে তাকে বলবেন রোজমারি এই প্রস্তাব দিয়েছে যে, তার সিকিউরিটি এবং মাসে এক লক্ষ টাকা বেতন দিতে আমরা প্রস্তুত। তিনি যদি আমার কনসার্নে কাজ করেন তা হলে আমরা কৃতজ্ঞ বোধ করব।
চেষ্টা করব বলতে।
হ্যাঁ, এক লক্ষ টাকা মাইনে ছাড়াও তার যাবতীয় খরচও আমরা দেব, ধরুন মাসে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো। দয়া করে একথাও বলবেন, বেতন নিয়ে তিনিও তার মতামত দিতে পারেন, আমরা বিবেচনা করতে রাজি আছি।
বলব।
আপনি আজ একটু টেনশনে আছেন। ঠিক আছে আসুন। কাল কথা হবে।
সোনালি সম্পূর্ণ একটা ঘোরের মধ্যে নিজের ঘরে এল। এমনকী যে-লোকটা তার টেবিলের মুখোমুখি বসে তার জন্য অপেক্ষা করছিল, প্রথমে তাকে লক্ষই করল না।
সুব্রত বলল, কোথায় গিয়েছিলেন দিদি?
আপনি কখন এলেন?
মিনিট পাঁচেক হবে।
সোনালি নিজের চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ নিজেকে সংযত করল। গোপীনাথকে সে ভালবাসে না ঠিকই, কিন্তু উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা তাকে বড্ড কাহিল করে ফেলেছে।
সোনালি বিনা ভূমিকায় বলল, সুব্রতবাবু, আপনার গোপীদা এখন কোথায়?
সুব্রত ভ্রু তুলে বলল, কেন বলুন তো!
আমি জানতে চাই গোপীনাথ এখন কলকাতায় কি না। আপনি জানেন?
সুব্রত একটু চুপ করে থেকে বলল, খবরটা চাপা নেই। অনেকেই জানে। আমিও বলব বলেই আপনার কাছে এসেছি।
তা হলে বলুন।
গোপীদা এখন কলকাতায়।
কেন?
গোপীদাকে রোম থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। অনেক বিপদের ভিতর দিয়ে।
কীরকম বিপদ?
তাকে মারবার জন্য অনেক চেষ্টা হয়েছে। বরাতজোরে বেঁচে গেছেন। কিন্তু কলকাতাও তার পক্ষে হট হয়ে উঠছে।
তা হলে কী হবে?
শুধু ভাগ্যের ওপর আর নির্ভর করা যাচ্ছে না।
আমরা কী করতে পারি?
গোপীদা যদি পালিয়ে বা লুকিয়ে থাকতে রাজি হতেন তা হলে একটা কথা ছিল। কিন্তু হি ইজ এনজয়িং দি ডেনজারস।
সে কী!
সেটাই তো কথা। পরশু দিন ওঁর ফ্ল্যাটে দুটো নোক ঢুকেছিল, উইথ আর্মস।
সোনালি সভয়ে বলল, তারপর?
গোপীদা অ্যালার্ট ছিলেন বলে বেঁচে যান। কিন্তু বারবার এরকম হবে না। সত্যিকারের প্রফেশনাল খুনির পাল্লায় পড়লে মুশকিল আছে।
সোনালি একটু চুপ করে থেকে বলল, রোজমারি ওর সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে চায়। চাকরিও দিতে চাইছে। মাসে দেড় লাখ টাকা মাইনে এবং সেটাও নেগোশিয়েবল।
সুব্রত একটু হাসল, জানি।
জানেন?
হ্যাঁ। রোজমারি প্রস্তাবটা আমাকেই প্রথম দেয়।
গোপীনাথ কী বলছে?
গোপীদা রাজি।
রাজি?
হ্যাঁ। তবে রোজমারির সিকিউরিটি সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। লুলু লোকটা ভাল নয়।
লুলু কে?
ম্যাডামের পেয়ারের লোক। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের সিকিউরিটি ইনচার্জ।
ও। লোকটা ভাল নয় কেন?
লুলু মে বি এ ডাবল এজেন্ট। ডাবল এজেন্টদের তো বিশ্বাস করা যায় না। হয়তো উলটো পার্টির টাকা খেয়ে গোপীদাকে সেই খুন করে বসল।
সোনালি শিহরিত হয়ে বলে উঠল, না না, তা হলে কিছুতেই লুলু নয়।
আমিও তাই ভাবছি। কিন্তু ম্যাডামের লুলুর প্রতি খুব দুর্বলতা। উনি হয়তো লুলু সম্পর্কে কোনও বিরুদ্ধ কথা বিশ্বাসই করতে চাইবেন না।
আমি সেকথা রোজমারিকে জানিয়ে দিতে চাই।
কী বলবেন?
বলব, গোপীনাথের সিকিউরিটির ভার আমরা নেব। লুলুকে এর মধ্যে আনা চলবে।
বলে দেখুন তা হলে।
তার আগে গোপীনাথের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।
টেলিফোন তুলে নিন না, হাতের কাছেই রয়েছে।
সোনালি মাথা নেড়ে বলল, এখন নয়।
কেন এখন নয়?
আই অ্যাম ফিলিং নার্ভাস।
কেন সোনালিদি? নার্ভাস হওয়ার মতো কী আছে?
বহুকাল সম্পর্ক নেই। হয়তো রি-অ্যাক্ট করবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুব্রত বলল, কেন যে আপনাদের সম্পর্কটা এমন বিষিয়ে গেল কে জানে। অথচ দু’জনেই তো ভাল।
আমি ভাল নই।
কে বলল ভাল নন? আপনি খুব ভাল।
তাই বুঝি?
গোপীদাও ভাল।
সোনালি চুপ করে রইল।
সুব্রত একটু পরে বলল, গোপীদা এখন ফ্ল্যাটেই আছেন। আপনি ফোনটা করুন সোনালিদি।
রোজমারির প্রস্তাবটা ওকে দেব তো!
হ্যাঁ, কিন্তু আমার আর একটা জরুরি কথা আছে।
কী কথা?
আপনি কিছু মনে করবেন না তো?
তেমন কিছু কথা কি?
হয়তো পছন্দসই হবে না। প্লিজ, রাগ করবেন না।
ঠিক আছে, বলুন।
গোপীদা কীরকম বিপদের মধ্যে আছেন তা তো বুঝতেই পারছেন।
পারছি। হি ইজ বিয়িং হাউন্ডেড।
হ্যাঁ। হাউন্ডেড বাই হার্ডেন্ড ক্রিমিন্যালস।
বুঝলাম।
গোপীদা তবু একা থাকছেন। এই একা থাকাটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। লোনলি ম্যান ইজ ইজি টারগেট।
তা হলে কী করতে হবে?
আমি চাই, গোপীদার একজন সর্বক্ষণের সঙ্গী থাকুক। তাতে দু’জোড়া চোখ দু’জোড়া কান এবং দু’জোড়া হাত থাকবে।
সোনালি অবাক হয়ে বলল, একজন গার্ড রাখলেই তো হয়।
গার্ড! গার্ড কি ততটা অ্যালার্ট হবে? বেতনভুক কর্মচারী কি পারে বুক দিয়ে বাঁচাতে?
তা হলে কে পারবে?
গোপীদার কোনও আপনজন। গোপীদাকে ভালবাসে এমন কেউ। সেটা আপনি।
আমি! বলে হাঁ করে চেয়ে থাকে সোনালি।
আপনিই সোনালিদি। আপনি ছাড়া কারও কথা ভাবাই যায় না। আমি যাচ্ছি। আপনি ফোনটা করুন।
সুব্রত চলে গেল। সোনালি বিস্মিত সর্বস্বান্তের মতো বসে রইল। কী অনায়াসে বলে চলে গেল সুব্রত। কিন্তু কী সাংঘাতিক একটা ঝড় তুলে গেল তার বুকে।
সোনালি আরও কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল অভিভূতের মত। তারপর দুর্বল হাতে টেলিফোনটা তুলে ডায়াল করল।
টেলিফোনটা কানে দিয়ে শুনল ওপাশে রিং হচ্ছে।
রিং হয়ে যেতে লাগল, ফোন কেউ ধরল না।
২৮.
ফোনে নো-রিপ্লাই হলে ধরে নিতে হয় যে, লোকটা ফ্ল্যাটে নেই। অথবা ফোনটা খারাপ। ফোন খারাপ থাকার কথা নয়, থাকলে সুব্রত জানত। বাড়ি নেই এটাই ধরে নেওয়া ভাল।
সোনালি তবু একটু উদ্বেগের মধ্যে রইল। লোকটা বিপদের মধ্যে আছে। মারাত্মক বিপদ। একটা কিছু যখন তখন হয়েও যেতে পারে তো! চিন্তাটা সোনালি মাথা থেকে তাড়াতে পারল না। অথচ গোপীনাথের সঙ্গে তার জাগতিক সম্পর্ক শেষ হয়েছে। তাকে নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে।
সোনালির ডাক এল মনোজের ঘর থেকে, আধ ঘণ্টা বাদে।
মিস সোম, বসুন।
সোনালি বসল।
আপনার সঙ্গে রোজমারি আজ একটা অপ্রিয় প্রসঙ্গে কথা বলেছে।
হ্যাঁ।
মনোজের মুখটা খুবই ভারাক্রান্ত এবং উদ্বিগ্ন। সে গলা খাঁকারি দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, আমিও এর আগে একদিন প্রসঙ্গটা তুলে আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলেছিলাম। তবু কথাটা যে উঠছে তার কারণ দুটো। আমাদের অ্যালয়ের কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন থেকে আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। দ্বিতীয় কথা, গোপীনাথ বসুর মতো ট্যালেন্টেড লোককে যে-কোনও মূল্যেই বাঁচানো উচিত।
সোনালি মাথা ঠান্ডা রেখে বলল, গোপীনাথ বসুকে সিকিউরিটি দেওয়ার ব্যাপারে কিছু কথা আছে।
কী কথা?
আপনাদের দেওয়া সিকিউরিটি আমাদের পছন্দ নয়।
মনোজ হঠাৎ এ কথায় ঝুঁকে পড়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কেন বলুন তো!
লুলু সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা নেই।
মনোজ অবাক হয়ে বলল, লুলু! লুলু আবার কে?
ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের সিকিউরিটি ইনচার্জ।
মনোজ ভ্রু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড কিছু মনে করার চেষ্টা করল। তারপর হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, লুলু! মাই গড! লুলু মানে তো নওলকিশোর লালা। সে-ই কি আমাদের সিকিউরিটি ইনচার্জ?
ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের সিকিউরিটি ইনচার্জ কে সেটাও মনোজ জানে না দেখে বিস্মিত সোনালি বলল, হ্যাঁ। কেন, আপনি জানতেন না?
মনোজ একটা অদ্ভুত চোখে সোনালির দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে ওপর নীচে কয়েকবার মাথা নেড়ে বলল, আঁ! হ্যাঁ-হ্যাঁ। অবশ্যই।
সোনালির স্পষ্ট মনে হল, মনোজ সত্যিই জানত না। এবং জেনে মোটেই খুশি হল না। তার মুখে আচমকা একটা রক্তাভা দেখা গেল।
একটু সময় নিয়ে এই আকস্মিক অপ্রতিভতাকে একটু সামলে নিয়ে মনোজ হেসে বলল, আসলে সবসময়ে সব জিনিস খেয়াল থাকে না। আমি একটু অ্যাকাডেমিক টাইপের। বাস্তববোধ কম। ওসব রোজমারিই দেখে কিনা। হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন।
সোনালি খুব শান্ত, দৃঢ় গলায় বলল, আমরা লুলুর কথাই বলছিলাম। সিকিউরিটির ব্যাপারে লুলুকে আমাদের পছন্দ নয়।
মনোজ একটু চুপ করে থেকে বলল, কেন নয় বলবেন?
ওর সম্পর্কে আমাদের কিছু সন্দেহ আছে।
মনোজ ভ্রু কুঁচকে আরও একটু ভেবে বলল, লুলুর কনসার্নের নাম গ্লোবাল সিকিউরিটি, না?
না তো! ইউনিভার্সাল আই।
ওঃ, তা হবে। নওলকিশোরের অনেক কোম্পানি, অনেক ব্যাবসা। সবকিছুর খবর রাখা অসম্ভব। তা হলে আপনারা কী চান?
গোপীনাথের সিকিউরিটির ভার অন্য কেউ নিক।
মনোজ প্রস্তাবটা অগ্রাহ্য করল না। বলল, বেশ। কিন্তু চাকরির অফারটা?
সেটা উনি রাজি হলে আপনাকে জানাব।
চিন্তিত মনোজ হঠাৎ যেন সবকিছু থেকে খানিকটা দূরে সরে গেল। নিস্পৃহ হয়ে গেল। লুলুর প্রসঙ্গটা কি এতই অরুচিকর ওর কাছে? কেনই বা? সুব্রত বলেছিল, লুলু রোজমারির পেয়ারের লোক। কথাটা কতটা সত্যি! আর সবচেয়ে বড় কথা, লুলু কে? আসলে কে?
মনোজের কাছ থেকে খুব নিচু স্বরে বিদায় নিয়ে চলে এল সোনালি। টেবিলটা চটপট গুছিয়ে নিয়ে সে বেরোবার মুখে আর একবার টেলিফোন করল গোপীনাথকে। রিং বেজে গেল। ফোন কেউ ধরল না।
অন্য দিনের চেয়ে আজ অনেক দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এল সোনালি। গোপীনাথের ফোন কেন নো-রিপ্লাই হচ্ছে সেটা তার জানা দরকার। ট্যাক্সি পাওয়া যাবে কি না ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যখন সে ঊর্ধ্বশ্বাসে বাইরের দিকে ছুটছিল তখন বাইরে চমৎকার লনের দু’পাশে যে গাড়ি পার্ক করার জায়গা আছে, সেখান থেকে কে যেন অনুচ্চ স্বরে ডাকল, সোনালিদি।
হেলমেট পরা, সুব্রতকে সে প্রথমটায় চিনতে পারেনি। সুব্রত তার মোটর বাইকটাকে পার্কিং লট থেকে বের করে সামনে এনে দাঁড় করাল, উঠুন।
সোনালি এই প্রথম টের পেল তার হাত-পা বশে নেই। সে রীতিমতো কাঁপছে। বলল, আমি পারব না। পড়ে যাব।
উঠুন সোনালিদি। উই মাস্ট রিচ হিম কুইকলি। গত তিন ঘণ্টা ধরে গোপীদার ফোনে নো-রিপ্লাই।
সোনালি সুব্রতর পিছনে উঠে পড়ল। তারপর কীভাবে যে রাস্তাটা পার হল তা সে জানেও না। সম্পূর্ণ হতচেতনা বা আচ্ছন্নতার মধ্যে ছিল সে। একজন চেনা মানুষ এখন আর স্বামী নয়–তবু তো চেনা। তার মৃত্যুটা কীভাবে নেবে সোনালি।
সুব্রত বাইকটাকে লক করে তার হাত ধরে প্রায় হিঁচড়ে টেনে এনে লিফটে উঠে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।
কী হয়েছে সুব্রতবাবু? আপনি এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন?
সোনালিদি, প্রে টু গড।
ওর কি কিছু হয়েছে?
হোক তা আমরা কেউ-ই চাইছি না।
লিফট থামতেই দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে গেল সুব্রত। পিছনে সোনালি।
দরজাটা আধখোলা ছিল। সুব্রত সপাটে সেটাকে খুলে ভিতরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল। বাইরের ঘরের দৃশ্যটাই বীভৎস। দেওয়াল, দরজা, ডিভান, কম্পিউটার, সোফাসেট সর্বত্র এলোপাথাড়ি গুলি চালানোর চিহ্ন। মেঝেয় অবধি কোথাও কোথাও চলটা উঠে গেছে। না হোক গোটা ত্রিশ-চল্লিশবার গুলি চালানো হয়েছে এই ঘরে।
সুব্রত শোয়ার ঘরটায় উঁকি দিল। এ ঘরেও কয়েকবার গুলি চলেছে বটে, কিন্তু বেশি নয়। সুব্রত বাথরুম, বারান্দা, আর একখানা ঘর সর্বত্র ঘুরে দেখল। কোথাও লাশ নেই।
সোনালি সুব্রতর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে আছে। আতঙ্কিত গলায় বলল, এসব কী হয়েছে সুব্রতবাবু?
গুলি চলেছে। কিন্তু কেউ মরেনি। গোপীদা হয় পালিয়েছে, নয় কেউ বা কারা তুলে নিয়ে গেছে।
অ্যাবডাকশন?
হতেও পারে। গোপীদাকে কতবার বললাম আমার বাড়িতে চলে যেতে, কেন যে গেল। সাহস ভাল, কিন্তু অতি-সাহস তো ভাল নয়।
সোনালি ঘাবড়ে গেছে। মুখ শুকনো, ঠোঁট সাদা। তবু যেন ভিতর থেকে কিছু কঠিন হয়েছে সে। চারদিকে চেয়ে বলল, এত গুলি চালাল কেন বলুন তো? মারতে হলে তো একটা-দুটো গুলিই যথেষ্ট।
সেটাই ভাবছি।
সদর দরজার কাছে গিয়ে ঘরটা একবার দেখল সোনালি। তারপর হঠাৎ ডান ধারে কাঁচের শার্সিওলা জানালার দিকটায় গিয়ে বলল, সুব্রতবাবু, এদিকে আসুন।
সুব্রত গেল।
যতদুর মনে হচ্ছে কেউ বাইরে থেকে এই জানালা দিয়ে ভিতরে গুলি করেছে।
সুব্রত অবাক হয়ে বলল, বাইরে থেকে?
হ্যাঁ। ওই দেখুন, বাইরে ভারা বাঁধা আছে।
কথাটা মিথ্যে নয়। বাড়ির এ পাশটায় বাস্তবিক ভারা বাঁধা আছে। সম্ভবত রাজমিস্ত্রি বা রঙের মিস্ত্রিদের কাজ চলছে। তবে আজ কোনও মিস্ত্রি নেই। জানালার কাচগুলি ভাইব্রেশনে ফেটে গেছে। শব্দ হয় এমন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। হলে লোক জমে যেত। কাজ হয়েছে নিঃশব্দে।
সুব্রত বলল, কিন্তু গোপীদা কোথায়?
সোনালি চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছিল। কোথাও রক্তের চিহ্ন দেখতে পেল না সে।
সুব্রত জানালা দিয়ে নীচে ঝুঁকে কিছু দেখছিল। হঠাৎ চাপা গলায় বলল, সোনালিদি! এদিকে আসুন।
সোনালি প্রায় ছুটে এল।
কী সুব্রতবাবু?
সুব্রত নীচের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, কিছু দেখতে পাচ্ছেন?
কী?
নীচে কিছু ঝোঁপঝাড় রয়েছে। বোধহয় এ বাড়ির কিচেন গার্ডেন। দেখতে পাচ্ছেন?
সোনালি ঝুঁকে দেখে বলল, পাচ্ছি।
ভাল করে দেখুন, ঠিক জানালার সোজাসুজি নীচে একটা ঝোঁপের ভিতর থেকে একজোড়া পা বেরিয়ে আছে।
সোনালি মাথা ঘুরে বোধহয় পড়েই যেত। সুব্রত ধরে ফেলে বলল, নার্ভাস হবেন না। মাথা ঠান্ডা রাখুন।
কার পা? আপনার গোপীদা?
আসুন আমার সঙ্গে। ব্যাপারটা দেখা দরকার।
কিন্তু যাবে কী করে সোনালি? তার হাত-পা কাঁপছে, বুকে প্রচণ্ড ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট। বলল, সেই দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে?
ভাল করে না দেখে কিছু ধরে নেওয়া কি ভাল? মনে হচ্ছে যার পা দেখা যাচ্ছে সে এই আটতলা থেকেই নীচে পড়ে গেছে।
সোনালি বিবশ গলায় বলল, আটতলা থেকে? তা হলে কি বেঁচে থাকার কথা।
হু নোজ? লেট আস সি। চলুন।
নীচে নেমে গোপীনাথের মৃতদেহ পর্যবেক্ষণের মতো অবস্থা সোনালির নয়। তার শরীর যেন নেই হয়ে গেছে, মাথা সম্পূর্ণ বোধশূন্য। এত বিকল তার কোনওদিন লাগেনি। ভয় নয়, মনটা যেন দুর্ভেদ্য অন্ধকার।
অবস্থাটা বুঝে সুব্রত একরকম তাকে ধরে ধরেই লিফট পর্যন্ত আনল। লিফটাকে ওপরে আনতে একটু সময় লাগল। সুব্রত চাপা স্বরে বলল, স্বাভাবিক আচরণ করুন। নইলে লোকে সন্দেহ করবে।
নীচে নেমে তারা একজন ছোকরা দারোয়ানকে দেখতে পেল। একটা বাচ্চা চা-ওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে।
সুব্রত গিয়ে বলল, পিছনদিকে বাগানের মধ্যে কেউ পড়ে আছে।
লোকটা হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, কে পড়ে আছে?
সেটাই দেখা দরকার। আমাদের সঙ্গে এসো।
আপনারা কোন ফ্ল্যাটের মেহেমান?
গোপীনাথ বসু। আটতলা। এসো, সময় নেই।
লোকটা একটা বেঁটে লাঠি হাতে নিয়ে উঠল। পিছনে বাস্তবিকই বিস্তর ঝোঁপঝাড়। ঘনবদ্ধ বাগান। আটতলা থেকে একটা প্রমাণ সাইজের মানুষ পড়ে যাওয়াতেও যে তেমন শব্দ হয়নি তা দারোয়ানের আচরণেই বোঝা যাচ্ছে। শব্দটা সে শুনতে পায়নি।
মস্ত একটা কামিনী ঝোঁপ ভেদ করে লোকটা পড়েছে। ঝোঁপের মধ্যেই আটকে আছে তার দেহ। শুধু পা দুটো বাইরে। পায়ে বিদেশি দামি জুতো, পরনে ফেডেড জিনসের প্যান্ট, গায়ে একটা জিন্সেরই শার্ট।
না, লোকটা গোপীনাথ নয়। এ লোকটা ছোটখাটো, রোগার দিকেই। হাত থেকে একটা স্টেনগান গোছের জিনিস ছিটকে ঝোপেই আটকে আছে।
দারোয়ান চেঁচাল, কে লোকটা?
সুব্রত তাকে ধমক দিয়ে বলল, চেঁচাচ্ছ কেন? পুলিশে খবর দাও।
দারোয়ান বলল, উনি তো ফ্ল্যাটের লোক নন! লোকটার মুখ ভাল করে দেখে নিল সুব্রত। না, এ ফ্ল্যাটের লোক তো নয়ই, এ দেশের লোকও নয়। স্পেন বা দক্ষিণ আমেরিঙ্গর মানুষ। গায়ের রং বাদামি। মোটা গোঁফ আছে।
সোনালি প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে স্থির চোখে লোকটাকে দেখছিল।
সোনালিদি, এবার স্বাভাবিক হোন।
সোনালি মাথা নেড়ে বলল, স্বাভাবিক হব! কী করে বলুন তো! এসব কী হচ্ছে। আপনার গোপীদাই বা কোথায়?
তা জানি না। তবে মনে হচ্ছে এ লোকটাই ভারা বেয়ে উঠে গোপীদাকে গুলি করার চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু তারপর কী হয়েছিল?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
দারোয়ানটা হঠাৎ লোকটার পা ধরে টানাহ্যাঁচড়া করতে যাচ্ছিল। সুব্রত ধমক দিয়ে বলল, ওরকম করবে না, পুলিশ খেপে যাবে।
তা হলে কী করব স্যার?
থানায় খবর দাও। বাড়িতে কারও টেলিফোন নেই? যাও তাড়াতাড়ি।
লোকটা চলে গেল।
আমরা কী করব সুব্রতবাবু?
চলুন, গোপীদার ফ্ল্যাটে গিয়ে একটু কফি খাওয়া যাক।
কী যে বলেন!
সোনালিদি, আমাদের যে অপেক্ষা করতেই হবে। চলুন।
তারা আবার ওপরে এল। ফ্ল্যাটে ঢুকল। সোনালি বলল, কফিটা আমি করে আনছি।
সুব্রত চারদিকটা ঘুরে দেখছিল। জবাব দিল না।
হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠতেই সুব্রত একরকম দৌড়ে গিয়ে সেটা ধরল।
হ্যালো।
একটা সতর্ক সরু গলা বলল, কে?
কাকে চাই?
গোপীনাথ বসু আছেন?
না, নেই।
একটু চুপ থেকে গলাটা হঠাৎ মোটা হয়ে গেল, কে রে, সুব্রত নাকি?
হ্যাঁ, গোপীদা! আপনি বেঁচে আছেন?
আছি। আজকাল বেঁচে থাকাটাই কেমন অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।
ফ্ল্যাটে এ কী কাণ্ড হয়ে আছে?
সেইজন্যই একটু গা-ঢাকা দিতে হয়েছে।
কী হয়েছিল বলবেন?
খুব সাংঘাতিক ব্যাপার। দুপুরে কম্পিউটার নিয়ে বসেছিলাম। কিছু কাজ ছিল। হঠাৎ কী হল জানিস, ঘরের স্বাভাবিক আলোর প্যাটার্নে একটা সূক্ষ্ম চেঞ্জ ঘটল। খুব সূক্ষ্ম। বাঁদিকে চেয়েই দেখলাম, শার্সির বাইরে একটা মাথা উঠে আসছে, একটা নলও যেন দেখতে পেলাম।
তারপর?
বিশ্বাস করবি না সেই ঘটনা। কোথায় দৌড়ে পালাব, তা নয়। আমি সটান মেঝেতে শুয়ে ড্রাই সাঁতার দিয়ে ওই জানালার দিকেই এগিয়ে গেলাম। লোকটা শার্সি দিয়ে ভিতরে এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছিল।
সর্বনাশ!
আমাকে যখন দেখতে পায় তখন আমি জানালার কাছে পৌঁছে গেছি।
আপনি কি পাগল?
না, আমি বুদ্ধিমান। লোকটা শেষ চেষ্টা করেছিল আমাকে ঝাঁঝরা করে দিতে। আমি শুধু হাত বাড়িয়ে ওকে একটা ধাক্কা দিয়েছি।
এত সাহস ভাল নয় গোপীদা।
লোকটা কি মরে গেছে?
হ্যাঁ। না মরলেও মরবে।
দিস ইজ মাই ফাস্ট মার্ডার।
এটা মার্ডার নয় গোপীদা। সেলফ ডিফেন্স।
২৯.
যে-কোনও ঘটনারই একটা ধাক্কা আছে। গোপীনাথ ধাক্কাটা এখনও সামলে উঠতে পারেনি। একটা লোক–তা সে হোক না আততায়ী–তার হাতেই খুন হয়েছে, এই নগ্ন সত্যটা সে ভোলেই বা কী করে? আত্মরক্ষার্থে খুন যে খুন নয় তাও সে জানে, তবু কি মন তা মানছে?
টেলিফোনে সুব্রতর মোলায়েম গলা বলে যাচ্ছিল, আপনি মোটেই এটাকে হোমিসাইড হিসেবে নেবেন না। আপনি লোকটাকে ধাক্কা না দিলে লোকটা আপনাকে অবশ্যই খুন করত। বুঝেছেন ব্যাপারটা?
বুঝেছি। তবু আমার খুব নার্ভাস লাগছে।
আপনি এখন কোথায় গোপীদা?
একটা পাবলিক কল বুথ থেকে কথা বলছি। গড়িয়াহাটে।
শুনুন, আপনার এখন আর এই ফ্ল্যাটে আসার দরকার নেই। আমার মনে হয়, এখন কিছুদিন অন্যত্র যাওয়াই আপনার পক্ষে ভাল।
দূর বোকা।
কেন, বোকা বলছেন কেন?
লোকটা কোন তলা থেকে পড়েছে, কেন পড়েছে এসব পুলিশের জানা নেই। কিন্তু তদন্তের সময়ে পুলিশ যদি দেখে যে আমি সন্দেহজনকভাবে অনুপস্থিত তা হলে দোষটা আমার ঘাড়ে চাপাতে সুবিধে হবে।
সুব্রত একটু ভেবে বলল, বাঃ বেশ বলেছেন তো! কিন্তু সন্দেহ করার কারণ তো থেকেই যাচ্ছে। আপনার ঘরের দেওয়াল মেঝে সর্বত্র গুলির দাগ, পুলিশ এলে তো জলের মতো বুঝতে পারবে যে, লোকটা কোন ফ্ল্যাটে ঘটনা ঘটাতে এসেছিল। তখন তো আপনাকেই সন্দেহ করবে।
নাও করতে পারে। আমি যদি বলি যে, ঘটনার সময় আমি ঘরে ছিলাম না এবং লোকটা অ্যাক্সিডেন্টলি ভারা থেকে পড়ে গেছে?
পুলিশ বিশ্বাস করবে কি?
করবে। কারণ লোকটা বিদেশি, বাঁশের ভারায় ওঠার অভিজ্ঞতা নেই। তার ওপর লোকটা একটা হাই ইমপ্যাক্ট অটোমেটিক অস্ত্র চালাচ্ছিল। খুবই রিস্ক ছিল কাজটায়।
সুব্রত ফের একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ বলল, আপনি না একটু আগেই বলছিলেন যে, আপনি নার্ভাস বোধ করছেন?
করছিই তো।
যে নার্ভাস তার ব্রেন এত চমৎকার কাজ করে কীভাবে?
গোপীনাথ একটু হেসে বলল, মাথা বেচেই তো খাই। আমাদের বুদ্ধিজীবী বলা হয়, সেটা ভুললে চলবে কেন?
যাকগে, তা হলে আপনি ফ্ল্যাটটা ছাড়বেন না?
ফ্ল্যাটটা ছাড়লে এবং গা-ঢাকা দিলে আমি বাঁচব বটে; কিন্তু ঘটনাগুলো আমাদের হাতের বাইরে চলে যাবে। আর বাঁচলেও সেটা হবে সাময়িক। আমার পিছনে যারা লেগেছে তারা খুনের ফেরিওয়ালা। এক-একটা খুনের জন্য যদি বিশেষ ব্যক্তিকে খুনের চুক্তি থাকে–তা হলে বিরাট টাকার লেনদেন হয়, বুঝলি?
বুঝলাম।
তাই ওরা সহজে হাল ছাড়বে না। যেখানেই পালাই, খুঁজে বের করে মারবে। ডেডবডিটা কি ওখানেই পড়ে আছে?
হ্যাঁ। কেউ বুঝতেই পারেনি যে, একটা লোক পড়ে গেছে নীচে। এমনকী দারোয়ানও নয়। সুতরাং আইউইটনেস নেই। না, গোপীদা, আপনি বোধহয় নিরাপদ।
মোটই নয়।
কেন বলুন তো!
আশপাশে মেলা হাইরাইজ বাড়ি আছে। যেসব বাড়ি থেকে কেউ যে ঘটনাটা দেখেনি তার কী বিশ্বাস আছে? এখনই হয়তো মুখ খুলবে না, কিন্তু সময়মতো হয়তো বলে দেবে।
ওঃ, আপনি তো ভীষণ সমস্যায় ফেললেন গোপীদা? যা-ই বলছি তাই উড়িয়ে দিচ্ছেন?
ওরে, বিপদে পড়ে এখন যে আমার বাস্তববুদ্ধি আর কাণ্ডজ্ঞান হয়েছে একটু।
তা হলে কী করবেন?
রিস্ক নিয়ে ওই ফ্ল্যাটেই থাকব। তবে অজুহাতগুলো ভাবতে হবে।
একা থাকবেন?
দোকা থাকার বিপদ আছে। দু’নম্বর লোকটিকে প্রথমত বিশ্বাস করা যাবে না। দ্বিতীয়ত দু’নম্বর লোকটিকে খামোখা বিপদে ফেলা হবে।
কেউ যদি স্বেচ্ছায় বিপদের ঝুঁকি নেয়?
তুই নিবি আমি জানি। কিন্তু তোর বউ বাচ্চা আছে, তোকে এই বিপদে টেনে আনার চেয়ে আমার গলায় দড়ি দেওয়া ভাল।
আমি নই। তবে আমি ছাড়াও কেউ থাকতে পারে।
গোপীনাথ একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার কেউ নেই, তুই তো জানিস। এই যে একা হয়ে গেছি, এই একাই এখন আমার অভ্যাস। না রে, তুই আমাকে নিয়ে ভাবিস না।
আমি না ভাবলেও কেউ কেউ ভাবছে।
তুই কি সোনালিকে মিন করছিস? কেন রে? ও মেয়েটার সেন্টুতে খোঁচা দিয়ে কেন এই বিপদের মধ্যে ঠেলে দিবি? ও মতলব ছাড়। সোনালির আমার প্রতি কোনও দুর্বলতা নেই, আমি জানি। আমার দুঃখের আর বিপদের কথা ওকে শুনিয়ে তুই প্রায় ওকে ফোর্স করছিস বলে আমার বিশ্বাস। এ কাজটা ঠিক হচ্ছে না। লিভ সোনালি অ্যালোন।
আপনাকে নিয়ে পারা যায় না। আপনি এত স্টাবার্ন।
শোন না পাগলা, রোজমারি আর মনোজ কী বলছে?
তারা আপনাকে এক লাখ টাকা বেতন এবং ইনসিডেন্টাল এক্সপেন্সের জন্য মাসে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চায়। অবশ্য অফার নেগোশিয়েবল।
গোপীনাথ নাক সিঁটকে বলল, দেড় লাখ মাত্র?
আরে না। আরও উঠবে। প্লাস আপনার সিকিউরিটি।
সিকিউরিটি তো তুই অ্যাকসেপ্ট করতে চাইছিস না। লুলু না কী যেন নাম লোকটার!
হ্যাঁ। আপনি কোম্পানির সিকিউরিটি না নিয়ে নিজস্ব সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে পারেন। খরচ ওঁরা দেবেন।
গুড।
আপনার অফার কী?
এটা গরিব দেশ, খুব বেশি চাওয়া হয়তো ঠিক হবে না।
দেশ গরিব হোক, ওঁরা তো গরিব নন। বছরে কয়েক কোটি ডলার টার্নওভার। আপনি ছাড়বেন কেন?
ঠিক আছে, বেতনটাকে তিনগুণ করে দিতে বল।
তার মানে তিন লাখ?
হ্যাঁ। আর ওই পঞ্চাশ হাজার।
রেটটা চিপ হয়ে গেল না?
আরে না। এটা তো স্টপ গ্যাপ ব্যবস্থা।
গোপীদা আপনি সাক্কিতে কত বেতন পেতেন?
সে অনেক টাকা। আমার হিসেব নেই। তবে ফেবুলাস সামথিং। ব্যাঙ্কে জমা হত। টাকা রোজগারটা আমার কাছে অর্থহীন লাগে এখন। কোনও মানে হয় না। টাকা খরচা করারও তো পথ পাই না।
গরিবদের দিলে পারেন তো৷
দূর বোকা? তোর কি ধারণা গরিবদের টাকা বিলিয়ে দিয়ে তাদের উপকার করা যায়? টাকার ব্যবহার গরিবরা জানেই না। উলটোপালটা খরচ করে, মদটদ খায়, ফুর্তি করে। গরিবদের যদি কখনও দিতে হয় দিবি, কিন্তু আন্ডার গাইডেন্স, নইলে ওই টাকা কারও কারও বিপদ ডেকে আনতে পারে।
বুঝলাম। এবার আপনি ফ্ল্যাটে চলে আসুন। আমরা অপেক্ষা করছি।
আমরা। আমরাটা কে?
আমি আর আমার এক কলিগ।
কলিগকে টেনে এনেছিস কেন?
ইনি ভাল সিকিউরিটির কাজ জানেন বলে এনেছি।
তোকে তো বলেইছি আমার সিকিউরিটি গার্ড লাগবে না।
তবু দেখুন, পছন্দ না হলে ফিরিয়ে দেবেন।
তোকে নিয়ে আর পারা যায় না। পুলিশ এসেছে? উঁকি মেরে দেখ তো?
এখনও আসেনি গোপীদা।
গুড। আমি আসছি।
গোপীনাথ ফোন রেখে দেওয়ার পর সুব্রত ফোনটা ধীরে নামিয়ে রেখে ফিরে সোনালির বিবর্ণ মুখ দেখতে পেল।
কী বলছিল ও?
গোপীদাকে যতটা ইমপ্র্যাকটিক্যাল ভাবতাম ততটা নন। ক্লিয়ার ব্রেনে ভাবছেন। ডিটেলসে ভাবছেন, দ্যাটস এ গুড সাইন।
সোনালি দুর্বল গলায় বলল, কীসের গুড সাইন বলুন তো! আপনারা কি পাগল হয়ে গেলেন? এরকম ঝাকে ঝাকে গুলি ছুঁড়ে গেছে, আর একটু হলেই তো মরত, গুড সাইন কীসের?
আছে সোনালিদি, আছে। হি ইজ লিভিং ডেনজারাসলি, ঠিক কথা। কিন্তু উনি যে সিচুয়েশনটা সম্পর্কে সচেতন সেটাও তো একটা প্লাস পয়েন্ট।
এসব হেঁয়ালি আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
সুব্রত একটু হেসে বলল, আসলে বিপদ দেখে আপনি খুব ঘাবড়ে গেছেন, যাওয়ারই কথা, কিন্তু গোপীদা ঘাবড়াননি।
কী হয়েছিল বলল?
লোকটা যখন ভরা বেয়ে ওপরে উঠেছিল তখন গোপীদা কম্পিউটারে কাজ করছিলেন, উনি বললেন, উনি ঘরের আলোয় খুব সূক্ষ্ম একটা চেঞ্জ টের পেয়েছিলেন, বুঝলেন?
বুঝলাম।
না সোনালিদি, বোঝেননি। আরও তলিয়ে ভাবুন। নরম্যালি এত সূক্ষ্ম চেঞ্জ ধরাটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়, বিশেষ করে যখন আপনি খুব মন দিয়ে কোনও কাজ করছেন।
ও, তাই বুঝি?
তার মানে কী জানেন তো! গোপীদার সিক্সথ সেন্স খুব ভাল কাজ করছে। আর সেটাই এই সিচুয়েশনে সবচেয়ে ভাল খবর। ইট উইল সেভ হিম।
সোনালি ভ্রু কুঁচকে বলল, কিন্তু একদিন যদি সিক্সথ সেন্সটা ফেল করে তা হলে কী হবে?
সুব্রত নিপাট ভালমানুষের মতো বলল, সেইজন্যই তো আপনাকে দরকার।
আমাকে। বিস্মিত সোনালি বলল, আমাকে দিয়ে কোন কাজ হবে?
গোপীদার এখন বোধহয় সবচেয়ে প্রয়োজন আপনাকে। নইলে এই ত্রিভুবনে গোপীদার আর কোনও বন্ধু নেই।
কেন, আপনিই তো আছেন।
হ্যাঁ, আমিও গোপীদার খুব বিশ্বস্ত বন্ধু বটে, কিন্তু আমি চব্বিশ ঘন্টার বন্ধু নই।
আপনার গোপীদার কোনও বন্ধু নেই কেন বলুন তো।
যাঁরা জিনিয়াস তারা একটু বন্ধুহীন হন। আসলে ইন্টেলেকচুয়ালি তারা এত হাই যে, সমান মাপের মানুষ পাওয়া মুশকিল। তা ছাড়া ইগো প্রবলেম তো থাকেই।
তবু স্বীকার করবেন না যে, আপনার গোপীদা স্বার্থপর।
সুব্রত সবেগে মাথা নেড়ে বলল, না সোনালিদি, গোপীদা একজন হেল্পলেস ম্যান। কতটা অসহায় তা হয়তো আপনি জানেন না। এমনিতেই উনি একটু আনসোশ্যাল, সংসারী নন, তার ওপর কাজপাগল। আর এখন তো ঘোরতর বিপদে পড়ে সম্পূর্ণ এক্স কমিউনিকেটেড। উনি চাকরিটা নিতে চাইছেন কেন জানেন, টু বি ইন দি গেম এগেন। চাকরিতে জয়েন করলে বিপদও আছে। হি উইল হ্যাভ টু লিভ অ্যান এক্সপোজড লাইফ, ইজি টারগেট। গোপীদার সত্যিই কোনও বন্ধু নেই সোনালিদি।
সোনালি গম্ভীর হল। চিন্তিতও হয়তো উদ্বিগ্নও। সামান্য ধরা গলায় বলল, তবে চাকরি করতে দিচ্ছেন কেন? বারণ করুন না।
বারণ করার আমি কে? ওঁর ওপর আমার অধিকার সামান্য, তা ছাড়া ওঁর অলটারনেটিভই বা কী? পালিয়ে থাকলেও খুব সুবিধে হবে না, ওঁর পিছনে কারা লেগেছে তা তো বুঝতেই পারছেন। দুনিয়ার সবচেয়ে কৃতবিদ্য খুনিরা। তাও এক তরফ নয়, দুই তরফ, উনিও সেই কথাই বলছিলেন, পালিয়ে থেকে হবেটা কী, বরং ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে।
সোনালি ভাবছিল। ভ্রু কোঁচকানো এবং দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে থেকে। একটু বাদে বলল, আমার কী করা উচিত তা বুঝতে পারছি না।
যদি ইচ্ছে করে তবে গোপীদাকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা করতে পারেন।
আপনি তো জানেন, উই আর নো মোর রিলেটেড অ্যাজ হাজব্যান্ড অ্যান্ড ওয়াইফ। উই ওয়ার নেভার গুড ফ্রেন্ডস। সত্যি কথা বলতে কী, উই হ্যাড ভেরি লিটল রাপোর্ট। ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হত খুবই কম।
আমি গোপীদাকে জানি সোনালিদি, লোকটা ওই রকমই। কাণ্ডজ্ঞানের বেশ অভাব। কিন্তু হোপফুলি হি হ্যাজ চেঞ্জড।
সেটা প্রমাণসাপেক্ষ।
আচ্ছা, আচ্ছা, লেট হিম কাম।
সোনালি একটা শ্বাস ফেলে বলল, আমি বরং চলে যাই। আমাকে দেখলে হয়তো খুশি হবে না।
হু নোজ? একটু থেকেই যান।
হয়তো ভাববে আমি রি-এন্ট্রির চেষ্টা করছি।
গোপীদা কি মিনমাইন্ডেড সোনালিদি?
লোকটাকে আমি ভাল চিনি না।
কে কাকে চেনে? চিনতে সময় লাগে।
সোনালি নিরস্ত হল। তারপর কে জানে কেন, রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। হয়তো গোপীনাথ আসার মুহূর্তে সামনে থাকতে চায় না।
বাইরে মোটামুটি অন্ধকার হয়ে আসছে। গোপীনাথ একটু দেরি করছে আসতে। কৌতূহলী সুব্রত জানালার কাছে গিয়ে নীচে তাকাল। হ্যাঁ, পুলিশ এসেছে। কয়েকজন পুলিশ এবং বেশ কিছু কৌতূহলী লোক।
ডোরবেল বাজল। সুব্রত গিয়ে দরজা খুলতেই গোপীনাথের হাসিমুখ দেখা গেল।
কী রে?
আপনার জন্য আমরা ভেবে সারা হচ্ছি আর আপনি দিব্যি হাসিহাসি মুখ করে ঘরে ঢুকছেন?
তবে কি কাদব রে? তবে আমার বোধহয় শোকার্ত মুখ নিয়েই থাকা উচিত। কিন্তু কী হচ্ছে জানিস?
কী হচ্ছে?
আই অ্যাম এনজয়িং দা লাইফ থরোলি। যত ঘটনা ঘটছে ততই ভাল লাগছে। বুঝলি রে পাগলা মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আমি এত ভাল কোনওদিন থাকিনি।
বটে!
একজ্যাক্টলি। ভাবছি পাগল হয়ে গেলাম নাকি!
সুব্রত মাথা নেড়ে বলল, পাগলামি হলে টের পেতাম।
এখন কী করলাম জানিস?
কী করলেন?
নীচে গিয়ে পাঁচজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দিব্যি ডেডবডিটা দেখলাম। পুলিশ অফিসারের সঙ্গে একটু ঠাট্টা-ইয়ারকিও করলাম। একটুও ঘাবড়ে যাইনি। অথচ লোকটা একটু আগে আমার হাতেই
ফের গোপীদা?
যাকগে। এনি ওয়ে আই অ্যাম নাউ এ ভেরি কনফিডেন্ট ম্যান। মনে হচ্ছে আমার আরও এক জোড়া চোখ, আরও এক জোড়া কান এবং মগজে আরও কিছু ঘিলু কেউ সাপ্লাই দিয়েছে। দাঁড়া, আগে পোশাকটা পালটাই।
গোপীনাথ শিস দিতে দিতে শোয়ার ঘরে গিয়ে ঢুকল এবং কিছুক্ষণ পরে পরিষ্কার একটা সাদা লুঙ্গি আর গেঞ্জি চড়িয়ে বেরিয়ে এল। বলল, মুশকিল কী জানিস, মাঝে মাঝে বড্ড খিদে পায়।
খিদে।
হ্যাঁ। তোর ক্যাটারাররা দু’বেলা সেই মিল সার্ভ করে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জলখাবার তো দেয় না। ওটা আমাকে বানিয়ে নিতে হয়। কিন্তু সবসময়ে সময় হয় না, খেয়ালও থাকে না। তখন খিদে চেপে জল খেয়ে সময়টা কাটিয়ে দিতে হয়। হ্যাঁ, তা তোর সেই কলিগটি কোথায়? বিদেয় করে দিয়েছিস?
হয়তো বিদেয় হতে চাইবে না।
বটে। কিন্তু তাকে তো আমার দরকার নেই।
কে জানে দরকার আছে কি না। আগে আলাপ তো হোক।
রান্নাঘর থেকে সোনালি বেরিয়ে এল। হাতে একটা ট্রে। তাতে কফির কাপ, টোস্ট ওমলেট এবং কাটা ফল বিভিন্ন প্লেটে সাজানো। কিছু কাজুবাদামও দেখা যাচ্ছিল আলাদা পিরিচে। গোপীনাথের সামনের টেবিলে রেখে যখন দাঁড়াল সামনে, তখন গোপীনাথ যেন ভূত দেখছে। মুখে কথা নেই।
কথা কিছুক্ষণ হারিয়েই গেল যেন সকলের মুখ থেকে।
৩০.
বেশ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত থেকে গোপীনাথ খুব স্তিমিত গলায় বলল, তুমি! সোনালি মুখখানা যেন দাতে দাঁত চেপে কঠোর করে বলল, হ্যাঁ আসতে হল।
আমি তো সুব্রতকে বারণই করেছিলাম তোমাকে ডিস্টার্ব করতে। ও কথা শুনল না।
ও আমাকে এনেছে কে বলল?
সুব্রত আনেনি?
আমার ইচ্ছে না হলে কি আনতে পারত।
গোপীনাথ বোধহয় লজ্জা ও সংকোচে মাথা নিচু করে বলল, তুমি নিজের ইচ্ছেয় আমার সঙ্গে দেখা করবে ভাবিনি। আমার বড় অসময়ে এলে।
কীসের অসময়? তুমি কী করেছ?
গোপীনাথ অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, কোনও দোষ করেছি বলে তো মনে হয় না। কিন্তু ঘটনার একটা ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে গেছি। আমার কাছাকাছি কেউ থাকুক আমি চাই না। হি অর শি উইল বি ইন মরটাল ডেনজার।
সে তো খানিকটা আঁচ পাচ্ছিই। এরকম সাংঘাতিক অবস্থায় তুমি থাকছ কী করে?
একটু ম্লান হেসে গোপীনাথ বলল, থাকছি আর সাধে? থাকতে হচ্ছে। যাব কোথায়?
অন্তত কিছুদিনের জন্য তো একটু লুকিয়ে থাকা যায়।
মাথা নেড়ে গোপীনাথ বলে, কোথায় লুকোব? যেখানেই যাব সেখানেই ঘটনা ঘটবে। যাদের কাছে যাব তারা বিপদে পড়বে। আমি এখন অচ্ছুৎ। আমার কাছে তোমাদের আসার দরকার নেই। দেখছ তো কী কাণ্ড হয়ে গেল আজ। সাব মেশিনগান দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়ে যাচ্ছিল।
সোনালি একটু রেগে গিয়ে বলল, একটা কারণ তো থাকবে।
কারণ তো আছেই। আদ্রেঁর রিসার্চ নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া চলছে। সলিড ফুয়েল নিয়ে রিসার্চ। জিনিসটা যদি তৈরি করা যায় তা হলে খুব লাভজনক। তাই কম্পিটিটররা নেমে পড়েছে।
আদ্রেঁর দায় তোমার ঘাড়ে চাপছে কেন?
অনেকের ধারণা, কাজটা হয়তো আমি শেষ করতে পারি। সোনালি, তোমার পাসপোর্টটা কি ভ্যালিড আছে?
কেন থাকবে না? আছে।
ওঃ! বলে গোপীনাথ একটা কাতর শব্দ করল।
কী হল?
গোপীনাথ ফের ম্লান হেসে বলল, আমার তো কোনওকালেই কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু ছিল না। তোমার সঙ্গে যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে সেটা ভুলে গিয়ে এখনই একটা অন্যায্য আবদার করতে যাচ্ছিলাম।
সোনালি ভ্রু কুঁচকে চাপা গলায় বলল, কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
হ্যাঁ হ্যাঁ খাচ্ছি। আয় রে সুব্রত।
সুব্রত কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আমারও পাসপোর্ট আছে। আমি একবার হংকং গিয়েছিলাম। কোনও কাজ থাকলে বলতে পারেন।
তুই রোম শহরটা চিনিস না, সোনালি চেনে।
রোমে কোনও কাজ আছে?
হ্যাঁ। কিন্তু বিপজ্জনক কাজ।
কী কাজ?
একটা বন্ধ ফ্ল্যাটে ঢুকে একটা জিনিস খুঁজতে হবে।
কী জিনিস?
আদ্রেঁর ডায়েরি।
কোনও ফর্মুলা আছে নাকি?
কী আছে জানি না। তবে ওর পেপার্সে ডায়েরিটার রেফারেন্স আছে বারবার।
কাজটা খুব শক্ত কি?
খুব শক্ত।
তা হলে সোনালিদিকে বলছেন কেন?
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, ঠিক কাজ করিনি। আমার মাথাটা ঠিক নেই কিনা।
সোনালি একটু দূরে সোফায় বসে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, কী ঠিক করেছ, আমার ছোঁয়া কিছু খাবে না?
সেকী!বলে তাড়াতাড়ি কফির কাপ তুলে নিল গোপীনাথ। তারপর বলল, আমার সবকিছুই ডিসকর্ডে চলছে। সংগতিহীন আচরণ। তবে ইন্সটিংক্ট কাজ করছে। ভাল কাজ করছে।
সোনালি বলল, আমাকে অনভিপ্রেত মনে হলে সেটা বলে দাও। তা হলে আমি আর আসব না।
গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, অনভিপ্রেত কেন হবে? তা নয়। তবে তোমাকে আমার কাছে আর আসতে হবে না।
শোনো, তুমি আমাকে সহ্য করতে না পারলে আমি আসব না ঠিকই। কিন্তু যদি বিপদের ভয়ে আমাকে তাড়াতে চাও তা হলে আসব।
কেন সোনালি? তুমি কী করবে এসে?
তা জানি না। পরে ভাবব। সুব্রতবাবু, আপনি আমার বাড়িতে খবরটা দিয়ে দেবেন কি যে, আমি এই ভদ্রলোকের ফ্ল্যাটে আছি এবং হয়তো কয়েকদিন থাকব?
ওঃ সোনালিদি, বাঁচালেন।
গোপীনাথ মুখ গোমড়া করে বলল, তুই যে এত ইডিয়ট তা জানতাম না। মাথার গ্রে সেলগুলো তো একদম ইনঅ্যাক্টিভ দেখছি।
শোনো মিস্টার বোস, আমি থাকছি।
সোনালি, প্লিজ!!
একটা কারণেই থাকছি যে, দুটো মাথা সবসময়েই একটা মাথার চেয়ে বেশি কাজের। তোমাকে বাঁচানো দরকার।
গোপীনাথ কফি খেল। তারপর হঠাৎ টোস্টের প্লেটটা টেনে নিয়ে গোগ্রাসে খেতে লাগল। বলল, অনেকক্ষণ খিদে পেয়েছে। খাইনি।
সোনালি সুব্রতর দিকে চেয়ে বলল, আপনাকে একটু সাহায্য করতে বললে করবেন কী?
করব। বলুন।
আমার কিছু জিনিস চাই। একটা চিরকুট দিচ্ছি, আমার মাকে দেবেন। মা সব গুছিয়ে দেবে। সেটা এখানে আমার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
এটা কোনও কাজ হল? চিরকুটটা লিখে ফেলুন। এনে দিচ্ছি।
গোপীনাথ শুধু বলল, অবাধ্য।
কফি খেয়ে সুব্রত চটপট বেরিয়ে গেল। বলে গেল, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই আসছি। ততক্ষণ আপনারা সেটলমেন্টে আসুন।
সুব্রত চলে যাওয়ার পর সোনালি বলল, শোনো, আমি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাই এখন আর বিশ্বাস করি না। বিয়ে জিনিসটার ওপর কোনও আস্থা নেই আমার। কিন্তু বন্ধুত্ব জিনিসটাকে মানি৷ তুমি আমাদের বিয়েটাকে ভুলে গেলে ভাল হয়। আমি আজ বন্ধুর মতোই এসেছি, নট অ্যাজ অ্যান এক্স-ওয়াইফ।
গোপীনাথ হঠাৎ মুখ তুলে সোনালির চোখে চোখ রেখে বলল, তুমি কখনও আমার বন্ধু ছিলে? আমাদের বন্ধুত্বের রিলেশনটাই বা কবে কীভাবে হল?
আমরা একসঙ্গে তো কিছুকাল ছিলাম।
ওই পর্যন্তই। একসঙ্গেও কি ছিলাম?
সেটা তোমার দোষ।
কবুল করছি। আমি তোমাকে কম্পানি দিইনি। আমি বর্বরের মতোই ব্যবহার করেছি। তাই আমরা যেমন স্বামী-স্ত্রী হইনি, তেমন বন্ধুও হয়ে উঠিনি। তাই আজ হঠাৎ তোমার এই বন্ধুর মতো আগমনটা অস্বাভাবিক।
সোনালি খোঁচা খেয়ে লাল হল। তীব্র গলায় বলল, তুমি তো সত্যিই বর্বর। কারও বন্ধুত্ব পাওয়ারও যোগ্য নয়।
গোপীনাথ হিমশীতল গলায় বলল, শোনো আমি বর্বর হলেও আমার কতকগুলো নিজস্ব মর্যাল ভ্যালুজ আছে। নিঃসম্পর্কের কোনও মহিলার সঙ্গে এক ফ্ল্যাটে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
সোনালি এ কথায় ছিটকে উঠে দাঁড়াল। তীব্রতর গলায় বলল, তোমার মর্যালিটি শুনে আমার হাসি পায়। ইউ ওয়্যার অলওয়েজ এ লায়ার, এ চিট, এ ডিবচ।
ঠান্ডা গলায় গোপীনাথ বলল, হ্যাঁ, ঠিক কথা। আমার ওসব দোষও আছে। যদি জানোই, তা হলে হঠাৎ আজ বন্ধুত্ব পাতাতে এলে কেন?
কেন বলে তোমার মনে হয়?
মে বি ইউ আর আফটার মাই মানি।
উত্তেজিত সোনালি দাতে দাঁত ঘষে বলল, মানি! মানি! লজ্জা করল না বলতে? যখন রোম থেকে সুব্রতকে ফোন করে আমাকে সর্বস্ব দিতে চেয়েছিল তখন কে রিফিউজ করেছিল?
গোপীনাথ তেমনি উত্তেজনাহীন নিষ্ঠুরতায় বলল, মে বি নট মানি, বাট ফর সাম আদার রিজিনস।
হোয়াট আর দোজ রিজিনস?
গোপীনাথ একটা হাই তুলে বলল, সেটা ভাবতে হবে।
তুমি তোমার এত সাহস যে, আমাকে
সোনালি কাঁদত হয়তো। কিন্তু শক্ত হল। তার চোখ থেকে উগ্র ঘৃণা শরাঘাতে জর্জরিত করছিল গোপীনাথকে। সে বলল, তোমার বন্ধুত্বটাকে কেন বিশ্বাস করি না জানো? ওটা অ্যারেঞ্জড বন্ধুত্ব। তোমাকে কেউ শিখিয়ে পড়িয়ে এনেছে।
অলরাইট, আই অ্যাম লিভিং।
গুড নাইট।
সোনালি প্রায় দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল এবং বেরিয়ে গেল। দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হাসল গোপীনাথ। কৌশলটা যে এত সহজে কাজ করবে তা প্রত্যাশিত ছিল না। আপাতত দুশ্চিন্তা কমল। সোনালি নিরাপদ।
গোপীনাথ চুপচাপ বসে ট্রে-র সমস্ত খাবারগুলো শান্তভাবে খেয়ে নিল। তার খিদে পেয়েছিল, কিন্তু এতক্ষণ টের পায়নি।
খেয়েদেয়ে ট্রে-টা রান্নাঘরে যখন রাখতে গেল গোপীনাথ তখন ডোরবেল বাজল। গোপীনাথ ধীরেসুস্থে গিয়ে দরজা খুলে দেখল, পুলিশ।
স্যার, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
আপনারা কি পুলিশের লোক? তা হলে আমারই আপনাদের কাছে যাওয়ার কথা।
কেন বলুন তো?
জাস্ট লুক অ্যাট মাই রুম।
পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালেন, মাই গড। ঘটনাটা তা হলে এ ফ্ল্যাটেই ঘটেছে?
দেখতেই তো পাচ্ছেন। ভাগ্যিস আমি ঘটনার সময় ফ্ল্যাটে ছিলাম না! কী কাণ্ড বলুন তো! এসব কি টেররিস্ট গ্রুপটুপের কাজ নাকি মশাই?
তা এখনই বলতে পারি না। লোকটা বিদেশি। তার কাছ থেকেও কিছু জানার উপায় নেই। কারণ লোকটা মারা গেছে। পকেটে কাগজপত্র বা পাসপোর্টও পাওয়া যায়নি। আপনি একবার নীচে গিয়ে লোকটাকে দেখবেন? হয়তো আপনি চিনতে পারেন। আপনাকেই যখন মারতে এসেছিল।
গোপীনাথ শান্ত গলায় বলল, তার দরকার নেই, নীচে ভিড় দেখে আমি স্পটে গিয়ে লোকটাকে দেখেছি। ওকে আমি চিনি না, চেনার কথাও নয়। ওপরে এসে দেখছি এই কাণ্ড।
দু’জন পুলিশ অফিসার ঘরে এসে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখল। জানালার কাছে গিয়ে উকিঝুঁকি দিল। তারপর সোফায় এসে বসে বলল, এবার আমাদের কিছু প্রশ্নের জবাব দিন দয়া করে।
আমার নাম গোপীনাথ বসু। সায়েন্টিস্ট এবং এনআরআই। রোমে থাকি। সাক্কি ইনকরপোরেটেড নামে কোম্পানিতে চাকরি করি। ডিভোর্সি। কয়েকদিন হল দেশে এসেছি। আর কী জানতে চান বলুন!
আপনাকে খুন করে কার লাভ হতে পারে?
আমার জানা নেই।
আপনার কোনও শত্রু আছে? দেশে বা বিদেশে?
না মশাই, আমার খুব সাদামাটা লাইফ। ভেরি সিম্পল।
আপনার পাসপোর্টটা দেখাতে পারেন কি?
কেন পারব না? বলে গোপীনাথ উঠে গিয়ে পাসপোর্টটা নিয়ে এসে পুলিশ অফিসারের হাতে দিল। অফিসার সেটা খুঁটিয়ে দেখে সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে দিয়ে বলল, লোকটা বিদেশি বলেই বলছি, রোমে কিছু ঘটনা ঘটেনি তো!
না। কী ঘটনা ঘটবে?
এই ফ্ল্যাট কি আপনার নিজস্ব?
হ্যাঁ। কয়েক বছর আগে কিনেছিলাম।
এখানে কে থাকে?
আমি এলে থাকি। নইলে ফাঁকা তালাবন্ধ পড়ে থাকে।
কেউ থাকে না?
না।
ঠিক আছে। আগে লোকটার আইডেন্টিটি বের করি, তারপর আমরা আবার আসব।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
ইতিমধ্যে আপনি, আশা করি, কোথাও যাবেন না!
আমার ছুটি খুব বেশি দিনের নয়। আপনারা একটু তাড়াতাড়ি করলে ভাল হয়।
চেষ্টা করব স্যার।
দ্বিতীয় পুলিশ অফিসারটি এতক্ষণ কথা বলেনি। এবার বলল, আপনি কি সাধারণত এই ঘরেই থাকেন বা কাজ করেন?
হ্যাঁ। কম্পিউটারের সামনে দিনের অনেকটা সময় কাটে আমার।
আমরা ভাবছি, খুনি খালি ঘরে গুলি চালাল কেন। সেটা তো লজিক্যাল নয়।
তা জানি না। এমনও হতে পারে লোকটা তলা ভুল করেছে। তাড়াহুড়ো ছিল বলে ভাল করে ঘরটা দেখেনি।
আমরা সব পসিবিলিটি নিয়েই ভাবব।
পুলিশ যাওয়ার পর গোপীনাথ দরজা বন্ধ করল এবং বেশ আরাম করে পা ছড়িয়ে সোফায় বসে টিভিটা চালু করল। টিভির দিকে অর্থহীন চেয়ে থেকে সে ভাবছিল। মনের ভিতর একটা কেমন ওলটপালট হচ্ছে সোনালিকে দেখার পর থেকে। সোনালি সুন্দরী। কিন্তু মেয়েদের সৌন্দর্য ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামানোর নেই গোপীনাথের। বিদেশে সে সুন্দরী তো কম দেখেনি। আর সুন্দরী বলেই হঠাৎ তার এতকালের ঠান্ডা বুকে ঝড় উঠবে তাও নয়। কিন্তু যেটা তাকে সামান্য হলেও স্পর্শ করেছে তা হল সোনালির এই পাশে এসে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা। এবং এই সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়ে। গোপীনাথের জীবন শুকনো নিঃসঙ্গ। এই উষরতার মধ্যে একটা যেন একটু জীবনের ছোঁয়া, হঠাৎ যেন অন্য জগতের দরজা একটু ফাঁক হয়ে গেল।
বোকা সোনালি গোপীনাথের কৌশলটা ধরতে পারেনি। রেগে চলে গেল, অর্থাৎ যা গোপীনাথ চেয়েছিল। এখন গোপীনাথ নিশ্চিন্ত। শত্রু বা মৃত্যুর সম্মুখীন হতে এখন আর তার দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের কিছু নেই।
ডোরবেল বাজল আধঘণ্টা বাদে। গোপীনাথ বেড়ালের মতো চকিত পায়ে গিয়ে আই হোলে চোখ রাখল। সুব্রত।
দরজা খুলে বলল, আয়।
সুব্রত গম্ভীর মুখে বলল, সোনালিদিকে নাকি অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন?
হ্যাঁ। একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেল। ক্ল্যাশ অব ইগো। আগেও হত।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। সোনালিও আমাকে অপমান করেছে।
সুব্রত ঘরে ঢুকে বলল, চালাকি ছাড়ুন গোপীদা।
চালাকি! চালাকির কথা উঠছে কেন?
আপনি ইচ্ছে করে একটা ঝগড়া পাকিয়ে সোনালিদিকে এখান থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছেন।
ওরে পাগলা, তা নয়।
তাই গোপীদা, আমি জানি।
তা হলে বলি শোন, সোনালির কোনও বিপদ হোক তা আমি চাই না। এই বিপদের মধ্যে কিছুতেই ওকে রাখতে পারি না।
কিন্তু উনি চালাকিটা যে ধরে ফেলেছেন।
অ্যাঁ!
হ্যাঁ।
সোনালি আড়াল থেকে দরজার ফ্রেমে এসে দাঁড়াল। মুখ গম্ভীর।