প্রথম কিছুক্ষণ কিছুই ঘটল না। চারদিক নিস্ফূপ, শুধু ঝিঝি ডাকার শব্দ।
মহেন্দ্র উত্তর্ণ হয়ে ছিলেন, চাপা গলায় বললেন, ।ভেতরে কী হচ্ছে কে জানে। আমাদেরও কি ভেতরে যাওয়া উচিত?
পবন বললেন, ক্ষেপেছো? ওই খাড়া নিমগাছ বেয়ে ওঠা আমার কম্ম নয়। আমি বাঘ ভাল্লুককেও ডরাই না, কিন্তু খাড়া জায়গায় উঠতে আমার ভারি ভয়।
কিন্তু তা বলে তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। পরঞ্জয়বাবুকে তো দেখলে, এই বয়সেও কেমন তরতর করে উঠে গেলেন।
আরে ওঁর কথা বাদ দাও। জঙ্গলে থেকে থেকে ওঁর একটা জংলি ভাব এসে গেছে। হয়তো হনুমান আর বাঁদরদের কাছে ট্রেনিং নেন। উনি পারলে কি আমাদেরও পারতে হবে?
একটু চেষ্টা করলে হত। আমার বেশ উদ্বেগ হচ্ছে।
আচমকা পবন হাত বাড়িয়ে মহেন্দ্রর মুখে চাপা দিয়ে বলল, চুপ! কে যেন আসছে। এসো, ওই ঝোঁপটার আড়ালে দাঁড়াই।
অন্ধকার তাঁদের চোখে সয়ে গেছে। তাই দেখতে তেমন অসুবিধে হচ্ছিল। পুকুরের ধার ধরে একজন নয়, পরপর তিনটে ভুতুড়ে মূর্তিকে সন্তর্পণে আসতে দেখা গেল। হাবভাব মোটেই ভাল নয়।
খুব চাপা গলায় পবন বললেন, অন্ধকারে ঠাহর করা মুশকিল। তবে মনে হচ্ছে এরা সেই তিন চোর।
কাদের কথা বলছো?
একজন হল জগা, অন্যজন পাগলু, তিন নম্বরটা ওদের এক স্যাঙাৎ। নাম জানি না।
মহেন্দ্র বললেন, হুঁ, জগা আর পাগলুকে চিনি। এরা চায় কী?
গুপ্তধন ছাড়া আর কী চাইবে বলো! কয়েক ঘণ্টা আগেই এদেরই তো অজ্ঞান করে ফেলে রেখে এসেছিলেন আমাদের সুজনবাবু। ওষুধটা হয়তো তেমন জোরালো ছিল না, তাই চটকা ভাঙতেই তিনজন হাজির হয়েছে এসে। ভালই হয়েছে। এদের কাজে লাগানো যেতে পারে।
তার মানে?
শোনো, মানে না জেনে কি আর কথাটা তুলেছি? ভেতরে কী ঘটছে না ঘটছে আমরা জানি না, এদের তিনজনকে যদি ভেতরে পাঠানো যায় তাহলে পরঞ্জয়বাবুর একটু জোর হয়। এদের কাছে গাছ বেয়ে ছাদ ডিঙানো কোনও সমস্যা নয়। লোকবলও তো দরকার।
কিন্তু এরা যদি খুনোখুনি করে?
সে এলেম এদের নেই। ছাপোষা ছিচকে চোর সব। তুমি বাক্সটা নিয়ে আড়ালে থাকো, আমি গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা কই।
দেখো, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন না নষ্ট হয়।
হবে না। কোনও ভয় নেই, তাছাড়া সুজনের ওপর এদের রাগও আছে সেই রাগটাও আমাদের কাজে লাগবে।
পাগলু, জগা আর রামু ইতিউতি চাইতে চাইতে নিমগাছটার তলাতেই এসে দাঁড়াল। তাদের চোরের চোখ, বাড়ির ভেতরে ঢোকার এইটাই যে সোজা পথ তা লহমায় বুঝতে পেরেছে।
জগা বলল, পাগলুদাদা, এবার কী করা?
জয় মা বলে ঢুকে পড়তে হবে। সুজনবাবু এতক্ষণে কাজ সেরে ফেলেছে কি না কে জানে।
রামু বলল, আরে নেহি ভাই, কাম সারতে সোময় লাগবে। লেকিন হামলোক ঘুসে করব কী?
কেন, আর কিছু না হোক সাতকড়ির বাড়িতে দামি জিনিসের অভাব কী? সুজনবাবু ভাগ না দিলে অন্যভাবে পুষিয়ে নিতে পারবে।
জগা আর পাগলু একইসঙ্গে বলে উঠল, হা, সেটা ঠিক কথা।
তাছাড়া সুজনবাবুও পিস্তল হাতে সাতকড়ির বাড়িতে ঢুকেছে, তাকেও পেয়ে যাবে। মোকাবিলাটাও করে নিতে পারবে।
জগা আর পাগলু সোৎসাহে বলে উঠল, তা তো বটেই।
হঠাৎ রামু বলে উঠল, আরে ভাই, ই তো তাজ্জব কি বাত, হামলোগ তো তিন আদমি থা, লেকিন এই চৌঠা আদমি কৌন আছে?
জগা বলল, হা হা, তাই তো, এ পাগলুদাদা, আমরা তো তিনজন ছিলাম, তাই না?
তাই তো মনে হচ্ছে।
দাঁড়াও তো গুনে দেখি, এক…দুই…তিন…চার…নাঃ, এ তো চারজনই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে দেখছি, তবে কি চারজনই ছিলাম?
পাগলু একটু মাথা চুলকে বলল, মাথাটা ভাল কাজ করছে না। সুজনবাবু যে কী ওষুধটা খাওয়ালেন, মাথাটা একেবারে গুবলেট হয়ে গেছে। তিনজন না চারজন থাকার কথা সেটা পর্যন্ত ভুল হয়ে যাচ্ছে।
এবার চতুর্থজন মোলায়েম গলায় বলল, দুশ্চিন্তা কোরো না হে, আমি তোমাদের দলের লোক নই। আমার নাম পবনকুমার সামন্ত।
পাগলু সঙ্গে সঙ্গে হাতজোড় করে বলল, উরেব্বাস, পবনবাবু! প্রাতঃপেন্নাম হই, প্রাতঃপেন্নাম হই, তা আপনি এখানে?
কাজেই এসে পড়েছি। ভিনগাঁয়ে অচেনা জায়গায় তোমাদের দেখে ভারি ভালও লাগছে। তোমরা কেন এসেছো তাও জানি। আর দেরি না করে এই গাছ বেয়ে ছাদে উঠে যাও। ভেতরে ঢোকার পথ পাবে, সুজনবাবু আর নিতাই পালও ঢুকেছে। আর শোনো, পঞ্জয়বাবুকে চেনো?
আজ্ঞে, খুব চিনি।
উনিও আছেন, তবে উনি আমাদের লোক। যাও ঢুকে পড়ে গিয়ে।
যে আজ্ঞে।
বলে তিনজন আর দ্বিরুক্তি না করে গাছ বেয়ে উঠে পড়তে লাগল, তাদের কাছে কাজটা জলবত্তরলং। ছাদে উঠে তিনজন দেখল সিঁড়িঘরের দরজা হাট করে খোলা।
পাগলু বলল, চল চল, দেরি হয়ে না যায়।
তিনজনেই অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নেমে এল। রামু চাপা গলায় বলল, ভাই, হামার হিস্যা উস্যা লাগবে না। হামি এখুন যা পারি মাল নিয়ে চলিয়ে যাবো, তুমলোগ হিস্যা উস্যা বুঝে লিও।
জগা বলল, আরে মাল তো আমরাও সরাব, এখন আলাদা হলে কিন্তু ভাল হবে না রামুদাদা।
আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে।
বাড়িটা বিশাল, অন্ধকারে ঘুরে ঘুরে তারা দিশাহারা হয়ে যেতে লাগল। ঘরের পর ঘর, তার ফাঁকে ফাঁকে অজস্র অলিগলি, রাজ্যের জিনিসপত্র চারদিকে। কিন্তু লোকজন কোথাও আছে বলে মনে হল না।
পাগলু বলল, হ্যাঁ রে, সাতকড়ি কি এত বড় বাড়িতে একা থাকে?
তা কে জানে?
লোকজন নেই কেন?
থাকার তো কথা। দিনুগুণ্ডা বলেছিল, সাতকড়ির চারদিকে নাকি শক্ত পাহারা।
দূর! কোথায় কী? সুজনবাবুদেরও তো চিহ্ন দেখছি না।
শোনো পাগলুদাদা, আমার মনে হয়, নিচের তলাতেই আসল গাড্ডা, চলো নিচে নামি।
তারা ধীরে ধীরে একতলায় নেমে এল। সিঁড়ির গোড়াতেই মস্ত মোটা শক্ত গরাদ দিয়ে পথ আটকানো।
ও বাবা! এ যে দেখছি জেলখানার ফটক।
পাগলু বলল, ওরে ভাল করে দেখ, ওরা যখন ভেতরে ঢুকেছে তখন গরাদেও ফাঁক আছে।
বাস্তবিকই তাই, দেখা গেল, গরাদের গায়ে তালাটা ঝুলছে বটে, কিন্তু সেটা ভোলা, সন্তর্পণে তালা সরিয়ে তারা ফটক খুলে ঢুকল।
একতলাতেও আর এক ভুলভুলাইয়া। চারদিকে অজস্র গলিখুঁজি, অজস্র ঘর, অজস্র বন্ধ দরজা।
জগা বলল, এ তো গোলকধাঁধাঁ দেখছি।
রামু জিনিসপত্র খুঁজতে খুঁজতে বলল, হাঁ হাঁ উ বাত তো ঠিক আছে। কিন্তু চুরানেকে লিয়ে কোই চিজ তো মিলছে না রে জগুয়া।
মিলবে মিলবে। সবুরে মেওয়া ফলে।
তিনজনে মিলে গুটিগুটি এগোতে এগোতে আচমকাই একটা পিস্তলের শব্দ পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। দুম দুম করে দুটো ফায়ার হল। কে যেন আঃ বলে একটা আর্তনাদ করে উঠল।
ই কী পাগলুদা?
ওরে, খেল শুরু হয়ে গেছে, চল চল।
শব্দটা সামনে থেকেই এসেছিল। তিনজনে একটু দ্রুত পায়ে এগোতে লাগল।
বেশিদূর এগোতে হল না। সামনে একটা লম্বা প্যাসেজের শেষ প্রান্তে একটা লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বেশ লম্বাচওড়া লোক।
তিনজনেই হাঁটু গেড়ে বসে লোকটাকে ঠাহর করল, পাগলু বলল, এই তো পরঞ্জয়বাবু!
.
২৭.
পরঞ্জয়বাবুর বাঁ কাঁধে গুলি লেগেছে। রক্তে ভাসাভাসি কাণ্ড। তবে শক্ত ধাতের লোক বলে জ্ঞান আছে। একটু আঃ উঃ করে উপুড় থেকে পাশ ফিরে কাত হয়ে তাদের দিকে চেয়ে বললেন, তোমরা কারা?
পাগলু বলল, আমি পাগলু, এ জগা আর ও রামুয়া। আপনাকে কারা মারল?
বোধহয় সুজনবাবু। অন্ধকারে কি আর ভাল করে দেখেছি? তবে চিন্তার কিছু নেই। চোট লেগে কাহিল হয়ে পড়লেও মরছি না। তোমাদের আমি চিনি। হরিপুরের লোক তোমরা, চুরিটুরি করো, তাই না?
যে আজ্ঞে।
শোনো বাপু, সুজনবাবুর সঙ্গে নিতাই পাল আর শূলপাণিও আছে। তবে শূলপাণিকে ওরা ধরে এনেছে, তার দুটো হাত বাঁধা বলেই মনে হল। তোমরা একটু এগোলে বাঁয়ে পথ পাবে। ওরা আমাকে গুলি করেই ওদিকে গেছে। সাবধান।
যে আজ্ঞে। কিন্তু ওনাদের সঙ্গে এঁটে ওঠা যাবে কি? দেখি চেষ্টা করে।
পরঞ্জয়বাবু উঠে বসলেন, বললেন, হেঁটে যেও না, হামাগুড়ি দিয়ে যাও, পিস্তল তুললে মেঝেতে শুয়ে পড়লেই হবে। যাও।
তিনজনে এগোতে লাগল, বাঁয়ে একটা গলি পেয়ে একটু ঢুকতেই সামনে একটা ঝনাৎ করে শব্দ হল, সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর গলা আওয়াজ কৌন হ্যাঁয় রে?
ফের একটা গুলির শব্দ এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্তনাদ।
জগা বলল, বাপ রে! এতো খুন-খারাপির কারবার!
পাগলু বলল, তাই দেখছি। তবু চল এগোই।
গলিটা ডানধারে বেঁকেছে এবং সেখানে একটা লোহার দরজা। এখানেও একটা লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে, তার হাতে একটা খোলা ভোজালি। অন্য হাতে টর্চ, টর্চ জ্বেলে দেখা গেল, এ লোকটার পেটে গুলি লেগেছে। জ্ঞান নেই, তারা আর সময় নষ্ট না করে দরজাটা ঠেলল, সেটা খুলেও গেল।
পাগলু বলল, সুজনবাবু যে আমাদের চেয়েও অনেক পাকা লোক দেখছি!
রামু বলল, হাঁ হাঁ, উস্তাদ লোক আছে, ইনকো পাস শিখনেসে আচ্ছা হোগা।
একটু সামনে সুজনবাবুরা একটা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সুজনবাবু বললেন, নিতাই, এটাই সাতকড়ির ঘর মনে হচ্ছে। দরজাটা কাঠের হলেও বেশ ভারী আর কারুকাজ করা।
তাই তো মনে হচ্ছে।
সুজনবাবু শূলপাণির দিকে চেয়ে বললেন, এবার বলো শূলপাণি, সাতকড়িকে কী বলতে হবে।
আমি জানি না।
তুমি সব জানো। সাতকড়ির সঙ্গে তোমার যোগাযোগ ছিল, তুমি প্রায়ই এখানে আসতে সেটা তো নিজের মুখেই কবুল করেছে।
তা আসতাম। তবে সংকেত-টংকেত কিছু জানি না।
সে কথা বললে হবে কেন? সাতকড়িকে খোলানোর কৌশল তোমার ভালই জানা আছে।
আমাকে ছেড়ে দিন, আমি কিছু জানি না।
দেখ বাপু, তীরে এসে তরী ডুবলে তো আমার চলবে না। হাতে বেশি সময়ও নেই। টালবাহানা করলে আমাকে অন্য পন্থা নিতে হবে।
এই বলে সুজনবাবু পিস্তলটা একটু নাচালেন।
ভয় খেয়ে শূলপাণি বলল, আজ্ঞে বেবাক ভুলে গেছি।
কিছুই ভোলোনি বাপু। ভুলবার পাত্র তুমি নও। পাগল সেজে অনেকের চোখকে ফাঁকি দিয়েছে বটে, কিন্তু আমাকে পারোনি। হরিদাসপুরের আর্মারি লুটের ফেরারী আসামী তুমি। হরিপুরে ঘাপটি মেরে পাগল সেজে চোরাই অস্ত্রের চালানদার ছিলে। তোমার নামে হুলিয়া বেরিয়েছিল। যদি ভাল চাও তো যা বলছি করো। নইলে বিপদ আছে।
শূলপাণি মাথাটা ঝুঁকিয়ে একটু চুপ করে থেকে বলল, আপনি যা শুনেছেন তার সব সত্যি নয়। আর্মারি লুটের দলে আমি ছিলাম বটে, কিন্তু নিজের ইচ্ছেয় নয়। না থাকলে আমাকে খুন করা হত। আর অস্ত্র চালানের ব্যাপারেই আমার কী করার ছিল বলুন। আপনার স্যাঙাৎ নিতাই পালই তো ছিল নাটের গুরু! যাকগে এসব কথা, আমার জীবনের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে। নইলে সাতকড়িবাবুর কাছ থেকে ভাল রকম দাঁও মেরে কবেই বড়লোক হতে পারতুম। কিন্তু আমার জানা ছিল ও সম্পত্তির অন্য মালিক আছে। আমি তোক তো খারাপ নই সুজনবাবু।
না, তুমি গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসীপাতা। বেশি সাধু সেজো না, তোমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিলে বোধহয় পাঁচ-দশ হাজার টাকা পুরস্কারও পাওয়া যাবে। যা বলছি যদি ঠিকঠাক করো তাহলে ছেড়ে তো দেবই, চাও তো বখরাও দিতে পারি।
আগে বলুন, সাতকড়িবাবুকে খুনটুন করবেন না।
আরে না হে, না। খুন করব কেন? খুনের অনেক ফ্যাঁকড়া। কাজটা গুছিয়ে নিতে পারলে ওসব করতে যায় কোন বোকারাম?
তাহলে পিস্তলটা আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিন।
একটু দোনোমোনো করে সুজনবাবু তাই করলেন। শূলপাণির দু’হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, সুতরাং সে পিস্তল দিয়ে কিছু করতে পারবে না।
শূলপাণি গলাখাঁকারি দিয়ে চোখ বন্ধ করল। তারপর বেশ সুরেলা গলায় গীতার একটি শ্লোক আবৃত্তি করতে লাগল, ন চ তিষ্ঠামি বৈকুণ্ঠে, যোগীনাং হৃদয়ে ন চ, মদ্ভা যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদঃ…. ইত্যাদি। শ্লোক আবৃত্তি শেষ হলে শূলপাণি ডাকল, সাতকড়িবাবু, আমি শূলপাণি, দরজা খুলুন।
ঠিক তিনবার কথাটা বলে সে চুপ করল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর দরজার খিলটিল খোলার আওয়াজ হতে লাগল। একটু পরেই একটা দরজা ফাঁক হয়ে একজন বুড়ো মানুষ দেখা দিলেন। হাতে লণ্ঠন। এত লোক দেখে একটু তটস্থ হয়ে বললেন, এসব কী শূলপাণি? এরা কারা?
জবাবটা দিলেন সুজনবাবু, আমরা আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই, সময় বেশি নেই।
বুড়ো মানুষটি খুবই অবাক হয়ে বললেন, এই মাঝরাতে এমন কী কথা!
মাঝরাতে ছাড়া সুবিধে হচ্ছিল না মশাই, চলুন, ভেতরে চলুন।
সাতকড়িবাবুকে একরকম ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে সুজনবাবু ঢুকলেন, বিনা ভূমিকায় বললেন, সাতটা কড়ি আর সাতটা পয়সার রহস্যটা কী তা আমি জানি না। কিন্তু আমিই সেই পয়সা আর কড়ির মালিক। এবার আমার পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিন।
আপনি মালিক? কিসের মালিক! পয়সা বা কড়িই বা কিসের? আমি ওসব কিছু জানি না। আপনি কি ডাকাতি করতে ঢুকেছেন?
তাও বলতে পারেন। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আমি আঙুল বাঁকাতেও জানি।
হঠাৎ সাতকড়ির সাতানব্বই বছরের জীর্ণ শরীরটা টানটান হয়ে দাঁড়াল। গলার জোরও বাড়ল। সাতকড়িবাবু বললেন, বাপু হে, আমার বয়স সাতানব্বই হয়েছে, আমাকে ভয় দেখিও না। প্রাণের ভয় আমার নেই। অন্যায্য কিছু আমার কাছে আদায় করতে পারবে না। তবে জোর খাটালে খাটাতে পারো।
সুজনবাবু বিনা বাক্যব্যয়ে শূলপাণির পকেট থেকে পিস্তলটা টেনে বের করে বললেন, তবে তাই হোক। আমাদের আর তর্ক করার সময় নেই। কাজ হাসিল করে কেটে পড়তে হবে।
সুজনের বোধহয় ইচ্ছে ছিল সাতকড়িবাবুকে ঘায়েল করে চাবির গোছাটা হাতিয়ে নিয়ে ঘরে রাখা সিন্দুক আর বাক্সগুলো খুলে যা পারেন হাতিয়ে নেবেন। কিন্তু পিস্তলটা তুলতে যেতেই হঠাৎ শূলপাণি তাঁর হাতে একখানা পেল্লায় লাথি কষিয়ে নিজেও পড়ে গেল। সুজনবাবুর হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে গিয়ে দেয়ালে লেগে মেঝেয় পড়ল।
সুজনবাবু হিংস্র গলায় বললেন, বীরত্ব দেখাচ্ছো! বীরত্ব! দাঁড়াও বীরত্ব বের করছি।
সুজনবাবু পিস্তলটা গিয়ে কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে দাঁড়াতেই তিনটে আবছা মূর্তি হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। সুজনবাবু পিস্তলটা তুলবার সময় পেলেন না। তার আগেই তাঁকে কোমর ধরে পেড়ে ফেলল জগা। নিতাই পালকে পাকড়াল রামু আর পাগলু।
.
আধঘণ্টা বাদে ঘরের মধ্যে জড়ো হলেন পরঞ্জয়, পবন এবং মহেন্দ্র। শূলপাণির বাঁধন খুলে সুজন আর নিতাইকে বাঁধা হয়েছে।
সাতকড়ি একখানা আসত কাঁচ দিয়ে মহেন্দ্রর পয়সা আর কড়িগুলো দেখছিলেন। তারপর বললেন, সব ঠিকই আছে বাবা, তোমার প্রপিতামহ দীর্ঘজীবী ছিলেন, রসিকও ছিলেন। আমাকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বলেছিলেন, ব্যবসায় খাটাতে। আর বলেছিলেন যদি তাঁর নাতি বা তস্যপুত্র কেউ সংকেত ভেদ করে দাবি করে তাহলেই এই টাকা শোধ দিতে হবে। নইলে নয়। তা আমার বাপু টাকা-পয়সার তেমন দরকার নেই। ভোগই বা করবে কে বলো! যক্ষের মতো লাখো লাখো টাকা আগলে আছি বলেই বোধহয় প্রাণটাও বেরোচ্ছে না। তুমি আমাকে এবার ভারমুক্ত করো।
সিন্দুক খুলে টাকার বান্ডিল বের করতে করতে সাতকড়িবাবু বললেন, তা সুদে আসলে বড় কমও হয়নি। ধরো প্রায় সাত লক্ষ টাকা।
সুজন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ভোর হচ্ছিল,জানালা দিয়ে একটুকরো তেরছা লাল রোদ এসে দেয়ালে পড়ল।