২৬. স্বর

স্বর

ইন্দো-ইয়োরোপীয় শ্বাসাঘাত পদ্ধতি বৈদিক সংস্কৃতের মধ্যেই সবচেয়ে ভালভাবে সংরক্ষিত হয়েছিল; এই শ্বাসাঘাত সম্পূর্ণত ব্যাকরণগত কাঠামোর উপর নির্ভরশীল, অর্থের ভূমিকা এখানে নিতান্তই গৌণ। বিভিন্ন শব্দের রূপতাত্ত্বিক ও ব্যাকরণগত চরিত্র অনুযায়ী তা নির্ধারিত, পদাৰ্থয়ের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। ধ্রুপদী সংস্কৃতের সঙ্গে বৈদিক ধ্বনিতত্ত্বের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্ৰভেদ। এখানেই যে বৈদিক ভাষা শব্দের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপেই স্বাধীন সাঙ্গীতিক শ্বাসাঘাত ব্যবহার করে। ভিন্ন ভিন্ন রচনায় তার প্রয়োগ যেমন ভিন্ন, তেমনি মূল্যও পৃথক।

প্রাচীন ভাষাগুলিতে দু’ধরনের শ্বাসাঘাত প্ৰচলিত ছিল; এদের একটি হল উচ্চারণের ঝোক অনুযায়ী গ্রিকরীতির শ্বাসাঘাত এবং অন্যটি হল বৈদিক সুক্তে ব্যবহাত সাঙ্গীতিক, স্বরের আরোহন-অবরোহণ নির্ভর শ্বাসাঘাত। কণ্ঠস্বর যখন উচ্চগ্রামে উন্নীত হয়, তাকে বলে ‘উদাত্ত’, মধ্যম অবস্থানে ‘স্বরিত’ এবং নিম্নগ্রামে ‘অনুদাত্ত’। কোন শব্দে কেবল একটি স্বরবর্ণেরই ‘উদাত্ত’ শ্বাসাঘাত থাকা সম্ভব। শ্বাসাঘাতের চরিত্র শব্দের বহিরঙ্গ সংস্থান অনুযায়ী নির্ধারিত হত না; বহু প্ৰাচীন ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষায় সারাধণভাবে পালনীয় কিছু রূপতাত্তিক নিয়ম অনুযায়ী শ্বাসাঘাত নির্ণত হত। এই শ্বাসাঘাত শব্দের ধ্বনিগত কাঠামোরই অঙ্গ ছিল। গ্রিক ভাষায় শ্বাসাঘাতের প্রধানতম ঝোঁকের মতো বৈদিক ভাষায় উদাত্ত স্বরেরও শব্দাবলীতে বা অণ্বয়ে কোন নির্দিষ্ট অবস্থান ছিলনা–শব্দের যে কোন স্বরবর্ণেই তা প্ৰযুক্ত হতে পারত। ইন্দো-ইয়োরোপীয় মূল ভাষার বক্রস্বরটি অবশ্য প্রাচীন ভারতীয় আৰ্য ভাষায় উত্তরাধিকার রূপে গৃহীত হয় নি; বৈদিক শ্বাসাঘাতপ্রক্রিয়ায় বিশিষ্ট লক্ষণরূপে স্বরিতের স্বতন্ত্র অবস্থান লক্ষণীয়। উচ্চাব্যচতাহীন স্বরবর্ণ ও শব্দাংশে অনুদাত্ত শ্বাসাঘাত সংস্থাপিত হয়। স্বরিত যেমন ঋগ্বেদে উচ্চতম স্বরগ্রাম রূপে গৃহীত, যজুর্বেদ সংহিতায় উদাত্ত এই গৌরবের অধিকারী। বৈদিক সাহিত্যে মোট যে ছয় ধরনের শ্বাসাঘাত পাওয়া যায়, নিম্নতম থেকে উচ্চতম স্বরপর্যায়ের ক্ৰমিক অভিব্যক্তিরাপে সেগুলি হল : অনুদাক্ততর। → অনুদাত্ত (নিহিত বা একশ্রুতি) → প্রচয় → সন্নতর → উদাত্ত → উদাত্ততর। শ্বাসাঘাতের এ সমস্ত সূক্ষ্ম বৈচিত্র্যের উল্লেখ পাওয়া যায় শুক্লযজুর্বেদে। সাধারণভাবে স্বরবিন্যাসে তিনটি স্বরই স্বীকৃত; উদাত্ত, স্বরিত এবং অনুদাত্ত। শ্বাসাঘাতের ফলে সূক্ত-আবৃত্তি অধিকতর আকর্ষণীয়, সৌষ্ঠবপূর্ণ ও গতিময় হয়ে ওঠে; আপাতদৃষ্টিতে যা সাধারণ শব্দপুঞ্জ তাতে সেই সন্ত্রম ও বিস্ময়বোধ যুক্ত হয়, ইন্দ্ৰজাল ও ধর্মের পক্ষে বা অপরিহার্য। যথার্থ শ্বাসাঘাতসহ সতর্ক উচ্চারণ বিশেষীকৃত প্ৰশিক্ষণের উত্তম ফলশ্রুতিরূপে গণ্য ছিল; এই শিক্ষা ছিল হােতৃ শ্রেণীর পুরোহিতদের নিঃসপত্ন অধিকার। তবে যেহেতু কিছু কিছু ব্ৰাহ্মণ ও উপনিষদ জাতীয় গ্রন্থেও শ্বাসাঘাত প্ৰযুক্ত হয়েছিল, তাই অনুমান করা যায় যে, সমুন্নীত যাজকতান্ত্রিক ভাষারই অর্থাৎ সেই যুগের পরিশীলিত সাহিত্যিক ভাষারই এই একটা বিশিষ্ট লক্ষণ ।