৩৬৫*
মঠ, (বেলুড়?)১২৭
১৩ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় মিসেস বুল,
আমার শরীর বিশেষ ভাল যাচ্ছে না; যদিও খানিকটা বিশ্রাম পেয়েছি, তবু আগামী শীতের আগে পূর্ব শক্তি ফিরে পাব বলে বোধ হয় না। জো-র একখানি পত্রে জানলাম যে, আপনারা দুজন ভারতবর্ষে আসছেন। বলাই বাহুল্য আপনাদের এখানে দেখতে পেলে আমি আনন্দিত হব; কিন্তু গোড়া থেকেই জেনে রাখা ভাল যে, ভারতবর্ষ পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর। বড় নগরাদি ছাড়া অন্যত্র ইওরোপীয় জীবনযাত্রার সুখ-সুবিধা নেই বললেই চলে।
ইংলণ্ড থেকে সংবাদ পেলাম যে, মিঃ স্টার্ডি অভেদানন্দকে নিউ ইয়র্কে পাঠাচ্ছেন। আমাকে বাদ দিয়ে ইংলণ্ডের কাজ চলা অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। এক্ষণে একটি মাত্র পত্রিকা মিঃ স্টার্ডি চালাবেন। এই মরসুমেই আমি ইংলণ্ডে যাবার আগেই ব্যবস্থা করেছিলাম, কিন্তু ডাক্তারদের বোকামিতে বাধা পেলাম। ভারতবর্ষের কাজ চলছে।
ইওরোপ কিম্বা আমেরিকার কেউ ঠিক এখনই এদেশের কোন কাজে আসবে বলে আমার তো মনে হয় না। তা ছাড়া কোন পাশ্চাত্য দেশবাসীর পক্ষে এদেশের জলবায়ু সহ্য করা বিশেষ কষ্টসাধ্য। এনি বেস্যাণ্টের অসাধারণ শক্তি থাকলেও তিনি কেবল থিওসফিষ্টদের মধ্যে কাজ করেন; ফলে এদেশে ম্লেচ্ছদের যে-রকম সমাজবর্জিত হয়ে থাকা প্রভৃতি নানা অসম্মান ভোগ করতে হয়, তাঁকেও তাই করতে হচ্ছে। এমন কি গুডউইন পর্যন্ত মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ওঠে এবং তাকে ঠিক করে দিতে হয়। গুডউইন বেশ কাজ করছে, সে পুরুষ বলে লোকের সঙ্গে মিশতে বাধা নেই। কিন্তু এদেশে পুরুষদের সমাজে মেয়েদের কোন স্থান নেই, মেয়েরা শুধু নিজেদের মধ্যেই কাজ করতে পারে। যে-সব ইংরেজ বন্ধু এদেশে এসেছেন, তাঁরা এ যাবৎ কোন কাজেই লাগেননি; ভবিষ্যতেও তাঁদের দ্বারা কিছু হবে কিনা, জানি না। এ সকল জেনেও যদি কেউ চেষ্টা করতে রাজী থাকে, তবে তাকে সাদরে আহ্বান করি।
সারদানন্দ যদি আসতে চায় তো চলে আসুক, আমার স্বাস্থ্য এখন ভেঙে গেছে; সুতরাং সে এলে সব কাজ গুছোতে বিশেষ সাহায্য হবে, সন্দেহ নেই।
দেশে ফিরে গিয়ে যাতে এদেশের জন্য কাজ করতে পারেন—এই উদ্দেশ্যে মিস মার্গারেট নোব্ল্ নামে একটি ইংরেজ মেয়ে ভারতে এসে এখানকার অবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়-লাভের জন্য খুব উৎসুক হয়েছে। আপনারা যদি লণ্ডন হয়ে আসেন, তবে আপনার সঙ্গে আসার জন্য তাকে লিখেছি। বড় অসুবিধা এই যে, দূর থেকে কখনও আপনারা এখানকার অবস্থা পুরোপুরি বুঝতে পারবেন না। দুটি দেশের ধরন এতই স্বতন্ত্র যে, আমেরিকা কিম্বা ইংলণ্ড থেকে তার কোন ধারণা করা অসম্ভব।
ভাববেন যে, আপনারা যেন আফ্রিকার অভ্যন্তরে যাবার জন্য বেরিয়েছেন, তারপর যদি দৈবাৎ উৎকৃষ্ট কিছু পান তো সেটা আশাতিরিক্ত। ইতি
আপনাদের
বিবেকানন্দ
৩৬৬
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
অমৃতসর
২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
যোগেন এক পত্রে … বাগবাজারে … বাটী ২০,০০০ টাকায় … কিনিতে বলেন। … ঐ বাড়ী কিনিলেও বেশ হাঙ্গাম আছে, যথা—ভেঙেচুরে বৈঠকখানাটিকে একটি হল করা এবং অন্যান্য বন্দোবস্ত করা। আবার ঐ বাটী অতি প্রাচীন ও জীর্ণ। যাহা হউক গিরিশবাবু ও অতুলের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া যাহা ভাল হয় করিবে। আমি সদলে অদ্য কাশ্মীরে চলিলাম দুইটার গাড়ীতে। মধ্যে ধর্মশালা পাহাড়ে যাইয়া শরীর অনেক সুস্থ হইয়াছে এবং টনসিল, জ্বর প্রভৃতি একেবারে আরাম হইয়া গিয়েছে। …
তোমার এক পত্রে সকল সমাচার জ্ঞাত হইলাম। নিরঞ্জন, লাটু, কৃষ্ণলাল, দীননাথ, গুপ্ত ও অচ্যুত আমার সঙ্গে কাশ্মীর যাইতেছে।
মান্দ্রাজ হইতে যে ব্যক্তি famine work-এ (দুর্ভিক্ষ-সেবাকার্যে) ১৫০০ টাকা দিয়াছে, সে চায় যে তাহার বিশেষ টাকা কি কি খরচে গেল—তাহার একটি তালিকা। উহা তাহাকে পাঠাইবে। আমরা এক রকম আছি ভাল। ইতি
বিবেকানন্দ
পুঃ—মঠের সকলকে আমার ভালবাসা দিবে।
৩৬৭
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
C/o ঋষিবর মুখোপাধ্যায়
প্রধান বিচারপতি, শ্রীনগর, কাশ্মীর
১৩ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
এক্ষণে কাশ্মীর। এদেশ সম্বন্ধে যে প্রশংসা শুনিয়াছ, তাহা সত্য। এমন সুন্দর দেশ আর নাই, আর লোকগুলিও সুন্দর, তবে ভাল চক্ষু হয় না। কিন্তু এমন নরককুণ্ডের মত ময়লা গ্রাম ও শহর আর কোথাও নাই। শ্রীনগরে ঋষিবরবাবুর বাড়ীতে ওঠা গেছে। তিনি বিশেষ যত্নও করছেন। আমার চিঠিপত্র তাঁর ঠিকানায় পাঠাইবে। আমি দু-এক দিনের মধ্যে অন্যত্র বেড়াইতে যাইব; কিন্তু আসিবার সময় পুনরায় শ্রীনগর হইয়া আসিব এবং চিঠিপত্রও পাইব। গঙ্গাধর সম্বন্ধে যে চিঠি পাঠাইয়াছ, তা দেখিলাম। তাহাকে লিখিবে যে মধ্যপ্রদেশে অনেক orphan (অনাথ) রহিয়াছে ও গোরখপুরে। সেখান হইতে পাঞ্জাবীরা অনেক ছেলেপুলে আনাইতেছে। মহেন্দ্রবাবুকে বলিয়া কহিয়া একটা এ-বিষয়ে agitation (আন্দোলন) করা উচিত—যাহাতে কলিকাতার লোকে ঐ-সকল orphan-এর charge (ভার) নেয়, সে বিষয়ে একটা আন্দোলন হওয়া উচিত—বিশেষতঃ যাহাতে মিশনরীরা যে-সকল orphan (অনাথ) লইয়াছে, তাহাদের যেন ফিরাইয়া দেয়—সে-বিষয়ে গভর্ণমেণ্টকে Memorial (স্মারকলিপি) দেওয়া উচিত। গঙ্গাধরকে আসিতে বল এবং রামকৃষ্ণ-সভার তরফ হইতে এ-বিষয়ে একটা বিষম হুজ্জুক করা উচিত। কোমর বেঁধে বাড়ী বাড়ী গিয়ে হুজ্জুক কর। Mass meeting (জনসভা) করাও ইত্যাদি। সিদ্ধি হউক না হউক—একটা বিষম গোলমাল কর। Central Province (মধ্যপ্রদেশ) এবং গোরখপুর ইত্যাদিতে যে-সব প্রধান বাঙালী আছে, তাদের পত্র লিখে সব facts (বিবরণ) জানাও এবং তুমুল আন্দোলন কর। রামকৃষ্ণ-সভা একদম জেঁকে যাক। হুজুকের উপর হুজ্জুক—বিরাম না যেন হয়, এই হল secret (রহস্য)। সারদার কার্যের পরিপাটি দেখে খুব খুশী হলাম। গঙ্গাধর এবং সারদা যেখানে যেখানে গেছে, সেই সেই জেলায় এক একটা centre (কেন্দ্র) না করে আর যেন বিরত না হয়।
এইমাত্র গঙ্গাধরের পত্র পাইলাম। সে ঐ জেলায় centre (কেন্দ্র) করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—বেশ কথা। তাহাকে লিখিও যে, তাহার বন্ধু ম্যাজিষ্ট্রেট আমার পত্রের অতি সুন্দর উত্তর দিয়াছেন। কাশ্মীর হইতে নামিয়াই লাটু, নিরঞ্জন, দীনু ও খোকাকে পাঠাইয়া দিব; কারণ উহাদের এখানে আর কোন কার্য সম্ভব নয়, এবং কুড়ি-পঁচিশ দিনের মধ্যে শুদ্ধানন্দ, সুশীল ও আর একজনকে পাঠাইবে। তাহাদের আম্বালায় ক্যাণ্টনমেণ্ট মেডিকেল হল, শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়ের বাটীতে পাঠাইবে। আমি সেখান হতে লাহোরে যাইব। দুটো করে গেরুয়া রঙের মোটা গেঞ্জি, পাতবার আর মুড়ি দেবার দুই দুই কম্বল, আর গায়ে দেবার একটা করে গরম কাপড় ইত্যাদি লাহোরে কিনিয়া দিব। যদি ‘রাজযোগ’ বইয়ের অনুবাদ হইয়া গিয়া থাকে তো তাহা ছাপাইবে ঘরের পয়সায়। … ভাষা যেখানে দুরূহ আছে, তাহা অতি সরল করিবে এবং যদি পারে—তুলসী তাহার একটা হিন্দী তর্জমা করুক। ঐ বইগুলি বাহির হইলে মঠের অনেক সাহায্য হয়।
তোমার শরীর—বোধ হয় এক্ষণে বেশ আছে। আমার শরীর ধর্মশালা … যাওয়া অবধি এখনও বেশ আছে। ঠাণ্ডাটিই বেশ লাগে এবং শরীর ভাল থাকে। কাশ্মীরের দু-একটা জায়গা দেখিয়া একটা উত্তম স্থানে চুপ করিয়া বসিব—এই প্রকার ইচ্ছা, অথবা জলে জলে ঘুরিব। যাহা ডাক্তারবাবু বলেন, তাহাই করিব। এখানে রাজা এখন নাই। তাঁহার মেজভাই সেনাপতি আছেন। তাঁহার সম্পাদকতায় একটা বক্তৃতা হইবার উদ্যোগ হইতেছে। যাহা হয় পরে লিখিব। দু-এক দিনের মধ্যে যদি হয় তো থাকিব; নহিলে আমি বেড়াইতে চলিলাম। সেভিয়ার মরীতেই রহিল। তাহার শরীর বড়ই অসুস্থ—টাঙ্গার ঝটকায়। মরীর বাঙালী বাবুরা বড়ই ভাল এবং ভদ্র।
জি. সি. ঘোষ, অতুল, মাষ্টার মহাশয় প্রভৃতি সকলকে আমার সাষ্টাঙ্গ দিবে ও সকলকে তাতাইয়া রাখিবে। যোগেন যে বাটী কিনিবার কথা বলিয়াছিল, তাহার খবর কি? আমি এখান হইতে অক্টোবর মাসে নামিয়া পাঞ্জাবে দু-চারটি লেকচার দিব। তাহার পর সিন্ধু হইয়া কচ্ছ, ভুজ ও কাথিয়াওয়াড়—সুবিধা হইলে পুণা পর্যন্ত, নহিলে বরোদা হইয়া রাজপুতানা। রাজপুতানা হইয়া N. W. P (উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ) ও নেপাল, তারপর কলিকাতা—এই তো প্রোগ্রাম এখন; পরে প্রভু জানেন। সকলকে আমার প্রণাম আশীর্বাদ ইত্যাদি।
বিবেকানন্দ
৩৬৮*
[মেরী হেলবয়েস্টারকে লিখিত]
C/o ঋষিবর মুখোপাধ্যায়
প্রধান বিচারপতি, শ্রীনগর, কাশ্মীর
১৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
প্রিয় শুদ্ধানন্দ,
অবশেষে আমরা কাশ্মীরে এসে পড়েছি। এ জায়গার সব সৌন্দর্যের কথা তোমায় লিখে আর কি হবে? আমার মতে এই হচ্ছে একমাত্র দেশ, যা যোগীদের অনুকূল। কিন্তু এদেশের যারা বর্তমান অধিবাসী, তাদের অপূর্ব দৈহিক সৌন্দর্য থাকলেও তারা অত্যন্ত অপরিষ্কার! এদেশের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখবার জন্য এবং শারীরিক শক্তিলাভের জন্য আমি এক মাস জলে জলে ঘুরে বেড়াব। কিন্তু নগরটিতে এখন ভয়ানক ম্যালেরিয়া এবং সদানন্দ ও কৃষ্ণলালের জ্বর হয়েছে। সদানন্দ আজ ভাল আছে, কিন্তু কৃষ্ণলালের এখনও জ্বর আছে। ডাক্তার আজ এসে তার জোলাপের ব্যবস্থা করে গেছেন। আমরা আশা করি, সে কালকের মধ্যে সেরে উঠবে এবং আমরা যাত্রাও করব কাল। কাশ্মীর গভর্ণমেণ্ট আমাকে তাঁদের একখানি বজরা ব্যবহার করতে দিয়েছেন, বজরাটি বেশ সুন্দর, আরামপ্রদ। তাঁরা জেলার তহশিলদারদের উপরও আদেশ জারি করেছেন। এদেশের লোকেরা আমাদের দেখবার জন্য দল বেঁধে আসছে; আমাদের সুখে রাখার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই করছে।
আমেরিকায় কোন কাগজে প্রকাশিত ডাক্তার ব্যারোজের একটি প্রবন্ধ ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’-এ উদ্ধৃত হয়েছে; কে একজন নিজের নাম না দিয়ে ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’-এর ঐ অংশ আমায় পাঠিয়েছে এবং এর কি উত্তর হবে জানতে চেয়েছে। আমি অংশটুকু ব্রহ্মানন্দকে পাঠাচ্ছি এবং যে অংশগুলি নিছক মিথ্যা, তার উত্তরও লিখে দিচ্ছি।
তুমি ওখানে ভাল আছ এবং তোমার দৈনন্দিন কার্য চালিয়ে যাচ্ছ জেনে সুখী হলাম। আমি শিবানন্দের কাছ থেকেও একখানি পত্র পেয়েছি; তাতে ওখানকার কাজের সবিশেষ খবর আছে।
একমাস পরে পাঞ্জাব যাচ্ছি; তোমাদের তিনজনকে আমি আম্বালাতে পাব আশা করি। যদি কোন কেন্দ্র স্থাপিত হয় তো তোমাদের একজনকে কার্যভার দিয়ে যাব। নিরঞ্জন, কৃষ্ণলাল ও লাটুকে ফেরত পাঠিয়ে দেব।
আমার ইচ্ছা আছে, একবার চট করে পাঞ্জাব ও সিন্ধু হয়ে কাথিয়াওয়াড় ও বরোদার ভেতর দিয়ে রাজপুতানায় ফিরব, সেখান থেকে নেপাল যাব, সর্বশেষ কলিকাতায়।
আমাকে শ্র্রীনগরে ঋষিবরবাবুর বাড়ীর ঠিকানায় পত্র দিও। আমি ফিরিবার পথে পত্র পাব। সকলকে আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানিও। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
৩৬৯
[শ্রীযুক্ত হরিপদ মিত্রকে লিখিত]
শ্রীনগর
কাশ্মীর, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
আজ ৯ মাস যাবৎ শরীর অত্যন্ত অসুস্থ থাকায় এবং গ্রীষ্মাধিক্য অত্যন্ত বৃদ্ধি হওয়ায় পর্বতে পর্বতে ভ্রমণ করিতেছি। এক্ষণে কাশ্মীরে। আমি অনেক পর্যটন করিয়াছি; কিন্তু এমন দেশ তো কখনও দেখি নাই। এক্ষণে শীঘ্রই পাঞ্জাবে যাইব এবং পুনরায় কার্য আরম্ভ করিব। সদানন্দের মুখে তোমাদের সমস্ত সমাচার পাইলাম এবং [মধ্যে মধ্যে] পাইয়া থাকি। আমি নিশ্চিত পাঞ্জাব হইয়া করাচিতে আসিতেছি, সেথায় সাক্ষাৎ হইবে। ইতি
সাশীর্বাদং
বিবেকানন্দস্য
৩৭০
[শ্রীমতী ইন্দুমতী মিত্রকে লিখিত]
কল্যাণবরেষু,
মা, আমি (পত্র) লিখিতে পারি নাই এবং বেলগাঁও আসিতে পারি নাই বলিয়া উদ্বিগ্ন হইও না। আমি রোগে অত্যন্ত ভুগিতেছিলাম, এবং তখন আমার যাওয়া অসম্ভব ছিল। এখন হিমালয়ে ভ্রমণ করিয়া সমধিক স্বাস্থ্য লাভ করিয়াছি। কার্য শীঘ্রই পুনরায় আরম্ভ করিব। দুই সপ্তাহের মধ্যেই পাঞ্জাবে যাইব এবং লাহোর অমৃতসরে দুই-একটি লেকচার দিয়াই করাচি, গুজরাট, কচ্ছ ইত্যাদি। করাচিতে নিশ্চিত তোমাদের সহিত সাক্ষাৎ করিব।
এ কাশ্মীর বাস্তবিকই ভূস্বর্গ—এমন দেশ পৃথিবীতে আর নাই। যেমন পাহাড়, তেমনি জল, তেমনি গাছপালা, তেমনি স্ত্রীপুরুষ, তেমনি পশুপক্ষী। এতদিন দেখি নাই বলিয়া মনে দুঃখ হয়। তুমি কেমন আছ—শারীরিক ও মানসিক, বিশেষ খবর লিখিও। আমার বিশেষ আশীর্বাদ জানিবে, এবং সর্বদাই তোমাদের কল্যাণ কামনা করিতেছি, নিশ্চিত জানিও। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৭১
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]১২৮
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
শ্রীনগর, কাশ্মীর
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
এক্ষণে কাশ্মীর দেখিয়া ফিরিতেছি। দু-এক দিনের মধ্যে পাঞ্জাব যাত্রা করিব। এবার শরীর অনেক সুস্থ হওয়ায় পূর্বের (পূর্বের) ভাবে পুনরায় ভ্রমণ করিব, মনস্থ করিয়াছি। Lecture (লেকচার)-ফেকচার বড় বেশী নয়—যদি একটা-আদটা পাঞ্জাবে হয় তো হইবে, নহিলে নয়। এদেশের লোক তো এখনও এক পয়সা গাড়ীভাড়া পর্যন্ত দিলে না—তাহাতে মণ্ডলী লইয়া চলা যে কি কষ্টকর বুঝিতেই পার। কেবল ঐ ইংরেজ শিষ্যদের নিকট হাত পাতাও লজ্জাকর কথা। অতএব পূর্বের (পূর্বের) ভাব ‘কম্বলবন্ত’ হইয়া চলিলাম। এ হালে Goodwin (গুডউইন) প্রভৃতি কাহারও প্রয়োজন নাই বুঝিতেই পারিতেছ।
Ceylone (সিলোন) হইতে একটি সাধু P. C. Jinavara Vamer (পি. সি. জিনবর বমার) নামক—আমাকে এক চিঠি লিখিয়াছেন; তিনি ভারতবর্ষে আসিতে চান ইত্যাদি। বোধ হয় ইনিই সেই Siamese (শ্যামদেশীয়) রাজকুমার সাধু। ইঁহার ঠিকানা Wallawatta, Ceylone. যদি সুবিধা হয় ইঁহাকে Madras-এ (মান্দ্রাজ) নিমন্ত্রণ কর। ইঁহার বেদান্তে বিশ্বাস আছে। মান্দ্রাজ থেকে ইঁহাকে অন্যান্য স্থানে পাঠান তত কঠিন কার্য নহে। আর অমন একটা লোক সম্প্রদায়ে থাকাও ভাল। আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ সকলকে জানাইবে ও জানিবে। ইতি
বিবেকানন্দ
পুঃ—খেতড়ির রাজা 10th Oct. (১০ অক্টোবর) বোম্বে পৌঁছিবে—Address (অভিনন্দন) দিতে ভুলিও না।
V.
৩৭২
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
শ্রীনগর, কাশ্মীর
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
গোপাল-দাদার এক পত্রে অবগত হইলাম যে, তোমরা কোন্নগরে জমি দেখিয়া আসিয়াছ। জমি নাকি ষোল বিঘা নিষ্কর এবং দাম আট-দশ হাজারের কম। স্বাস্থ্য ইত্যাদি সকল বিবেচনা করিয়া যেমন ভাল হয় করিবে। আমি দু-এক দিনের মধ্যে পাঞ্জাব চলিলাম। অতএব এ স্থানে চিঠিপত্র আর লিখিও না। Next (পরবর্তী) ঠিকানা আমি ‘তার’ করিব। হরিপ্রসন্নকে পাঠাইবার কথা যেন ভুলো না। গোপাল-দাদাকে বলিবে যে, ‘তাঁহার শরীর শীঘ্রই ভাল হইয়া যাইবে—শীত আসছে, ভয় কি?—খুব খাও দাও, মৌজ উড়াও।’ যোগেনের শরীর কেমন থাকে তদ্বিষয়ে মিসেস সি. সেভিয়ার, স্প্রিং ডেল, মরী, ঠিকানায় এক চিঠি লিখিবে এবং তাহার উপর To wait arrival (না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করিবে) লিখিয়া দিও। সকলকে ভালবাসা আশীর্বাদ ইত্যাদি দিও। কিমধিকমিতি
বিবেকানন্দ
পুঃ—খেতড়ির রাজা ১০ অক্টোবর বোম্বাই আসিবে, Address (অভিনন্দন)-টা ভুলিও না।
৩৭৩*
(স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত)
শ্রীনগর, কাশ্মীর
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার স্নেহপূর্ণ চিঠিখানি পেয়েছি, মঠের চিঠিও পেয়েছি। দু-তিন দিনের মধ্যেই আমি পাঞ্জাব রওনা হচ্ছি। বিলাতী ডাক এসেছে। মিস নোব্ল্ তার পত্রে যে-সব প্রশ্ন করেছে সেগুলি সম্বন্ধে আমার উত্তর এইঃ
(১) প্রায় সব শাখা-কেন্দ্রই খোলা হয়েছে, তবে এখনও আন্দোলনের আরম্ভ মাত্র।
(২) সন্ন্যাসীদের অধিকাংশই শিক্ষিত, যারা তা নয় তারাও লৌকিক শিক্ষা পাচ্ছে। কিন্তু অকপট নিঃস্বার্থপরতাই সৎকার্যের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। সে উদ্দেশ্যে অন্য সব শিক্ষার চেয়ে আধ্যাত্মিক শিক্ষার দিকেই সমধিক মনোযোগ দেওয়া হয়।
(৩) লৌকিক বিদ্যার শিক্ষকবৃন্দঃ আমরা যাদের কর্মিরূপে পাচ্ছি তাদের অধিকাংশই শিক্ষিত। এক্ষণে আবশ্যক—শুধু তাহাদিগকে আমাদের কার্য-প্রণালী শেখান এবং চরিত্র গঠন করা। শিক্ষার উদ্দেশ্য—তাহাদিগকে আজ্ঞানুবর্তী ও নির্ভীক করা; আর তার প্রণালী হচ্ছে—প্রথমতঃ গরীবদের জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করা এবং ক্রমে মানসিক উচ্চতর স্তরগুলির দিকে এগিয়ে যাওয়া।
শিল্প ও কলাঃ অর্থাভাবহেতু আমাদের কর্মতালিকার অন্তর্গত এই অংশ এখনও আরম্ভ করতে পারছি না। বর্তমানে যে সোজা কাজটুকু করা চলে, তা হচ্ছে—ভারতবাসীদিগকে স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা এবং ভারতীয় শিল্পদ্রব্যাদি যাতে ভারতের বাইরে বিক্রয় হয়, তার জন্য বাজার সৃষ্টি করা। যারা নিজেরা দালাল নয়, পরন্তু এই শাখার সমস্ত লভ্যাংশ শিল্পীদের উপকারের জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত, কেবল তাদের দ্বারাই এ কাজ করান উচিত।
(৪) জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়ান ততদিনই প্রয়োজন হবে, যতদিন না জনসাধারণ শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। অন্য সব কিছু অপেক্ষা পরিব্রাজক সন্ন্যাসীদের ধর্মভাব ও ধর্মজীবন সমধিক কার্যকর হবে।
(৫) সকল জাতির মধ্যে আমাদের প্রভাব বিস্তারিত হবে। এ পর্যন্ত উচ্চ স্তরের মধ্যেই কেবল কাজ হয়েছে; কিন্তু দুর্ভিক্ষ-সাহায্যকেন্দ্রগুলিতে আমাদের কর্মবিভাগের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে নিম্নতর জাতিগুলিকেও আমরা প্রভাবিত করতে পারছি।
(৬) প্রায় সকল হিন্দুই আমাদের কাজ সমর্থন করেন; কিন্তু এই জাতীয় কার্যে প্রত্যক্ষ সহায়তা করতে তাঁরা অভ্যস্ত নহেন।
(৭) হাঁ, আমরা গোড়া থেকেই আমাদের দান ও অন্যান্য সৎকার্যে ভারতীয় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে ইতরবিশেষ করি না।১২৯
এই সূত্র আনুসারে মিস নোব্ল্কে চিঠি লিখলেই হবে। যোগেনের চিকিৎসার যেন কোন ত্রুটি না হয়—আসল ভেঙেও টাকা খরচ করবে। ভবনাথের স্ত্রীকে দেখতে গিয়েছিলে কি?
ব্রহ্মচারী হরিপ্রসন্ন যদি আসতে পারে তো বড় ভাল হয়। মিঃ সেভিয়ার একটা স্থানের জন্য বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে—যা হয় একটা শীঘ্র করে ফেলতে পারলে হয়। হরিপ্রসন্ন ইঞ্জিনীয়ার মানুষ, ঝট করে কিছু করতে পারবে। আর জায়গা-টায়গা সে ব্যক্তি বোঝেও ভাল। দেরাদুন মসূরীর নিকট একটা জায়গা হওয়া তাদের পছন্দ—অর্থাৎ যেখানে বেশী শীত না হয় এবং বার মাস থাকা চলে। হরিপ্রসন্নকে অতএব একদম আম্বালায় শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ী, মেডিকেল হল, আম্বালা ক্যাণ্টনমেণ্ট-এ পাঠাবে পত্রপাঠ। আমি পাঞ্জাবে নেমেই সেভিয়ারকে তার সঙ্গে দিয়ে পাঠাব। আমি ঝাঁ করে পাঞ্জাবটা হয়ে করাচি দিয়ে কাথিয়াওয়াড় গুজরাট না হয়ে রাজপুতানার ভিতর দিয়ে নেপাল হয়ে চট করে চলে আসছি। তুলসী যে মধ্যভারতে গেছে—সে কি দুর্ভিক্ষকার্যের জন্য? এখানে আমরা সব ভাল আছি …। সাধারণ স্বাস্থ্য খুব ভাল ও ডায়েবেটিস অনেকদিন ভাগলওয়া হয়েছেন—আর কোন ভয় করব না। সকলকে আমার আশীর্বাদ, প্রণাম ও ভালবাসা দিও। কালী নিউ ইয়র্কে পৌঁছিয়াছে, খবর পাইয়াছি; কিন্তু সে কোন চিঠিপত্র লিখে নাই। স্টার্ডি লিখছে, তার Work (কাজ) এত বেড়ে উঠেছিল যে, লোকে অবাক হয়ে যায়—আবার দু-চারজন তার খুব প্রশংসা করে চিঠিও লিখেছে। যা হোক, আমেরিকাতে অত গোল নাই—এক রকম চলে যাবে। শুদ্ধানন্দ এবং তার ভাইকেও হরিপ্রসন্নর সঙ্গে পাঠাবে—এ দলের মধ্যে খালি গুপ্ত আর অচ্যুত আমার সঙ্গে থাকবে। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৭৪*
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
শ্রীনগর, কাশ্মীর
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
প্রিয় মিস ম্যাকলাউড,
তোমার আসার যদি ইচ্ছাই থাকে, তবে তাড়াতাড়ি চলে এস। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুআরীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতে ঠাণ্ডা, তারপরে গরম। তুমি যা দেখতে চাও, তা ঐ সময়ের মধ্যেই হয়ে যাবে; কিন্তু সব কিছু দেখতে গেলে অবশ্য বছর-কয়েক লাগবে।
সময় বড় অল্প; তাই তাড়াতাড়ি এই কার্ড লেখার জন্য মনে কিছু করো না। অনুগ্রহ করে মিসেস বুলকে আমার আন্তরিক ভালবাসা জানাবে এবং গুডউইন যেন শীঘ্র সেরে ওঠে, সেজন্য আমার শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক প্রার্থনা জানাচ্ছি। মা, এলবার্টা, ছোট্ট শিশুটি ও হলিস্টারকে আমার ভালবাসা জানাবে; এবং সর্বশেষে, কিন্তু তাই বলে সব চেয়ে কম নয়, ফ্র্যাঙ্কিকেও আমার অনুরূপ ভালবাসাই জানাবে। ইতি
সতত ভগবদাশ্রিত
বিবেকানন্দ