গানাদো অনেক কিছুই ভাবেন, কিন্তু এক হিসেবে যে নিয়তি সোরাবিয়ার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ থেকে তাঁর জীবনে অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের অভিশাপ এনেছে, সেই নিয়তিই যে সোরাবিয়াকে নাটকের শেষ অঙ্কের জন্যে তার নিজের অগোচরে এই দুর্গম ইংকা সাম্রাজ্যে এনে ফেলেছে সেইটুকু ঠিক কল্পনা করতে পারেন না।
কেমন করে আর পারবেন? পিজারোর জাহাজে সেভিলের বন্দর ছাড়বার পর তাঁর ও কাপিন সানসেদোর পিছু নিয়ে সোরাবিয়া যে কতদূর পর্যন্ত ধাওয়া করেছে, তা গানাদো জানেন না। সেই অনুসরণের পথেই মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিসরূপী সোরাবিয়ার হঠাৎ এসপানিয়া আর যে নিরাপদ মনে হয়নি, মান সম্রম ঐশ্বর্য প্রতিপত্তি সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েও নিজের দেশ থেকে কিছুদিনের জন্যে নিরুদ্দেশ হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ বলে যে মনে হয়েছে, এ খবরও গানাদো পাননি।
কদোভার ঘাটে কর্টেজ-এর সঙ্গে অকস্মাৎ দেখা হবার পরই সোরাবিয়া শুধু কদোভা কি নিজের নতুন আস্তানার শহর মেদেলিন নয়, এসপানিয়াই ত্যাগ করবার ব্যবস্থা করেছে।
এসপানিয়া সে চিরকালের জন্যে ছাড়েনি। কিছুকাল বাইরে কোথাও কাটিয়ে। কর্টেজ-এর সন্দেহে তার সম্বন্ধে বেয়াড়া প্রশ্ন যদি কিছু ওঠে, সেটাকে থিতিয়ে দেবার সময় দিতে চেয়েছে।
আর সব জায়গা থাকতে তার পেরুতে আসাটা একেবারে আকস্মিক অবশ্য নয়। কর্টেজ-এর নিজের রাজ্য মেক্সিকোতে যাবার কথা ভাবাই যায় না। ফার্নানদিনা হিসপানিওলা এমনকী পানামায় পর্যন্ত বড় চেনাশোনার ভিড় বেড়ে গেছে। গা ঢাকা দিয়ে কিছুকাল থাকবার পক্ষে সেগুলো খুব প্রশস্ত নয়।
এসব রাজ্য ছেড়ে দিলে বাকি থাকে অজানা দুর্গম রহস্যময় এক সোনায় মোড়া কিংবদন্তির দেশ।
সোরাবিয়া বেপরোয়া হয়ে সেখানেই পাড়ি দিয়েছে। অজ্ঞাতবাসকে অজ্ঞাতবাস হবে, তারই সঙ্গে ভাগ্য একটু সদয় হলে সেখান থেকে সোনার কাঁড়িও নিয়ে আসা যেতে পারে।
ভাগ্য যে তার ওপর সদয় টম্বেজ বন্দরে জাহাজ থেকে নামবার পরই তার যেন প্রমাণ পেয়েছে। ভাগ্য অনুকূল না হলে ওখানেই গাল্লিয়েখোর সঙ্গে দেখা হবে কেন?
গাল্লিয়েখোর বিবরণ শুনতে শুনতেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছে সোরাবিয়া। দুনিয়ায় আর সবাই ভুল করতে পারে, কিন্তু পেরুর আদি ভীরাকোচার নতুন অবতারের রহস্য যে কী, সে বিষয়ে তার ধারণা একেবারে অভ্রান্ত হতে বাধ্য।
ভাগ্য যেন এ নতুন রাজ্যে তার প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তির চাবিকাঠি নিজে থেকে তার হাতে তুলে দিয়েছে।
এসপানিওল সেনাপতি পিজারোর কাছে এ রহস্যভেদের বাহাদুরি দেখাতে পারলে একমুহূর্তে তার কদর বেড়ে যাবে।
সে বাহাদুরি দেখাতে যে সে পারবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ সোরাবিয়ার নিজের মনে তখন নেই। তলোয়ার চালাবার কৌশলের একটি নমুনার কথা শুনেই সে চিনে ফেলেছে ভীরাকোচার অবতারকে! এ দেশের মর্কটগুলোর তো নয়ই, একটি মাত্র লোকের ছাড়া এসপানিওল বাহিনীরও কারও তলোয়ারের কাজের অমন সূক্ষ্ম কেরামতি নেই, যাতে যেখানে খুশি ওই চিকে-র দাগ দেওয়া যায়।
কথায় কথায় গানাদো নামে এক ত্রিয়ানার বেদে এসপানিওল বাহিনীতে আছে জেনে আর উত্তেজনা চেপে রাখতে পারেনি সোরাবিয়া। সেইদিনই গাল্লিয়েখোকে নিয়ে রওনা হয়েছে কাক্সামালকার উদ্দেশে।
কামালকায় যখন সে গিয়ে পৌঁছেছে, গানাদো তখন সেখান থেকে নিরুদ্দেশ। পিজারো তার নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারে চিন্তিত হয়েছেন, কিন্তু খুব বেশি গুরুত্ব ব্যাপারটায় দেওয়া প্রয়োজন মনে করেননি।
মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিসরূপী সোরাবিয়া কামালকায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যা বলেছে, তা পিজারো বিশ্বাসই করতে পারেননি প্রথমে।
গানাদো, মানে ওই সামান্য বেদেটা এমন আশ্চর্য কেউ? তার বুদ্ধি আর কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় অবশ্য আগে অনেকবার পেয়ে মনে মনে তারিফ করতে বাধ্য হয়েছেন। সত্যি কথা বলতে গেলে আতাহুয়ালপার কাছ থেকে সোনার কাঁড়ি আদায় করবার ফন্দি নিজের মাথা থেকে সে-ই বার করেছিল। লোকটাকে কেন তাঁর বরাবর যেন চেনা-চেনা লেগেছে, তা ঠিক মনে করতে না পারলেও, তার কয়েকটা পরামর্শের জন্যে তার প্রতি একটু কৃতজ্ঞই বোধ করছেন।
সেই গানাদো তলোয়ারের খেলায় এসপানিয়ার কিংবদন্তির বীর এল সিড-এর মতো অদ্বিতীয়? সে-ই ভীরাকোচার অবতার সেজে এসপানিওল সৈনিকদের জব্দ করে মুখে কলঙ্ক-চিহ্ন দেগে দেয়? কেন?
পিজারোর কেন? প্রশ্নের ভালরকম জবাবই দিয়েছে সোরাবিয়া।
গানাদোর শয়তানির অকাট্য প্রমাণ হিসেবে জানিয়েছে যে গানাদো আসলে পলাতক এক ক্রীতদাস। মেক্সিকো থেকে স্পেনের যাত্রী এক জাহাজে হিড্যালগো সেজে যাবার সময় সোরাবিয়া তার ছদ্ম পরিচয় ধরে ফেলার পর থেকেই সে নিরুদ্দেশ। পানামাতে একবার ধরা পড়তে পড়তে সে পালিয়ে বেঁচেছে। এসপানিয়ার ফেরারি গোলাম বলেই সব এসপানিওল-এর ওপর তার রাগ। সুযোগ পেলেই সে তাই এসপানিওলদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করে। শয়তানের সাকরেদটা বেদে বলে নিজের পরিচয় দিলেও সত্যিই জাতবেদে নয়। সোরাবিয়া বেদেদের বড় ঘাঁটি ত্রিয়ানায় খোঁজ নিয়ে তা জেনেছে। কোথা থেকে তলোয়ারের খেলা সে অবশ্য আশ্চর্যরকম শিখেছে। খোদ শয়তানই তাকে শিখিয়েছে হয়তো। নইলে তলোয়ারের সূক্ষ্ম ফলার অমন আশ্চর্য কেরামতি মানুষের হাতে সম্ভব নয়। ইচ্ছে করলে সে বুঝি খেলতে খেলতে তলোয়ারের ডগায় শত্রুর মুখে নিজের নামও লিখে দিতে পারে। তার তলোয়ারের কাজ থেকেই সোরাবিয়া তাকে চিনেছে।
গানাদো যত বড় ওস্তাদই হোক, সাপের ওপরেও নেউল আছে। সোরাবিয়াকে বেকায়দায় একবার পেয়ে সে হাত ফসকে পালিয়েছিল। কিন্তু দুবারের বার আর নয়। তলোয়ারের ডগায় নাম লেখার কসরত সোরাবিয়া সাধবার চেষ্টা করেনি, কিন্তু এফোঁড় ওফোঁড় করার কেরামতিতে তার জুড়ি সে দেখতে চায়।
পিজারো ধৈর্য ধরে যে এত সব আস্ফালন শুনেছেন তার কারণ মনে মনে তখনও তিনি বেশ একটু বিভ্রান্ত। গানাদো সম্বন্ধে কী ধারণা তিনি করবেন তা তখনও ঠিক করে উঠতে পারছেন না।
মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিসকে গণ্যমান্য হিড্যালগো বলেই তিনি অবশ্য ধরে নিয়েছেন। কিন্তু এরকম লোকের কথাও একেবারে নির্বিচারে বিশ্বাস করা যায় কি? মার্কুইস-এরও তো ভুল হতে পারে!
মার্কুইসকে এর আগে পিজারো কখনও দেখেননি। নামটাও কখনও শুনেছেন কি
প্রথমে ঠিক মনে করতে পারেননি। নাম না শোনা অবশ্য আশ্চর্য কিছু নয়। পিজারো তো আর কর্টেজ-এর মতো নিজেই খানদানি ঘরের ছেলে নয়। আদি পরিচয় তো তাঁর শুয়োরের রাখাল। জারজ সন্তান যাকে বলে, তা-ও। বড় ঘরোয়ানাদের কোনও খবরই তিনি রাখেন না।
মার্কুইস-এর চালচলন আর আত্মপরিচয় দেওয়া থেকেই পিজারো তাকে বিশ্বাস করেছেন। তা ছাড়া সেভিল-এ নেমে দেনার দায়ে বন্দি হবার পর সম্রাটের আদেশে মুক্ত হয়ে টোলেডোতে রাজদরবারে নিজের আর্জি পেশ করতে গিয়ে এইরকম একটা নাম যেন শুনেছিলেন বলে পরে মনে পড়েছে। টোলেডোর রাজদরবারে এইরকম নামের কেউ যেন তাঁর সেভিল-এ বন্দি থাকার কথা প্রথম জানিয়েছিল।
মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিসই সেই লোক কি না, পিজারো অবশ্য জিজ্ঞেস করেননি। মার্কুইস হিসেবে সোরাবিয়া নিজের গরজেই তা চেপে গিয়েছে।
মার্কুইস হিসেবে সমীহ করলেও তার সব কথা নির্ভুল বলে পিজারো যেমন মনে করেননি তেমনই কতকগুলো ইঙ্গিত যে তার আশ্চর্যরকম মিলে গেছে তা-ও অস্বীকার করতে পারেননি নিজের মনে।
গানাদোই আতাহুয়ালপার কাছ থেকে সোনার পাহাড় আদায় করবার ফন্দি ভেবে বার করেছিল ঠিকই, কিন্তু তার পক্ষে সে সোনার এতটুকু বখরা দাবি না করা বেশ একটু অবিশ্বাস্য।
নিজের পরিচয় যা সে দিয়েছে তা সত্যি হলে সোনার লোভ এভাবে তার ত্যাগ করার কথা তো ভাবাই যায় না।
যদি কোনও কারণে সে মারা পড়ে থাকে ইতিমধ্যে তা হলে অবশ্য আলাদা কথা। কিন্তু তা-ও তো একদিক দিয়ে অসম্ভব বলেই মনে হয়। অসুখে বিসুখে দুর্ঘটনায় কিংবা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে দু-একজন এসপানিওল সৈনিক মাঝে মাঝে মারা যায় না এমন নয়। কিন্তু তাদের মৃতদেহ তো গায়েব হয়ে যায় না এমন ভোজাবাজিতে? নিজেদের মধ্যে মারামারি করলে তা একেবারে গোপনও থাকে না। সিপাই মহলে। তা জানাজানি হয়ে যায়ই না কোনও-না-কোনও দলের মধ্যে। গানাদোর সঙ্গে কারোও সে রকম মারাত্মক কেন, ছোটখাটো ঝগড়ার কথাও কেউ জানে না!
নিজেদের মধ্যে মারামারিতে না হয়ে এদেশের কারও হাতে তার নিহত হওয়াও বিশ্বাসের অযোগ্য। এরকম ঘটনা এ পর্যন্ত ঘটেনি। রহস্যময় ভীরাকোচার অবতারের কাছে যাদের চরম লাঞ্ছনা হয়েছে তারাও কেউ প্রাণে মারা যায়নি। গেলেও তাদের লাশগুলো অদৃশ্য হত না নিশ্চয়!
সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা এই যে গানাদোর কামালকা থেকে অন্তর্ধানের পর থেকে ভীরাকোচার অবতারের নামে যে উপদ্রব এসপানিওল সৈনিকদের ওপর হচ্ছিল তা একেবারে থেমে গেছে। সেরকম ঘটনা একটাও তার পর আর ঘটেনি।
মার্কুইস-এর সন্দেহ তাই একেবারে ভুল বলে উড়িয়ে দেবার নয়। কিন্তু গানাদো সত্যিই যদি অমন সাংঘাতিক মানুষ হয় তা হলে এখন তার সন্ধান কী করে পাওয়া যাবে? কামালকা শহরে সে নেই। এ শহর ছেড়ে কোথাও সে গেছে এমন কোনও প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে না।
মার্কুইসরূপী সোরাবিয়া এ রহস্যও ভেদ করেছে। নানারকম প্রশ্ন করে সে জেনেছে যে কামালকা থেকে একমাত্র সোনা বরদার দল ছাড়া বাইরে যাবার সুবিধে কেউ পায়নি। সোনা-বরদার দলের সবাই পেরুর লোক। কিন্তু তাদের সাজ-পোশাক দেখবার পর এই ছদ্মবেশেই যে গানাদো সকলের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে এ বিষয়ে মার্কুইস-এর আর সন্দেহ থাকেনি।
পিজারোকে নিজের ধারণার কথা এবার জোরের সঙ্গে জানিয়েছে মার্কুইস। পিজারোর কাছে ছোট একটা রিসালা নিয়ে কুজকো শহরে গিয়ে গানাদোকে ধরবার অনুমতিও সে আদায় করেছে।
পিজারো দোভাষী হিসেবে ফেলিপিলিও আর এ রাজ্যের অভিজ্ঞ সৈন্যাধ্যক্ষ হিসেবে হেরাদাকে মার্কুইস-এর সঙ্গে দিয়েছেন, আর সেই সঙ্গে ফেলিপিলিওর হাতে রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুকে নিজের শিলমোহর মারা আদেশও দিয়েছেন সোনা-বরদার দলে যারা যারা আছে সকলকে মার্কুইস-এর হাতে সমর্পণ এবার জন্যে।
মার্কুইসরূপী সোরাবিয়া অত ব্যস্ত হয়ে তাই প্রথমে রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুর খোঁজ করেছে।
তাঁকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত জন দুই অধস্তন পুরোহিতকে সে পাকড়াও করবার ব্যবস্থা করলে।
তারা নেহাত তাঁবেদার। সত্যিই কিছুই জানে না। রাজপুরোহিত কয়েকদিন আগে খুব তাড়াহুড়ো করে সৌসা গেছেন এই খবরটুকুই তারা দিতে পারলে।
টম্বেজ বন্দরে পা দেওয়ার পর থেকে কামালকা হয়ে কুজকো পর্যন্ত আসার মধ্যে মার্কুইসরূপী সোরাবিয়া এ রাজ্যের হালচাল যতখানি সম্ভব জেনে নিয়েছে।
সৌসা যে একটা কারাদুর্গ, কামালকায় যে বন্দি তারই বড় বৈমাত্র ভাই ভূতপূর্ব ইংকা হুয়াসকার যে সেখানে বন্দি হয়ে আছে সে খবর তার অজানা নয়।
ভিলিয়াক ভূমুর শশব্যস্ত হয়ে সেখানে হঠাৎ যাওয়া বেশ একটু সন্দেহজনক মনে হল তার। রেইমির মতো এ রাজ্যের প্রধান উৎসবের প্রথম লগ্নেও সেখান থেকে না এসে পৌঁছোনো আরও।
এর ভেতরেও সেই শয়তান গানাদোর কোনও কারসাজি থাকা অসম্ভব নয় বলেই তার সন্দেহ হল।
গানাদোকে অবিলম্বে খুঁজে বার করা তাই একান্ত দরকার। তাঁবেদার পুরোহিতদের কাছে খবর নিয়ে যা সে জানল তা-ও বেশ একটু, গোলমেলে।
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমু নিজেই নাকি এবারের সোনা বরদার দলের সকলকে বন্দি করে গেছেন।
শুধু তাদের একজনকে নাকি পাওয়া যায়নি। কাকে পাওয়া যায়নি?
তাঁবেদার পুরোহিতরা তার নামধাম পরিচয় কিছু জানে না। শুধু রাজপুরোহিতের সঙ্গে দেখা করবার সময় যারা তাকে দেখেছিল ও পরে কোরিকাঞ্চার অতিথিশালায় তাকে বন্দি করতে গেছল রাজপুরোহিতের আদেশে, তারা খানিকটা বর্ণনা দিতে পারল তার চেহারার।
সোরাবিয়ার পক্ষে ওইটুকুই যথেষ্ট।
খোঁজ যার পাওয়া যায়নি সে যে গানাদো ছাড়া আর কেউ নয় এবিষয়ে সন্দেহ। আর তার রইল না।
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুও, যে কোনও কারণেই হোক, গানাদোর শত্রু। হয়েছেন বুঝল সোরাবিয়া। এই কুজকো শহর থেকে রাজপুরোহিতের তীক্ষ্ণ সজাগ পাহারা এড়িয়ে তা হলে গানাদো গেল কোথায়!
আবার কাক্সামালকার দিকে সে যেতে পারে?
না, তা সম্ভব নয়। জোর গলায় জানালে চেলা পুরোহিতরা।
তা হলে সৌসার দিকে?
না, তা-ও নয়। কুজকো থেকে বার হবার প্রায় অগম্য যে পথ আছে তাতেও ভিলিয়াক ভূমুর আদেশে এমনভাবে কড়া পাহারা দেওয়া হচ্ছে যে একটা মাছিরও সাধ্য নেই তার ভেতর দিয়ে গলে যাবার।
তা হলে গানাদো এই কুজকোতেই আছে নিশ্চয়।
তা-ও অসম্ভব।ভয়ে ভয়ে নিবেদন করলে কোরিকাঞ্চার তাঁবেদাররা, এক এক করে এ শহরের প্রত্যেকটি মানুষের হিসেব নেওয়া হয়েছে, মায় বাইরে থেকে তীর্থযাত্রী হিসেবে যারা এসেছে তাদেরও।
সে লোকটা কি তা হলে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবার মন্ত্র জানে!—তীক্ষ বিদ্রূপ করলে সোরাবিয়া।
তা-ই জানে বোধহয়। এবারও সসম্রমে জানালে ছোট পুরোহিতরা।
তা হলে হাওয়া শুষে নেবার মন্ত্র আমিও জানি। হিংস্রভাবে বললে সোরাবিয়া। একটা দরকারি কাজ আগে সেরে আসি, তারপর গানাদোকে খুঁজে পাওয়া যায় কি আমি দেখছি।
সঙ্গী হেরাদাকে সে শুধু রিসালার অর্ধেক সওয়ার দিয়ে পাঠাল সৌসায় গিয়ে রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুর খবর নিতে।
কী দরকারি কাজটা সোরাবিয়া আগে সারতে চায় সেটা বোঝা গেল খানিক বাদেই।
কোরিকাঞ্চার ছোট মোহান্তদের সঙ্গে আলাপ সেরে ফেলিপিলিওকে সঙ্গে রেখে বাছাই জন-পাঁচেক সওয়ার সেপাই নিয়ে সোরাবিয়া ব্যস্ত হয়ে ফিরে এল সূর্যবরণ প্রান্তরের মাঝখানে মৃত ইংকা হুয়াইনা কাপাক-এর শব-সভা যেখান সাজানো হয়েছিল সেইখানে।
কিন্তু কোথায় সেখানে ইংকাশ্রেষ্ঠ হুয়াইনা কাপাক-এর শব-সভা। রেইমির উৎসব গেছে পণ্ড হয়ে। বেলা বেড়ে সূর্য তখন পুবের আকাশে অনেক ওপরে উঠে এসেছে। হানাদার এসপানিওলদের ভয়ে সমস্ত সূর্যবরণ প্রান্তরই ফাঁকা। হুয়াইনা কাপাক-এর শব-সভার কোনও চিহ্ন সেখানে নেই।
কোথায় গেল সে-সব? চড়া গলায় জিজ্ঞাসা করেছে সোরাবিয়া।
কী-সব কোথায় গেল? বুঝেও না বোঝার ভান করেছে ফেলিপিলিও।
সেই সোনার সিংহাসন আর দামি দামি আসবাবপত্রগুলো, কার একটা মড়াকে যার মাঝে বসিয়ে রেখেছিল? এত করে বোঝাতে হবার জন্যেই মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছে সোরাবিয়ার।
সেগুলো যেখানকার সেখানেই নিয়ে গেছে। ফিলিপিলিও ওইটুকুই জানিয়েছে উত্তরে।
সেই যেখানটা কোথায় জানতে চাইছি! খিঁচিয়ে উঠেছে সোরাবিয়া! ধমক দিয়ে বলেছে, নিয়ে চলো সেখানে।
ফেলিপিলিও মিছেই এসপানিওলদের সঙ্গ এতদিন করেনি। দেশের কুলাঙ্গার হলেও মানসম্রম সব একেবারে পায়ে লুটিয়ে দিয়ে বিদেশিদের গোলাম সে হয়নি। নিজের প্যাঁচালো ধারালো বুদ্ধিতে এই বিদেশিদের দম্ভ আর আস্ফালনের যোগ্য জবাব সে দিতে শিখেছে।
বাইরে অত্যন্ত বিনীত চেহারা ফুটিয়ে মোলায়েম গলায় সে তার অক্ষমতা জানিয়েছে। বলেছে যে, কোথায় সে সব সরানো হয়েছে তা তার জানা নেই।
না জানো তো জিজ্ঞেস করো এই বাঁদির বাচ্চাদের কাউকে! হুকুম করেছে সোরাবিয়া।
জিজ্ঞেস কাকে করব? যেন হতাশ হয়ে বলেছে ফেলিপিলিও, আমাদের একশো হাত দূর থেকে দেখলে এরা পালাচ্ছে। যদি বা কাউকে ধরতে পারা যায় সে কি কিছু বলতে পারবে! ইংকাদের প্রেত-প্রাসাদ তো একটা নয়! বেশির ভাগই সেসব আবার এমন লুকোনো যে নিজস্ব অনুচরেরা ছাড়া তার সন্ধান কেউ জানে না। এক ভিলিয়াক ভূমুর নিজের গোপন কিপুর গোছায় ছাড়া কোথাও তাদের হদিস মেলবার নয়। ভিলিয়াক ভমু তো আবার এখানে নেই।
তোর বক্তৃতা শুনতে এখানে আসিনি, বেইমান মর্কট! সোরাবিয়া প্রচণ্ড এক চড় মেরেছে ফেলিপিলিওর গালে। তারপর হিংস্রভাবে বলেছে, যেমন করে পারিস সে জায়গার হদিস জোগাড় কর। সে সিংহাসন আমার চাই। যে আজ্ঞে মার্কুইস! সসম্রমে বলেছে ফেলিপিলিও।
হ্যাঁ, ফেলিপিলিও যেমন করে পারে সে জায়গার হদিস জোগাড় করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে বটে।
সোরাবিয়া নিজের চোখে তা দেখেছে।
ফেলিপিলিও পাছে খোঁজায় ঢিল দেয় সেই সন্দেহে তার সঙ্গে সঙ্গে থেকেছে। সোরাবিয়া। ফেলিপিলিও তাতে অস্বস্তিবোধ করবার বদলে সত্যিই যেন খুশি। খুশি বোধহয় তার আন্তরিকতা দেখাবার সুযোগ পাবার দরুন!
কী আন্তরিকতাই না দেখা গেছে ফেলিপিলিওর! সোরাবিয়ার চড় খেয়েই তার গরজ, তার আন্তরিক আগ্রহ যেন বেড়ে গেছে!
কারও কাছে খোঁজ নিতে সে বাকি রাখেনি। অন্তত নাগালের মধ্যে যাদের পাওয়া গেছে তাদের প্রত্যেকের কাছে।
প্রথমেই নাগালের মধ্যে পাওয়া গেছে কোরিকাঞ্চার ছোট পুরুতদের। কুজকো শহরের লোক এই দিনটির আগে পর্যন্ত স্বচক্ষে তাদের রাজ্যে হানাদার কোনও সাদা বিদেশি দেখেনি।
শুধু গুজব শুনেছে তাদের সম্বন্ধে।
গুজব সাধারণত সত্যের চেয়ে অনেক ফাঁপানোই হয়। কিন্তু ভোর থেকে বেলা দুপুরের মধ্যেই কুজকোবাসীদের এসপানিওল হানাদারদের সঙ্গে যেটুকু পরিচয় হয়েছে তাতে তাদের মনে হয়েছে, গুজব বুঝি সত্যের তুলনায় অনেক ফিকে।
এসপানিওলরা যা দেখেছে, যা পেয়েছে, লুঠপাট তো করেইছে, দেবস্থান থেকে শুরু করে কোনও কিছুরই মান আর রাখেনি।
এসপানিওলদের নামেই কুজকোর যে যেখানে পেরেছে পালিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাদের মধ্যে সওয়ার সেনাদের হাতে ধরাও পড়েছে অনেকে। যারা ধরা পড়েছে তাদের লাঞ্ছনার আর সীমা থাকেনি, বিশেষ করে মেয়েদের। তাদের যা হয়েছে তা মৃত্যুর অধিক।
এ সব কিছুর খবরই কোরিকাঞ্চার ছোট পুরুতদের কানে এসেছে, তারা চোখেও দেখেছে অনেক কিছু।
আর সবাই পালাবার চেষ্টা করলেও তাদের সে উপায় নেই। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মন্দিরে দেবতার সম্মানে তাদের থাকতে হয়েছে।
তাই তাদের কাছেই ফেলিপিলিওর খোঁজ নেবার প্রথম সুযোগ হয়েছে। সে সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করেছে ফেলিপিলিও।
সোরাবিয়ার হুকুমে বলির পাঁঠার মতো কোরিকাঞ্চার পুরুতদের তখন দাঁড় করানো হয়েছে ভেতরের চত্বরে।
ফেলিপিলিও সোরাবিয়ারই উপযুক্ত প্রতিনিধির মতো মুখের চেহারা আর গলায় তাদের কুইচুয়া ভাষায় তার প্রশ্ন জানিয়েছে।
কিন্তু সে প্রশ্ন শুনে তাদের মুখগুলো হঠাৎ অমন হয়ে গিয়েছে কেন? প্রাণের ভয়ে মানের ভয়ে দাঁড়াবার মতো পায়ের জোর না পেয়ে, বুক যাদের কাঁপছে তাদের মুখের অমন অদ্ভুত চেহারা হয়ে গেল কীসে?
সোরাবিয়ার সেটা লক্ষ এড়ায়নি। তার কাছে এ দেশের মর্কটদের মুখের ভাবটাবের কোনও অর্থই নেই। তবু একটু খটকা তার লেগেছে। নিজের দেশের মানুষ। হলে এ ধরনের মুখের ভাব যেন কাঁদতে গিয়ে হাসি চাপার বলেই তার মনে হত।
পুরুতদের মুখগুলো এই রকম অদ্ভুত হয়ে গেলেও জবাব কেউ দেয়নি। দেবার ক্ষমতাই তাদের নেই।
কী প্রশ্ন তা হলে করেছে তাদের ফেলিপিনিও!
প্রশ্ন বড় জবর। চোস্ত কুইচুয়া ভাষায় ফেলিপিলিও জিজ্ঞাসা করেছে, এই যে সাদা চামড়ার জানোয়ারটা মানুষের পোশাকে সেজে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, সে কী চায় জানো? সে আমাদের দেবতাদের সব ধনদৌলত লুঠ করতে চায়। দেবে তোমরা সে সবের সন্ধান?
প্রথমটা এসপানিওল শত্রুদের কাছে নিজেকে বিকোনো এক দেশদ্রোহীর মুখে এরকম অপ্রত্যাশিত কথা শুনে তারা হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। ফেলিপিলিও যে সত্যিই তার মনিবদের অমন করে গাল পাড়বে তা বিশ্বাস করাই শক্ত হয়েছে তাদের পক্ষে। একটু সন্দেহ হয়েছে, ফেলিপিলিও হয়তো তাদের পরীক্ষা করছে কি না এমনই করে! সন্দেহটা টেকেনি। তার বদলে ব্যাপারটার মধ্যে যে মজা আছে সেইটেই বড় হয়ে উঠেছে। শুধু ফেলিপিলিওর পাশে তার মনিবের দুশমনি চেহারা দেখেই কোনওরকমে মুখে হাসি তারা সামলেছে।
ফেলিপিলিও সম্বন্ধে যেটুকু সন্দেহ ছিল তা কেটে গেছে তার পরের কথায়।
ফেলিপিলিও মুখোনা আগের মতোই হিংস্র করে রেখে বলেছে, একেবারে চুপ করে থাকলে সাদা জানোয়ারটা সন্দেহ করবে। তোমরা দু-একজন অন্তত মাথাটা নাড়ো।
তাই নেড়েছে দু-একজন।
ফেলিপিলিও যেন হতাশভাবে সোরাবিয়ার দিকে ফিরে কাতর স্বরে বলেছে, দেখলেন তো মার্কুইস, ওরা কিছুই জানে না বলছে!
বলছে শয়তানি করে! গর্জন করে উঠেছে সোরাবিয়া, তলপেটে দুটো লাথি দিলেই কিছু জানে কি না বোঝা যাবে! ওদের বলো যে মড়ার কবরখানা কোথায় এখনই না বললে তলোয়ার খুঁজে গলার ছিদ্রগুলো বড় করে দেব।
তাই বলছি, মার্কুইস! সসম্রমে মার্কুইসের হুকুম শুনে ফেলিপিলিও পুরুতদের দিকে ফিরে ধমকের সুরে বলেছে, সাদা শকুনটা কী বলে, জানো! পবিত্র একটা নাম পাষণ্ডটার নোংরা পচা মুখে উচ্চারিত হওয়া চাই না বলেই একটু ঘুরিয়ে বলছি। পাষণ্ডটা বলছে—আমাদের পরম পূজনীয় সাবেকি ইংকাশ্রেষ্ঠের প্রেত-প্রাসাদের খবর না দিলে তোমাদের সকলের গলার ছিদ্র তলোয়ারের ফলায় বড় করে দেবে! জানোয়ারটার হুমকি শুনে ভয় পেয়ো না। আর যাই হোক, বিদেশি শয়তানদের ও সর্দার নয়, যাকে খুশি কোতল করবার এক্তিয়ার নিয়েও আসেনি। অন্যায় জুলুমবাজি যার তার ওপর করলে ওকেও জবাবদিহি দিতে হবে। ওর হম্বিতম্বির জবাবে মাথা নেড়ে আমাদের ভাষায় শুধু ওকে যা পারো বাপান্ত করে নাও। আমি ওকে জল বুঝিয়ে দেব!
এত কী বক বক করছিস, মর্কট? ফেলিপিলিওর দীর্ঘ বক্তৃতা পছন্দ হয়নি সোরাবিয়ার, দাঁত খিঁচিয়ে বলেছে, যা বলেছি তা বোঝাতে অত কথা কীসের!
ফেলিপিলিও বিনীতভাবে জানিয়েছে যে ভাল করে না বোঝালে ওরা যে ঠিক ববাঝে না। তা ছাড়া মার্কুইস যে কত বড় একজন রাজাগজা গোছের মানুষ, ইচ্ছে করলে ওদের সব ক-টার মাথা যে কেটে নিতে পারেন, তা-ই ওদের বোঝাতেই অত কথা বলতে হচ্ছিল।
তা অত বোঝাবার পরও ওদের মুখে রা নেই কেন? ফেলিপিলিওর কৈফিয়তেও ঠাণ্ডা না হয়ে বলেছে সোরাবিয়া, সব কি বোবা নাকি?
বোবা যে নয় তার প্রমাণ দিয়েছে এবার পুরুতদের একজন। এতক্ষণে নিজেদের খানিকটা সামলাতে পেরে একজন মুখ খুলেছে।
মুখ খুলে ফেলিপিলিও যা বলেছিল সেই মতো সোরাবিয়ার বাপান্ত অবশ্য সে করেনি। হাজার হলেও কোরিকাঞ্চার সমর্পিত সেবায়েত হিসেবে অত বড় প্রতিহিংসার জ্বালাতেও ইতরতায় নামা তাদের পক্ষে সহজ নয়।
পুরোহিত তাই শুধু দেবাদিদেব ভীরাকোচার নাম নিয়েই বলেছে যে, এ রাজ্যে দেবতা ও পূর্বপুরুষদের নামে উৎসর্গ করা পবিত্র সম্পদের দিকে নোংরা লোভের হাত যে বাড়াবে স্বয়ং আদিদেব ভীরাকোচাই তার উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবেন।
কী বলছে কী, বাঁদির বাচ্চাটা? হদিস কিছু দিচ্ছে? চড়া গলায় হলেও একটু উৎসুক হয়েই জিজ্ঞাসা করেছে সোরাবিয়া।
আজ্ঞে হ্যাঁ, মার্কুইস। ওরা যেমন জানে সেই হদিসই দিচ্ছে? বলে ফেলিপিলিও সোরাবিয়ার লালচটা আর একটু উসকে দিয়েছে।
কী হদিস দিচ্ছে? বেশ অধীর হয়েই জানতে চেয়েছে সোরাবিয়া।
আজ্ঞে, বলছে যে ওসব লুকোনো প্রেত-প্রাসাদের হদিস পাওয়া নাকি শক্ত নয়। বিনীত মোলায়েম গলায় বলেছে ফেলিপিলিও, শুধু বেঁচে থাকতে তা পাওয়ার উপায় নেই।
তা-ই বলছে! রাগে ফেটে পড়েছে সোরাবিয়া—ওদের সবাইকে সেই হদিস পেতেই আমি পাঠাচ্ছি। কোরিকাঞ্চার এই মন্দিরে সব কটাকে আমরা গলায় ফাঁসি দিয়ে ঝোলাব!
ওই হম্বিতম্বিই সার অবশ্য। চড়-চাপড় লাথি-ঘুষির বেশি চালাতে সাহস করেনি সোরাবিয়া। পিজারোর নেকনজরে থাকবার মতলবেই নিজেকে সামলানো তার সুবুদ্ধির পরিচয় বলে মনে হয়েছে।
সোনার সিংহাসনের লোভে প্রেত-প্রাসাদ খোঁজার চেষ্টা কিন্তু সে ছাড়েনি। ফেলিপিলিও তাকে এ খোঁজায় শেষ পর্যন্ত অক্লান্তভাবে যে ধরনের সাহায্য করে গেছে তার নমুনা আগেই পাওয়া গেছে কোরিকাঞ্চার মন্দিরে।
না গানাদোর সন্ধান, না তার অত লোভের সোনার সিংহাসন যেখানে রাখা সেই হুয়াইনা কাপাস-এর প্রেত-প্রাসাদের হদিস, কিছুই না পেয়ে বিফল হয়েই সোরাবিয়ার আবার এসপানিওল রিসালা নিয়ে কামালকায় ফিরে যাওয়ার কথা।
সঙ্গী হেরাদাকে সূর্যবরণ প্রান্তরের প্রথম ঘটনার পর কারা দুর্গ সৌসার দিকে সে। পাঠিয়েছিল, কিন্তু হেরাদা সন্ধ্যা হবার আগেই সে যাওয়া বাতিল করে তাঁবেদার সওয়ারদের নিয়ে কুজকোতেই ফিরে এসেছে।
কোনও কারণেই ভাগ হয়ে এসপানিওল রিসালা যেন নিজেদের দুর্বল না করে, সব সময়ে সর্বত্র যেন তারা একসঙ্গে থাকে, কুজকো রওনা হবার সময় সেনাপতি পিজারোর এই নির্দেশের কথা মনে করেই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে হেরাদা।
সন্ধ্যাবেলা জোর করে দখল করা কোরিকাঞ্চার এক অতিথিশালায় দুই দলপতির আলাপ হয়েছে এর পর তাদের গতিবিধি কী হবে তাই নিয়ে।
গানাদোর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। কুজকোর রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভুমুরও কোনও পাত্তা নেই। এ শহরের লোকেরা এসপানিওলদের ভয়ে কাঠ! তারা এসপানিওল সওয়ার সৈনিকদের তুলনায় নিরস্ত্র অসহায় বললেই হয়। তবু সামান্য সেনাদল নিয়ে চারিধারে এ দেশের মানুষের চাপা ঘৃণা হিংসায় ঘেরা হয়ে বেশিদিন তাদের আসল ঘাঁটি কামালকা থেকে এতদূর শহরে থাকা নিরাপদ হবে বলে মনে হয়নি হেরাদার। সে পরের দিন সকালেই সওয়ার বাহিনী নিয়ে কামালকায় ফিরে যাবার পরামর্শ দিয়েছে। সোরাবিয়াকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে হয়েছে সে। পরামর্শ।
সওয়ার সেনাদের কাছে হুকুম চলে গেছে পরের দিন ভোরেই ফিরে যাবার জন্যে তৈরি হবার।
সুতরাং সকল দিক দিয়ে নিষ্ফল সোরাবিয়ার এ অভিযানের ওপর এখানেই যবনিকা পড়বে এ কথাই ভাবা স্বাভাবিক।
কিন্তু নিয়তির নির্দেশ আলাদা। যে শয়তানি বুদ্ধি আর ভাগ্য মেক্সিকোয় কর্টেজ-এর বাহিনীর দল-খেদানো, মান-খোয়ানো এক সামান্য হিড্যালগো জুয়াড়িকে এক লাফে এসপানিয়ার মার্কুইস হবার সুযোগ করে দিয়েছে সেই ভাগ্যই কোন গৃঢ় উদ্দেশ্যে কে জানে এখানেও নিজের হাতে যেন শেষ মুহূর্তে ঘটনার খুঁটি নেড়েছে।
যা সে খুঁজছে সেই গোপন প্রেত-প্রাসাদের হদিস অপ্রত্যাশিতভাবে মিলে গেছে। সোরাবিয়ার। হদিস মিলেছে ছোট একদল এসপানিওল দলের কাছে। তারা যথারীতি লুঠতরাজের ধান্দায় সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফৌজি আস্তানায় ফিরছিল। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। শহরের একটু বাইরে পাহাড়ি দুর্গম একটা রাস্তায় একদল কুজকোবাসীকে আসতে দেখে তারা তাড়া করে। তাড়া করতে গিয়ে একটি পাহাড়ি বাঁক ঘুরে দূরে খাড়া একটা পাহাড়ের গায়ে যেন কেটে লাগানো একটা দরজা গোছের তারা দেখতে পায়। যে কুজকোবাসীদের কতকটা মজা করেই তারা তাড়া করেছিল, তাদের সবাই তখন এদিকে-ওদিকে পালিয়ে গেছে। এসপানিওলদের হাতে ধরা পড়েছিল শুধু একজন। ভাষা কেউ কারও জানে না। তবু ইশারা ইঙ্গিতে জায়গাটা কী তাকে জিজ্ঞেস করা হয়। হিজিবিজি যা সে বলে তা বুঝতে না পেরে তাকে সেদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় তারপর। সে চেষ্টায় লোকটার মুখ চোখ যা হয় তাতে জায়গাটা ভয়ংকর কিছু বলেই এসপানিওল সওয়ার দলের ধারণা হয়েছে। লোকটা সেদিকে যেতে তো চায়ইনি, তাদের জুলুমে এমনভাবে ভূমিশয্যা নিয়েছে যে মেরে ফেললে যেন তাকে আর ওদিকে নড়ানো যাবে না। তখন সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। লোকটার ব্যাপার দেখে শুনে এসপানিওলদেরও কেমন গা ছমছম করেছে জায়গাটায়। ভরসা করে রাত্রে তাই সেদিকে আর এগোয়নি। ইচ্ছে ছিল পরের দিন দিনের আলোয় একবার হানা দিয়ে দেখবে কিন্তু তা তো আর হবার নয়।
সোরাবিয়া জায়গাটা কী হতে পারে একবার জিজ্ঞাসা করেছে ফেলিপিলিওকে।
ফেলিপিলিও মনে মনে প্রমাদ গুনলেও বাইরে কিছু বুঝতে দেয়নি। জায়গাটা পুরনো কালের কোনও সত্যি-সত্যি হানা দেওয়া ধ্বংসপুরীর অবশেষ বলে তুচ্ছই করে দিতে চেয়েছে।
কিন্তু সোরাবিয়া তার কথা মানেনি। ধ্বংসপুরী বা যাই হোক, সেই রাত্রেই নিজের বাছাই করা ক-জন সওয়ার সৈনিক নিয়ে মশাল জ্বেলে সে হানা দিতে বেরিয়েছে। সেই পাহাড়ে লুকোনো পুরীতে। সঙ্গে যেতে বাধ্য করেছে ফেলিপিলিওকে।