২৬তম অধ্যায় – অৰ্জ্জুনযুদ্ধে কৌরব–পলায়ন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় কৌরবপক্ষীয় বীরগণ সংগ্রামে নিবৃত্ত না হইয়া ধনঞ্জয়কে পরাজয় করিবার মানসে তাঁহার উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন; কিন্তু মহাবীর ধনঞ্জয় গাণ্ডীব-প্রভাবে তাঁহাদিগের মনোরথ বিফল করিলেন। তাঁহার অশনিসদৃশ অসহ্য শরনিকর জলধরনির্মুক্ত বারিধারার ন্যায় নিপতিত হইতে লাগিল। কৌরব সৈন্যগণ সেই শরনিকর সহ্য করিতে না পারিয়া কেহ কেহ পিতা, কেহ কেহ ভ্রাতা ও কেহ কেহ বয়স্যগণকে পরিত্যাগপূর্ব্বক আপনার পুত্রের সমক্ষেই তথা হইতে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। ঐ সময় অনেকের রথাশ্ব ও অনেকের সারথি নিহত হইল এবং অনেকের অক্ষ, যুগ, চক্র ও ঈষা ভগ্ন হইয়া গেল। কেহ কেহ অস্ত্রহীন ও কেহ কেহ নিতান্ত শরপীড়িত হইল। কেহ কেহ অক্ষত-শরীর হইয়াও ভয়ে পলায়ন করিতে লাগিল। বাহনশূন্য হইয়া কেহ কেহ পুত্র, কেহ কেহ পিতাকে আহ্বান করিতে আরম্ভ করিল। অনেকানেক মহারথ দৃঢ়তর আঘাতে মোহপ্রাপ্ত হইয়া নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। অন্যান্য মহারথগণ তাঁহাদিগকে স্বীয় রথে সমারোপিত করিয়া ক্ষণকাল আশ্বাস প্রদানপূর্ব্বক পুনরায় সমরস্থলে সমাগত হইলেন। কেহ কেহ দুৰ্য্যোধনের আদেশরক্ষার্থে সমাহত ব্যক্তিদিগকে পরিত্যাগপূর্ব্বক যুদ্ধার্থ গমন করিলেন। কোন কোন বীর পানীয় পান, কেহ কেহ অশ্বগণের মাপনোদন [শ্রম দূর], কেহ কেহ বৰ্ম্ম পরিধান, কেহ কেহ রথসজ্জা এবং কেহ কেহ পিতা, ভ্রাতা ও পুত্রগণকে আশ্বাস-প্রদান ও স্বীয় শিবিরে সংস্থাপন করিয়া পাণ্ডব-সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া পুনরায় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। তৎকালে সেই কিঙ্কিণীজালজড়িত বীরগণকে অবলোকন করিয়া বোধ হইতে লাগিল যেন দানবগণ ত্রৈলোক্যবিজয়ে সমুদ্যত হইয়াছে।
ধৃষ্টদ্যুম্নযুদ্ধে দুর্য্যোধন–পরাজয়
“ঐ সময় অনেক মহাবীর সুবর্ণভূষিত রথে আরোহণপূর্ব্বক সহসা সমাগত হইয়া পাঞ্চালরাজতনয় ধৃষ্টদ্যুম্নের সহিত যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও নকুলপুত্র শতানীক কৌরবপক্ষীয় বীরদিগের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন কৌরব-সৈন্য পরিবেষ্টিত হইয়া ক্রোধভরে তাহাদের বিনাশবাসনায় মহাবেগে গমন করিতে লাগিলেন। আপনার পুত্র রাজা দুর্য্যোধন পাঞ্চালতনয়কে সমাগত সন্দর্শন করিয়া কৰ্ম্মার পরিমার্জিত নারাচ, অর্ধনারাচ ও বৎসদন্ত বাণে তাঁহার চারি অশ্বকে বিনাশ ও তাঁহার বাহু ও বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন দুর্য্যোধনের শরাঘাতে অঙ্কুশাহত মাতঙ্গের ন্যায় নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া শরনিপাতে কুরুরাজের চারি অশ্বকে শমনসদনে প্রেরণপূর্ব্বক তাঁহার সারথির মস্তকচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন, রাজা দুর্য্যোধন রথবিহীন হইয়া অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণপূর্ব্বক স্বীয় সৈন্যগণকে নিতান্ত নিস্তেজ দেখিয়া সুবলনন্দন শকুনির সমীপে সমুপস্থিত হইলেন।
“এইরূপে কৌরবপক্ষীয় রথ-সকল ভগ্ন হইলে দুই সহস্র গজারোহী সৈন্য চতুর্দ্দিক হইতে পঞ্চপাণ্ডবকে পরিবেষ্টন করিল। পাণ্ডবগণ করিসৈন্যে পরিবৃত হইয়া মেঘাচ্ছাদিত গ্রহগণের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন কৃষ্ণসারথি শ্বেতাশ্ব অর্জ্জুন সুতীক্ষ্ণ বিবিধ নারাচে সেই পৰ্ব্বতাকার গজসৈন্য বিপ্রোথিত করিতে আরম্ভ করিলে কুঞ্জরগণ অর্জুনের এক এক শরে নিহত হইয়া নিপতিত হইতে লাগিল। তাহাদের পতনে অসংখ্য সৈন্য প্রাণ পরিত্যাগ করিল। ঐ সময় মত্তমাতঙ্গ-সদৃশ পরাক্রান্ত মহাবীর ভীমসেন সেই গজসৈন্যসন্দর্শনে ক্রোধভরে গদাগ্রহণপূর্ব্বক রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া দণ্ডপাণি কৃতান্তের ন্যায় তাহাদিগের সম্মুথে সমুপস্থিত হইলেন। কৌরব-সৈন্যগণ তদ্দর্শনে নিতান্ত ভীত হইয়া বিষ্ঠা-মূত্র পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। পতাকার হস্তিসকল বৃকোদরের গদাঘাতে বিদীর্ণকুম্ভ ও রুধিরাক্তকলেবর হইয়া চীৎকার করিতে করিতে কিয়দ্দুরে গমন করিয়া ছিন্নপক্ষ পৰ্ব্বতের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। তখন রাজা যুধিষ্ঠির ও মাদ্ৰীতনয়দ্বয় রোষাবিষ্ট হইয়া গৃধপযুক্ত নিশিতশরনিকরে সেই গজারোহিগণকে শমনসদনে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। এ দিকে আপনার পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নের শরে পরাজিত হইয়া অশ্বারোহণে তথা হইতে প্রস্থান করিলে মহাবীর পাঞ্চালনন্দনও পাণ্ডবগণকে গজসৈন্যপরিবেষ্টিত অবলোকন করিয়া প্রভদ্রকগণ সমভিব্যাহারে তাহাদিগের বিনাশবাসনায় ধাবমান হইলেন।
“ঐ সময় মহাবীর অশ্বত্থামা, কৃপ ও কৃতবর্ম্মা ইহারা রথীগণমধ্যে রাজা দুর্য্যোধনকে অবলোকন না করিয়া বিবর্ণবদনে উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিলেন, ‘রাজা দুর্য্যোধন কোথায় গমন করিয়াছেন?’ হে মহারাজ! সেই ঘোরতর লোকক্ষয় কালে রাজা দুর্য্যোধনকে নিরীক্ষণ না করিয়া তাঁহাদের মনে এই আশঙ্কা হইয়াছিল যে, কুরুরাজ নিহত হইয়াছেন।’ তখন কোন কোন যোদ্ধা তাঁহাদের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘দুৰ্য্যোধনের সারথি বিনষ্ট হওয়াতে তিনি শকুনির নিকট গমন করিয়াছেন। অন্যান্য ক্ষত-বিক্ষত ক্ষত্রিয়গণ কহিলেন, ‘দুর্য্যোধনকে লইয়া আর আমাদিগের কি কাৰ্য্য সাধন হইবে? তবে তিনি জীবিত আছেন কি, একবার তাঁহার অনুসন্ধান কর। এক্ষণে সকলে সমবেত হইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়াই আমাদের কর্তব্য। ঐ দেখ, পাণ্ডবেরা মাতঙ্গ গণকে বিনাশ করিয়া এই দিকে আগমন করিতেছে, অতএব আমরা যে সমস্ত সৈন্য পরিবেষ্টিত হইয়াছি, তাহাদিগকে বিনষ্ট করিতে প্রবৃত্ত হই।’ হে মহারাজ! তৎকালে শরনিকর নিপীড়িত, ক্ষতবিক্ষতকলেবর, হতবাহন ক্ষত্রিয়গণ অপরিস্ফুটরূপে এই প্রকার কহিতে লাগিলেন।
“মহাবলপরাক্রান্ত অশ্বত্থামা ক্ষত্রিয়দিগের মুখে ঐরূপ কথা শ্রবণ করিয়া পাঞ্চাল সৈন্যগণের বিনাশসাধনপূর্ব্বক কৃপাচার্য্য ও কৃতবর্ম্মার সহিত সুবলনন্দন শকুনির সন্নিধানে গমনে সমুদ্যত হইলেন। তখন মহাবীর পাণ্ডবেরা ধৃষ্টদ্যুম্নকে পূরোবর্তী করিয়া কৌরব-সৈন্যগণকে বিনাশপূর্ব্বক আগমন করিতে লাগিলেন। আপনার সৈন্যগণ সেই মহাবলপরাক্রান্ত বীরগণকে প্রহৃষ্টমনে আগমন করিতে দেখি এককালে প্রাণরক্ষায় নিরাশ হইল। উহাদিগের মুখমণ্ডল ভয়ে বিবর্ণ হইয়া গেল। তখন আমরা পাঁচজন সেই সমস্ত সৈন্যকে ক্ষীণায়ুধ ও অরাতিগণে পরিবেষ্টিত দেখিয়া বহুসংখ্যক অশ্ব ও হস্তী লইয়া, কৃপাচার্য্যের সমীপে অবস্থানপূর্ব্বক প্রাণপণে পাঞ্চালসৈন্যগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলাম এবং অল্পক্ষণমধ্যে অর্জুনের শরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি গমন করিতে লাগিলাম। তথায় আমাদিগের ঘোরতর যুদ্ধ হইল। পরিশেষে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন আমাদিগকে পরাজিত করিলে আমরা রণস্থল হইতে অপসৃত হইলাম। অনন্তর মহারথ সাত্যকি চারি শত রথীর সহিত আমার প্রতি ধাবমান হইলেন। আমি শ্রান্তবাহন মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নের নিকট হইতে কথঞ্চিৎ মুক্তিলাভ করিয়া নরকে নিপতিত পাপ-পরায়ণের ন্যায় সাত্যকির সৈন্যমধ্যে নিপতিত হইলাম। তখন মুহূর্তকাল ঘোরতর সংগ্রাম হইল। পরিশেষে মহাবীর সাত্যকি আমার পরিচ্ছদ ছিন্ন ভিন্ন করিয়া আমাকে স্মৃতি ও ধরাতলে নিপতিত দেখিয়া দৃঢ়তররূপে আক্রমণ করিলেন। অনন্তর মহাবীর বৃকোদর গদা ও অর্জ্জুন নারাচ দ্বারা হস্তীদিগকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তখন সেই পৰ্ব্বতোপম মাতঙ্গগণ চতুর্দ্দিক হইতে গাঢ়তর নিপীড়িত হইয়া প্রাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক নিপতিত হইতে লাগিল। তাহাদের পতনে পাণ্ডবগণের রথমার্গ অবরুদ্ধপ্রায় হইল। তখন মহাবীর বৃকোদর সেই সমস্ত মৃত হস্তীদিগকে অপসারিত করিয়া রথগমনের পথ পরিষ্কৃত করিলেন। এ দিকে মহাবীর অশ্বত্থামা, কৃপ ও কৃতবর্ম্মা রথীগণমধ্যে রাজা দুর্য্যোধনকে নিরীক্ষণ না করিয়া তাহার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত ধৃষ্টদ্যুম্নকে পরিত্যাগপূর্ব্বক উদ্বিগ্ন মনে শকুনির সন্নিধানে গমন করিলেন।”