২৬.
সোমবার জুন ৬, ২০১১
অশোকের মৃত্যু রহস্য সমাধান নিয়ে একেনবাবু ঠিক কোথায় আছেন জানি না। যেটা জানি, সেটা হল নানান জিনিস নিয়ে কারণে অকারণে মাথা ঘামাচ্ছেন। আমাকে সকালে বললেন, এশিয়া ইনস্টিটিউটের আকাহাশির সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে। এই রকম অনুরোধ একেনবাবু প্রায়ই করেন। ফোনে ওঁর কথা নাকি কেউ বুঝতে পারে না। প্রমথ এ ধরণের অনুরোধ রিফিউজ করে। বলে, “কী ভেবেছেন আপনি, আমি আপনার পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট? একেনবাবুর স্ট্যান্ডার্ড উত্তর, কী যে বলেন স্যার, আমার যা ইংরেজি, তার ওপর এই তো অ্যাকসেন্ট।’ আমি অবশ্য ওঁর অনুরোধ না রেখে পারি না। ওঁর এই সমস্যাটা প্রমথরও অজানা নয়, ফোনে অচেনা বিদেশীদের কিছু বোঝাতে উনি যা স্ট্রাগ্ন করেন, তাতে খারাপই লাগে! যেটা ভেবে পেলাম না, সেটা হল আকাহাশির সঙ্গে ওঁর হঠাৎ কী দরকার পড়ল? সেটা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, “চলুন না স্যার, সব সময়েই কারণ থাকতে হবে নাকি?”
অর্থাৎ, উত্তর দেবেন না। কারণ ছাড়া উনি কিছু করেন বলে আমার মনে হয় না। মুশকিল হল আকাহাশিকে সন্ধে ছ’টার আগে পাওয়া গেল না। ওঁর সেক্রেটারি প্রথমে প্রায় ভাগিয়েই দিচ্ছিল। শেষে আমি নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বলায় কিছুটা কাজ হল।
অশোক দুবের মৃত্যু নিয়ে আমার নিজের কাজ প্রায় মাথায় উঠেছিল। অনেক কষ্ট করে পেপারটা প্রায় শেষ করে ফেলেছি। যেটুকু বাকি ছিল, সেগুলো বিকেলের মধ্যেই শেষ করলাম। সন্ধে ছ’টা নাগাদ আমরা তিনজনই হাজির হলাম আকাহাশির অফিসে।
আকাহাশি বোধহয় ভেবেছিলেন আমি একা আসছি, কারণ ওঁর সেক্রেটারিকে আসার কারণ (যা তখন নিজেই জানতাম না) বা ক’জন আসছি কিছুই জানাইনি। এখানে আসার পথে একেনবাবুর কাছে একটু হিন্ট পেলাম কী উনি জানতে চান।
.
তিনজনকে দেখে আকাহাশি একটু অবাক হলেন।
আমি নিজের পরিচয় দিয়ে প্রমথ আর একেনবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম।
“কী ব্যাপার বলুন তো?” আকাহাশি প্রশ্ন করলেন।
কথোপকথন আমিই শুরু করলাম। “মিস্টার জন হেক্টার মারা গেছেন, আপনি কি খবরটা জানেন?”
“হ্যাঁ।”
“উনি ইন্ডিয়াতে গিয়েছিলেন আপনাদের এক্সিবিশনে যে বিষ্ণুমূর্তিটা ছিল –সে সম্পর্কে কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করতে।”
“এটা কিন্তু আমি জানতাম না।” প্রসঙ্গটাতে আকাহাশি একটু অসোয়াস্তি বোধ করছেন বুঝতে পারলাম।
“এ ব্যাপারে আপনার মতামত পত্রিকায় পড়েছি। আপনার মতে ওটা কম্বোডিয়ার, তাই তো?”
“মূর্তিটা যেখান থেকে এসেছে… তাদের যা দাবি, সেটাই আমি বলেছি।” আকাহাশি একটু সতর্ক হয়ে উত্তর দিলেন।
“তার মানে স্যার, আপনি নিজে শিওর নন।” এবার একেনবাবু মুখ খুললেন।
“যিনি আমাদের এক্সিবিট হিসেবে ওটা দিয়েছেন, তাঁকে সন্দেহ করার কোনও কারণ দেখিনি।”
“তিনি তো স্যার, বিপাশা মিত্র।”
“হ্যাঁ।”
“মূর্তিটা এখন কোথায়?”
“ধরে নিচ্ছি, ওঁর কাছেই আছে।”
“তাই নাকি? কিন্তু ওঁর প্রাইভেট মিউজিয়ামের কিউরেটর কিন্তু জানেন না সেটা কোথায়।”
আকাহাশি এবার একটু বিরক্ত হলেন। বললেন, “আপনার কি মনে হয় উত্তরটা আমি জানব?”
“আপনার এখান থেকেই তো প্যাক করে মূর্তিটা ম্যাডামের কাছে গিয়েছিল?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু ম্যাডামের কাছে পৌঁছোয়নি।”
“মিস মিত্র কি আপনাকে সেটা খুঁজে বার করার দায়িত্ব দিয়েছেন?”
“না স্যার।”
“তাহলে এ নিয়ে আপনি এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?”
“না স্যার, মাথা ঘামাচ্ছি না। শুধু ভাবছিলাম বিপাশা মিত্র আপনাদের একজন বড় পেট্রন, তাই না স্যার?”
“হ্যাঁ, এটা পাবলিক নলেজ। শুধু উনি নন, ওঁর বাবাও এই প্রতিষ্ঠানকে বহু অর্থ দান করেছেন।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার।”
“কী ইন্টারেস্টিং?” আকাহাশি একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন।
“না, না, স্যার, ওঁদের অর্থদানের কথা ভাবছি না। ভাবছি মূর্তিটা না পাওয়া গেলে তো তার অথেন্সিটি নিয়ে তর্কাতর্কির অর্থ হয় না।”
আকাহাশি চুপ। বোধহয় বোঝার চেষ্টা করলেন, একেনবাবু কোনদিকে এগোচ্ছেন।
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার” আকাহাশিকে একটু হতভম্ব করেই একেনবাবু উঠে পড়লেন।
আমি আকাহাশিকে ধন্যবাদ জানালাম আমাদের সময় দেওয়ার জন্যে। উনিও সৌজন্য দেখিয়ে কিছু একটা বললেন। সেটা শোনার আগেই একেনবাবু দরজার বাইরে চলে গেছেন।
.
আকাহাশির অফিস থেকে বেরিয়েই প্রমথ একেনবাবুকে চেপে ধরল, “আপনার মাথায় কী ঘুরছে বলুন তো? এতদিন তো অশোকের খুন নিয়ে মেতেছিলেন, সেইসঙ্গে বিপাশার ছবি বা স্ট্যাম্প যাই বলুন, সেই নিয়ে। এখন বিষ্ণুমূর্তি নিয়ে পড়লেন কেন? বিপাশা তো বলেইছে ওটা চুরি হয়নি!”
“রাইট স্যার।”
“রাইট যদি হয়, তাহলে ওই নিয়ে আকাহাশিকে খোঁচা দেওয়া কেন?”
“ঠিকই বলেছেন স্যার, আসলে আমার এই নীলাটাই গন্ডগোল করছে। মাঝেমাঝেই অদ্ভুত চিন্তা মাথায় আসে, নিজেরই গুলিয়ে যায়।”
“দয়া করে আর নীলার দোহাই দেবেন না, সোজাসুজি বলুন মাথায় কী ঘুরছে জানাবেন না। এদিকে তো আবার বলে বেড়ান আমরা আপনার অ্যাসোসিয়েট!”
“আপনি না স্যার, সত্যি! আমি কি ইচ্ছে করে কিছু লুকিয়ে রাখি? আমি নিজেই কনফিউসড। ভাবছিলাম, বিষ্ণুমূর্তিটা লুকোনো হল কেন? নিশ্চয় জন হেক্টারের ভয়ে।”
“সেটা এখন অবভিয়াস,” আমি বললাম। “জন হেক্টার যদি পত্রপত্রিকায় একটা অকাট্য প্রমাণ দাখিল করতেন, তাহলে আকাহাশি আর বিপাশা দুজনের পক্ষেই সেটা এমব্যারাসিং হত।”
“ঠিক স্যার, এখন আর সে সমস্যা রইল না।”
“আপনি কি বলতে চান, তার জন্যেই জন হেক্টারকে খুন করা হল? দ্যাট্স ননসেন্স!”
“রাইট স্যার, তাই আমি কনফিউসড।”
“হয়তো এই দুটো জিনিস কানেক্টেড নয়। হেক্টারকে খুন করা হয়েছে ওঁর ক্যামেরা, ল্যাপটপ এইসবের লোভে।”
“রাইট স্যার।”
“আপনি তো দেখছি আজ রাইট’ বলার মুডে আছেন!”
“কী আর বলব স্যার, আপনারা ‘রং’-তো কিছু বলছেন না।”
.
সাতটা প্রায় বাজে। একেনবাবু বললেন, “স্যার আপনার গাড়ি চড়ে একটু হোবোকেন যেতে পারি?”
“এখন? কোথায়?”
“যেখানে অশোকবাবুর ডেড বডি পাওয়া গিয়েছিল।”
“আবার ওখানে কী দেখবেন? পৌঁছতে পৌঁছতে তো রাত্রি হয়ে যাবে?”
সত্যি বলতে কি, এই রাতে ওখানে যেতে আমার এতটুকু ইচ্ছে করছিল না।
“একটা জিনিস স্যার আজ জানতে পারলাম ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের কাছ থেকে, কী করে ডেথের টাইমটা হোবোকেন পুলিশ বার করেছে।”
“কী জানলেন?”
“রাস্তায় ঢোকার মুখটা আটটা পর্যন্ত ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করা ছিল একটা গ্যাসলিকের জন্যে। আটাটার পর খোলা হয়। পুলিশ বডিটা পায় রাত দশটা নাগাদ। রাস্তাটা ওয়ানওয়ে সেটা তো সেদিনই দেখলাম। তাই এটা লজিক্যাল স্যার যে খুনি গাড়ি নিয়ে আটটার পর ওই রাস্তায় ঢুকেছিল। খুন করে বডিটা ফেলে চলে যায়।”
“আপনি গিয়ে ওখানে কি দেখতে চান?”
“সেটা কি আগে থেকেই জানি স্যার? চলুন না, এক্ষুনি বাড়ি ফিরে কী হবে? ওখান থেকে ফেরার পথে কোথাও ডিনার খেয়ে নেব।”
“আপনি খাওয়াবেন?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“দেখছেন স্যার, কোথাও খাওয়ার কথা উঠলেই প্রমথবাবু আমাকে কি রকম চাপ দেন?”
“তার কারণ আপনি এই কাজে টাকা পিটছেন, আর আমরা ঘুরে মরছি।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে স্যার, খাওয়াব।”
.
যে গ্যারাজে আমার গাড়ি থাকে সেটা আকাহাশির অফিস থেকে অনেকটা দূরে। গ্যারাজে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় পৌনে আটটা। বহু লোক দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির জন্যে। একজন মাত্র অ্যাটেন্ডেন্ট। সে একটা একটা করে গাড়ি আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বার করে আনছে। প্রায় পনেরো মিনিট লেগে গেল গাড়ি পেতে। যখন গাড়িতে উঠছি, তখন যাকে দেখলাম, তাকে এক্সপেক্ট করিনি। এক ঝলকের জন্যে, কিন্তু চিনতে অসুবিধা হল না– এড গুয়ান্সিয়াল। আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি ওর দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গাড়ি নিয়ে বেরোলাম। বেরোতেই প্রমথ ঘোষণা করল, “আগে খাব, তারপর যাব।”
বললাম, “একটু আগে বলতে পারলি না, এখন কোথায় পার্ক করব!”
“পার্কিং না পেলে, আবার গ্যারাজে ঢুকিয়ে দে।”
ভাগ্যক্রমে রাস্তাতেই একটা কার্বাইড পার্কিং পেয়ে গেলাম। সেখানে গাড়ি রেখে সামনেই দেখি একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। একেনবাবু মেনু দেখে খুব সন্তুষ্ট। বললেন, “চাইনিজরা খুব রিজনেবল স্যার।”
“ক’দিন আগেই তো মুণ্ডুপাত করছিলেন, চ্যাং লি লনড্রি আপনার কোটের বোতাম ছিঁড়ে দিয়েছিল বলে?”
“তা করেছিলাম স্যার। আসলে আমরা দোষে-গুণে মানুষ।”
.
খেয়েদেয়ে যখন বেরোলাম, তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। আজকে গাড়ি নিয়ে বেরোব ঠিক ছিল না, জিপিএস-টা বাড়িতে ফেলে এসেছি। সুতরাং কোনো গাইডেন্স সিস্টেম নেই। হোবোকেনে পৌঁছে রাস্তাটা খুঁজে বার করতে গিয়ে পথ হারালাম কয়েকবার। তখনই মনে হল একটা গাড়ি আমাদের পিছু নিয়েছে। ডাইনে বাঁয়ে যেদিকেই যাই, ছিনে জোঁকের মতো লেগে আছে। “সামথিং ইজ নট রাইট,” আমি একেনবাবু আর প্রমথকে বললাম। “আমাদের কেউ ফলো করছে!”
“কী বলছিস যা-তা!” প্রমথ একটা ধমক লাগাল।
“আমি গাড়ি চালাচ্ছি, আমি বুঝব না! একই হেডলাইট দেখতে পাচ্ছি।”
“কে ফলো করবে?” প্রমথ মুখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল।
“গ্যারাজ থেকে যখন গাড়ি বার করছিলাম, এড গুয়ান্সিয়ালকে দেখেছিলাম।”
“তাতে হয়েছেটা কী?” প্রমথ অনেক সময় বেশি সাহসী ভাব দেখায়। এর উত্তর দেওয়া নিষ্প্রয়োজন।
“গাড়িটা স্যার রাস্তার ধারে দাঁড় করান না, তাহলে বুঝবেন সত্যি সত্যি ফলো করছে। কিনা।”
“ক্ষেপেছেন, লোকটা নির্ঘাত এড বা ওর গুণ্ডা দলের কেউ। আমি আর হোবোকেনে ঘুরছি না সোজা লিঙ্কন টানেল ধরে ম্যানহাটানে যাচ্ছি।” কথাটা বললাম ঠিকই, কিন্তু টেনশনে আমি এখন কোথায় আছি নিজেই জানি না। একবার ডানদিকে ঢুকছি, একবার বাঁদিকে ঢুকছি। রাস্তাগুলো সরু সরু, গোটা অঞ্চলটাই নির্জন দোকানপাট কিছু নেই। পেছনের গাড়িটা চুম্বকের মতো লেগে আছে। গাড়ি আস্তে করলে, আস্তে করছে, জোরে চালালে দ্রুত পিছু নিচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যেও আশেপাশে যেটুকু নজরে আসছে, তাতে বুঝতে পারছি একই জায়গায় চক্কর খাচ্ছি। কিন্তু মাথা স্থির করে গোলোকধাঁধা থেকে বেরোতে পারছি না। হঠাৎ একটা বড় রাস্তার জাংশন দেখেই দ্রুত গতিতে গাড়ি ঘোরালাম। সঙ্গে সঙ্গেই পেছনের গাড়ির উপরে লাল-বাতি চক্কর খেতে শুরু করল। পুলিশের গাড়ি!
গাড়ি দাঁড় করাতেই, একটা দশাসই চেহারার লোক গাড়ি থেকে নেমে এসে মুখে টর্চ ফেলল। তারপর জানলার কাঁচে টোকা দিয়ে কাঁচটা নামাতে বলল। চোখের ওপর তখনো টর্চ, একটা গম্ভীর গলা কানে এল, “লাইসেন্স এন্ড রেজিস্ট্রেশন।”
উচ্চবাচ্য করে দিলাম। সেটা নিয়ে হাতে ধরা কম্পিউটারে কী সব পাঞ্চ করে পুলিশটা বলল, “কোথায় যাচ্ছিলে?”
দেখলাম এখানে সত্যি কথা বললে বিপদ। “ভুল করে এখানে ঢুকে পড়েছি, লিঙ্কন টানেল খুঁজছিলাম।”
“তুমি স্টপ সাইনে থামনি।” বলে খসখস করে একটা ট্র্যাফিক টিকিট লিখল। তারপর আরও বার কয়েক টর্চ দিয়ে প্রমথ আর একেনবাবুকে দেখল। ভাগ্যিস আমরা মদ্যপান করিনি, তাহলে আরও ফ্যাচাং হত। টিকিটটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল। “এই রাস্তা দিয়ে সোজা চলে যাও, টানেলের সাইন পাবে।”
.
জীবনে এই প্রথম ট্র্যাফিক টিকিট পেয়ে তেমন খারাপ লাগল না, ভাগ্যিস আমাদের ফলো করছিল পুলিশ, এড বা ডট বাস্টার টাইপের কোনো গ্যাং নয়! এই অচেনা জায়গায় ওদের পাল্লায় পড়লে কী হত ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
পুলিশ চলে যেতেই গাড়ি স্টার্ট করলাম। ঠিক এমন সময় একেনবাবুর নতুন মোবাইল বেজে উঠল।
“হ্যালো… হ্যাঁ স্যার।” অন্যপক্ষের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না। তবে একেনবাবুর মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম তিনি যথেষ্ট অবাক। শেষে বললেন, “বলেন কি? মিস্টার এডের লকারে পাওয়া গেছে? কংগ্রাচুলেশনস স্যার, ভেরি ইন্টারেস্টিং ডেভালপমেন্ট… থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”
“কী ব্যাপার?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“এড গুয়ান্সিয়ালকে গতরাত্রে পুলিস ধরেছে একটা ইললিগ্যাল গ্যাম্বলিং জয়েন্ট থেকে। আজ সকালে ওঁর লকার থেকে পুলিশ একটা সিন্ধ ডাক স্ট্যাম্প পেয়েছে। এড অবশ্য বলছেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। দোষীরা যেটা সবসময়েই বলে থাকে।”
প্রমথ আমাকে বলল, “তুই একটা স্টুপিড, একটু আগে কী করে এডকে দেখলি, আর সেই ভয়ে উলটোপালটা গাড়ি চালালি?”
কী আর বলব, একটু আগে ফোনটা এলে এই টেনশনটা হত না, টিকিটও হয়তো পেতাম না।
“যাক, অশোকের মৃত্যুর সমস্যাটা মনে হচ্ছে মিটে গেল,” প্রমথ বলল। “এবার এডকে চাপ দিয়ে বার করুন ফটোটা সে কোথায় ফেলেছে? তারপর সেটা নিয়ে বিপাশার কাছে বুক ফুলিয়ে কিছু টাকা দাবি করুন। একেই বলে ঝড়ে বক পড়ে আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে।”
একেনবাবু চুপ।
.
২৭.
মঙ্গলবার জুন ৭, ২০১১
বেশ কয়েকদিন বেভকে অফিসে দেখিনি। বোধহয় ছুটি নিয়েছে। একটু অবশ্য অবাক লাগছিল। গত সোমবার কিশোরের বাড়িতে যখন ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম, ছুটি নেবার কথা বলেনি। চিন্তা হচ্ছিল শরীরটরির ঠিক আছে কি না, যেরকম ভাইরাল ফিভার হচ্ছে চারিদিকে! আজ দেখলাম এসেছে। আমায় ‘হ্যালো’ বলল ঠিকই, কিন্তু ওইটুকুই। মুখের সেই হাসিটা নেই। বেভ হচ্ছে সেই দলে, যাদের মনের ভিতরে কী চলছে তা পরিষ্কার মুখে ফুটে ওঠে। আজ যে ওর মন বিক্ষিপ্ত, সেটা বুঝতে এক মুহূর্তও লাগল না। কিন্তু দাঁড়িয়ে যে জিজ্ঞেস করব, সে সময়টা এই মুহূর্তে নেই। সকাল থেকে নানা জায়গায় ছুটোছুটি করে যখন আবার অফিসে ঢুকলাম তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। আজ আর কোনও মিটিং নেই, বাঁচা গেছে!
বেশ কিছুদিন হল আমি আর প্রমথ একটা এইচডি অর্থাৎ হাই ডেফিনেশন টিভি কেনার কথা ভাবছি। কিন্তু অনেক গবেষণা করেও কী কেনা হবে স্থির করে উঠতে পারিনি। একেনবাবুর এ ব্যাপারে কোনও উৎসাহ নেই। তার মানে ওঁর কাছ থেকে কোনও কন্ট্রিবিউশন আশা করা যাবে না। ইদানীং প্রমথও এ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করছে না। তার কারণটা বুঝতে পারি। ও আর ফ্র্যান্সিস্কা নিশ্চয় শিগগিরি বিয়ে করার কথা ভাবছে, সেক্ষেত্রে শেয়ারে এখন টিভি কেনা অর্থহীন। প্রমথ বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ভাবতে খুবই খারাপ লাগে। একসঙ্গে আমরা বহু বছর কাটিয়েছি। আমাদের বাড়ির যা কিছু জিনিসপত্র, সবই ভাগাভাগি করে কেনা। তাই আমি চাই এ বাড়ি থেকে ও কিছু জিনিস নিয়ে যাক ওদের নতুন বাড়িতে। প্রমথকে এ ব্যাপারে একটা হিন্টও দিয়েছি। ওর উত্তর, “চুপ কর শালা, বেশি বদান্যতা দেখাতে হবে না। বুঝতে পারি, আমাকে ছেড়ে যেতে হবে, এর জন্য গিল্ট ফিলিং-এ ভুগছে। একদিন হঠাৎ বলল, “হ্যাঁরে, বেভ মেয়েটাকে তো বেশ ভালোই দেখতে, তোকে পছন্দও করে। কিশোরকে ফুটিয়ে তুই ওকে বিয়ে কর। আমি বলেছিলাম, আমার জন্যে তোকে ভাবতে হবে না। তুই নিজে আগে বিয়েটা কর। কিন্তু একটু অ্যাডভান্সড নোটিস দিস। রিসেপশনের পার্টি তো সেই আমাকেই অর্গানাইজ করতে হবে।
এই দেখুন, এইচডি টিভি-র কথা বলতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে এলাম। ঠিকমত গুছিয়ে লেখা আমার ধাতে নেই। যেটা বলছিলাম, প্রমথর ভরসাতে আর না থেকে আমি ঠিক করেছি, নিজেই এইচডি টিভি কিনবো। দোকান থেকে না কিনে মেল অর্ডার দিয়ে কিনলে কিছুটা সস্তায় পাওয়া যায়। কিন্তু টিভি যদি কাজ না করে, তাহলে কী করব? ফেরত পাঠানোও তো একটা ঝামেলা। এসব ব্যাপারে আমার অগতির গতি হল জনি চু। চায়না টাউনে ওর চেনাজানা কয়েকটা অ্যাপ্লায়েন্সের দোকান আছে, সেখান থেকে ভালো ডিসকাউন্ট জোগাড় করে দিতে পারবে, সে গ্যারান্টি আমায় দিয়েছে। প্ল্যান ছিল জনিকে পাকড়াও করে আজ লাঞ্চ টাইমে চায়না টাউনে যাব। মোটামুটি একটা আইডিয়া করতে পারব, ৩৭ থেকে ৪০ ইঞ্চি সাইজের টিভি কিনতে কত লাগবে। জনির একটাই ডিমান্ড ওকে চায়না টাউনে লাঞ্চ খাওয়াতে হবে। চাইনিজ খেতে নিজেই ভালোবাসি, আপত্তির প্রশ্নই ওঠে না। জনিকে যখন ফোন করতে যাচ্ছি, বেভ ঘরে ঢুকল।
“আর ইউ বিজি?” প্রশ্নটা করল ঠিকই, কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করে চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
ওর বিষণ্ণ মুখটা দেখে খারাপ লাগল।
“কী হয়েছে বেভ, সামথিং রং?”
“আই থিঙ্ক আই অ্যাম গোইং টু ব্রেক-আপ উইথ কিশোর।”
এই বম্ব শেলটার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না।
“সেকি?”
বেভের চোখটা দেখলাম ছলছল করছে। বলল, “হি হ্যাঁজ এ স্টাক-আপ ফ্যামিলি।”
বেভের এই কনক্লশনের কারণ যে কিশোরের কাকা, সেটা বুঝতে আইনস্টাইন হবার প্রয়োজন নেই। বললাম, “তুমি কিশোরকে বিয়ে করতে যাচ্ছ, ওর আঙ্কলকে নয়।”
“ইউ ডোন্ট নো দ্য হোল স্টোরি।” বেভ প্রায় আমায় থামিয়ে দিয়ে বলল।
আমি হিসেব করে দেখলাম ওর স্টোরি শুনতে গেলে আজ চায়না টাউন যাওয়া হবে না। কিশোরের উপর রাগও হল। র্যাস্কেলটা নিজে তো আমার সময় নষ্ট করছেই, আবার ওর গার্লফ্রেন্ডকে দিয়েও সময় নষ্ট করাচ্ছে! করছিস তো প্রেম, এত ভুল বোঝাবুঝির কী দরকার?”
বেভকে বললাম, “আমায় এখন চায়না টাউন যেতে হবে। ফিরে এসে যদি শুনি?”
“চায়না টাউনে কেন যাচ্ছ?”
বেভকে আমার কেনাকাটার ব্যাপারে কিছু বলার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু সোজসাপটা প্রশ্নের উত্তর না দিলেও চলে না। বললাম, “একটা টিভি খুঁজতে যাচ্ছি।”
“তার জন্যে চায়না টাউন কেন যাবে? জ্যাক তোমায় অনেক বেটার ডিল দেবে।”
“জ্যাক?”
“আমার আঙ্কল।”
“আবার এক আঙ্কলকে জড়াচ্ছ!” ফস করে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
“হি ইজ এ ডাউন-টু-আর্থ ম্যান, ইউ উইল সি। আর আমি তোমার সঙ্গে গেলে যে ডিল পাবে, কোথাও ম্যাচ করাতে পারবে না।”
এই অকাট্য যুক্তি খারিজ করে চায়না টাউন যাওয়া যায় না। তাও ইতস্তত করছি দেখে, বেভ বলল, “আনলেস ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট টু গো আউট উইথ মি।”
এরপর ওর সঙ্গে না যাওয়াটা অসম্ভব।
“আমি আসছি,” বলে বেভ বেরিয়ে গেল। একটু বাদেই ফিরে এসে বলল। “হেলেন আমাকে কভার করবে বলেছে, এখনি চল, লাঞ্চ টাইম হয়ে গেলে আঙ্কল জ্যাক দোকানে থাকবে না।”
.
বেভের আঙ্কল জ্যাকের দোকানটা দূরে নয়। দোকানের নামটা শুনেই চিনতে পারলাম। অনেকবারই দেখেছি, বেশ বড় সাইজের দোকান। ওটা যে বেভের আঙ্কলের সেটা জানতাম না। যেতে যেতে বেভ বলল, “আমি জানি না কিশোরের আঙ্কল কিশোরকে কী বলেছে, বাট হি ইজ বিহেভিং স্ট্রেঞ্জলি।”
“কী স্ট্রেঞ্জলি?”
উত্তরটা দীর্ঘ, সংক্ষেপ না করেই লিখছি–
যেদিন আমরা কিশোরের বাড়িতে ডিনার খেয়েছিলাম, তার পরের দিন কিশোর বেভকে ফোন করে বলে, ও ওর আঙ্কলকে বুঝিয়েছে, বেভ বাবার প্রফেশন নিয়ে মজা করছিল। বেভের বাবা একজন বিজনেসম্যান। তারপর বেভকে বলে, বেভ যেন সেই পরিচয়ই ওর বাড়ির সবাইকে দেয়।
‘কেন তোমাদের ফ্যামিলিতে কি ব্লু-কলার ওয়ার্কারদের নিয়ে সমস্যা আছে?’ বেভ ক্ষুব্ধ হয়েই প্রশ্নটা করে।
কিশোর উত্তরটা এড়িয়ে যায়। তোমাকে তো আমি মিথ্যে কথা বলতে বলছি না। তোমার বাবা তো বিজনেসম্যানই, প্লাম্বিং-তো বিজনেসই।
বেভ তখন রেগে গিয়ে বলে, “না, আমার বাবা প্লাম্বার ফার্স্ট, বিজনেসম্যান সেকেন্ড।
‘এই সামান্য একটা অনুরোধ তুমি রাখতে পারবে না? আমি তো তোমায় মিথ্যে কথা বলতে বলছি না!’
‘এটা সামান্য অনুরোধ নয়, তুমি আমার বাবার পরিচয় লুকোতে বলছ। আই অ্যাম প্রাউড অফ হিম।
কিশোর নাকি তখন বলে, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, পরে তোমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব। তবে মনে রেখো– ডিস্ক্রিশন ইজ বেটার পার্ট অফ ভ্যালার”।
এটা শুনে বেভ এত রেগে যায়, ফোন নামিয়ে রাখে। কিশোর বেশ কয়েকবার ফোন করে, কিন্তু বেভ উত্তর দেয়নি।
মনে মনে ভাবলাম, কিশোরটা একটা ইডিয়ট।
এসব শোনার পর আমার ঠিক কী বলা উচিত মাথায় খেলল না। বেভের মাথা একটু ঠাণ্ডা না হলে যাই বলি না কেন লাভ নেই। সো সরি টু হিয়ার দিস। থিংস উইল ওয়ার্ক আউট’… এসব বললাম ঠিকই। কিছু তো একটা বলতে হবে। লাকিলি কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেভের আঙ্কলের দোকানের সামনে পৌঁছে গেলাম।
.
বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু দোকানটা বিশাল। দু’তলা জুড়ে ডিসপ্লে। অজস্র টেলিভিশন পর পর সাজানো। এক পাশে হোম থিয়েটার– সেখানে থ্রি-ডি-র নানান সরঞ্জাম। আরেকদিকে তাকের ওপর সারি সারি ব্লু-রে ডিভিডি সেট। দোতালায় রয়েছে ডিজিট্যাল ক্যামেরা, ও অন্যান্য নানান ইলেকট্রনিক্সের সম্ভার। বেভের আঙ্কল জ্যাক দোকানে ছিলেন। শুভ্রকেশ সম্ভ্রান্ত চেহারার ভদ্রলোক। বয়স বোধহয় সত্তরের কাছাকাছি। কিন্তু স্বাস্থ্য এখনো অটুট। বেভকে দেখে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বেভকে বললেন, “এই নিশ্চয় তোমার সেই বন্ধু, রাইট?”
“না জ্যাক, এ আমার আরেক বন্ধু। ভেরি ডিয়ার ফ্রেন্ড, বাপি। ও একটা টেলিভিশন সেট কিনবে। তোমাকে কিন্তু ওকে ভীষণ ভালো ডিল দিতে হবে, আমি ওকে কথা দিয়ে নিয়ে এসেছি।”
“তুমি কথা দিলে, কী করে সেটা ফেলব? কী ধরণের সেট তুমি খুঁজছে ইয়ং ম্যান?”
আমি কী চাই বললাম। উনি ঘুরে ঘুরে বেশ কয়েকটা সেট দেখালেন। আমি মেল অর্ডারে কি রকম দাম হয় সেটা জানি। টিভির প্রাইসের সঙ্গে যে ডিসকাউন্ট প্রাইস ঝুলছে, সেটা কিন্তু মেল-অর্ডারের থেকে অনেকটাই বেশি। আমি দরাদরি করতে পারি না। তাই ভাবছিলাম কী করে বেভের আঙ্কল জ্যাককে এড়ানো যায়। জ্যাক বোধহয় আমার মনের ভাবটা বুঝলেন। বললেন, “ডিসকাউন্ট প্রাইসের দিকে তাকিয়ো না, আমার ফেভারিট ভাগ্নির বন্ধুর জন্য দাম অনেক কম হবে। ধর, এটা কিনতে চাইলে, তোমায় ৫৯০ দিতে হবে না, ৫২৫ দিলেই চলবে। এই দাম তুমি মেল-অর্ডারে পাবে না।”
উনি ঠিকই বলেছেন, এই মডেলের দাম আমি দেখেছি ৫৫০ থেকে ৫৭০-এ বিক্রি হচ্ছে। আমি ঝট করে ডিসিশন নিয়ে ফেললাম। “এটাই আমি কিনব।”
জ্যাক চোখ টিপে বেভকে বললেন, “এরকম বেশি বন্ধুকে আর এনো না, আমি দেউলিয়া হয়ে যাব।”
উত্তরে বেভ জ্যাককে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেল।
আমি যখন চেক-আউট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ক্রেডিট কার্ড দিচ্ছি, তখন শুনি জ্যাক বেভকে বলছেন, “এবার তুমি বাড়িটার পজেশন নাও। আমি বুড়ো হচ্ছি, চিরদিন তো থাকব না।”
বেভ কিছু উত্তর দিলো না।
“আমি জানি তুমি কি ভাবছ, কিন্তু তোমার মা নিশ্চয় চাইতেন তাঁর প্রাপ্যটা তুমি নেবে। তাঁর কথাটা একটু ভেবো।” বলে জ্যাক বেভকে আবার জড়িয়ে ধরলেন।
আমার ক্রেডিট কার্ড স্লিপে সই করা হয়ে গেছে। দোকান থেকেই টিভিটা বাড়িতে ডেলিভারি দিয়ে দেবে। তার টাইম ইত্যাদি ঠিক করে যখন মুখ ঘুরিয়েছি দেখি বেভ অদৃশ্য। গেল কোথায়? দেখি জ্যাকও নেই।
খানিক বাদেই বেভ পাশের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। “সরি, কেভিনের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হল। জানতাম না ও এখানে মাস দেড়েক ধরে কাজ করছে। খুব খুশি, এখানে মাইনেপত্র ভালো, সেলস কমিশন আছে। আই অ্যাম সো হ্যাপি ফর হিম।”
“কেভিন?”
“যে ফিলাটেলিস্ট কর্নারে কাজ করত। বললাম না তার কথা সেদিন?”
জ্যাকও আরেকটা ঘর থেকে উদয় হল। জ্যাককে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।
.
রাস্তায় বেরিয়ে বেভকে বললাম, “তুমি ঠিক জায়গাতেই নিয়ে এসেছিলে, তোমার আঙ্কল বলেই এরকম ডিল দিলেন। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।”
“ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। জ্যাকের মতো আঙ্কল হয় না, আমায় খুব ভালোবাসে। শুধু ওর নিজের মেয়েই ওকে বুঝল না।”
“কেন, কী হয়েছে?”
“শার্লি প্রায় আমার বয়সি। হাইস্কুল শেষ করতে না করতেই বাড়ি ছেড়ে ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে থাকতে শুরু করে। অত্যন্ত বাজে একটা ছেলে। ক’দিন বাদেই শার্লিকে ডাম্প করে পালায়। কিন্তু প্রেগনেন্ট করার আগে নয়। শার্লি বাড়ি না ফিরে অদৃশ্য হয়ে যায়।”
“ওর সেই বয়ফ্রেন্ড? সে কোথায়?”
“ছিল একটা ড্রাগ অ্যাডিক্ট, এখন বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। শার্লিও হয়তো নেই।”
“তোমার আঙ্কলের আর কোনও ছেলেমেয়ে আছে?”
“না। হি ইজ অ্যালোন নাউ। কয়েক বছর আগে স্ত্রীও মারা গেছে।”
“ওঁর স্ত্রী কি তোমার বাবার বোন?”
“আন্ট মিশেল হল বাবার বোন। আঙ্কল জ্যাক আমার মায়ের ভাই।”
.
চুপচাপ কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমি বেভকে জিজ্ঞেস করলাম, “লাঞ্চ খাবে?”
“কোথায়?”
“তুমি যেখানে চাও।”
“তাহলে এসো, এখানে ঢুকি।”
.
সামনেই একটা থাই রেস্টুরেন্ট ছিল, সেখানে ঢুকলাম। ভেতরটা লোকে গিজগিজ করছে। লাকিলি রেস্টুরেন্টের সামনে ক্যানোপির নীচে কয়েকটা টেবিল সাজানো ছিল। তার একটাতে জায়গা পেয়ে গেলাম।
খাবার অর্ডার করার পর বেভ হঠাৎ বলল, “তুমি তো আমায় জিজ্ঞেস করলে না, জ্যাক কী পজেশন নেবার কথা আমায় বলছিল?”
প্রশ্নটা আমার মনে জেগেছিল ঠিকই, কিন্তু ব্যাপারটা পার্সোনাল মনে হওয়ায় প্রসঙ্গটা তুলিনি।
“ব্যাপারটা নিশ্চয় ব্যক্তিগত, তাই জিজ্ঞেস করিনি।”
“ইট ইজ নাথিং টু ডু উইথ মাই সেক্স লাইফ, ইউ ক্যান অ্যাস্ক।” বলে এক ঝলক হাসল বেভ।
আজ সকাল থেকে যে বিষণ্ণ ভাবটা ওর ছিল, সেটা বোধহয় কেটে যাচ্ছে।
বললাম, “বেশ তাহলে জিজ্ঞেস করি, ব্যাপারটা কী?”
“বলতে পারি, কিন্তু লম্বা গল্প, তোমার শুনতে ইচ্ছে না করলে আমাকে থামিয়ে দিও।”
“বেশ, তাই দেব।”
“আমার দাদু ভীষণ বড়লোক ছিলেন। আঙ্কল জ্যাক আর মা ছাড়া ওর আর কোনও ছেলেপুলে ছিল না। মা হাইস্কুলে থাকতে থাকতেই বাবার প্রেমে পড়ে। কলেজে শেষ করার আগেই বাবাকে বিয়ে করে। বাবা খুব সুপুরুষ ছিল, কিন্তু গরিব ফ্যামিলির ছেলে। দাদুর এ বিয়েতে সম্মতি ছিল না। আমার জন্মের খুব অল্প দিনের মধ্যেই মা মারা যায়। দাদুর সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ ছিল না। ওই ফ্যামিলিতে একমাত্র আঙ্কল জ্যাকের সঙ্গেই ছিল। আঙ্কল জ্যাক আমার বাবাকে ভালোবাসত। দাদু মারা যাবার আগে আমায় দেখতে চেয়েছিল। তখন আমার বয়েস বারো। জ্যাকই আমায় জোর করে নিয়ে যায়। হ্যাঁম্পটন বিচের ওপর একটা হিউজ ম্যানশন। সেখানে ঢুকে আমি প্রথম বুঝতে পারলাম, কী ভীষণ বড়লোক এই দাদু। বিছানায় শুয়েছিল, পাশে একজন নার্স। আমাকে দেখে বুড়ো লোকটা হাত ধরে কাঁদতে শুরু করল। ফ্র্যাঙ্কলি, আই হ্যাড নো ফিলিংস ফর হিম। এর ক’দিন বাদেই শুনি দাদু মারা গেছে। উইলে আমার জন্যে একটা ট্রাস্ট রেখে গিয়েছে। তাতে অনেক টাকা আর গ্রিনিচে মা যেখানে বড় হয়েছে সেই বাড়িটা। জ্যাক হচ্ছে সেটার ট্রাস্টি। জ্যাক চায়, আমি ওটা নিই, বাট আই অ্যাম নট গোইং টু।”
“কেন?” আমি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম।
বাবা যতদিন বেঁচেছিল দাদু বাবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা চেয়েছিল, আমার সঙ্গে যেন দাদু-দিদিমার যোগাযোগ থাকে, কিন্তু বুড়ো বারবার অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। ওর ধারণা বাবা টাকার লোভে সেটা চেয়েছিল। আমি বাবাকে জানি, হি নেভার কেয়ার্ড ফর মানি। মাকে ভালোবেসেছিল বলেই বিয়ে করেছিল। আই উইল নেভার টাচ দ্যাট ওল্ড ম্যান’স মানি অ্যাস লং অ্যাস আই লিভ।”
‘কিশোর এটা জানে?” কেন এই প্রশ্নটা করলাম নিজেই জানি না।
“না, একমাত্র তোমাকেই বললাম। আজ শুধু তুমি আর আমি। প্লিজ ডোন্ট ব্রিং কিশোর হিয়ার, আই অ্যাম সো সিক অ্যাবাউট হিস অ্যাটিচুড।”
খাবার এসে গেছে। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, বেভ সম্পর্কে আমার ধারণা কী দ্রুত পালটে যাচ্ছে।
“কী ভাবছ?” বেভের প্রশ্নে সম্বিত ফিরল।
“কিছু না।”
বেভ হাত দিয়ে নিজের কপাল থেকে চুলটা একটু সরিয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, “ডু ইউ ফাইন্ড মি অ্যাট্রাক্টিভ?”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“ওটা তো আমার প্রশ্নের উত্তর হল না।”
“তুমি কি উত্তরটা জান না?”
“নো, আই অ্যাম স্টিল ওয়েটিং ফর দ্য অ্যানসার।”
বেভের দিকে তাকিয়ে আছি। এলোমেলো বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ে উড়ে কপালে এসে পড়ছে। ঠোঁটে আবছা লিপস্টিক। ক্যানোপির ফাঁক দিয়ে এক ফালি সূর্যের আলো টেবিলের উপর পড়েছে। তার রিফ্লেকশনে বেভের গলার হারের লকেটটা চিকমিক করছে। লকেটের ঠিক নীচেই, ওর সাদা নরম বুকের খাঁজের ভেতর গাঢ় লাল রঙের ছোট্ট একটা তিল। আগে খেয়াল করিনি। কালো ব্লাউজের বর্ডারে ওটা যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। আমার চোখে কী দেখল বেভ জানি না, অকারণেই আমার দিকে তাকিয়ে একটু লাজুক হাসল। আমার চোখের সামনে ওর দুই গালে আস্তে আস্তে দুটো টোল পড়ল।
আমি নিজেকে প্রায় হারিয়ে ফেলছিলাম। সজোরে মনকে ঝাঁকা দিয়ে সামলালাম।
বললাম, “দ্য আনসার ইজ, ইয়েস আই ডু, ভেরি মাচ সো৷”
মুখটা আলো হয়ে গেল বেভের। একটু হেসে মুখ নীচু করে খেতে শুরু করল।
খানিক বাদে মুখ তুলে বলল, “আমি যা বললাম, তা তুমি বিশ্বাস করলে? এটা তো বানানো গল্পও হতে পারে?”
“তা পারে, তবে বাড়ির পজেশনের ব্যাপারটা নিশ্চয় অসত্য নয়, ওটা তোমার আঙ্কল জ্যাকের কথা।”
“বাড়িটা হয়তো ব্রুকলিনের ছোট্ট বাড়ি।”
“হয়তো, কিন্তু তুমি যাকে বলছ, সে হচ্ছে একটা গরীব প্রফেসর, তার নিজের বাড়ি নেই। আছে শুধু একটা ভাঙা গাড়ি।”
“আবার ওটা গ্রিনিচের ম্যানসনও হতে পারে। আমি যদি প্রপার্টি ক্লেইম করি, আই উইল বি এ ভেরি রিচ উওম্যান। তুমি একজন রিচ উওম্যানের সঙ্গে লাঞ্চ খাচ্ছ।”
“ঐ,” আমি বললাম, “রিচ এন্ড বিউটিফুল।”
“থ্যাঙ্ক ইউ। হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ফ্রম এ রিচ এন্ড বিউটিফুল উওম্যান, ইফ শি ইজ রেডি টু অফার ইউ এনিথিং?” চোখে চোখ রেখে আবার প্রশ্ন করল বেভ।
মুখে প্রায় এসে যাচ্ছিল, ‘এভরিথিং’। ও মাই গড করছি কী– বেভ কিশোরের ফিঁয়াসে– এখনো এনগেজড! সতর্ক হয়ে উত্তর দিলাম, “মে বি অ্যানাদার গুড ডিল ফ্রম হার আঙ্কল জ্যাক।”
এগিয়ে একটু ঝুঁকে আমার হাতের ওপর হাতটা আলতো করে রেখে বলল, “ইউ আর সো ইজি টু প্লিজ।”
.
বিকেলে টিভি কেনার প্রসঙ্গে বেভের কথা এল। গল্প শেষ হলে প্রমথ মন্তব্য করল, “কিশোর তো মনে হচ্ছে ফুটে গেছে, মেয়েটাও ডিরেক্ট হিন্ট দিচ্ছে। ঝুলে যা, এ চান্স আর পাবি না।”
“চুপ কর, আই হ্যাভ আদার থিংস ইন লাইফ।”
“কি আবার আদার থিংস? করিস তো প্রফেসরি, ছাত্র পড়াস, খাতা দেখিস, আর কিছু ফালতু রিসার্চ।”
“আর একটা কথা বলবি না এ নিয়ে,” প্রমথকে আমি আল্টিমেটাম দিলাম।
“বেশ বলব না, কিন্তু তুইও এটা একেনবাবুর নতুন কাহিনির সঙ্গে যোগ করবি না। তোর একটা হ্যাবিট আছে নিজের ব্যর্থ প্রেমের একটা গাথা গল্পের ফাঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া।”
প্রমথর কথা অগ্রাহ্য করে টিভি কেনার কাহিনিটা ঢুকিয়ে দিলাম। প্রথমত এটা ব্যর্থ প্রেমের গাথা নয়। বেভের প্রতি একটা আকর্ষণ যে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে, সেটা অস্বীকার করতে পারি না, কিন্তু সেটা প্রেমের পর্যায়ে নয়।
.
২৮.
বুধবার জুন ৮, ২০১১
সকালে একেনবাবুকে মনে হল একটু এক্সাইটেড। কফি খেতে খেতে দ্রুত পা নাড়াচ্ছেন। অশোকের হত্যাকারী এড তো এখন জেলে। তার মানে কি বিপাশার হারানো ছবিটার হদিশ পেয়েছেন? কফি শেষ করে জিজ্ঞেস করলেন, “একটু হাঁটতে বেরোবেন নাকি স্যার?”
“কেন বলুন তো, কোনও কারণ আছে?”
“তা একটা আছে স্যার।”
“কোথায় যাবেন? এখনো তো দোকানপাট খোলেনি।”
“হোটেল তো খোলা স্যার। মিস সীমা আমাকে বলেছিলেন সকালে ওঁর ডিউটি থাকে। ওঁকে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ছিল।”
“হোটেলে ফোন করুন না।”
“না, না স্যার, এগুলো ফোন করে হয় না।”
“আপনি যান, আমাকে টানছেন কেন?”
“চলুন না স্যার। ভেরি নাইস আর বিউটিফুল মিস সীমা, আপনার ভালো লাগবে।”
প্রমথ সকাল সকাল কলেজে যাবে বলে দাড়ি কামাচ্ছিল। চেঁচিয়ে বলল, “হ্যাঁ, ওকে নিয়ে যান। নিজের মুরোদে তো কুলোবে না। আপনার দৌলতে যদি কাউকে পেয়ে যায়।”
এ কথা শুনেও যে আমি গেলাম, সেটা নিতান্ত একেনবাবুর অনুরোধ এড়াতে না পেরে।
.
অ্যাম্বাসেডর হোটেল আমাদের বাড়ি থেকে হাঁটাপথে বড় জোর মিনিট পনেরো। নিউ হেরিটেজের মতো সুপার লাক্সারি টাইপ নয়, তবে স্ট্যান্ডার্ড দামি হোটেল। ফাইভ না হলেও ফোর স্টার তো হবেই। সীমা শ্রীমালীকে অফিসেই পেলাম। একেনবাবু ভুল বলেননি। সুন্দরী না হলেও চেহারাটা খুবই মিষ্টি। কথাবার্তাতেও সপ্রতিভ, হোটেলের কাজে সেটা না হলে বোধহয় চলে না। সীমা বিজনেস অফিসটা দেখাশোনা করে। সীমার অফিসের পাশে একটা বড় ঘরে কম্পিউটার, প্রিন্টার, ফ্যাক্স, কপিং মেশিন, ইত্যাদি সাজানো। ঘরের মাঝখানে একটা লম্বা টেবিল, সেখানেও বেশ কিছু চেয়ার। ঘরটায় ওয়াই-ফাই কাভারেজও নিশ্চয় আছে, অনেকে সেখানে বসে নিজের ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছেন। কয়েকটা কিউবিক্যালও আছে প্রাইভেসির জন্য। আমরা থাকতে থাকতেই দু’জন এসে সীমার সাহায্য চাইলেন। আমরা অবশ্য বেশিক্ষণ সীমাকে বিরক্ত করলাম না। একেনবাবু বুঝবার চেষ্টা করছিলেন, ঠিক কখন এবং কেন অশোকের সঙ্গে সীমার ছাড়াছাড়ি হল।
একেনবাবু খুব অ্যাপলজিক্যালি বললেন। আমি জানি ম্যাডাম, এ নিয়ে আপনি আলোচনা করতে চান না, কিন্তু তাও আপনাকে বিরক্ত করছি। আপনি সেদিন বললেন, অশোকবাবু হঠাৎ কোল্ড ব্যবহার শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার আগে আপনাদের মধ্যে কোনও কথা কাটাকাটি বা এমন কিছু কি ঘটেছিল যেটা আপনার মনে পড়ে?”
“আপনাকে তো আগেই বলেছি, ‘না’।”
“তা বলেছেন ম্যাডাম। আপনার মা এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে কি অশোকবাবুর কিছু হয়েছিল?”
“কিছুই হয়নি। অশোককে মার খুব পছন্দ হয়েছিল, অশোকও খুব রেস্পেক্টফুল ব্যবহার করত। আমরা মাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে গিয়েছিলাম প্লেনে তুলে দিতে। যাবার আগে অশোককে বুকে জড়িয়ে মা অনেক আশীর্বাদ করলেন। আসলে আমার মা-বাবা খুব কনসার্ভেটিভ। কিন্তু মা যখন দেখলেন অশোকরাও ব্রাহ্মণ, উনি খুব খুশি হয়েছিলেন। ইনফ্যাক্ট যাবার আগে অশোককে সেটা বললেনও।”
“কিছু মনে করবেন না, ম্যাডাম, আপনিও কি সেরকম কনসার্ভেটিভ?”
“মোটেও না।”
“অশোকবাবুর সঙ্গে এ নিয়ে আপনার কোনওদিন আলোচনা হয়েছিল?”
“একবারই হয়েছিল। অশোক ছিল খুব লিবারেল, কাস্ট সিস্টেম হেট করত। বলেছিল, ‘আমি একটা মানুষ, পিরিয়ড। তার বাইরে আমি ভাবতে চাই না।’
আমি বলেছিলাম, ‘জাত-ফাত আমিও মানি না।‘
‘কিন্তু তোমার ফ্যামিলি মানে’, অশোক বলেছিল।
আমি রেগে গিয়ে বলেছিলাম, “আমার ফ্যামিলির জন্যে আমাকে দায়ী করতে পারো না।”
এটুকু বলে সীমা এক মুহূর্ত থামল। তারপর একেনবাবুকে বলল, “এনি ওয়ে ইট ইজ অল ওভার নাউ। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু টক অ্যাবাউট ইট এনি মোর। প্লিজ নো মোর কোয়েশ্চেন।”
একটু বিরক্ত মুখেই কথাটা শেষ করল সীমা। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে যোগ করল, “আপনার সঙ্গে আজই আমার প্রথম দেখা। আমি কিন্তু অভদ্র হতে চাইনি। অশোক। সম্পর্কে আলোচনা করতে আমার সত্যিই কষ্ট হয়।”
“আমি কিছু মনে করিনি,” আন্তরিক ভাবেই বললাম। “আবার যদি কোনদিন দেখা হয়, আমরা অন্য কথা বলব।”
“আই উইল বি হিয়ার।”
“আই অ্যাম সরি ম্যাডাম, এভাবে আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে। কথা দিচ্ছি আর আসব না।” একেনবাবু উঠে দাঁড়ালেন।
“দ্যাটস আলরাইট।” সীমা মনে হল বিরক্তি প্রকাশ করে একটু লজ্জিত হয়েছেন। “ইউ আর ওয়েলকাম টু স্টপ বাই।”
.
বাড়ি ফেরার পথে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার বলুন তো আপনার? অশোকের কিলারকে তো পুলিস ধরেছে? এখনো ও নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?”
“মুশকিলটা হল স্যার, ফটোটা তো পাওয়া যায়নি, আর বিষ্ণু মূর্তিটা কোথায় সেটাও আমরা জানি না!”
“ওয়েট এ মিনিট, বিষ্ণুমূর্তির ব্যাপার আসছে কোত্থেকে? বিপাশা তো জানেন সেটা কোথায়।”
“দ্যাট ইজ কনফিউসিং স্যার। যদি জানেন, তাহলে ওটা লুকিয়ে রেখেছেন কেন?”
“তার হাজার কারণ থাকতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে বা ওই ফটোর সঙ্গে মিস সীমার। কি সম্পর্ক?”
“মনে হচ্ছে কিছুই নেই। কিন্তু বলুন তো স্যার, মিস সীমাকে কেমন লাগলো?”
“প্রশ্নটার অর্থ একটু বুঝিয়ে বলুন তো? প্রমথকে মুরুব্বি ঠাউরে আমার ঘটকালি করার চেষ্টা করছেন?”
“কী যে বলেন স্যার। তা নয়, তবে মনে হল ছোটোখাটো দেখতে হলে কি হবে, ম্যাডাম বেশ তেজস্বী।”
একেনবাবুর মাথায় যে কী ঘোরে, বোঝা শিবেরও অসাধ্য।
.
২১.
বৃহস্পতিবার জুন ৯, ২০১১
কেন একেনবাবু আবার আমাকে টেনে নিয়ে নিউ হেরিটেজ হোটেলে এসেছেন জানি না। দেবরাজ সিং নেই, ইন্দ্র ছিলেন। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?”
“হ্যাঁ, একটা প্রশ্ন ছিল স্যার।”
“আজ আমি একটু ব্যস্ত, অনেক সময় কিন্তু দিতে পারব না। এদিকে শুনেছেন তো এডকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে।”
“তাই তো শুনলাম স্যার। আপনাদের তাস খেলা কি বন্ধ এখন?”
“হ্যাঁ, যা চলছে চারিদিকে। কে যে কী করে বেড়াচ্ছে বোঝা দায়। দেবরাজদা বলছিলো অশোকও বোধহয় এডের সঙ্গে জড়িত ছিল।”
“তাই নাকি স্যার?”
“তাই তো বলল। অবশ্য এটা পুলিশের কথা শুনে ওর স্পেকুলেশন। যাই হোক, আপনার প্রশ্নটা কি বলুন?”
“ছোট্ট প্রশ্ন স্যার, অনেক সময় নেব না। একটা জিনিস নিয়ে আমার খটকা লেগেছিলে, কেন তখন জিজ্ঞেস করিনি নিজেই জানি না স্যার। আপনি বলেছিলেন অশোক যেদিন খুন হন তার আগের দিন ওঁর একটা ফোন এসেছিল বাড়িতে।”
“হ্যাঁ, আমি ধরেছিলাম।”
“কখন স্যার?”
“সকাল এগারোটা নাগাদ।”
“আই সি। আপনাদের এখানে ফোন এলে, কে ফোন ধরেন?”
“রিসেপশনে যারা থাকে।”
“তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি স্যার?”
“সবাইকে তো এখন পাবেন না। আচ্ছা, দেখছি।”
.
লাকিলি অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হল না। প্রথম যাকে পাওয়া গেল, সেই স্যান্ডিই অশোকের ফোনটা ধরেছিল। যিনি ফোন করেছিলেন, তাঁর নামটা স্যান্ডির এখন আর মনে নেই। কিন্তু বলেছিলেন ব্যাপারটা খুব পার্সোনাল আর আর্জেন্ট। স্যান্ডি জানত না অশোক দু’দিনের জন্যে পেন্সিলভ্যানিয়া গেছে। ভেবেছিল বাড়িতে আছে, তাই অশোকের বাড়ির নম্বর লোকটিকে দিয়েছিল। তার কিছুক্ষণ বাদে লোকটি আবার ফোন করে অশোকের ইমেল অ্যাড্রেস চায়। সেটা স্যান্ডি দেয়, অশোকের ভয়েস মেল এর সঙ্গেও কানেক্ট করে দেয়। তারপর ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ বুঝে দেবরাজকেও কথাটা জানায়।
এটা জানার পর ইন্দ্রকে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন অশোকের ভয়েস মেল বা ইমেল চেক করতে পারা যাবে কিনা।
“না,” ইন্দ্র বলল। অশোক মারা যাবার পর ওর ভয়েস মেল ক্লোজ করে দেওয়া হয়েছে। ইমেলগুলো দেবরাজদা এবং পুলিশ দেখেছে, তেমন কিছু বোধহয় পায়নি। ওর ইমেল অ্যাকাউন্টও সিস্টেমে আর নেই।”
একেনবাবু মনে হল সেটা শুনে একটু হতাশ।
“আপনাদের আই.টি পার্সন, যিনি কম্পিউটার সিস্টেম দেখভাল করেন, তিনি কোথায়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ইন্দ্র যাঁকে ডেকে আনলেন, তাঁর নাম ফিলিপ। সদ্য বহাল হয়েছেন। আগে ছিলেন দীনেশ পাণ্ডা, তিনি কয়েকদিন আগে দিল্লীতে প্রমোশন পেয়ে চলে গেছেন।
আমি ফিলিপকে জিজ্ঞেস করলাম, “অশোকের পুরানো ইমেল অ্যাকাউন্ট কি উদ্ধার করা যায় না?”
ফিলিপ ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। অশোক যে কে ফিলিপের কোনও ধারণাই নেই।
ইন্দ্র বলল, “ফিলিপ মাত্র কয়েকদিন হল এসেছে। অশোক মারা যাবার পরে।”
আমি ফিলিপকে জিজ্ঞেস করলাম, “হোটেলের পুরোনো ইমেলগুলো রিট্রিভ করা যায় না আর্কাইভ থেকে?”
“পুরানো মানে কতদিনের পুরানো?”
“ধরুন দিন দশ-পনেরো আগের।”
“আমি আসার কয়েকদিন আগে সিস্টেম হার্ড ড্রাইভ ক্র্যাশ করে, সুতরাং বেশ কিছু ইমেল সেই সঙ্গে ধবংস হয়। আপনি যে-সময়ের ইমেল খুঁজছেন, সেগুলো পাওয়া যাবে না। পুরোনো ইমেল ব্যাক-আপ সার্ভার থেকে পেতে পারি।” ‘ইমেলগুলো ডেইলি বেসিসে আর্কাইভ করা হত না?”
“হলে তো ভালো হত, তাই না? নাউ ইট উইল গেট ফিক্সড।” বুঝলাম ফিলিপ আগের ডেটা ক্যুনিকেশনের বন্দোবস্তে বিশেষ সন্তুষ্ট নয়। “অশোকবাবুর নিজের কম্পিউটার থেকে পাওয়া যাবে না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
এবার ইন্দ্র উত্তর দিল, “না, ওর দুটো কম্পিউটারই রিফোরম্যাট করে ফেলা হয়েছে, ওখানে কিছুই নেই।”
“সরি,” আমি একেনবাবুকে বললাম, “নো লাক।”
“তাই তো দেখছি স্যার, চলুন ফেরা যাক।”
.
ফেরার পথে দেখি একেনবাবু একেবারে চুপচাপ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার বলুন তো, এখনো অশোককে নিয়ে পড়ে আছেন আপনি?”
“উপায় কি স্যার, বিপাশা ম্যাডামের সমস্যার সঙ্গে যে উনি জড়িত।”
“কোন সমস্যা? ফটো না বিষ্ণুমূর্তি?” আমি প্রশ্ন করলাম।
.
ঠিক এই সময়ে একেনবাবুর মোবাইলটা বাজল। একেনবাবুর কথা শুনে মনে হল, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট। “ভয়েস মেলটা উদ্ধার হয়েছে স্যার? ওয়ান্ডারফুল! ইমেলটার কি কিছু গতি হল স্যার? আজ রাতেই পাওয়া যাবে। থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ।”
“কার ভয়েস মেল, অশোকের?”
“হ্যাঁ, স্যার।”
“কিন্তু একটু আগে ইন্দ্র যে বলল ওটা ক্লোজ করে দেওয়া হয়েছে!”
“অশোকের নয় স্যার, অশোকের করা।”
“তার মানে বব ক্যাসেলের ভয়েস মেল?”
“হ্যাঁ, স্যার। তার আগে একটা কাজ করতে হবে স্যার, এখন ইন্ডিয়াতে কটা বাজে?”
ঘড়িতে দেখলাম ১২-টা বেজেছে। “রাত্রি সাড়ে ন’টা।”
“তাহলে বোধহয় একটু দেরি হয়ে গেল।”
“কাকে ফোন করবেন?”
“অশোকবাবুর দেশের বাড়িতে।”
“তাতেই বিপাশা রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে?” আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
“সবটাই হয়তো পণ্ডশ্রম স্যার, কে জানে!”
“সাড়ে নটা এমন কিছু দেরি নয়। অত ভাবাভাবি না করে ফোনটা করে ফেলুন।”
“তাই করি স্যার, বলে পকেটে হাত দিয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করে বললেন, ওই যাঃ, নম্বরটাই বাড়িতে ফেলে এসেছি। বাড়ি পৌঁছে করতে গেলে তো অনেক রাত হয়ে যাবে।”
“তা যাবে। কিন্তু কী জানতে ফোন করতে চান?”
“একটা জিনিস কনফার্ম করার কথা ভাবছিলাম, তার বোধহয় দরকার নেই। আসলে জানেন কি স্যার, মনে হচ্ছে টানেলের শেষে আলো দেখতে পাচ্ছি।”
“আপনার তো অনেকগুলো টানেল– অশোক দুবে, বিপাশা মিত্রের ফটো, বব ক্যাসেল, সেই সঙ্গে যোগ করেছেন বিষ্ণুমূর্তি। কোনটার কথা বলছেন?”
“সবগুলোর কথাই বলছি। আসলে স্যার, সব পথ এসে, মিলে গেছে শেষে, তোমারি দুখানি নয়নে।”
নাঃ, প্রমথ ঠিকই বলে, শনির দশায় একেনবাবুর মাথাটা একেবারে গেছে!
“কী বলছেন মশাই, ঠিক আছেন তো?”
“এক্কেবারে ফাইন স্যার। আমি বিপাশা ম্যাডামকে বলে দিই, কাল সকালে ওঁর কাছে গিয়ে রিপোর্ট দেব।”
“কী রিপোর্ট দেবেন?”
“যা সত্য তাই বলব, বানিয়ে তো কিছু বলা যাবে না।”
“আপনি এবার প্রমথকে নিয়ে যাবেন। আমি ওর মধ্যে যেতে রাজি নই।”
“কেন স্যার, এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন?”
.
৩০.
শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই গেলাম। একেনবাবুকে অজস্র প্রশ্ন করেও কিছুই ওঁর পেট থেকে বার করতে পারলাম না। ওঁর একটাই উত্তর, “আরে চলুন না স্যার, যা জানি, তাই বলব। মহাভারত তো তাতে অশুদ্ধ হবে না?”
প্রমথ একাধিক বার একেনবাবুর বাপান্ত করে আমায় বলল, “আজ এম্ব্যারাসমেন্টের চুড়ান্ত হবে।”
একেনবাবুর উপর আমি প্রমথর থেকে বেশি ভরসা রাখি, কিন্তু আজকে আমিও একটু অসোয়াস্তি বোধ করছি। বিপাশা মিত্রের মতো নামিদামি ক্লায়েন্টের কাছে এতদিন বাদে গিয়ে জানানো, হ্যাঁ, আপনার ছবি চুরি হয়েছে, সেটা জানি। কে চুরি করেছে সেটাও বোধহয় জানি, কিন্তু কোথায় ছবিটা আছে জানি না। আমি শিওর বিপাশা মিত্র সেটা শুনে দু’হাত তুলে নৃত্য করবেন না। বলতে গেলে উনি আমাদের যা বলছেন, এটা প্রায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটাই ওঁকে বলা।
বিপাশা মিত্র আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের সবাইকেই অভ্যর্থনা করে বসালেন। তারপর একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমার জিনিসটা পেয়েছেন?”
“এখনও বলতে পারছি না, ম্যাডাম। এসেছি প্রোগেস রিপোর্ট দিতে,” একেনবাবু স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের সঙ্গে বললেন। “আসলে যে কাজটা দিয়েছিলেন ম্যাডাম, সেটা খুবই কঠিন।”
“সেইজন্যেই তো কাজটা আপনাকে দিয়েছি। কী খাবেন আপনারা চা না কফি?”
“আগে যে কাজের জন্যে এসেছি শেষ হোক, তারপর।”
“বেশ, বিপাশা মিত্রের স্মিত মুখেই বললেন।
“ম্যাডাম, আপনি আমায় ভার দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া একটা ফটো খুঁজে বার করতে। কয়েকজনের নামও আপনি দিয়েছিলেন, যাঁদের আপনি সন্দেহ করেন। এঁদের মধ্যে মিস্টার দেবরাজ সিং ছিলেন। কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা হবার পরের দিন মিস্টার সিং এসে বললেন ওঁর হোটেলের ম্যানেজার মিস্টার অশোক দুবে খুন হয়েছেন। তার তদন্তের ভার আমায় নিতে হবে। আরও বললেন, আপনিই ম্যাডাম, ওঁকে আমার ঠিকানা দিয়েছেন।”
“হ্যাঁ, দিয়েছিলাম।”
“মিস্টার সিং বললেন, আগে ওঁর কাজটা করতে হবে, কারণ খুন একটা গুরুতর ব্যাপার। উনি অবশ্য জানতেন না, আপনি একটা ফটো খোঁজার ভার আমায় দিয়েছেন। ওঁর ধারণা ছিল আপনার হারিয়ে যাওয়া বিষ্ণুমূর্তিটা আমি খুঁজছি। আমরা অবশ্য আপনার কথা রেখে কী খুঁজতে বলেছেন সেটা জানাইনি। যাইহোক, এইজন্যেই আপনার কাজটা প্রথমে শুরু করিনি ম্যাডাম। মিস্টার সিং অবশ্য বলেছিলেন, আপনাকে এটা জানাবেন। বলেছেন কিনা জানি না, উনিও ব্যস্ত মানুষ।”
বিপাশা মিত্র একেনবাবুর দীর্ঘ ভূমিকাতে বোধহয় একটু অধৈর্য হলেন। বললেন, “এগুলো বলার কোনও দরকার নেই, আপনি ফটোর ব্যাপারে আসুন।”
“আসছি ম্যাডাম। আসলে কেন আপনার কাজটা শুরু করতে দেরি হল, তার একটু ব্যাকগ্রাউন্ড দিচ্ছিলাম। যাই হোক ম্যাডাম, আমরা আপনার ফটোটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। ভেবে চিন্তে মনে হল, এই ফটোটা যে চুরি করেছে, সে হয়তো আপনাকে কষ্ট দেবার জন্যে করেনি, করেছে আর্থিক লাভের জন্যে।”
“আর্থিক লাভ!”
“আপনার ছবিটা যে খামে ছিল ম্যাডাম, তাতে লাগানো স্ট্যাম্পটা আপনি ভালো করে দেখেননি। স্ট্যাম্পটা কিন্তু দামি ছিল। আমাদের প্রিলিমিনারি ফাইণ্ডিং হল, মিস্টার সিং-এর হোটেলের এক স্টাফ মিস্টার অশোক দুবে ওটা চুরি করেছিলেন।”
“অশোক দুবেকে আমি চিনি। ও আমার কাছে কাজের সূত্রেও এসেছে। ও কিছু চুরি করতে পারে বলে কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।”
“আমরাও প্রথমে করিনি ম্যাডাম। অশোকবাবুর মার্ডার নিয়ে তদন্ত করতে গিয়েই এটা আবিষ্কার করি।”
“কী করে? ও আই উইশ দেবরাজ এগুলো শুনত! ওকে কি ডাকব?”
“কোনও দরকার নেই ম্যাডাম, উনিও রিপোর্ট পাবেন। কিন্তু যেটা বলছিলাম, এটা আমরা আবিষ্কার করি একটু লাকিলি। ফিলাটেলিস্ট কর্নার, মানে যে দোকানে অশোকবাবু স্ট্যাম্পটা বিক্রি করতে গিয়েছিলেন, সেই দোকানেরই একজন রাস্তায় বাপিবাবুকে অশোকবাবু বলে ভুল করে স্ট্যাম্প কেনার কাস্টমার পাওয়া গেছে জানান। পরে আমরা সেই দোকানে গিয়ে নিশ্চিত ভাবে জানি, অশোকবাবু সত্যিই একটা সিন্ধু ডাক’ স্ট্যাম্প বিক্রি করার জন্যে এনেছিলেন।”
“সিন্ধু ডাক!”
“হ্যাঁ ম্যাডাম, প্রায় সাত আট হাজার ডলার দাম ওই স্ট্যাম্পের। আপনার কাছে অঙ্কটা বড় নয় ম্যাডাম, কিন্তু আমাদের বা অশোকবাবুর মতো লোকের কাছে এটা বড় অঙ্কের টাকা। লোভে পড়ে ওটা চুরি করা অবশ্যই সম্ভব।”
“ওর কি টাকার টানাটানি চলছিল? হি কুড হ্যাভ অ্যাস্কড দেবরাজ অর ইভেন মি!”
“মিস্টার সিংকে জানিয়েছিলেন ম্যাডাম, উনি শেষে দিতে রাজিও হয়েছিলেন, কিন্তু সেদিনই অশোকবাবু খুন হন।”
“হোয়াট এ ট্র্যাজেডি!”
“ইয়েস ম্যাডাম। উনি স্ট্যাম্পটা বিক্রি করার জন্যে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছিলেন। কেউ নিশ্চয় সেটা জানত। তারই লোভে অশোকবাবুকে সে খুন করে।”
“তার মানে অশোকের খুনি স্ট্যাম্প শুঙ্কু খামটা নিয়ে অদৃশ্য হয়?”
“প্রথমে তো তাই মনে হচ্ছিল ম্যাডাম। কিন্তু কাহিনিটা এখানেই শেষ নয়, বলতে পারেন এটাই শুরু।”
“এর পরেও কিছু আছে?” বিপাশা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ, ম্যাডাম। একটু আগে যে বললাম বাপিবাবুকে ফিলাটেলিস্ট কর্নারের একটি লোক এসে বলেছিল স্ট্যাম্পের কাস্টমার পাওয়া গেছে… গন্ডগোলের শুরু সেখান থেকে। বাপিবাবু শিওর যে দোকানের মালিক কথাটা বলেননি। দোকানের আরেকজন হলেন মালিকের স্ত্রী, তিনিও নন। এঁরা দু’জন ছাড়া, দোকানে কাজ করতেন আরেকটি মাত্র লোক। তিনি আবার চাকরি ছেড়ে একটা টিভির দোকানে মাস দেড়েক হল কাজ করছেন। সুতরাং তাঁর পক্ষেও কথাটা বলা সম্ভব নয়। তাহলে কে এই ভদ্রলোক, যিনি অযাচিত ভাবে বাপিবাবুকে খবরটা দিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন? এটাই কনফিউসিং ম্যাডাম। তার মানে কি এটা একটা সেট-আপ? কেউ কি চান যে আমরা ভাবি অশোকবাবুর কাছেই স্ট্যাম্পটা ছিল? শুধু তাই নয় ম্যাডাম, একজন ভদ্রলোক নিজেকে অশোকবাবু বলে পরিচয় দিয়ে একটা সিন্ধু ডাক’ স্ট্যাম্প দোকানেও নিয়ে গিয়েছিলেন! শুধু যোগাযোগ করার জন্যে যে নম্বরটা দোকানে দিয়ে এসেছিলেন, সে রকম কোনও নম্বরই টেলিফোন কোম্পানিতে নেই। আমি বলব সামথিং ওয়াজ নট রাইট ম্যাডাম। পুরো ব্যাপারটাই বেশ পিজলিং, ভেরি ভেরি পাজলিং।”
বিপাশা মিত্র চুপ করে শুনছেন। উনিও মনে হচ্ছে একটু কনফিউসড।
“তারপর হঠাৎ বব ক্যাসেল মারা গেলেন, ম্যাডাম।”
“সেটা খুবই দুঃখের কথা, কিন্তু তার সঙ্গে চুরি যাওয়া ফটোর কি সম্পর্ক? ও-ও কি এর মধ্যে ইনভলভড?”
“আই ডোন্ট থিঙ্ক সো ম্যাডাম। কিন্তু উনি একটা স্ট্রেঞ্জ অ্যাডভাইস আমাকে দিয়েছিলেন।”
“কী অ্যাডভাইস?”
“বলেছিলেন, অ্যাডভান্স না নিয়ে আপনার কাজ যেন আমি না করি।”
“আপনি কি সেই অ্যাডভাইস শুনে ভয় পাচ্ছেন, আপনার ফি আমি আপনাকে দেব?” বিপাশার চোখেমুখে বিরক্তি।
“মোটেই না ম্যাডাম।” তারপর একেনবাবু হঠাৎ প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ পালটে বললেন, “একটা প্রশ্ন ম্যাডাম, আপনার সেই কম্বোডিয়ার বিষ্ণুমূর্তিটা এখন কোথায় আছে?”
আচমকা প্রশ্নটা শুনে বিপাশা একটু মনে হল হতচকিত। জিজ্ঞেস করলেন, “এই প্রশ্নটা কেন করছেন?”
“আমি ম্যাডাম মিস্টার আকাহাশিকে ক’দিন আগে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলতে পারলেন না। শুধু বললেন, জন হেক্টার যখন ওই বিষ্ণুমূর্তির প্রাভানেন্স নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, তখন আপনারা জানিয়েছিলেন তার উপযুক্ত উত্তর আপনাদের কাছে আছে।”
“প্রাভানেন্স!”
“হ্যাঁ ম্যাডাম, মানে প্রুফ অফ ওনারশিপ, কোত্থেকে পাওয়া গেছে, কে আগে এর মালিক ছিল, তার নাম ঠিকানা…।”
“আমি জানি প্রাভানেন্স কি, কিন্তু স্ট্যাম্পের সঙ্গে বিষ্ণুমূর্তির কি সম্পর্ক?”
“স্ট্যাম্পের সঙ্গে নয় ম্যাডাম, জন হেক্টারের মৃত্যুর সঙ্গে। বলছিলাম না ম্যাডাম, ব্যাপারটা ভীষণ কমপ্লিকেটেড।”
এবার বিপাশা মিত্র বেশ বিরক্ত হয়েছেন মনে হল, “আপনি কি সাজেস্ট করছেন ওই বিষ্ণুমূর্তির জন্যে জন হেক্টার মারা গেছেন?”
“ঠিক তা নয় ম্যাডাম।”
“তাহলে?”
“আমি বলতে চাচ্ছি ম্যাডাম, ওই প্রাভানেন্সটা যত্ন করে রাখবেন। কারণ, ওটা সাউথ ইন্ডিয়ার মন্দির থেকে চুরি করা মূর্তি, তার প্রমাণ জোগাড় করতেই মিস্টার হেক্টার ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন। সেই কেস হয়তো অনেকদূর গড়াবে।”
এবার বিপাশা মিত্রের বিরক্তি আর চাপা রইল না। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন বেশ কঠোর স্বরে বললেন, “আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন মিস্টার সেন। ফটো সম্পর্কে যদি আর কিছু বলার না থাকে, তাহলে এখন যেতে পারেন।”
একেনবাবুও উঠে দাঁড়ালেন। বেশ শক্ত গলাতেই বললেন, “আমার মনে হয় ম্যাডাম, আপনার ফটো চুরি যায়নি, ওটা আপনার কাছেই আছে। ওটা চুরি গেছে আপনি আমায় বলেছেন দেবরাজবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে। যাই হোক, ধরে নিন ম্যাডাম, আপনার কেসটা আমি ছেড়ে দিচ্ছি, ওই ফটোর কোনও খোঁজ আমি করছি না। আর হ্যাঁ, মনে রাখবেন ম্যাডাম, অশোকবাবু যেদিন মারা যান, সেদিন সাড়ে আটটার সময় আপনি কিন্তু একা অফিসে ছিলেন।” বলে একেনবাবু আমাদের দিকে তাকালেন, “চলুন স্যার, আমরা যাই।”
দেখলাম বিপাশা মিত্রের মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ওঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
.
এমনিতে একেনবাবু বিনয়ের অবতার, কিন্তু রহস্য সমাধানের আগের মুহূর্তে উনি ট্রান্সফর্ম করে যান। “স্যার’, ‘ম্যাডাম’ এগুলো বলেন ঠিকই, এমন কি ‘পাজলড’, ‘কনফিউসড’ এ কথাগুলোও ব্যবহার করেন, কিন্তু তার পেছনে উঁকি মারে একটা দৃঢ় সংকল্প শিকারির অভিব্যক্তি, হু ইজ প্রিপেয়ারিং ফর হিস ফাইন্যাল কিল।
বিপাশা মিত্রের অফিস থেকে নেমে এসে যখন আমরা রাস্তায় বেরোচ্ছি, তখন দেখি নিউ ইয়র্ক পুলিশের কয়েকজন ইউনিফর্ম পরা অফিসার বিল্ডিং-এ ঢুকছে। সেদিকে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন, “গুড টাইমিং স্যার।”
প্রমথ বলল, “ব্যাপার কী বলুন তো, কী আগডুম বাগড়ম বকে এলেন, আবার এখন বলছেন “গুড টাইমিং’!”
“চট করে বলা যাবে না স্যার, কফিতে গলা ভেজাতে হবে।”
অন্যদিন হলে প্রমথ বলত নিজের পয়সায় খান। আজ বলল, “চলুন, সামনেই স্টারবাকের কাফে, আমি খাওয়াচ্ছি।”
.
কেন জানি না, আজ জায়গাটা ফাঁকা। আমরা আরাম করে একটা টেবিল নিয়ে বসলাম। প্রমথ শুধু কফি নয়, বেশ কিছু স্যান্ডউইচও কিনে আনলো। একেনবাবু তাঁর কাহিনি শুরু করলেন।
.
৩১.
“আসলে স্যার, দেবরাজবাবুই নাটের গুরু।”
“দাঁড়ান,” প্রমথ ওঁকে থামিয়ে দিল। “আপনিও তো দেখছি হ-য-ব-র-ল-র হুঁকোবুড়োর মতো শুরু করেছেন, তারপর এদিকে বড়মন্ত্রী তো রাজকন্যার গুলি সুতো খেয়ে ফেলেছে। আগে একটু ব্যাকগ্রাউন্ড দিন।”
“ব্যাকগ্রাউন্ড তো স্যার আপনারা জানেনই। প্রথম দিনই দেবরাজবাবু একটা কথা বলেছিলেন, তাতে খটকা লেগেছিল।”
“কী কথা?” এবার আমি প্রশ্ন করলাম।
“দেবরাজবাবু বলেছিলেন অশোকবাবু আপনার মতো দেখতে। কথাটা অবান্তর স্যার, কিন্তু বলার একটা উদ্দেশ্য ছিল। যখন একজন আপনাকে এসে স্ট্যাম্পের খরিদ্দার পাওয়া গেছে বললেন, তখন যাতে আমাদের সন্দেহ জাগে লোকটি আপনাকে অশোকবাবু ভেবে কথাটা বলেছেন। এই স্ট্যাম্পের ব্যাপারটা যে সম্পূর্ণ সেট-আপ সে ব্যাপারে আমি কনভিন্সড হয়ে যাই, যখন বেভ ম্যাডামের কাছে আপনি জানতে পারেন ফিলাটেলিস্ট কর্নারের একমাত্র সেলস পার্সন এসব ঘটনার অনেক আগেই অন্য জায়গায় কাজ নিয়েছেন। এরপর থেকেই স্যার দেবরাজবাবু আমার ফোকাসের মধ্যে এসে যান। এবার কতগুলো ঘটনার কথা বলছি, যেগুলো স্যার আপনারা সবাই জানেন। এক নম্বর, ইন্দ্রবাবুর বয়ান আনুয়ায়ী অশোকবাবুকে ‘জন’ বলে একজন ভদ্রলোক জরুরি কারণে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পরে আর ফোন করেননি। নিউ হেরিটেজ হোটেলে অপারেটর স্যান্ডিও সেটা কনফার্ম করলেন। তিনিই অশোকের বাড়ির ফোন নম্বরটা সেই জন, যাঁর নামটা স্যান্ডি মনে করতে পারেননি, তাঁকে দিয়েছিলেন। অশোকের ভয়েস মেল এবং ইমেলের অ্যাড্রেসও স্যান্ডি ভদ্রলোককে দিয়েছিলেন। আমরা ধরে নিতে পারি ভদ্রলোক অশোককে ইমেল পাঠিয়েছিলেন, হয়তো ভয়েস মেলেও মেসেজ রেখেছিলেন। প্রশ্ন হল, কী এত জরুরি প্রয়োজন ভদ্রলোকের ছিল? দু’নম্বর, আমরা একজন জনের খবর জানি, জন হেক্টার। তিনি ইন্ডিয়াতে গিয়েছিলেন বিষ্ণুমূর্তির ব্যাপারে আর কল্পনা বলে এক মহিলাকে ইন্টারভিউ করতে…”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান। জন ইংরেজিতে কমন নাম,” প্রমথ বলল। “হাজার হাজার জন আছে, এ দুটোকে মেলাবার চেষ্টা করছেন কেন?”
“টাইমিংগুলো যদি মেলান স্যার, তাহলে দেখবেন জন হেক্টার ইন্ডিয়াতে যেদিন খুন হন, তার অল্প সময়ের মধ্যেই অশোক হোবোকেনে খুন হন।”
“সো হোয়াট?”
“মানছি স্যার, তবু প্রশ্ন থাকে, এই জন কি সেই জন হেক্টার যিনি অশোককে কোনো একটা খবর দেবার চেষ্টা করেছিলেন? দু’জনের মৃত্যুর মধ্যে কি কোনও যোগ আছে? জাস্ট এ কোয়েশ্চেন স্যার, বাট ইট স্টার্টেড বদারিং মি।”
প্রমথ আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি ওকে থামিয়ে বললাম, “তুই চুপ করবি!” তারপর একেনবাবুকে বললাম, “প্লিজ কন্টিনিউ।”
“এবার ভাবুন স্যার, জন হেক্টার ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন বিষ্ণুমূর্তিটা সাউথ ইন্ডিয়ার ত্রিচি মন্দির থেকে আনা, সেটা প্রমাণ করতে। আমরা জানি যে, উনি সত্তর দশকে সাউথ ইন্ডিয়ার মন্দির নিয়ে বই লেখার জন্যে বহু ছবি তুলেছিলেন। সম্ভবত ত্রিচিতে গিয়েও মন্দির এবং তার ভিতরের নানান মূর্তির ছবি তুলেছিলেন, আর সেই ছবির একটার সঙ্গে বিপাশা ম্যাডামের বিষ্ণুমূর্তির হুবহু মিল দেখেছিলেন। সেইজন্যেই আকাহাশির কাছে প্রাভানেন্স নিয়ে উনি এত প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু ফটো থেকে কিছুই প্রমাণিত হয় না। উনি গিয়েছিলেন যে-মন্দিরে উনি বিষ্ণুমূর্তির ছবিটা তুলেছিলেন, সেখানে ওই মূর্তিটা এখনো আছে কিনা দেখতে। সেটা না থাকলে একটা সম্ভাবনা, ওখান থেকে কেউ চুরি করে ওটা সুজয় মিত্রকে বিক্রি করেছে। জন হেক্টার স্যার, একজন উঁদে ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার। মূর্তিটা যে চোরাই মাল সেটা প্রমাণ করতে পারবেন সহজেই, কিন্তু চুরিটা করেছে কে? কার কাছ থেকে সুজয় মিত্র মূর্তিটা কিনলেন? এটা যদি উনি বার করতে পারেন, তাহলেই সেটা সত্যিকারের নিউজ হবে।”
“এবার বুঝেছি, বিপাশা কেন বিষ্ণুমূর্তি চুরি গেছে বলে বাইরে বলেছিল,” প্রমথ বলল, “যাতে এসব কেচ্ছা বেরোলেও গায়ে তেমন লাগবে না, মূর্তিটা তো আর ওর কাছে নেই।”
“ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট স্যার। কিন্তু যেটা বলতে যাচ্ছিলাম, মনে আছে স্যার, মিস্টার হেক্টারের সেক্রেটারি প্যামেলা জোনস এক রিটায়ার্ড প্রফেসরের কথা বলেছিলেন? কল্পনা নামে বার্নার্ডস কলেজে ওঁর এক ছাত্রী ছিলেন, যিনি গ্রাজুয়েশনে আগেই হঠাৎ দেশে ফিরে যান, আর একটা মার্ডারে জড়িয়ে পড়েন?”
“মনে আছে,” আমি বললাম।
“আর এক কল্পনার কথা আমরা জেনেছি হেমন্ত চুগানি আর তাঁর আঙ্কলের কাছ থেকে। সাউথ ইন্ডিয়ান টেম্পেলের পুরোহিতের মেয়ে, যিনি একটা মার্ডার কেসে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এই দুই কল্পনা কি একই লোক? মিস কল্পনার কাছে মন্দিরের কিছু গয়না পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু ওঁর সঙ্গে যিনি ছিলেন, যাঁর গুলিতে গার্ডের মৃত্যু হয়, তাঁকে ধরা যায়নি। পুলিশের ধারণা তিনি ছিলেন কল্পনার বয়ফ্রেন্ড, যাঁর পরিচয় কল্পনাকে বহু জেরা করেও পাওয়া যায়নি। খবরটা মিস্টার হেক্টার যে জানতেন, সেটা হেমন্তবাবুই আমাদের বলেছেন। মন্দির থেকে মূর্তি চুরি যাবার ঘটনাটা আমরা কোথাও শুনিনি। ধরে নিচ্ছি। বিগ্রহ চুরি হয়ে থাকলেও মন্দিরের কর্তৃপক্ষ নিজেদের স্বার্থে সেটা হয়তো চেপে গিয়েছিলেন। সেখানে অন্য কোনও মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে ভক্তদের ঠাকুর-দর্শন থেকে নিরাশ করেননি। এটা আমার স্পেকুলেশন স্যার, মিস্টার হেক্টারও নিশ্চয় সেটাই ভেবেছিলেন। ত্রিচিতে গিয়ে খুঁজে খুঁজে সেই মন্দিরটা বার করার পর হেক্টার দেখলেন, সত্যিই আগে যেখানে পুরোনো বিষ্ণুমূর্তিটা ছিল, সেখানে আর সেটা নেই। এবার মিস্টার হেক্টার স্টার্টেড কানেক্টিং ডক্স। উনি চিন্তা সুরু করলেন, সুজয় মিত্রের সঙ্গে কল্পনার কোনও যোগ আছে কিনা! উনিই কল্পনার সেই বয়ফ্রেন্ড কিনা!
ডঃ আর মিসেস দাসের কাছ থেকে আমরা শুনেছি, বিপাশা মিত্রের বাবা, সুজয় মিত্র ১৯৭৫ সালে মাস ছয়েকের জন্যে ভারতবর্ষে গিয়ে ছিলেন। এমনিতে ওঁর ইন্ডিয়ার প্রতি কোনও প্রেম ছিল না স্যার। ইনফ্যাক্ট এর পর উনি আর কোনও দিন ইন্ডিয়াতে যাননি। এবার চিন্তা করুন স্যার, প্রথম স্ত্রী মানে বিপাশা ম্যাডামের মায়ের মৃত্যুর পর এত লম্বা সময়ের জন্যে উনি ইন্ডিয়া কেন গেলেন?”
“হয়তো মানসিক ভাবে উনি এত বিপর্যস্ত হয়েছিলেন, যে হি নিডেড এ চেঞ্জ অফ প্লেস, প্রমথ বলল।
“কিন্তু তা বলে ইন্ডিয়া স্যার? যে দেশের ব্যাপারে ওঁর কোনও ইন্টারেস্টই ছিল না!”
আমি বললাম, “একেবারে ছিল না বলছেন কেন, ইন্ডিয়ার বিষ্ণুমূর্তি তো একটা ছিল।”
“কম্বোডিয়ার স্যার, দ্যাট ওয়াজ দ্য ক্লেইম। না স্যার, ইন্ডিয়াতে এভাবে যাওয়ার অন্য কোনও কারণ আছে।”
“প্রেম?” প্রমথ বলল।
“এক্সাক্টলি স্যার। কোনও ইন্ডিয়ান মেয়ের প্রেমে হয়তো উনি পড়েছিলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর আগেই হয়তো পড়েছিলেন। হি ডিসাইডেড টু লিভ দ্য কান্ট্রি উইথ হার। আমরা জানি স্যার, কল্পনা এদেশে পড়াশুনো করতে এসেছিলেন। হঠাৎ পড়া বন্ধ করে দেশে চলে যান।”
প্রমথ বলল, “কিন্তু শি ওয়াজ নট দ্য ওনলি উওম্যান যে সত্তর দশকে এখান থেকে দেশে ফিরে গিয়েছে।”
“ট্রু স্যার, ট্রু” মাথা নাড়লেন একেনবাবু। “কিন্তু ধরুন এই কল্পনার প্রেমেই সুজয় মিত্র পড়েছিলেন। আমি ধরে নিচ্ছি, এই তথ্যটা মিস্টার হেক্টারের মতো ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টের পক্ষে বার করাটা খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়। এখন সুজয় মিত্র নানান দেশের পুরোনো মূর্তি কালেক্ট করেন। কল্পনার সঙ্গে একদিন মন্দিরে গিয়ে বিষ্ণুমূর্তিটা দেখে লোভ হয়। কল্পনাকে নিশ্চয় বলেন সে কথা। কল্পনার বাবা মন্দিরের পুরোহিত, সুতরাং সেখানে অসময়ে ঢুকতে পারাটা তাঁর পক্ষে তেমন কঠিন নয় স্যার। মিস্টার সুজয় মিত্রের একান্ত ইচ্ছায়ে ওঁরা দুজনে মিলে মন্দির থেকে মূর্তিটা সরাতে যান। তখন আচমকা একটি সিকিউরিটি গার্ড এসে পড়ায় সুজয় মিত্র তাকে গুলি করতে বাধ্য হন। মিস্টার সুজয় মিত্র পালাতে পারেন, কিন্তু মৃত্যুর আগে গার্ডের বিবৃতি থেকে কল্পনা ধরা পড়ে যান।”
“এবার বুঝেছি,” আমি বললাম। “তারপর ডাঃ দাস যাঁর কথা বলছিলেন, কাস্টমসের সেই বন্ধুর সাহায্য নিয়ে সুজয় মিত্র মূর্তিটা পাচার করে এদেশে নিয়ে আসেন।”
“এক্সাক্টলি স্যার, কিন্তু পরিচিতদের বলেন এটা কম্বোডিয়ার বিষ্ণুমূর্তি।”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান,” প্রমথ বলল। “না হয় মানলাম এই পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনা। সুজয় মিত্র গার্ড খুন করে মূর্তিটা পাচার করে নিয়ে এসেছেন, সুতরাং এর প্রাভানেন্স-টেন্স কিছু নেই। সো হোয়াট, তার সঙ্গে অশোক বা জন হেক্টারের মৃত্যুর সম্পর্কটা কী?”
“বলছি স্যার, বলছি। এটাই হচ্ছে স্যার মোস্ট ক্রিটিক্যাল পার্ট। আমরা সবাই জানি, যাঁর গুলিতে গার্ডের মৃত্যু হয়, তাঁকে ধরা যায়নি। পুলিশের ধারণা তিনি ছিলেন মিস কল্পনার বয়ফ্রেন্ড– যাঁর পরিচয় কল্পনাকে বহু জেরা করেও বার করা যায়নি। কিন্তু এই ‘বয়ফ্রেন্ড’ কথাটা হঠাৎ উঠছে কেন? কেন পুলিশ বা পত্রপত্রিকা এই কথাটা ব্যবহার করবে? ইট ট্রাবল্ড মি স্যার, ট্রাবল্ড মি এ লট। অবভিয়াসলি শি ওয়াজ নট ম্যারেড; ওয়াজ শি প্রেগনেন্ট যখন উনি ধরা পড়েন? সেইজন্যেই হয়তো ওঁর কাছ থেকে কোনও স্বীকারোক্তি আদায় করা যায়নি। নিজে জেলে থাকলেও ওঁর অনাগত সন্তানের বাবা জেলের বাইরে থাকবেন, এটাই উনি চেয়েছিলেন। দেন ইট মেকস সাম সেন্স স্যার। যা এখন পর্যন্ত শুনেছি, তার অনেক কিছুই স্পষ্ট হতে থাকে। বাচ্চা ডেলিভারির সময় যত এগিয়ে আসতে থাকে, মিস কল্পনা ততোই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হতে থাকেন। বেবিকে কার হাতে তুলে দেবেন? ধরে নিতে পারি ওঁর ধর্মনিষ্ঠ বাবা-মা তাঁদের অপরাধী মেয়ের পাপের ভার নিতে রাজি ছিলেন না। মিস্টার সুজয় মিত্রের কথা বললে পুলিশ কানেকশনটা ধরে ফেলবে। মিস্টার দুবে তখন সেখানকার জেলার। মিস কল্পনার মানসিক অবস্থা দেখে তিনি চিন্তিত হলেন, এরকম অবস্থায় অনেকে সুইসাইডও করে।”
“এটা আপনি কোত্থেকে জানলেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“কেন স্যার, আপনার কাছ থেকে!”
“আমার কাছ থেকে!”
“কী মুশকিল স্যার, হেমন্তবাবুর কাকা আপনাকে বলেননি যে, জেলে কল্পনা খুব মানসিক কষ্টে ছিলেন, একবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন? এও বলেছিলেন, তখন নাকি জেলার আর জেলারের স্ত্রীর চেষ্টায় অবস্থার কিছু উন্নতি হয়। আর সেই জেলার যে অশোক দুবের বাবা সেটা তো আপনার বন্ধু কিশোরের আঙ্কল বলেছিলেন!”
এবার আমার মনে পড়ল। “ঠিক আছে, বলুন।”
“হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম স্যার, এই সময়ে মিসেস দুবে মানে অশোকবাবুর মা কল্পনাকে অনেক দেখভাল করেন। কল্পনার বাচ্চা যেন ভদ্র পরিবারে ঠিক ভাবে কোথাও বড় হয়, সেটা দেখার প্রতিশ্রুতি বোধহয় দেন। আমি শিওর মিস্টার হেক্টার নানান লোকের সঙ্গে কথা বলে এইরকমই একটা আইডিয়া পেয়েছিলেন। মিসেস দুবের নিজের কোনও বাচ্চা হয়নি, সেটাও উনি খুঁজে বার করেছিলেন।”
“কী করে?” প্রমথ প্রশ্ন করল।
“তা তো বলতে পারব না স্যার। অনুমান করছি ত্রিচির হাসপাতালগুলোর ডেলিভারি রেকর্ড থেকে বা মিসেস দুবের গাইনোকলজিস্টের সঙ্গে কথা বলে, কিংবা ওঁদের কোনও নিকট আত্মীয়ের কাছে খোঁজ নিয়ে। হু নোজ? কিন্তু এর পরেই হি মেড এ লিপ অফ ফেইথ স্যার। মিস কল্পনা মারা গেছেন, সুতরাং তাঁর কাছ থেকে কিছুই জানা সম্ভব নয়। উনি মিস্টার আর মিসেস দুবের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। আমার বিশ্বাস উনি বার করতে চাইছিলেন অশোকবাবুই মিস কল্পনার সেই সন্তান কিনা। কিন্তু ওঁরা কেউ দেখা করতে রাজি হলেন না। হয়তো ভেবেছিলেন মিস কল্পনার প্রসঙ্গ এলে অশোকবাবুর কথা উঠতে পারে। অশোকবাবু যে অ্যাডপ্টেড সে নিয়ে কারোর সঙ্গে আলোচনা করতে ওঁরা রাজি ছিলেন না।”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনি এমন ভাবে বলে যাচ্ছেন অশোক যে অ্যাডপ্টেড, সেটা যেন আপনি আগে থেকেই জানতেন!” আমি বাধা দিয়ে বললাম।
“এটা আমার অনুমান স্যার,” এইজন্যেই সীমার জীবনের সঙ্গে অশোকবাবু নিজেকে জড়াতে চাননি। সীমার মা যখন অশোকবাবু ব্রাহ্মণ বলে আনন্দ প্রকাশ করছিলেন, অশোকবাবু মনে মনে অত্যন্ত আপসেট হয়েছিলেন, যার জন্যে সীমাকে বলেও ছিলেন আমি জাত-টাত নিয়ে ভাবি না, আমার কী জাত সে নিয়ে চিন্তা করি না।”
“এরকম ট্যাঞ্জেনশিয়ালি না বলে সোজাসুজি বললেই তো চুকে যেতো, সীমার সম্পর্কে যেটুকু আপনাদের কাছে শুনেছি, তাতে তো ওকে খুব আন-রিজনেবল মেয়ে বলে মনে হয়নি।” প্রমথ মন্তব্য করল।
“অশোকবাবু নিজে নিশ্চয় কারো কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন যে উনি অ্যাডপ্টেড, কিন্তু মিস্টার বা মিসেস দুবের কাছ থেকে নয়। তাঁরা এই সত্যটা গোপন রেখেছিলেন, কোনও মতেই অশোককে জানতে দিতে চাননি। ঠিক এই কারণেই অশোকবাবু জেনেও না জানার ভান করে গেছেন সারা জীবন, যাতে ওঁর মা-বাবা কথাটা লুকিয়ে রেখেছিলেন বলে কষ্ট না পান। মানুষের সাইকোলজি স্যার নানা ভাবে কাজ করে।”
“বুঝলাম, অশোকই হলেন সুজয় আর কল্পনার ছেলে, সো হোয়াট?”
“সেটা সত্যি কিনা জানি না স্যার, কিন্তু হলে এর ইমপ্লিকেশন ট্রিমেন্ডাস। অশোকবাবু সুজয় মিত্রের ছেলে হওয়া মানে সুজয় মিত্রের সম্পত্তির ফিফটি পার্সেন্টের মালিক।”
“কল্পনাকে তো সুজয় মিত্র বিয়ে করেনি, অশোক ওর ছেলে হলেও ইল্লেজিটিমেট চাইল্ড।”
“তাতে কিছু এসে যায় না স্যার। লেজিটিমেট ইল্লেজিটিমেট সবারই সম্পত্তিতে সমান অধিকার, যদি না সুজয় মিত্রের উইলে ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে কোনও বিশেষ ইনস্ট্রাকশন থাকে। মনে হয় না সেটা ছিল বলে স্যার। যাই হোক, আমার সন্দেহ হল অশোক যে সুজয় মিত্রের ছেলে, এটাই অশোককে জন হেক্টার জানিয়েছিলেন ফোনের মেসেজে এবং ইমেল-এ।”
“সেটা কেন করতে গেলেন? ওঁর কাছে তো কোনও প্রমাণই ছিল না অশোক সুজয় মিত্রের ছেলে বলে!” আমি প্রশ্ন তুললাম।
“কেন, এর উত্তর আমি দিতে পারবো না স্যার। মিস্টার হেক্টার দুয়ে দুয়ে এক করেছিলেন। অনুমান করছি ওঁর হিসেব অনুযায়ী কল্পনার সন্তান আর অশোকের প্রায় একই সময়ে জন্ম। মিসেস দুবে কল্পনার বাচ্চা হবার সময় দেখাশুনো করেন। কল্পনার সেই সন্তানের খবর কোথাও পাওয়া যায়নি। যেটা উনি জেনেছেন, মিসেস দুবের নিজের কোনও সন্তান হয়নি। ছোট্ট শিশু অশোক হঠাৎ করে দুবে পরিবারে চলে আসে, সন্তানের আদরে বড় হয়। এখন ওঁর দাবি ঠিক না ভুল, সেটা একমাত্র প্রমাণিত হবে ডিএনএ টেস্ট করে। তারজন্যে অশোককে সেই দাবি কোর্টে গিয়ে জানাতে হবে। একই সঙ্গে জন হেক্টার প্রমাণ দাখিল করবেন যে, বিষ্ণুমূর্তিটা কম্বোডিয়ার নয়, ত্রিচি থেকে চুরি করা বিষ্ণুমূর্তি। চোর হচ্ছেন প্রয়াত বিখ্যাত ব্যবসায়ী সুজয় মিত্র। চিন্তা করুন স্যার, এর ন্যাশেনাল ইমপ্যাক্টটা!”
‘মাই গড! তারপর?”
“মিস্টার সিং যখন খবর পেলেন জন বলে কেউ অশোকবাবুর সঙ্গে বিশেষ দরকারে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে, তখন প্রথমে হয়তো এমার্জেন্সি ভেবেই ইমেল-টা চেক করে দেখেন। হয় অশোকবাবুর পাসোয়ার্ড উনি জানতেন, অথবা ওঁর হোটেলের আই-টির স্টাফ দীনেশবাবুর সাহায্য নিয়ে সেটা বার করেন। ইমেলটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা ডিলিটও করেন যাতে অশোকবাবু ব্যাপারটা জানতে না পারেন। পরে হয়তো অশোকবাবুর ভয়েস মেলটাও দীনেশবাবু বা কাউকে দিয়ে ডিলিট করান। কিন্তু মনে হয় তার আগেই ভয়েস মেল চেক করে অশোকবাবু খবরটা জেনে গিয়েছিলেন। ভয়েস মেল তো রিমোটলিও চেক করা যায়। অন্য কোনো ভাবেও জেনে থাকতে পারেন।”
“অনেক সম্ভাবনাই আছে, কল ফরওয়ার্ডিং, দীনেশবাবুর কাছ থেকে ফোন পেয়ে, ওদের হোটেলে অটোম্যাটিক ইমেল ফরওয়ার্ডিং অ্যালাও করলে,” প্রমথ বলল।
“যাই হোক স্যার, খবরটা জেনে অশোকবাবু দু’জনকে ফোন করেন মিস্টার ক্যাসেল আর মিস সীমাকে। কাউকেই পান না। মিস সীমাকে দেওয়া মেসেজটা তো আমরা জানি ‘আই হিট দ্য জ্যাকপট’। অশোকবাবু জানতেন, এত বড় খবর আর চাপা থাকবে না। বাবা-মা এতদিন কথাটা গোপন রাখলেও, উনি যে অ্যাডপ্টেড চাইল্ড– সেটা বিশ্বের সবাই জানবে। সুতরাং সীমাকে সুখবরটা না জানানোর এবং এতদিন কেন এরকম অদ্ভুত ব্যবহার সীমার সঙ্গে করছিলেন, সেটা না বলার কোনো কারণই থাকে না। মিস সীমাকে দেওয়া মেসেজের অন্য এক্সপ্লানেশনও হতে পারে, কিন্তু মিস্টার ক্যাসেলকে দেওয়া মেসেজ স্যার, একেবারে আন-অ্যাম্বিগুয়াস। সেটাই ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট উদ্ধার করেছেন। মেসেজটা হল, এইমাত্র খবর পেলাম, আমি বিপাশার বৈমাত্রেয় ভাই। সুতরাং রিয়েল এস্টেট কোম্পানির ফিফটি পার্সেন্ট আমার হবে। তুমি কিন্তু আমার সঙ্গে থাকবে। ফোন কোরো।’ এখন দেবরাজবাবু হ্যাড টু অ্যাক্ট ফাস্ট। মিস্টার হেক্টারের মতো ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টারের খবর হালকা ভাবে নেওয়া যায় না। ইট মাস্ট বি টু। তার মানে মিস্টার হেক্টারকে সরাতে হবে, সেই সঙ্গে অশোকবাবুকেও। এই সময়ে মিস্টার ক্যাসেল কিন্তু দেবরাজবাবুর ফোকাসে নেই। উনি জানেনও না মিস্টার ক্যাসেল এ বিষয়ে কিছু জানেন বলে।”
“সরাতে হবে কেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“সরাতে হবে টু প্রোটেক্ট বিপাশা মিত্র।”
“মেকস নো সেন্স, প্রমথ বলল। “বিপাশা মিত্রের সম্পত্তির দাবিদার থাকলে দেবরাজ সিং-এর তাতে কী?”
“আপনি ভুলে গেছেন স্যার, দেবরাজবাবু ম্যাডাম বিপাশার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ওঁর হোটেলের একটা বিরাট এক্সপ্যানশানের প্ল্যান করেছিলেন, সেগুলো তো সব লাটে উঠবে!”
“কেন লাটে উঠবে, অশোককে নিয়েও তো সেটা করা যেত,” আমি বললাম।
“আই ডাউট ইট স্যার, অশোকবাবুর ইন্টারেস্ট ছিল সোশ্যাল কজ-এ, এম্পায়ার বিল্ডিং-এ নয়। দেবরাজবাবু সেই চান্সটা নিতে চাননি।”
“এক্সপ্যানশনটা না হয় নাই হতো,” আমি বললাম।
“স্যার, যে ভদ্রলোক দশ বছরে একটা ছোটো হোটেল থেকে একটা হোটেল-সাম্রাজ্য বানিয়েছেন, তিনি কখনোই তাতে সন্তুষ্ট হতেন না। এছাড়া আমি নিশ্চিত দু’বছরের মধ্যে এত বড় এক্সপ্যানশানের জন্য বাজারে অনেক ধার দেনাও হয়েছে। থামতে চাইলেও থামাটা কঠিন স্যার, বিশেষ করে দেবরাজবাবুর মতো লোকের পক্ষে।”
“আপনার পয়েন্টটা বুঝতে পারছি।”
“যা বলছিলাম স্যার, বিপাশা মিত্র ও দেবরাজের স্বার্থ এখানে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। দেবরাজের সঙ্গে বিপাশার একটা কুইক প্ল্যান হয়। অশোকবাবুকে সরাতে হবে। কাজটা দেবরাজবাবুই করবেন, ম্যাডাম বিপাশাকে বিশেষ কিছুই করতে হবে না। ওঁকে শুধু পুলিশকে বলতে হবে, যে-রাতে অশোকবাবু খুন হন, সেদিন দেবরাজবাবু ওঁর সঙ্গে সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ছিলেন। এতে দুজনেরই একটা অ্যালিবাই থাকে। কিন্তু অশোকবাবুর খুন হবার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ খাড়া করা দরকার। যাতে খুনি ধরা না পড়লেও, টাকার জন্যেই তিনি খুন হয়েছেন, সেটা যেন মনে হয়। সেক্ষেত্রে মিস্টার সিং একেবারেই সন্দেহের উর্ধ্বে থাকেন। অশোকবাবু হাজার দশেক ডলার খুঁজছেন, সেটা মিস্টার সিং জানতেন। তখনই বিপাশা ম্যাডামের স্পেশাল ফটো শুক্কু খাম হারিয়েছে গল্পটা বানানো হয়, আর আমাদের খেলার পুতুল হিসেবে কাজে লাগান হয়।”
“সোজা স্ট্যাম্প চুরি গেছে বলাটাই কি বুদ্ধিমানের কাজ হত না?” প্রমথ বলল। “বিপাশা মিত্র ফটো চুরির কাহিনি ফাঁদলেন কেন?”
“আমি বলব ওটা দেবরাজবাবুর আইডিয়া স্যার। স্ট্যাম্প চুরি গেছে’ বড় সোজাসুজি হয়ে যেত, দেবরাজবাবু টুইস্ট, মানে একটু ধোঁকা দিতে ভালোবাসেন। মনে নেই ইন্দ্রবাবু প্রথম দিন কি বলেছিলেন? দেবরাজবাবু জানতেন ফটোকে পাশ কাটিয়ে আমরা স্ট্যাম্পের দিকেই এগোব, বলা যায় স্যার উনিই আমাদের একটু খেলিয়ে সেই পথে নিয়ে যাবেন। আমরা তদন্ত করে সিদ্ধান্তে আসব, দামি স্ট্যাম্প কেড়ে নেবার জন্যে অশোকবাবুকে খুন করা হয়েছে। সেটা পুলিশের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এখন অশোকবাবু মিস্টার হেক্টারের কাছ থেকে পাওয়া খবরটা দেবরাজবাবুকে জানিয়েছিলেন কিনা স্যার, সেটা জানা অসম্ভব। কিন্তু দেবরাজবাবু অশোকবাবুকে বাড়ি পৌঁছে দেবার অছিলায় খুন করেন। প্রায় একই সঙ্গে ওঁর পরিচিত সুপারি কিলার দিয়ে জন হেক্টারকে খুন করান। কারণ মিস্টার হেক্টার বেঁচে থাকলে দেবরাজবাবুর উপর অশোকবাবুকে খুন করার দায় বর্তাতে পারে। তিনি অশোকবাবুকে যে-খবর জানিয়েছেন, সেটা দেবরাজবাবু যদি কোনমতে জেনে থাকেন, তাহলে অশোকবাবুকে খুন করার একটা মোটিভ ওঁর থেকে যায়। এরপরেই ইন্ডিয়াতে গিয়ে স্যার, দেবরাজবাবু একটু নাটক করেন কিশোরবাবুর কাকার সঙ্গে কী করে ওঁর হোটেলের সিকিউরিটি বাড়ানো যায় সেই নিয়ে।”
“আর ইউ শিওর অ্যাবাউট অল দিস? অশোক তো বব ক্যাসেলের ভয়েস মেল-এ জোক করেও সম্পত্তি পাবার কথাটা বলতে পারে! বন্ধুদের সঙ্গে আমরা মজা করি না!” আমার বিস্ময় এখনও কাটেনি।
“কাল রাত পর্যন্ত ছিলাম না স্যার, কিন্তু এখন ‘ইয়েস’। মিস্টার ক্যাসেলের ভয়েস মেলের মেসেজকে অশোকের জোক বলে এখন আর উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। অশোকের ই-মেল ডিলিট করা হলেও মিস্টার হেক্টারের ইমেল ডিলিটেড হয়নি। ওঁর সেন্ট ফোল্ডার থেকে অশোককে পাঠানো ই-মেলটা পাওয়া গেছে। সেটাই কাল রাতে আমায় ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট জানালেন।”
“সবই বুঝলাম, কিন্তু তার থেকে দেবরাজ যে খুনি সেটা প্রমাণ হয় কী করে?”
“সেটাই একটু ট্রিকি স্যার। এখন পর্যন্ত যেটা জানি, সেটা হল দেবরাজবাবুর মোটিভ আছে এবং ওঁর কোনও অ্যালিবাই নেই। হি ওয়াজ ক্লেভার স্যার, ওঁর মোবাইল সুইচ-অফ করে রেখেছিলেন, যাতে করে মোবাইল টাওয়ারের ডেটাবেস থেকে পুলিশ বার না করতে পারে উনি কোথায় ছিলেন। সেইজন্যেই বব ক্যাসেল ওঁকে সেদিন রাতে মোবাইলে ধরতে পারেননি। বিপাশা ম্যাডামের সঙ্গে উনি সন্ধে থেকে মোটেই ছিলেন না। সাড়ে আটটা পর্যন্ত দেবরাজবাবু যে বিপাশা ম্যাডামের কাছে আসেননি, সেটাতো সতীশবাবুর কাছেই শুনলাম।”
“হোবোকেনে আটটায় কাউকে খুন করে ন’টার আগে বিপাশার কাছে পৌঁছনো সম্ভব নয়। প্রায় এক ঘণ্টার পথ।” আমি মন্তব্য করলাম।
“কিন্তু বব ক্যাসেল তো ডেড, বিপাশা যে সাড়ে আটটা পর্যন্ত একা ছিলেন, সেটা তো সতীশ কুমারের শোনা কথা, তিনি নিজে তো দেখেননি। এ ব্যাপারে আদালত প্রত্যক্ষদর্শী খোঁজে।” প্রমথ প্রশ্ন তুলল।
“আর কেউ দেখেননি তা তো নয় স্যার, ক্লিনিং লেডি দেখেছিলেন। মনে নেই। সতীশবাবু তাকে মিস্টার ক্যাসেলকে অফিস থেকে ডেকে আনতে বলেছিলেন। সেটা আমি স্টুয়ার্টসাহেবকে জানিয়ে দিয়েছি। এতক্ষণে বোধহয় তার স্টেটমেন্টও নেওয়া হয়ে গেছে।”
“সবই তো বললেন, বব ক্যাসেল মারা গেলেন কেন, সুইসাইড না খুন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“দিস ইজ মাই স্পেকুলেশন স্যার, পুলিশ যখন মিস্টার ক্যাসেলকে জেরা করতে আসে, তার আগেই উনি অশোকবাবুর মেসেজটা পেয়ে গিয়েছিলেন। ম্যাডাম বিপাশা সাড়ে আটটার সময় চিন্তিত ভাবে কারোর জন্যে অপেক্ষা করছিলেন, সেটা মিস্টার ক্যাসেল জানতেন। আর দেবরাজবাবুর অ্যালিবাই হচ্ছে ম্যাডাম বিপাশা, সেটাও তিনি কারো কাছ থেকে জেনেছিলেন। না জানার কারণ নেই স্যার, দেবরাজবাবু নিজেই তো সবাইকে বলে বেরিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই মিস্টার ক্যাসেল সন্দেহ করেন দেবরাজবাবু ও ম্যাডাম বিপাশা অশোকবাবুর খুনের সঙ্গে জড়িত। আমার মনে হয় সেইজন্যেই স্যার সেদিন একটু ঠাট্টার ছলে আমাদের বলেছিলেন, অ্যাডভান্স না নিয়ে ম্যাডাম বিপাশার কাজ না করতে, কারণ উনি বুঝতে পারছিলেন ম্যাডাম বিপাশা আর দেবরাজবাবু দুজনেই হেডিং ফর ট্রাবল! যাই হোক, মোদ্দাকথা হল স্যার মিস্টার ক্যাসেল নাউ হ্যাঁস দ্য ট্রাম্প কার্ড। দেবরাজবাবুর অ্যালিবাই আর থাকে না, যদি মিস্টার ক্যাসেল পুলিশকে সত্যি কথাটা বলেন। উনি ঠিক করলেন এরই জোরে দেবরাজবাবুকে ব্ল্যাকমেল করবেন। মায়ের অসুখের জন্যে মিস্টার ক্যাসেলের প্রচুর টাকার দরকার, সেটা একমাত্র এভাবেই পাওয়া সম্ভব। মিস্টার ক্যাসেল যখন ওই হাইরাইজ কনস্ট্রাকশন সাইটে যান, তখন দেবরাজবাবু সেখানে আসেন। হয়তো আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, ওখানে ওঁরা নিরিবিলিতে কথা বলবেন। দেবরাজবাবু কোনো চান্স নিতে চাননি, দুটো মার্ডারের বদলে তিনটে হলে তফাৎ আর এমন কী? ধাক্কা দিয়ে কনস্ট্রাকশন সাইট থেকে কাউকে ফেলে দেওয়া খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়।”
“দ্যাটস ইনসেইন,” আমি বললাম।
“হি ইজ নট এ সেইন ম্যান স্যার, হি ইজ ম্যাড– এ ম্যাডম্যান। নইলে এমন কাজ কেউ করতে পারে?”
“কিন্তু ঐ স্ট্যাম্পের ব্যাপারটা কী, যেটা এড-এর লকারে পাওয়া গেছে।
“আমি শিওর স্যার, এড অ্যারেস্টেড হয়েছে শুনে দেবরাজবাবু নিজেই ওটাকে ওখানে রেখে দিয়েছিলেন। এক ঢিলে দু-পাখি মারা। অশোক খুনের রহস্যের সমাধান হল, নিজেও বেঁচে গেলেন।”
“কিন্তু উনি স্ট্যাম্পটা পেলেন কোত্থেকে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“ইডিয়টের মতো কথা বলিস না,” প্রমথ বলল। পাঁচ হাজার ডলারের স্ট্যাম্প কেনা তো ওঁর কাছে ললিপপ কেনার মতো। সেটা কিনেই তো নিয়ে গিয়েছিলেন ফিলাটেলিস্ট কর্নারে।”
“আপনারা ভুলে গেছেন স্যার, প্রথম দিনই বিপাশা ম্যাডাম বলেছিলেন, “দেবরাজ স্ট্যাম্প চেনেন। আমি ধরে নেব স্যার উনি স্ট্যাম্প একটু আধটু কালেক্ট করেন, নইলে বিপাশা ম্যাডাম কথাটা বলতেন না। যাইহোক, দেবরাজবাবুকে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ওঁর অফিস আর বাড়ি সার্চ করার ওয়ারেন্টও ইস্যু হয়েছে। হয়তো ইতিমধ্যে অশোককে যে হ্যান্ডগান দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেটাও পাওয়া যাবে। পুলিশ যে বিপাশা ম্যাডামকেও প্রশ্ন করার জন্যে এল, সেটা তো আমরা বেরোনোর সময়েই দেখলাম। কিন্তু আয়রনিটা কি জানেন স্যার?”
“কী?”
“কল্পনাদেবীর বাচ্চা জন্ম নিতে গিয়ে মারা যায়। তখনই বোধ হয় ওঁর মেন্টাল ব্রেকডাউন হয়। এনিওয়ে, অশোকবাবু অ্যাডপ্টেড ছিলেন ঠিকই, কিন্তু সুজয় মিত্রের ছেলে ছিলেন না।”
“এটা আবার কোত্থেকে জানলেন!”
“কাল তো আর মিস্টার দুবেদের ফোন করা হয়নি। আমার এক কলিগ এখন ত্রিচিতে পোস্টেড। তাঁকে ফোন করে ইনফর্মেশনটা জানতে চেয়েছিলাম। তিনিই মিস্টার দুবেদের কাছে খবরটা নিয়ে জানালেন। কিন্তু তারজন্যেই কী ঘটল দেখুন! আসলে স্যার, মানি করাপ্টস পিপল। দ্য এফেক্ট কুড বি ডেঞ্জারাস স্যার, ইফ এ ম্যাড ম্যান ইজ ইনভলভড।”
.
।।পরিশিষ্ট।।
পরদিন ভোরে একেনবাবু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের ফোন পেয়ে আমাদের সুখবরটা দিলেন। দেবরাজ সিং অপরাধ স্বীকার করেছেন। যে সুপারি কিলার দিয়ে জন হেক্টারকে খুন করা হয়েছিল, সে ধরা পড়ায় দেবরাজ সিং-এর নাম বলে দিয়েছে। ইন্ডিয়ার জেলে পচা-র থেকে নিউ ইয়র্কের জেলে যাওয়াটাই বোধহয় দেবরাজবাবুর বেশি বাঞ্ছনীয় মনে হয়েছে। বিপাশা মিত্রও অ্যারেস্টেড হয়েছেন। আপাতত ওঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে মিথ্যে অ্যালিবাই দিয়ে অবস্ট্রাকশন অফ জাস্টিস। কিন্তু মনে হয় হত্যাকারীর সহযোগী হিসেবে আরও গুরুতর চার্জ পরে আনা হবে।