২৬. অন্ধকার নেমে এলে

অন্ধকার নেমে এলে দুজন গুড়ি মেরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে। বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে একটি কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কে?

আমরা।

গোপন সংকেত?

কোমাডো ড্রাগন।

সাথে সাথে খুট করে দরজা খুলে গেল। ভেতরে আবছা অন্ধকার, যে দরজাটা খুলেছিল, একজন দীর্ঘদেহী মানুষ, একটু সরে দাঁড়িয়ে সে দুজনকে ঢুকতে দিল। একজন নারী এবং একজন পুরুষ ঘরের ভেতরে ঢুকে। নারীটি কমবয়সী একটি মেয়ে, লাল চুল একটি রুমাল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। পুরুষ মানুষটির চেহারায় একটি অস্বাভাবিক কাঠিন্য।

ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা একজন জিজ্ঞেস করল, কী খবর?

নিষ্ঠুর কঠিন চেহারার মানুষ কিংবা লাল চুলের মেয়ে কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। তারা হেঁটে ঘরের মাঝামাঝি ধাতব টেবিলটার পাশে রাখা চেয়ারটাতে বসে। পুরুষ মানুষটি নিজের হাতে কিছুক্ষণ মাথাটা চেপে ধরে রেখে সোজা হয়ে বসে বলল, খিদে পেয়েছে। কোনো খাবার আছে?

শুকনো প্রেটিন আর কিছু কৃত্রিম খাবার। খানিকটা রক্তের জেলো।

তাই দাও। উত্তেজক পানীয় নেই?

খুঁজলে একটা বোতল পাওয়া যেতে পারে।

খুঁজে দেখ।

খাবার এবং পানীয় টেবিলে দেবার পর দীর্ঘদেহী মানুষটি এসে ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল, কী খবর?

নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটি কিছু শুকনো প্রোটিন চিবুতে চিবুতে এক ঢোক উত্তেজক পানীয় খেয়ে বলল, আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? তোমরা সবাই খুব ভালো করে জান খবর ভালো না।

সেটা তো জানি। কিন্তু কতো খারাপ?

আমাদের পুরো পরিকল্পনাটা ছিল নেটওয়ার্ক দিয়ে। নেটওয়ার্ক দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল। কিন্তু নেটওয়ার্কটিই নেই আমরা কী করব?

এখন আমরা কী করব?

মানুষের সাথে মিশে যেতে হবে।

মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা জিজ্ঞেস করল, তার মানে আমরা কী ধরে নেব রবোমানবের বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে? আমরা মানুষের কাছে পরাজিত হয়েছি?

নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটি মাথা ঘুরিয়ে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল, মানুষ নিজেও পরাজিত হয়েছে। আমাদের হাত থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে তারা নেটওয়ার্ক ধ্বংস করেছে, এখন তারা পশুর মতো বেঁচে আছে।

দীর্ঘদেহী মানুষটি বলল, তোমার ধারণা সত্যি নয়। মাত্র দুই সপ্তাহ পার হয়েছে তার মাঝে মানুষ নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে। আমি কয়েকটি শহর ঘুরে এসেছি। সেখানে মানুষেরা রীতিমতো উৎসব করছে।

নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটি কিছুক্ষণ দীর্ঘদেহী মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এখন আমাদের মানুষের সাথে মিশে যেতে হবে। দরকার হলে এখন আমাদের তাদের উৎসবে যোগ দিতে হবে।

দীঘদেহী মানুষটি বলল, তুমি বলেছিলে বিকেল তিনটার সময় নেটওয়ার্ক দখল হবে। দুই ঘণ্টার ভিতরে মানুষদের আঘাত করতে হবে। শহরগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। রবোমানবেরা তোমার কথা বিশ্বাস করে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে শহরের দখল নেবার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত নেটওয়ার্ক দখল হয় নি-বরং নেটওয়ার্ক ধ্বংস হয়েছে। সারা পৃথিবীর খবর জানি না কিন্তু বেশির ভাগ শহরে রবোমানদের ধরে ফেলেছে। কোথাও কোথাও মেরে ফেলেছে। কোথাও জেলে আটকে রেখেছে।

নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটি তীব্র দৃষ্টিতে দীর্ঘদেহী মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এই সবকিছু জানি। তুমি কেন আবার এই কথাগুলো আমাকে শোনাচ্ছ?

তুমি আমাদের আনুষ্ঠানিক দলপতি। সেজন্যে শোনাচ্ছি। রবোমানবদের ভবিষ্যতের দায়িত্ব তোমার হাতে ছিল। তুমি কী তোমার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছ?

হ্যাঁ। আমি আমার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছি। এর চাইতে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব না।

তাহলে কেন পৃথিবীর সব রবোমানব দুই সপ্তাহের মাঝে ধ্বংস হয়ে গেল?

সবাই ধ্বংস হয়নি। তুমি কেন অসংলগ্ন কথা বলছ?

দীর্ঘদেহী মানুষটি এক পা অগ্রসর হয়ে বলল, আমি অসংলগ্ন কথা বলছি। রবোমানব হিসেবে আমি আমার দলপতির কাছে কৈফিয়ত চাইছি।

আমি তোমার কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। যেটা হয়েছে সেটা একটা দুর্ঘটনার মতো। আমরা কেউ ভুলেও চিন্তা করিনি মানুষ হয়ে মানুষেরা নিজেরা নিজেদের মাথায় গুলি করবে। নেটওয়ার্ক ধ্বংস করবে।

দলপতি হিসেবে তোমার সবকিছু চিন্তা করা উচিত ছিল।

মধ্যবয়স্ক মহিলাটি বলল, তুমি আমাদের দলপতি। তোমাকে সব দায় দায়িত্ব নিতে হবে।

নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটি হঠাৎ এক ধরনের বিপদ আঁচ করতে পারে, সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায়, তোমরা কী বলতে চাইছ?

কেউ কোনো কথা না বলে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

নিষ্ঠুর চেহারায় মানুষটি তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা রিভলবার বের করার চেষ্টা করে, কিন্তু তার আগেই দীর্ঘদেহী মানুষটি একটি লোহার রড দিয়ে নিষ্ঠুর মানুষটির মাথায় আঘাত করল। একটা কাতর শব্দ করে সে নিচে পড়ে যায়, তার হাতে তখনো রিভলবারটি রয়ে গেছে। দীর্ঘদেহী মানুষটি রিভলবারটি নিজের হাতে নিয়ে নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটির মাথার দিকে তাক করল।

লাল চুলের মেয়েটি তার মাথার রুমালটি খুলে চুলগুলো তার পিঠে ছড়িয়ে পড়তে দিয়েছে। সে আংগুল দিয়ে চুলোর জটাগুলো মুক্ত করতে করতে একটু বিরক্ত হয়ে বলল, নির্বোধের মতো কাজ করো না। গুলির শব্দ শুনলে মানুষ

সন্দেহ করবে। ওকে যদি মারতে চাও নিঃশব্দে মেরে ফেল।

মধ্যবয়স্ক মহিলাটি টেবিলের ওপর থেকে উত্তেজক পানীয়ের বোতলটা থেকে খানিকটা পানীয় ঢকঢক করে খেয়ে বলল, যদি ওকে মেরে ফেলবে বলেই ঠিক করেছিলে তাহলে আরেকটু আগে মেরে ফেললে না কেন? আমাদের আধবোতল উত্তেজক পানীয় বেঁচে যেত!

দীর্ঘদেহী মানুষটি লোহার রডটি নিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা রবোমানবের দলপতির দিকে এগিয়ে গেল। নিষ্ঠুর চেহারার দলপতি শূন্য দৃষ্টিতে দীর্ঘদেহী মানুষটির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিস ফিস করে বলল, থুল সত্যি কথাই বলেছিল! আমাদের কেউ বেঁচে থাকবে না। আমরা সবাই সবাইকে মেরে ফেলব।

দীর্ঘদেহী রবোমানবটি লোহার রডটি ওপরে তুলে প্রচণ্ড বেগে নিচে নামিয়ে আনে। ঘরের দেওয়াল গোল ছোপ ছোপ রক্তে ভরে উঠতে থাকে।