২৬৯তম অধ্যায়
সমস্ত আশ্রমমধ্যে গার্হস্থ্যের সমধিক প্রশংসা
“মহাত্মা স্যূমরশ্মি গোদেহমধ্য হইতে এই কথা কহিলে কপিল কহিলেন, ‘যোগিগণ কৰ্ম্মফলে অনিত্যতা দর্শন করিয়া জ্ঞানমার্গ আশ্রয়পূৰ্ব্বক পরমাত্মাকে লাভ করিয়া থাকেন, তাঁহারা সংকল্পমাত্রেই সমুদয় লোকে গমন করিতে সমর্থ হয়েন। যাঁহারা হর্ষবিষাদাদিশূন্য, নমস্কারবিহীন, প্রার্থনা-পরিবর্জ্জিত, শুদ্ধস্বভাব, নিৰ্ম্মলচিত্ত, সৰ্ব্বপাপবিমুক্ত, শোকবিহীন, বিষয়বাসনা পরিত্যাগ ও মোক্ষলাভে কৃতনিশ্চয় এবং ব্রহ্মস্বরূপ হইয়া থাকেন, তাঁহারা অনায়াসে নিত্য সিদ্ধ লোকে গমন করিতে সমর্থ হয়েন। যে ব্যক্তি ঐ সকল ব্যক্তির ন্যায় উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিতে পারে, তাহার গার্হস্থ্য প্রয়োজন কি?
“তখন স্যূমরশ্মি কহিলেন, মহর্ষে! ব্রহ্মজ্ঞানসম্পন্ন সন্ন্যাসীরা তত্ত্বজ্ঞান ও পরমগতি লাভ করিতে পারেন, যথার্থ বটে; কিন্তু কেহই গৃহস্থের আশ্রয় ব্যতীত কোন ধর্ম্মপালনে সমর্থ হয়েন না। জীবসমুদয় যেমন জননীকে আশ্রয় করিয়া জীবিত থাকে, তদ্রূপ অন্যান্য আশ্রয়নিবাসী ব্যক্তিরা একমাত্র গার্হস্থ্যধর্ম্ম প্রভাবেই জীবন ধারণ করে। গৃহী ব্যক্তিরাই যজ্ঞানুষ্ঠান ও তপস্যা করিয়া থাকেন। গার্হস্থ্যধৰ্ম্মই সুখার্থী ব্যক্তিগণের সুখের মূল। সম্ভানোৎপাদনই মনুষ্যের সুখলাভের প্রধান কারণ; কিন্তু গৃহস্থাশ্রম ভিন্ন অন্য আশ্রমে কখনই সন্তানলাভে সমর্থ হওয়া যায় না। গৃহস্থদ্বারাই তৃণ, ধান্য ও পৰ্ব্বতজাত সোমলতা প্রভৃতি ওষধিসমুদয় সংগৃহীত হয় এবং ওষধি হইতে লোকের প্রাণরক্ষা হইয়া থাকে; সুতরাং গার্হস্থ্যকেই সৰ্ব্বাপেক্ষা প্রিয়তম জীবনের কারণ বলিতে হইবে। কোন্ ব্যক্তি গৃহস্থাশ্রমকে মোক্ষলাভের প্রতিবন্ধক বলিয়া নির্দ্দেশ করিতে পারে? শ্রদ্ধাবিহীন, অনভিজ্ঞ, স্থূলদৃষ্টি, আলস্যপরায়ণ, গার্হস্থ্যধৰ্ম্মপালনে অসমর্থ, পরিশ্রান্ত, মূঢ় ব্যক্তিরাই প্রব্রজ্যাশ্রম [সন্ন্যাস আশ্রম] অবলম্বনপূৰ্ব্বক শান্তির উপায় দর্শন করিয়া থাকে। নিত্যসিদ্ধ বেদমৰ্য্যাদাই ত্রৈলোক্যরক্ষার কারণ।
‘বেদবিৎ ব্রাহ্মণেরাই জন্মাবধি সকলের পূজনীয় হইয়া থাকেন। ব্রাহ্মণের বিবাহ ও গর্ভাধান প্রভৃতি সমুদয় সংস্কার এবং পারত্রিক [পরলোকবিষয়ক] ও ঐহিক [সাংসারিক] ফলসাধক কাৰ্য্যসমুদয়ে বেদমন্ত্র সমুদয় প্রবর্ত্তিত হয়, সন্দেহ নাই। মৃত ব্যক্তির দাহ, শ্রাদ্ধ, সপিণ্ডীকরণ, পিণ্ড মজ্জন [শ্রাদ্ধক্রিয়ান্তে জলে পিণ্ড বিসর্জ্জন] এবং তাহার স্বর্গলাভের উদ্দেশে গো প্রভৃতি পশুদান এই সমুদয় কাৰ্য্যই মন্ত্রমূলক। অচ্চিত্মাৎ, বর্হিষদ ও ক্রব্যাদ নামক পিতৃগণ ঐ সমুদয় কাৰ্য্য মন্ত্রমূলক বলিয়া অনুমোদন করিয়া থাকেন। যখন মানবগণ দেবতা, ব্রাহ্মণ ও পিতৃগণের নিকট ঋণী রহিয়াছে এবং যখন বেদমন্ত্রে কর্ম্মকাণ্ডের বিধি নির্দ্দিষ্ট আছে, তখন আমার মতে কোন ব্যক্তিই মোক্ষলাভ করিতে পারে না। ফলতঃ শ্রীবিহীন আলস্যপরতন্ত্র ব্যক্তিরাই মিথ্যাস্বরূপ মোক্ষকে সত্য বলিয়া প্রতিপাদন করিয়া থাকে। যে ব্রাহ্মণ বেদশাস্ত্রানুসারে যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করেন, পাপ কখনই তাঁহাকে হরণ বা আকর্ষণ করিতে সমর্থ হয় না। তিনি যজ্ঞ ও যজ্ঞে নিহত পশুদিগের সহিত স্বর্গে গমন করিতে পারেন। যেমন পশুগণ হইতে তাঁহার তৃপ্তিলাভ হয়, তদ্রূপ তাহা হইতেও পশুগণ পরিতৃপ্ত হইয়া থাকে। মনুষ্য বেদোক্ত কাৰ্য্যে অনাদর, কপটতা ও মায়াদ্বারা কখনই পরব্রহ্ম লাভ করিতে সমর্থ হয় না। বৈদিক কাৰ্য্যদ্বারাই ব্রহ্মপদার্থ লাভ হইয়া থাকে।’
কর্মী ও জ্ঞানীর উপাসনাপথের পার্থক্য
‘কপিল কহিলেন, “যে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত হিংসাবিহীন দর্শ, পৌর্ণমাস, অগ্নিহোত্র ও চাতুর্ম্মাস্য যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, সনাতন ধর্ম্ম তাঁহাদিগকেই আশ্রয় করিয়া থাকে। কৰ্ম্মত্যাগী, ধৈৰ্য্যবান্, পবিত্র, ব্রহ্মজ্ঞ মহাত্মারা ব্রহ্মের সাক্ষাৎকারদ্বারাই অমৃতকাঙ্ক্ষী দেবগণকে তৃপ্ত করিতে পারেন। যে ব্যক্তি সমুদয় প্রাণীর আত্মস্বরূপ ও সৰ্ব্বভূতে সমদর্শী হইয়া ব্রহ্মলোকাদি অতিক্রম করিতে পারেন, দেবগণও তাঁহার গন্তব্যস্থানে অন্বেষণ করিয়া বিমোহিত হয়েন [তৎপথে আকৃষ্ট হয়েন ]। জ্ঞানবান্ ব্যক্তিরা জীবকে জরায়ুজাদি চারি শ্রেণীতে বিভক্ত এবং উহার মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার ও চিত্ত এই চারি মুখ আর হস্ত, বাক্য, উদর ও উপস্থ এই চারি দ্বার নিরূপিত করিয়াছেন। জীব হস্তাদি দ্বারচতুষ্টয়ের পালনকর্ত্তা, অতএব ঐ দ্বারসমুদয় রক্ষা করা অবশ্য কৰ্ত্তব্য। যে বুদ্ধিমান ব্যক্তি অক্ষক্রীড়া, পরধনাপহরণ ও নীচজাতির জন পরিত্যাগ করেন এবং ক্রোধবশতঃ কাহাকেও প্রহার করেন না, তাঁহারই হস্তদ্বার রক্ষিত হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি সত্যব্রত, মিতভাষী ও অপ্রমত্ত হইয়া ক্রোধ, মিথ্যাবাক্য, কুটিলতা ও লোকনিন্দা পরিত্যাগ করেন, তাঁহার বাগ্দ্বার সুরক্ষিত হয়। যে ব্যক্তি অতিভোজন ও লোভ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক শরীররক্ষার্থ যৎকিঞ্চিৎ আহার ও সতত সাধুদিগের সহিত সহবাস করেন, তিনিই জঠরদ্বার রক্ষা করিতে পারেন। যে ব্যক্তি একপত্নীসত্ত্বে সম্ভোগার্থে অন্য কামিনীর পাণিগ্রহণ, পরস্ত্রীগমন ও ঋতুসময় ব্যতীত স্বীয় পত্নীতে বিহার না করেন, তাঁহারই উপস্থদ্বার পরিরক্ষিত হয়। যে মহাত্মা এইরূপে চারি দ্বার সুরক্ষিত করিতে পারেন, তাঁহাকেই ব্রহ্মবিদ্ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। আর যে ব্যক্তি ঐ সমুদয় দ্বার রক্ষা করিতে না পারে, তাহার সমুদয় কাৰ্য্যই নিষ্ফল হয়। সে তপস্যা, যজ্ঞ বা শরীর দ্বারা কোন ফলই লাভ করিতে সমর্থ হয় না।
‘যে মহাত্মা উত্তরীয় বসন ও উত্তম শয্যা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক বাহুরূপ উপাধানে মস্তকস্থাপন করিয়া প্রশান্তচিত্তে ভূমিশয্যায় শয়ন করেন, যে ব্যক্তি অন্যের সুখদুঃখচিন্তায় পরাদ্ভুখ হইয়া থাকেন, যিনি দম্পতিদিগকে [পতি-পত্নীকে] পরস্পরানুরক্ত দর্শন করিয়াও ঈর্ষাশূন্যচিত্তে একাকী বিহার করিতে পারেন, যে ব্যক্তি সমুদয় প্রাণীর গতি এবং প্রকৃতি ও বিকৃতি-সমন্বিত সমুদয় পদার্থ পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হয়েন এবং যিনি সমুদয় প্রাণীর আত্মস্বরূপ হইয়া কোন প্রাণী হইতেই ভয় বা কোন প্রাণীকে ভয়-প্রদর্শন করেন না, দেবগণ তাঁহাদিগকেই ব্রহ্মজ্ঞ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। কামী ব্যক্তিরা দান-যজ্ঞাদির ফলস্বরূপ চিত্তশুদ্ধি না থাকাতে গুরূপদিষ্ট তত্ত্বজ্ঞান পরিজ্ঞাত হইতে না পারিয়া স্বর্গাদিলাভ অভিলাষ করিয়া থাকে। আশ্রমবাসী জ্ঞানবানেরা স্বকাৰ্য্য ও নিত্যসিদ্ধ পুরাতন নিষ্কামধৰ্ম্ম আশ্রয় করিয়া বেদান্তশ্রবণাদি দ্বারা আত্মার সমালোচনাপূৰ্ব্বক সংসারমূলক অজ্ঞান ধ্বংস করিতে পারেন। কিন্তু কামী ব্যক্তিরা সেই নিষ্কাম ধৰ্ম্মের কিয়দংশ-মাত্রও অনুষ্ঠান করিতে না পারিয়া ঐ আপদ, আচার, প্রমাদ ও পরাভববিহীন, প্রত্যক্ষফলপ্রদ অবিনশ্বর ধর্ম্মকে নিরর্থক ও ব্যভিচারী বিবেচনা করিয়া থাকে। ফলতঃ নিষ্কাম ধর্ম্ম যে যজ্ঞানুষ্ঠানাদি সকাম ধৰ্ম্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। কারণ, প্রথমতঃ যজ্ঞাদি কাৰ্য্যে জ্ঞাত হওয়াই নিতান্ত দুঃসাধ্য; যদিও উহা কোনক্রমে জ্ঞাত হওয়া যায়, তাহা হইলেও উহার অনুষ্ঠান করা সহজ নহে; আবার যদিও উহার অনুষ্ঠান করা যায়, তাহা হইলেও উহাদ্বারা অনন্ত সুখভোগের সম্ভাবনা নাই; অতএব যজ্ঞাদির ফল বিনশ্বর জ্ঞান করিয়া তত্ত্বজ্ঞান আশ্রয় করাই কৰ্ত্তব্য।‘
“স্যূমরশ্মি কহিলেন, ‘ভগবন! বেদে কৰ্ম্মানুষ্ঠান ও কৰ্ম্মত্যাগ উভয়েরই বিধি সুস্পষ্ট নির্দ্দিষ্ট আছে; এক্ষণে আপনি কৰ্ম্মানুষ্ঠান ও কৰ্ম্মত্যাগ এই উভয়ের ফল কি তাহা কীৰ্ত্তন করুন।’
“কপিল কহিলেন, ‘সাধু লোকেরা কর্ম্মত্যাগসহকারে ব্রহ্মপ্রাপ্তিরূপ সৎপথে অবস্থানপূৰ্ব্বক অনুভবদ্বারা ব্রহ্মকে প্রত্যক্ষের ন্যায় নিরীক্ষণ করিয়া থাকেন; কিন্তু আপনারা যে স্বর্গাদির প্রার্থনা করিয়া যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করেন, ইহলোকে তাহার কি প্রত্যক্ষ ফল দেখিতে পান?
‘স্যূমরশ্মি কহিলেন, “ব্ৰহ্মন! আমার নাম স্যূমরশ্মি। আমি জ্ঞানলাভের অভিলাষে আপনার সন্নিধানে আগমন করিয়া এই গোশরীরে প্রবেশপূৰ্ব্বক সরলভাবে প্রশ্ন করিয়াছি, বস্তুতঃ প্রতিপক্ষ হইয়া আপনার প্রশ্নের সিদ্ধান্ত করা আমার অভিপ্রেত নহে। আপনারা ব্ৰহ্মপ্রাপ্তিরূপ সৎপথে অবস্থানপূর্ব্বক অনুভবদ্বারা ব্রহ্মকে প্রত্যক্ষের ন্যায় নিরীক্ষণ করিয়া থাকেন; কিন্তু ঐ ব্ৰহ্মপ্রত্যক্ষ কিরূপ? এই বিষয়ে আমার অতিশয় সংশয় উপস্থিত হইতেছে, আপনি তাহা অপনোদন করুন। আমি বেদবিরুদ্ধ তর্কশাস্ত্রের অনুশীলন না করিয়া কেবল আগমার্থ প্রকৃতরূপে অবগত হইয়াছি। বেদবাক্যই আগম এবং যাহা বেদার্থনিৰ্ণায়ক মীমাংসা শাস্ত্র, তাহাও আগম বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। প্রত্যেক আশ্রমে সেই আগমপ্রতিপাদিত বিধি প্রতিপালন করিলে সিদ্ধিলাভ হয়। আগমের নির্ণয়ানুসারে ঐ সিদ্ধি প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে। কোন নৌকা ভিন্নদেশগামী নৌকায় বদ্ধ হইলে যেমন আরোহীকে গন্তব্য স্থানে উপনীত করিতে পারে, তদ্রূপ আমাদের পূর্ব্ববাসনানিবন্ধন কর্ম্মসমুদয় আমাদিগকে কখনই জন্মমৃত্যুরূপপ্রবাহ হইতে উত্তীর্ণ করিতে সমর্থ হইবে না। যাহা হউক, এক্ষণে আমি আপনার নিকট সমুপস্থিত হইয়াছি, আপনি আমাকে এই বিষয়ে উপদেশ প্রদান করুন। মনুষ্যগণের মধ্যে কখনই সৰ্ব্বত্যাগী, সন্তুষ্ট, শোকশূন্য, নীরোগ, ইচ্ছাবিবর্জ্জিত, সংসর্গবিমুখ ও নিষ্কৰ্ম্মা নাই। আপনারাও আমাদিগের ন্যায় শোক ও হর্ষের একান্ত বশীভূত এবং অন্যান্য প্রাণীগণের ন্যায় আপনাদিগের ইন্দ্রিয়ের কাৰ্য্য আছে। অতএব এক্ষণে চারি বর্ণ ও চারি আশ্রমের অক্ষয় সুখস্বরূপ কি, আপনি তাহা কীৰ্ত্তন করুন।
“কপিল কহিলেন, “ব্ৰহ্মন্! সমস্ত কাৰ্য্যের যে-যে শাস্ত্র অনুষ্ঠিত হয়, তৎসমুদয়ই ফলোপধায়ক। যে মতে অবস্থানপূৰ্ব্বক শমদমাদিগুণ অবলম্বন করা যাইতে পারে, সেই মতেই সৰ্ব্বদোষশূন্য ঈশ্বরকে লাভ করা যায়, সন্দেহ নাই। যে ব্যক্তি জ্ঞানী, তাহার সংসারে আর কিছুমাত্র অনুরাগ থাকে না। অজ্ঞানই জন্মমরণরূপ শৃঙ্খল দ্বারা প্রজাদিগকে অশেষবিধ ক্লেশ প্রদান করিয়া থাকে। তোমরা জ্ঞানবান্ ও নিরাময়, কিন্তু তোমাদিগের মধ্যে কাহারও কখন জীবাত্মার সহিত পরমাত্মার অভেদজ্ঞান জন্মে না। কোন কোন বিতণ্ডাপরায়ণ [কুতর্কনিপুণ] শাস্ত্রার্থাপহারক [স্বমত প্রতিষ্ঠাৰ্থ প্রকৃত অর্থের গোপনকারী] অনীশ্বরবাদী মূঢ় ব্যক্তি শাস্ত্রের প্রকৃত তত্ত্ব অবগত না হইয়া কাম দ্বেষদ্বারা অভিভূত ও অহঙ্কারের বশবর্তী হয় এবং অনীশ্বরবাদীরা শমদমাদির অনুষ্ঠানে পরাঙ্মুখ ও মোহপরবশ হইয়া জ্ঞান নিতান্ত নিষ্ফল বলিয়া কীৰ্ত্তন করে, তাহারা কিছুতেই জ্ঞানৈশ্বর্য্য প্রভৃতি গুণগ্রামের অনুসরণ করে না। সেই তামসিক লোকদিগের তমোগুণই একমাত্র আশ্রয়। যাহার যেরূপ প্রকৃতি, সে তাহার বশবর্তী হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি তমোগুণের বশীভূত, তাহার কাম, দ্বেষ, ক্রোধ ও দম্ভ প্রভৃতি প্রতিনিয়তই পরিবর্দ্ধিত হয়। যাহারা উৎকৃষ্ট গতিলাভের অভিলাষ করেন, সেই স্বকার্য্যনিরত যতিগণ এইরূপ চিন্তা করিয়া শুভাশুভ পরিত্যাগ করিবেন।
“স্যূমরশ্মি কহিলেন, ‘ব্ৰহ্মন্! আমি শাস্ত্রানুসারে আপনার নিকট কৰ্ম্মানুষ্ঠান প্রশস্ত ও সন্ন্যাস অপ্রশস্ত বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়াছি। শাস্ত্রাৰ্থ প্ৰকৃতরূপ অবগত না হইলে কাহারও কোন শাস্ত্রোক্ত কাৰ্য্যসাধনে প্রবৃত্তি জন্মে না। ন্যায়ানুগত আচারই শাস্ত্র, আর যাহা অন্যায্য, তাহা অশাস্ত্র। শাসন অতিক্রম করিয়া কখনই শাস্ত্রীয় প্রবৃত্তি প্রবর্ত্তিত হয় না। যাহা বেদবাক্যের বিপরীত, তাহা কদাচ শাস্ত্র বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে না। যাহারা কেবল প্রত্যক্ষ বস্তুরই অস্তিত্ব স্বীকার করে, তাহারা ইহলোকের প্রতিই বিশ্বাস করিয়া থাকে। যাহাদিগের বুদ্ধি অজ্ঞানদ্বারা উপহত হয়, সেই বিমূঢ় ব্যক্তিরা শাস্ত্রে যাহা দোষাবহ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে, বুঝিতে না পারিয়া তাহারও অনুষ্ঠান করে; তাহাদিগকে আমাদিগের ন্যায় সতত শোক প্রকাশ করিতে হয়। দেখুন, সকল লোকেই আপনাদিগের ন্যায় সমভাবে শীতোষ্ণাদি সহ্য করে, কিন্তু অনেকেরই সহিত যে আপনাদের কাৰ্য্যগত ভেদ দৃষ্ট হইয়া থাকে, উহা নিতান্ত বিস্ময়কর। যাহা হউক, এক্ষণে আপনি সকল শাস্ত্রের সিদ্ধান্তানুসারে অনন্তস্বরূপ ব্রহ্মের বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়া একমাত্র সুখপ্রার্থী চারি বর্ণ ও চারি আশ্রমের মধ্যে আমার অন্তঃকরণ শান্তিরসে আপ্লাবিত করিলেন। আপনি যাহা কহিলেন, ইহা সৰ্ব্বতোভাবে উৎকৃষ্ট বটে; কিন্তু ইহার অনুষ্ঠান করা সহজ নহে। যিনি যোগযুক্ত ও কৃতকাৰ্য্য হইয়া দেহমাত্র ধারণপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে ভ্রমণ করিতে সমর্থ হয়েন, সেই জিতেন্দ্রিয় অবিবাদী ব্যক্তিই কৰ্ম্মকাণ্ড-বেদে অশ্রদ্ধা প্রদর্শনপূৰ্ব্বক মোক্ষ আছে, এ কথা স্পষ্টাক্ষরে নির্দ্দেশ করিতে পারেন। কিন্তু যে ব্যক্তি পরিবারবর্গপরিবৃত, সে কদাচ মুক্তিবিধায়ক কার্য্যের অনুষ্ঠানে সমর্থ হয় না। যখন দান, অধ্যয়ন, যজ্ঞানুষ্ঠান, সন্তানোৎপাদন ও ঋজুতা অবলম্বন করিলেও মুক্তিলাভ হয় না, তখন মুক্তিপ্রার্থী ব্যক্তিকে, মুক্তিকে ও মুক্তিলাভার্থ নিরর্থক পরিশ্রমকে ধিক্! ফলতঃ কর্ম্মকাণ্ড বেদবাক্যের বিরুদ্ধাচরণ করিলে নাস্তিক বলিয়া পরিগণিত হইতে হয়। যাহা হউক, এক্ষণে আমার মোক্ষবিষয়ে সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে; অতএব আপনি উহার যাথার্থ্য কীৰ্ত্তন করুন। আমি আপনার নিকট সমুপস্থিত হইয়াছি, আপনি আমাকে উপদেশ প্রদান করুন। আপনি যেরূপ মুক্তির বিষয় অবগত হইয়াছেন, আমাকেও তদ্বিষয়ে উপদেশ দিন।’ ”