২৬৮. অধিকারিভেদে যজ্ঞদ্রব্যবিধান—গো-কপিলসংবাদ

২৬৮তম অধ্যায়

অধিকারিভেদে যজ্ঞদ্রব্যবিধান—গো-কপিলসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মনুষ্য যোগপ্রভাবে যে হিংসা করিয়াও ষড়ৈশ্বৰ্য্য লাভ করিতে পারে, তাহা আপনি কীর্ত্তন করিয়াছেন, এক্ষণে যে ধর্ম্ম অবলম্বন করিলে ভোগ ও মোক্ষ উভয়ই লাভ করা যায়, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন। গার্হস্থ্য ধর্ম্ম ও যোগধর্ম্ম উভয়ই মুক্তি প্রদান করিতে পারে, সন্দেহ নাই; কিন্তু ঐ উভয়ের মধ্যে কোন ধর্ম্ম প্রধান?”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! ঐ উভয় ধৰ্ম্মই উৎকৃষ্ট, উৎকৃষ্টফলপ্রদ ও সাধুজনের সেবনীয়; কিন্তু ঐ উভয় ধৰ্ম্মই প্রতিপালন করা নিতান্ত সুকঠিন। যাহা হউক, এক্ষণে তোমার সংশয়চ্ছেদনার্থ উহার প্রমাণ সংস্থাপনপূর্ব্বক গো-কপিলসংবাদ নামে এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর।

“একদা মহর্ষি ত্বষ্টা নরপতি নহুষের গৃহে আতিথ্যস্বীকার করিলে, তিনি শাশ্বত বেদবিধানানুসারে তাঁহাকে মধুপর্কপ্রদানার্থ গোবধ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, এমন সময় জ্ঞানবান্ সংযমী মহাত্মা কপিল যদৃচ্ছাক্রমে তথায় সমাগত হইয়া নহুষকে গোবধে উদ্যত দেখিয়া স্বীয় শুভকারী নৈষ্ঠিকী বুদ্ধিপ্রভাবে, “হা বেদ।” এই শব্দ উচ্চারণ করিলেন। ঐ সময় স্যূমরশ্মি নামে এক মহর্ষি স্বীয় যোগবলে সেই গোদেহে প্রবিষ্ট হইয়া কপিলকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘মহর্ষে! আপনি বেদবিহিত হিংসা অবলোকন করিয়া বেদে অবজ্ঞা প্রদর্শন করিলেন; কিন্তু আপনি যে হিংসাশূন্য ধর্ম্ম অবলম্বন করিয়া রহিয়াছেন, উহা কি বেদবিহিত নহে? ধৈর্য্যশালী বিজ্ঞানসম্পন্ন তপস্বীরা সমুদয় বেদকেই পরমেশ্বরের বাক্য বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। পরমেশ্বরের কোন বিষয়ে অনুরাগ, বিরাগ ও স্পৃহা নাই। সুতরাং কি কর্ম্মকাণ্ড, কি জ্ঞানকাণ্ড, তাঁহার নিকট উভয়ই তুল্য। অতএব কোন বেদই অপ্রমাণ হইতে পারে না।

“কপিল কহিলেন, “আমি বেদের নিন্দা করিতেছি না এবং কর্ম্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড এই উভয়বিধ বেদের তারতম্য নির্দ্দেশ করাও আমার অভিপ্রেত নহে। কি সন্ন্যাস, কি বানপ্রস্থ, কি গার্হস্থ্য, কি ব্রহ্মচর্য্য লোকে যে ধর্ম্ম অনুসারে কার্য্য করুক না কেন, পরিণামে অবশ্যই তাহার উৎকৃষ্ট গতিলাভ হইয়া থাকে। সন্ন্যাসাদি চারি প্রকার আশ্রমবাসীদিগের চারি প্রকার গতি নির্দ্দিষ্ট আছে। তন্মধ্যে সন্ন্যাসী মোক্ষ, বানপ্রস্থ ব্রহ্মলোক, গৃহস্থ স্বর্গলোক এবং ব্রহ্মচারী ঋষিলোক লাভ করিয়া থাকেন। বেদে কাৰ্য্য আরম্ভ করা ও না করা উভয়েরই বিধি আছে। ঐ বিধিদ্বারা কার্য্যের আরম্ভ ও অনারম্ভ উভয়ই দোষাবহ বলিয়া প্রতিপন্ন হইতেছে। সুতরাং বেদানুসারে কাৰ্য্যের বলাবল বিবেচনা করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। অতএব যদি তুমি বেদশাস্ত্র ভিন্ন যুক্তি বা অনুমানদ্বারা অহিংসা অপেক্ষা কোন উৎকৃষ্ট ধর্ম্ম স্থির করিয়া থাক, তাহা কীৰ্ত্তন কর।’

“স্যূমরশ্মি কহিলেন, ‘মহর্ষে! এইরূপ শ্রুতি আছে যে, স্বৰ্গকামনা করিয়া যজ্ঞ করা কর্ত্তব্য। প্রথমতঃ ফলকল্পনা করিয়া যজ্ঞ করিতে হয়। ছাগ, অশ্ব, মেষ, ধেনু ও পক্ষী প্রভৃতি গ্রাম্য ও আরণ্য জন্তুসমুদয় এবং ওষধিসকল জীবগণের জীবনধারণের উপায়। প্রতিদিন সায়ং ও প্রাতঃকালে ঐ সকল উপায় অবলম্বনপূর্ব্বক জীবিকা নির্ব্বাহ করা বিধেয়। ভগবান্ প্রজাপতি ধান্য ও পশু সকল যজ্ঞের প্রধান অঙ্গ বলিয়া নির্দ্দেশপূর্ব্বক যজ্ঞের সৃষ্টি ও ধান্যাদিদ্বারা যজ্ঞে দেবগণকে অর্চ্চনা করিয়াছেন। ধেনু, ছাগ, মনুষ্য, অশ্ব, মার্জ্জার, অশ্বতর ও গর্দ্দভ এই সাত গ্রাম্য এবং সিংহ, ব্যাঘ্র, বরাহ, মহিষ, হস্তী, ভল্লুক ও বানর এই সাত আরণ্য এই চতুর্দ্দশবিধ জন্তুদ্বারা যজ্ঞকাৰ্য্য নির্ব্বাহ হইয়া থাকে। পশু বিনাশ করা যজ্ঞের প্রধান অঙ্গ এবং উহা পূর্ব্বতন মহাত্মাদিগের অনুমোদিত বলিয়া কীৰ্ত্তিত হইয়াছে। সমুদয় বিদ্বান্ ব্যক্তিই স্ব স্ব ক্ষমতানুসারে যজ্ঞে পশু বিনাশ করিয়া থাকেন। মনুষ্য, পশু, বৃক্ষ ও ওষধি প্রভৃতি সকলেই স্বৰ্গকামনা করে; কিন্তু যজ্ঞ ভিন্ন, উহাদিগের স্বর্গলাভের উপায়ান্তর নাই। ওষধি, পশু, বৃক্ষ, লতা, আজ্য [ঘৃত], দধি, দুগ্ধ, পুরোডাশাদি [যজ্ঞীয় পিষ্টকাদি] হবনীয় [আহুতির যোগ্য] দ্রব্য, ভূমি, দিক্‌, শ্রদ্ধা, কাল, ঋক্, যজুঃ, সাম, যজমান, অগ্নি, এই সপ্তদশ পদার্থ যজ্ঞের অঙ্গ। যজ্ঞ লোকপ্রতিষ্ঠার মূল কারণ।

‘গোসমুদয় আজ্য, দধি, দুগ্ধ, গোময়, আমিক্ষা [ছানা], চর্ম্ম এবং লাঙ্গুল, শৃঙ্গ ও পাদধৌত সলিলদ্বারা যজ্ঞ নির্ব্বাহ করিয়া থাকে। ঐ সমুদয় দ্রব্য দক্ষিণা ও ঋত্বিক্‌গণের সহিত মিলিত হইলেই যজ্ঞকাৰ্য্য সুসম্পন্ন হয়। পূর্ব্বতন মানবগণ ঐ সমুদয় দ্রব্য আহরণ করিয়াই যজ্ঞ নিৰ্ব্বাহ করিয়া গিয়াছেন। ফলতঃ যাঁহারা ফলাভিসন্ধি না করিয়া কেবল কর্ত্তব্যবোধে যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া থাকেন, তাঁহারাই জীবহিংসা বা অন্যের অনিষ্টাচরণে প্রবৃত্ত হয়েন না। ঐ সমুদয় শাস্ত্রোক্ত যজ্ঞের অঙ্গভূত দ্রব্য পরস্পর পরস্পরের সাহায্য করিয়া থাকে। ঋষিপ্রণীত স্মৃতিশাস্ত্র পাঠ করিয়া বোধ হইতেছে যে, বেদ উহাতেই প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। ঐ শাস্ত্র ক্রিয়াপ্রবর্ত্তক বলিয়া বিদ্বান ব্যক্তিরা উহাতে আস্থা করিয়া থাকেন। ব্রাহ্মণ ও বেদ যজ্ঞের আদি কারণ। যজ্ঞীয় দ্রব্যসমুদয় ব্রাহ্মণে অর্পণ করাই বিধেয়। জগৎ হইতে যজ্ঞ এবং যজ্ঞ হইতে জগৎ রক্ষিত হইয়া থাকে। প্রণব বেদের আদি; অতএব প্রথমে প্রণব উচ্চারণ করিয়া যজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপের অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য। বেদে কথিত আছে এবং সিদ্ধ মহর্ষিরাও কহিয়া থাকেন যে, যিনি সাধ্যানুসারে যজ্ঞে প্রণব, নমঃ, স্বাহা ও বষট্‌ শব্দ প্রয়োগ করেন, ত্রিলোকমধ্যে তাঁহার কিছুমাত্র শঙ্কা থাকে না। যিনি ঋক্, যজু, সাম এবং সামবেদপূরক শব্দ-সমুদয় অবগত হয়েন, তিনিই যথার্থ ব্রাহ্মণ। অগ্নিহোত্র, সোমযাগ ও অন্যান্য যজ্ঞদ্বারা যে ফললাভ হইয়া থাকে, আপনি তাহা বিলক্ষণ অবগত আছেন। অতএব অবিচারিতচিত্তে স্বয়ং যজ্ঞানুষ্ঠান এবং অন্যকে যজ্ঞানুষ্ঠানের উপদেশ প্রদান করা সৰ্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। যজ্ঞানুষ্ঠান করিলে পরকালে স্বর্গ ফললাভ হইয়া থাকে। যাহারা যজ্ঞানুষ্ঠান না করে, তাহাদিগের ইহলোকে ও পরলোকে সদগতিলাভ হয় না। বেদবেত্তারা কর্ম্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড এই উভয় বেদকেই প্রমাণ বলয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন।’ ”