২৬৭তম অধ্যায়
জয়দ্ৰথকর্ত্তৃক দ্ৰৌপদীহরণ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর দ্রুপদনন্দিনী ভ্রূকুটিবন্ধন ও ফুৎকার পরিত্যাগপূর্ব্বক ক্ৰোধকম্পিত্যকলেবরে পুনরায় জয়দ্রথকে কহিতে লাগিলেন, “ওরে মূঢ়! তুমি স্বকর্ম্মনিরত, যশস্বী মহেন্দ্ৰতুল্য যক্ষরাক্ষসগণের অজেয়, মহারথ পাণ্ডবদিগের নিন্দা করিয়া লজ্জিত হইতেছ না? সাধু ব্যক্তিরা কদাচ পরমপূজ্য কৃতবিদ্য বনবাসী বা গৃহস্থ তপস্বীর প্রতি কুবাক্য প্রয়োগ করেন না, পামরগণই তাদৃশ কাৰ্য্য করিয়া থাকে। আমার বোধ হয়, ক্ষত্ৰিয় সমাজে এমন কোন ব্যক্তি তোমার সমভিব্যাহারে নাই যে, মহাগর্তে পতনোন্মুখ মানবের হস্ত ধারণপূর্ব্বক প্রতিনিবৃত্ত করে।
“যেমন অবিবেকী ব্যক্তি দণ্ডমাত্র গ্রহণ করিয়া হিমাচলের উপত্যকায় গিরিকূটপরিমিত মদস্রাবী কুঞ্জরকে আক্রমণ করিবার মানস করে, তদ্রূপ তুমিও ধর্ম্মরাজকে পরাজয় করিতে বাসনা করিতেছ। যখন তুমি ক্রুদ্ধ ভীমসেনকে অবলোকন করিবে, তখন মনে করিবে যে, অজ্ঞানতাবশতঃ সুখপ্রসুপ্ত মহাবলপরাক্রান্ত সিংহকে পদাঘাত করিয়া তাঁহার মুখলোম উৎপাটনপূর্ব্বক পলায়ন করিতেছ। যখন অর্জ্জুনের সহিত তোমাকে যুদ্ধ করিতে হইবে, তখন তুমি মনে করিবে যে, পর্ব্বতকন্দরজাত মহাবলপরাক্রান্ত শয়ান সিংহকে পদাঘাত করিতেছ। রে দুরাত্মন! তুমি পুরুষশ্রেষ্ঠ নকুল ও সহদেবের সহিত সংগ্ৰাম করিতে বাসনা করিয়া তীক্ষ্নবিষ অতি প্ৰমত্ত কৃষ্ণস্যপদ্বয়ের পুচ্ছদেশে পাদবিক্ষেপ করিবার অভিলাষ করিতেছ। রে মন্দাত্মন! যেমন বেণু, নল ও কদলী আপনার নাশের নিমিত্ত ফলিত হয়, যেমন কৰ্কট আত্মবিনাশের নিমিত্ত গৰ্ভধারণ করে, তদুপ তুমি আমাকে গ্রহণ করিতেছ।”
জয়দ্ৰথ কহিলেন, “হে কৃষ্ণে! পাণ্ডুনন্দনগণের যেরূপ বলবিক্রম, তাহা আমার অবিদিত নাই। তুমি উক্তপ্রকার বিভীষিকা প্রদর্শন করিয়া কখনই আমাকে ত্রাসিত করিতে পারিবে না। আমি পরমোৎকৃষ্ট সপ্তদশকুলে [কৃষি, বাণিজ্য, দুৰ্গ, সেতু, হস্তী, খনির আকর, করগ্রহণ এবং সৈন্যসংগ্ৰহ—এই অষ্টবিধ। কর্ম্ম, প্ৰভুশক্তি, মন্ত্রশক্তি, উৎসাহশক্তি প্রভুসিদ্ধি, মন্ত্রসিদ্ধি, উৎসাহসিদ্ধি, প্রভুদয়, মন্ত্রোদয় এবং উৎসাহোদয় এই নববিধ শক্তি—এবংবিধ সপ্তদশগুণোপেত বংশ।] জন্মগ্রহণ করিয়াছি, শৌৰ্য্য প্রভৃতি ছয় গুণ [শৌৰ্য্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষতা, দক্ষিণ্য এবং ঐশ্বৰ্য্য] আমাতে বর্ত্তমান আছে, তন্নিমিত্ত পাণ্ডবগণকে অতি হীন জ্ঞান করিয়া থাকি! অতএব হে নিতম্বিনি! তুমি শীঘ্র গজ বা রথে আরোহণ কর, বাকচাতুৰ্য্যদ্বারা আমাকে নিবৃত্ত করিতে পরিবে না, এক্ষণে সহজে আমার বশীভূত না হইলে আমি বলপূর্ব্বক লইয়া যাইব, তখন অবশ্যই তোমাকে আমার প্ৰসাদ প্রার্থনা করিতে হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
দ্রৌপদী কহিলেন, “আমি মহাবলসম্পন্না হইয়া কি নিমিত্ত দুর্ব্বলার ন্যায় তোমার বশবর্ত্তিনী হইব? তুমি নিগ্ৰহ করিলেও কখন আমি তোমার প্রসাদ প্রার্থনা করিব না। দেখ, একরথস্থ মহাবলপরাক্রান্ত কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন যাহার সহায়, ক্ষুদ্র মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, ইন্দ্রও তাঁহাকে হরণ করিতে পারেন না। অগ্নি যেমন গ্ৰীষ্মকালে শুষ্ক তৃণ দগ্ধ করিয়া বনমধ্যে প্রবেশ করে, তদুপ অরতিনিপাতন অর্জ্জুন রথারোহণপূর্ব্বক শক্রগণের অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চারপূর্ব্বক তোমার সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিবেন।
“মহাবীর জনার্দ্দন অন্ধক, বৃষ্ণি ও কেকয়-বংশ-সভূত রাজপুত্ৰগণ-সমভিব্যাহারে আগমন করিয়া আমার সহায় হইবেন। তুমি জান না, মহাবীর ধনঞ্জয়ের ভয়ঙ্কর শরনিকর গাণ্ডীব হইতে অতিবেগে বহির্গত হইয়া ঘনঘটার ন্যায় গভীর গর্জ্জন করে। তুমি যে সময় সেই অর্জ্জুনকে পতঙ্গপুঞ্জসদৃশ শর সমুদয় নিক্ষেপ করিতে নিরীক্ষণ করিবে, তখন অবশিষ্ট তোমাকে স্বীয় অসদভিপ্ৰায়ের নিন্দা করিতে হইবে। যখন মহাবীর ধনঞ্জয় গাণ্ডীব ধারণপূর্ব্বক শঙ্খধ্বনি ও তরবারিনিঃস্বন করিতে করিতে তোমার বক্ষঃস্থলে বাণাঘাত করিবেন, তখন তোমার মন কিরূপ অবস্থাগ্রস্ত হইবে, বলিতে পারি না। অরে অধম! যখন তুমি গদাহস্ত বৃকোদর ও ক্ৰোধবিষপ্রদীপ্ত মাদ্রীসূতদ্বয়কে মহাবেগে আগমন করিতে অবলোকন করিবে, তখন তোমার মনে অবশ্যই অনুতাপ উপস্থিত হইবে। আমি পাণ্ডবগণ ব্যতীত অন্য কোন পুরুষকে কখন মনেও স্থান প্রদান করি নাই, অদ্য সেই সতীত্ববলে অচিরাৎ অবলোকন করিব যে, পাণ্ডুনন্দনগণ তোমাকে সমরাঙ্গনে আকর্ষণ করিতেছেন। তুমি আমাকে নিগ্ৰহ করিয়াও ভীত করিতে পরিবে না। আমি কুরুবংশাবতংস পাণ্ডবগণসমভিব্যাহারে কম্যাকবনে সমাগত হইয়াছি।”
বিশালনেত্ৰা যাজ্ঞসেনী পাণ্ডবগণের সহিত মিলিত হইবার মানসে তাঁহাদেরই আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন; কিন্তু একবারও তাঁহাদিগকে ভৎসনা করিলেন না। তিনি বারংবার জয়দ্রথকে তাঁহার শরীর স্পর্শ করিতে নিষেধ করিতে লাগিলেন এবং ধৌম্য পুরোহিতকে আহ্বান করিলেন। দুরাত্মা জয়দ্রথ তাঁহার বাক্যে কৰ্ণপাত না করিয়া তদীয় উত্তরীয় বসন ধারণ করিল। তখন পতিব্ৰতা দ্ৰৌপদী উপায়ান্তর প্রাপ্ত না হইয়া বেগে জয়দ্রথকে আকর্ষণ করিবামাত্র সেই দুরাত্মা ছিন্নমূল পাদপের ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইল; কিন্তু সে তৎক্ষণাৎ গাত্ৰোত্থান করিয়া সাতিশয় বলপূর্ব্বক দ্ৰৌপদীকে আকর্ষণ করিতে লাগিল। দ্রুপদনন্দিনী জয়দ্রথের আকর্ষণে নিতান্ত পীড়িত হইয়া পুরোহিত ধৌম্যের চরণে প্ৰণিপাতপূর্ব্বক অগত্যা সিন্ধুরাজের রথে আরোহণ করিলেন।
তখন মহামতি ধৌম্য জয়দ্রথকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “অরে পাপাত্মন! তুমি পাণ্ডবগণকে পরাজয় না করিয়া কখনইহাকে হরণ করিতে পরিবে না। কেন এরূপ দুষ্কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইলে? একবার পুরাতন ক্ষত্রিয়ধর্ম্মের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। তুমি অচিরাৎ যুধিষ্ঠির প্রমুখ পাণ্ডবগণের নয়নপথে পতিত হইয়া এই পাপের সমুচিত ফল প্রাপ্ত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।” ধৌম্য জয়দ্রথকে এই কথা বলিয়া তাহার পদাতিসৈন্যের মধ্যবর্ত্তী হইয়া যশস্বিনী দ্রুপদনন্দিনীর অনুগমন করিতে লাগিলেন।