২৬৬. আশুকারী ও চিরকারীর দোষগুণ প্রদর্শন

২৬৬তম অধ্যায়

আশুকারী ও চিরকারীর দোষগুণ প্রদর্শন

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! অতি দুরূহ কাৰ্য্য উপদেশবিষয়ে আপনি আমাদিগের পরম গুরু। এক্ষণে কোন কাৰ্য্য করিতে হইলে, উহা শীঘ্র, কি বিলম্বে করা কর্ত্তব্য, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি এই উপলক্ষে মহর্ষি অঙ্গিরার বংশসম্ভূত চিরকারীর পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। যে ব্যক্তি বহুকাল চিন্তাপূৰ্ব্বক কার্য্যানুষ্ঠান করে, তাহাকে অপরাধে লিপ্ত হইতে হয় না। মহর্ষি গৌতমের চিরকারীনামে এক পুত্র ছিলেন। ঐ পুত্র মেধাবী, কাৰ্য্যকুশল ও মহাত্মা ছিলেন এবং সুদীর্ঘকাল বিবেচনা করিয়া কাৰ্য্যসমুদয় নির্ব্বাহ করিতেন। তিনি দীর্ঘকাল কার্য্যচিন্তা, নিদ্ৰাসেবন ও জাগরণ করিতেন এবং দীর্ঘকালের পর, তাঁহার কর্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্যবোধ হইত বলিয়া লোক তাঁহাকে চিরকারী বলিয়া আহ্বান করিত। অদীর্ঘদর্শী মূঢ় ব্যক্তিরা তাঁহাকে অলস ও নির্ব্বোধ বলিয়াও কীৰ্ত্তন করিত।

মাতৃবধে পিতৃ-আজ্ঞাপ্রাপ্ত চিরকারীর চিন্তাধারা

“একদা মহর্ষি গৌতম স্বীয় পত্নীকে ব্যভিচারদোষে লিপ্ত বোধ করিয়া রোষভরে সেই চিরকারী পুত্রকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘বৎস! তুমি তোমার জননীকে সংহার কর। মহর্ষি পুত্রকে এই আজ্ঞা প্রদান করিয়া তৎক্ষণাৎ তথা হইতে বনাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। মহাত্মা চিরকারী স্বীয় স্বভাবসিদ্ধ দীর্ঘসূত্রিতানিবন্ধন অনেকক্ষণের পর আজ্ঞা গ্রহণ করিয়া বহুকাল এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিলেন, পিতার আজ্ঞা প্রতিপালন করিলে জননীকে সংহার করিতে হয়, আর যদি জননীকে সংহার না করি, তাহা হইলে পিতার আজ্ঞা লঙ্ঘন করা হয়; অতএব এক্ষণে কিরূপে এই ধৰ্ম্মসঙ্কট হইতে পরিত্রাণ প্রাপ্ত হই? পুত্র পিতা ও মাতা উভয়েরই অধীন; সুতরাং পিতৃ-আজ্ঞা প্রতিপালন ও জননীকে রক্ষা এই উভয়ই পুত্রের অবশ্য কর্ত্তব্য ও পরমধর্ম্ম। ঐ উভয়ের মধ্যে এক বিষয়ে অনাস্থা করিলেই পুত্রকে অধৰ্ম্মভাজন হইতে হয়। কেহই কখন মাতাকে বিনাশ করিয়া সুখ বা পিতাকে অবজ্ঞা করিয়া প্রতিষ্ঠালাভ করিতে সমর্থ হয় না; অতএব পিতাকে অবজ্ঞা করা এবং জননীকে রক্ষা করা, এই উভয় কার্য্যই সৰ্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। পিতা স্বয়ং স্বীয় শীল [চরিত্র], গোত্র ও কুলের রক্ষণার্থ পত্নীতে পুত্ররূপে আত্মাকে সংস্থাপিত করিয়া থাকেন। পিতা ও মাতা উভয়েই আমাকে পুত্র বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন; অতএব অবশ্যই আমাকে তাঁহাদিগের উভয়কে আপনার উৎপত্তির প্রধান হেতু বলিয়া অবধারণ করিতে হইবে। পিতা জাতকৰ্ম্ম ও উপনয়নকালীন যে-যে বাক্য প্রয়োগ করিয়া থাকেন, তাহাতে তাঁহারই গৌরব দৃঢ়রূপে প্রকাশ হইয়া থাকে। ভরণপোষণ ও অধ্যাপনাদিনিবন্ধন পিতা প্রধান গুরু। বেদে ইহাও কীৰ্ত্তিত আছে যে, পিতা পুত্রকে যাহা অনুমতি প্রদান করেন তাহা প্রতিপালন করাই পুত্রের পরমধর্ম্ম। পুত্র পিতাকে কেবল প্রীতিদান করে; কিন্তু পিতা পুত্রকে শরীরাদি সমুদয় দেয় বস্তুই প্রদান করিয়া থাকেন। অতএব অবিচারিতচিত্তে পিতার আজ্ঞা প্রতিপালন করা – পুত্রের অবশ্য কর্ত্তব্য। তদ্বারা পুত্র সমুদয় পাপ হইতে পরিত্রাণ প্রাপ্ত হইতে পারে। পিতা পুত্রকে জন্মদান, অশনবসনাদি [১] প্রদান, বেদাধ্যাপন ও লোকাচার প্রদর্শন করিয়া থাকেন। পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম্ম ও তপস্যাস্বরূপ পিতাকে প্রীত করিলেই দেবগণকে পরিতৃপ্ত করা হয়। তিনি পুত্রকে উদ্দেশ করিয়া যাহা উচ্চারণ করেন, সেসমুদয়ই পুত্রের আশীর্ব্বাদরূপে পরিণত হয়। পিতা আহ্লাদিত হইলেই পুত্র সমুদয় পাপ হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিয়া থাকে। বৃক্ষ হইতে ফল-পুষ্প নিপতিত হয়; কিন্তু পিতা ক্লেশগ্রস্ত হইলেও কখনই পুত্রকে পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হয়েন না।

বিচারান্তে চিরকারীর মাতৃবধ-নিবৃত্তি

যাহা হউক, পিতা যে পুত্রের পক্ষে সামান্য বস্তু নহেন, তাহা চিন্তা করিলাম; এক্ষণে মাতার বিষয় চিন্তা করি। অরণি [অগ্নিগর্ভ কাষ্ঠ যে কাঠের মধ্যে অগ্নি থাকে, পরস্পর ঘর্ষণে কণাকারে বহির্গত হয়] যেমন হুতানের উৎপত্তির হেতু, তদ্রূপ জননী এই পাঞ্চভৌতিক দেহের প্রধান কারণ। আর্ত্ত [দুঃখিত] ব্যক্তিদিগের জননীই সুখের একমাত্র আধার। মাতা বর্ত্তমান থাকিলে আপনাকে সহায়সম্পন্ন এবং মাতৃবিয়োগ হইলেই আপনাকে অনাথ বলিয়া বোধ হইয়া থাকে। লোকে শ্রীভ্রষ্ট হইয়াও জননীকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইলে তাহাকে আর শোকাবেগ সহ্য করিতে হয় না। যাহার জননী বিদ্যমান থাকে, সে পুত্রপৌত্রাদিসম্পন্ন ও শতবর্ষবয়স্ক হইলেও আপনাকে বালকের ন্যায় জ্ঞান করে। পুত্র সক্ষম বা অক্ষম হউক, স্থূল বা কৃশই হউক, মাতা সততই তাহাকে রক্ষা করিয়া থাকেন। মাতা ব্যতীত পুত্রের পোষণকৰ্ত্তা আর কেহই নাই। মাতৃবিয়োগ হইলেই লোক আপনাকে বৃদ্ধ ও দুঃখিত বলিয়া জ্ঞান এবং সমুদয় জগৎ শূন্যময় অবলোকন করিয়া থাকে। মাতার সমান তাপনাশের স্থান, গতি, পরিত্রাণ ও প্রিয়বস্তু আর কিছুই নাই। মাতা জঠরে ধারণ করেন বলিয়া ধাত্রী, জন্মের কারণ বলিয়া জননী, অঙ্গাদি পরিপোষণ করেন বলিয়া অম্বা এবং পুত্র প্রসব করেন বলিয়া বীরসূনামে কীৰ্ত্তিত হইয়া থাকেন।

‘শৈশবাবস্থায় জননী পুত্রকে প্রতিপালন করেন বলিয়া মাতাকে সেবা করা পুত্রের অবশ্য কৰ্ম্ম। পুত্র মাতা হইতে উৎপন্ন হয় বলিয়া মাতা পুত্রের অপর দেহস্বরূপ। মাংসশোণিতসম্পন্ন কোন্ সচেতন ব্যক্তি স্বীয় দেহের ন্যায় জননীর দেহ বিনষ্ট করিতে পারে? মৈথুনসময়ে পিতা ও মাতা উৎকৃষ্ট পুত্রলাভের অভিলাষ করিয়া থাকেন। কিন্তু ঐ অভিলাষ পিতা অপেক্ষা মাতারই সমধিক হয়, সন্দেহ নাই। পুত্র যাহার ঔরসে ও যে গোত্রে জন্মগ্রহণ করে, তাহা মাতার অপরিজ্ঞাত থাকে না। ভরণপোষণনিবন্ধন পুত্রের প্রতি জননীর সমধিক প্রীতি ও স্নেহ জন্মে। এ দিকে আবার পিতারই পুত্রে সম্পূর্ণ অধিকার। যদি পুরুষ কোন রমণীর পাণিগ্রহণপূৰ্ব্বক তাহার রক্ষায় পরাঙ্মুখ হয়েন, তাহা হইলে সেই স্ত্রীর ব্যভিচারদোষ ঘটিলেও সে নিন্দনীয় হয় না। স্ত্রীকে ভরণ ও প্রতিপালন করিতে হয় বলিয়া পুরুষ ভর্ত্তা ও পতিশব্দে নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে; এই উভয়বিধ গুণবিরহে তাহাকে ভর্ত্তা বা পতি বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে না। ফলতঃ স্ত্রীলোকের কোন বিষয়ে কিছুমাত্র অপরাধ নাই, প্রত্যুত স্ত্রী ব্যভিচার দোষে লিপ্ত হইলেই তাহার স্বামীকেই সেই বিষয়ে অপরাধী বলিয়া স্থির করা উচিত। ভর্ত্তা স্ত্রীলোকের পরমদেবতা। আমার জননী ইন্দ্রকে ভর্ত্তাসদৃশ রূপসম্পন্ন নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার হস্তে আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন; সুতরাং এই বিষয়েই তিনি ব্যভিচারদোষে লিপ্ত হইতে পারেন না। পুরুষরাই সকল বিষয়ে সম্পূর্ণ অপরাধী; স্ত্রীলোক পুরুষেরই একান্ত অধীন বলিয়া সে কোন বিষয়েই অপরাধী হইতে পারে না। আমার জননী মৈথুন-তৃপ্তির নিমিত্ত ইন্দ্রকে কিছুমাত্র অনুরোধ করেন নাই; সুতরাং তাঁহার অধৰ্ম্মের সম্ভাবনা কি? প্রত্যুত ইন্দ্রই স্বয়ং তাঁহার নিকট প্রার্থনা করাতে অধর্ম্মে নিপতিত হইয়াছেন।

‘স্ত্রীলোকমাত্রেই অবধ্য, বিশেষতঃ পতিব্রতচারিণী জননী কোনক্রমেই বধাৰ্হ হইতে পারেন না। অবিচক্ষণ পশুরাও এই বাক্যে অনুমোদন করিবে, সন্দেহ নাই। পিতাতে দেবতাসকল অধিষ্ঠান করিতেছেন, কিন্তু জননীতে দেবতা ও মনুষ্য উভয়ই প্রতিষ্ঠিত আছেন। সুতরাং পিতা কেবল পারলৌকিক শুভদাতা, কিন্তু মাতা ইহলোক ও পরলোক উভয় লোকেই শুভপ্রদান করিয়া থাকেন।

পত্নীদোষবিষয়ে গৌতমের মত পরিবর্ত্তন

“চিরকারী দীর্ঘসূত্রতা নিবন্ধন বহুক্ষণ এইরূপ নানাপ্রকার তর্ক-বিতর্ক করিতে লাগিলেন। একদা তপানুষ্ঠানপরায়ণ মহাপ্রাজ্ঞ গৌতম মেধাতিথি পত্নী বধদণ্ডের একান্ত অনুপযুক্ত বিবেচনা করিয়া, শাস্ত্রজ্ঞানপ্রভাবে অনুতাপিত হইয়া অবিরল বাষ্পকুললোচনে কহিলেন, ত্রিলোকাধিপতি পুরন্দর ব্রাহ্মণবেশ ধারণপূৰ্ব্বক অতিথিভাবে আমার আশ্রমে উপস্থিত হইয়াছিলেন। আমি তাঁহাকে শান্তবাক্যে স্বাগত প্রশ্নপূৰ্ব্বক পাদ্য, অর্ঘ্য প্রভৃতি যথোচিত উপচারে অর্চ্চনা করিয়া কহিয়াছিলাম, “আমি আপনারই একান্ত অধীন।” আমি তৎকালে এই বিবেচনা করিলাম যে, এইরূপ শিষ্টাচার প্রদর্শন করিলে ইন্দ্র আমার প্রতি অতিশয় সন্তুষ্ট হইবেন। কিন্তু তিনি স্বীয়চপলতাদোষে যদি আমার পত্নীর উপর বল প্রকাশ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমার পত্নী কি নিমিত্ত ব্যভিচারদোষে লিপ্ত হইবে? ফলতঃ এক্ষণে বোধ হইতেছে যে, এই বিষয়ে আমার পত্নী, আমি ও ইন্দ্র আমরা কেহই অপরাধী নহি। কেবল পত্নী প্রতিপালন-ধর্ম্মের ব্যতিক্রমই ইহাতে অপরাধী হইতেছে। মহর্ষিগণ কহিয়া থাকেন যে, ঈর্ষা হইতে ব্যসন উৎপন্ন হয়। আমি ঈর্ষাপ্রভাবেই স্ত্রীহত্যাজনিত পাপসাগরে নিপতিত হইলাম।

‘পত্নী ভর্ত্তৃদুঃখে দুঃখিতা হয় বলিয়া বাসিতা [গর্ভধারিণী জননীতুল্যা] এবং অবশ্য ভরণীয়া বলিয়া ভাৰ্য্যা শব্দে নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। আজ আমি সেই পতিব্রতা ভার্য্যাকে বিনাশ করিলাম। এক্ষণে কে আমাকে এই পাপ হইতে পরিত্রাণ করিবে? আমি উদারবুদ্ধি চিরকারীকে প্রমাদবশতঃই ভাৰ্য্যাবধে আদেশ করিয়াছি। যদি চিরকারী অদ্য আপনার নামানুরূপ কাৰ্য্য করে, তাহা হইলে সে নিঃসন্দেহেই আমাকে এই পাতক হইতে বিমুক্ত করিতে সমর্থ হইবে।

পত্নীর উদ্দেশে স্বগতবাক্যে গৌতমের বিলাপ

‘বৎস চিরকারি! তোমার মঙ্গল হউক; যদি তুমি অদ্য আপনার নামানুরূপ কাৰ্য্য করিয়া থাক, তাহা হইলেই তোমার নাম সার্থক। তুমি আজ আমাকে, তোমার জননীকে এবং মাতৃবধরূপ পাপ হইতে আপনাকে রক্ষা কর; আমি বহুকাল যে তপঃসঞ্চয় করিয়াছি, তাহার যেন কোন ব্যাঘাত না জন্মে। তুমি অদ্য যথার্থই চিরকারী হও। বুদ্ধির প্রাখৰ্য্যনিবন্ধন [তীক্ষ্ণতাহেতু—সূক্ষ্মবুদ্ধির জন্য] তুমি স্বভাবতঃই বহু বিলম্বে কাৰ্য্য করিয়া থাক, আজ যেন তাহার অন্যথা না হয়। আহা! তোমার জননী বহুদিন তোমাকে গর্ভে ধারণ ও তোমা হইতে কতই শুভ প্রত্যাশা করিয়াছিল। আজি তুমি আপনার দীর্ঘসূত্রিতা সফল করিয়া তাহার সেই শুভ প্রত্যাশা সফল কর। তুমি কোন কাৰ্য্যে আমার আদেশ প্রাপ্ত হইয়া সন্তাপভয়ে তাহার অনুষ্ঠানে বিলম্ব কর এবং কোন কার্য্যে নিবারণ করিলেও তাহা সংসাধন করা যুক্তিসিদ্ধ কি না, ইহা বিচার করিবার নিমিত্ত বিস্তর বিলম্ব করিয়া থাক; অতএব এক্ষণে আমাকে ও আমার পত্নীকে এই চিরসন্তাপ হইতে রক্ষা কর।

“মহর্ষি গৌতম দুঃখিতমনে এইরূপ নানাপ্রকার বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া গৃহে প্রত্যাগমনপূৰ্ব্বক দেখিলেন, আপনার আত্মজ চিরকারী বিষন্নমনে অবস্থান করিতেছেন। চিরকারী পিতা গৌতমকে প্রত্যাগত দেখিয়া শস্ত্র পরিত্যাগপূৰ্ব্বক দুঃখিতচিত্তে তাঁহাকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্ত তাঁহার চরণে নিপতিত হইলেন। গৌতম পুত্রকে প্রণত ও আপনার পত্নীকে লজ্জায় পাষাণভূত [প্রস্তরবৎ নিশ্চেষ্ট] দেখিয়া সাতিশয় সন্তোষলাভ করিলেন। তৎকালে সেই মহাত্মার চিত্তবৃত্তি স্ত্রী-পুত্রের প্রতি কিছুমাত্র বিকৃত হইল না। মাতৃবধপরাঙ্মুখ শস্ত্রপাণি পদাবনত চিরকারীও বিনীতস্বভাব নিবন্ধন পিতার কঠিন আজ্ঞা বিস্মৃতপ্রায় হইলেন। তখন পিতা গৌতমও পুত্রকে আপনার চরণে নিপতিত দেখিয়া বিবেচনা করিলেন, চিরকারী ভয়প্রভাবে শস্ত্রগ্রহণচাপল্য সংবরণ করিতেছে।

“অনন্তর তিনি চিরকারীর মস্তকাঘ্রাণ ও তাঁহাকে গাঢ় আলিঙ্গনপূৰ্ব্বক তাঁহার এই কার্য্যের সবিশেষ প্রশংসা করিয়া প্রীতি প্রফুল্লচিত্তে কহিলেন, ‘বৎস! তোমার মঙ্গল হউক, তুমি চিরজীবি হও। তুমি আমার আজ্ঞা-প্রতিপালনে বিলম্ব করিয়া আমার যথেষ্ট উপকার করিয়াছ। তুমি আমার আজ্ঞা লঙ্ঘন করাতে আমি তদ্বিষয়ে কিছুমাত্র দুঃখিত হইতেছি না।’

বহু বিচারপূৰ্ব্বক কাৰ্য্য করার সাফল্য

“মহাত্মা গৌতম এই কথা বলিয়া সুধীর চিরকারীদিগের উদ্দেশে এই উপদেশ প্রদান করিতে লাগিলেন, ‘মিত্রবধ ও কার্য্যপরিত্যাগ সবিশেষ বিবেচনা করিয়াই করা কর্ত্তব্য। অনেক দিন বিবেচনার পর যে মিত্রতা স্থাপিত হয়, তাহা বহুকাল স্থায়ী হইয়া থাকে। ক্রোধ, দর্প, অভিমান, অনিষ্টচিন্তা, অপ্রিয়ানুষ্ঠান ও পাপাচরণবিষয়ে বহুকাল বিলম্ব করাই বিধেয়। লোকে ভৃত্য ও স্ত্রীলোকের অপরাধ অস্পষ্টরূপে অবগত হইলে তাহাদের দণ্ডবিধান করিবার নিমিত্ত বহুক্ষণ বিচার করিবে।’

“হে যুধিষ্ঠির! মহর্ষি গৌতম স্বীয় পুত্র চিরকারীর এইরূপ চিরকারিতা-দর্শনে সাতিশয় সন্তোষলাভ করিয়াছিলেন। অতএব কোন কাৰ্য্য উপস্থিত হইলে বহুকাল বিবেচনা করিয়া তাহার অনুষ্ঠান করাই কৰ্ত্তব্য। যে ব্যক্তি বহুকাল ক্রোধ সংবরণ ও বহু বিলম্বে কাৰ্য্যানুষ্ঠান করে, তাহাকে পরিশেষে আর সন্তাপসাগরে নিমগ্ন হইতে হয় না। বহুকাল বৃদ্ধবর্গের সহবাস করিবে। দেবতাকে বহুকাল ধ্যান করিয়া পূজা করা কর্ত্তব্য। বহুক্ষণ কাৰ্য্যানুষ্ঠান ও ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিবে। বহুকাল পণ্ডিতমণ্ডলীর উপাসনা, শিষ্ট ব্যক্তিদিগের সেবা ও আত্মার একাগ্রতাসম্পাদন করিলে মনুষ্য সকলের সমাদরভাজন হইতে পারে। যিনি সকলকে ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করিয়া থাকেন, তিনি কোন বিষয় জিজ্ঞাসা করিলে সবিশেষ বিবেচনা করিয়া তাহার প্রত্যুত্তর প্রদান করা কৰ্ত্তব্য; তাহা হইলে আর পশ্চাত্তাপে সন্তপ্ত হইতে হয় না। হে ধৰ্ম্মরাজ! মহাতপাঃ মহর্ষি গৌতম সেই আশ্রমে বহুকাল অতিক্রম করিয়া পুত্ৰসমভিব্যাহারে দেবলোকে গমন করিয়াছিলেন।”