২৬২তম অধ্যায়
তুলাধারকর্ত্তৃক বিবিধ ধৰ্ম্মব্যাখ্যা
ভীষ্ম কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! মহাত্মা তুলাধার এই কথা কহিলে জাপকাগ্রগণ্য মহামতি জাজলি তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে বণিক্পুত্র! তুমি রস, গন্ধ, বৃক্ষ, ওষধি ও ফলমূলসমুদয় বিক্রয় করিয়াও কিরূপে এরূপ নিশ্চলবুদ্ধি ও জ্ঞানলাভ করিলে, তাহা আমার নিকট সবিস্তর কীৰ্ত্তন কর।
“তখন ধর্ম্মার্থতত্ত্বজ্ঞ বৈশ্যকুলোদ্ভব জ্ঞানতৃপ্ত মহাত্মা তুলাধার তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘জাজলে! আমি সৰ্ব্বভূতহিতকর পূর্ব্বতন সনাতন ধর্ম্ম পরিজ্ঞাত হইয়াছি। প্রাণীগণের প্রতি অহিংসা অথবা বিপদ্কালে অল্পমাত্ৰ হিংসাদ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করাই প্রধান ধৰ্ম্ম। আমি তদনুসারে কেবল পরিচ্ছন্ন [সীমাবদ্ধ কতকগুলি নির্দ্দিষ্ট দ্রব্য] কাষ্ঠ ও তৃণাদির ব্যবসায় অবলম্বনপূর্ব্বক জীবনযাপন করিতেছি। অলক্ত [আলতা], পদ্মককাষ্ঠ [সুগন্ধি কাষ্ঠ], তুঙ্গকাষ্ঠ [সুগন্ধি কাষ্ঠ], কস্তুরী প্রভৃতি বিবিধ গন্ধদ্রব্য এবং সুরা ব্যতীত বিবিধ রসের অকপটে ক্রয়বিক্রয়দ্বারা আমার জীবিকা নির্ব্বাহ হইতেছে।
‘যে ব্যক্তি সকলের সুহৃদ এবং যিনি কায়মনোবাক্যে সকলের হিতানুষ্ঠান করিয়া থাকেন, তিনিই যথার্থ ধর্ম্মতত্ত্বজ্ঞ। অনুরোধ, বিরোধ, দ্বেষ ও কামনা পরিত্যাগ এবং সৰ্ব্বভূতে সমভাবে দৃষ্টিপাত এই সমুদয়ই আমার প্রধান নিয়ম। আকাশমণ্ডল যেমন মেঘাদিসহযোগে বিবিধাকার ধারণ করে, তদ্রূপ একমাত্র জগদীশ্বর সৰ্ব্বজীবে অধিষ্ঠিত হইয়া বিবিধ বেশ ধারণ করিতেছেন। আমি এই বিবেচনা করিয়া অন্যের কাৰ্য্যদর্শনে প্রশংসা বা নিন্দা করি না। আমি সমুদয় লোককে সমান বলিয়া জ্ঞান করি। লোষ্ট্র ও কাঞ্চনে আমার বিশেষ জ্ঞান নাই। আমি অন্ধ, বধির ও উন্মত্তের ন্যায় বিষয়ভোগরহিত হইয়া কালযাপন করিতেছি। বৃদ্ধ, আতুর ও কৃশ ব্যক্তিদিগের ন্যায় আমারও অর্থ, কাম ও ভোগবিষয়ে কিছুমাত্র স্পৃহা নাই। লোক যখন স্বয়ং কাম, বিদ্বেষ ও ভয় পরিত্যাগ করে; অন্যকে ভয়-প্রদর্শন না করে, কায়মনোবাক্যে কোন জীবের প্রতি পাপাচরণে প্রবৃত্ত না হয়, তখনই তাহার ব্রহ্মপদলাভ হইয়া থাকে। অভয়দানের তুল্য পরমধৰ্ম্ম আর নাই। যে ব্যক্তি নিতান্ত ক্রূরভাষী ও কঠিন দণ্ডকারী এবং লোকে মৃত্যুমুখের ন্যায় যাহা হইতে ভীত হয়, সেই ব্যক্তি নিঃসন্দেহে মহাভয় প্রাপ্ত হইয়া থাকে। আমি পুত্রপৌত্রসমন্বিত হিংসাবিহীন মহাত্মা বৃদ্ধগণের ব্যবহার অবলম্বন করিয়া আছি। মূঢ়েরা সদাচারের কিয়দংশ বিরুদ্ধ দেখিয়া সমুদয় সনাতন ধর্ম্ম পরিত্যাগ করে; কিন্তু বিদ্বান্ জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা সদাচারের বিরুদ্ধাংশ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক উহার অনুষ্ঠানদ্বারা সংসার হইতে মুক্তিলাভ করিয়া থাকেন। এইরূপে যে ব্যক্তি দমগুণ অবলম্বন ও দ্রোহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সাধুজনচরিত আচার আশ্রয় করে, তাহারই অচিরাৎ ধর্ম্মলাভ হয়। যেমন নদীবেগসহকারে কাষ্ঠদ্বয়ের পরস্পর সংযোগ ও বিচ্ছেদ হয়, তদ্রূপ কৰ্ম্মপ্রবাহদ্বারা পিতাপুত্রাদির পরস্পর সংযোগ ও বিয়োগ হইয়া থাকে।
অভয়দানের শ্রেষ্ঠতা—অহিংসার প্রশংসা
‘যে মহাত্মা কখন কোন প্রাণীকে ভয়-প্রদর্শন না করেন, তিনিই সৰ্ব্বদা সমুদয় প্রাণী হইতে অভয় লাভ করিতে সমর্থ হয়েন। লোক্সমুদয় ভীষণ গর্জ্জনশীল বৃকের ন্যায় যে ব্যক্তি হইতে ভীত হয়, সেই ব্যক্তি সমুদয় লোক হইতে ভয় প্রাপ্ত হইয়া থাকে। যাঁহারা এই অভয়দানরূপ আচার প্রতিপালন করেন, তাঁহারা সহায়সম্পন্ন, উৎকৃষ্ট ভোগশালী ও সৌভাগ্যযুক্ত হইয়া শ্রেষ্ঠতা লাভ করিতে পারেন; পণ্ডিতেরা শাস্ত্রে তাঁহাদিগকেই প্রধান বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। যাহাদিগের হৃদয়ে অল্পমাত্ৰ ধৰ্ম্মপ্রবৃত্তি নিহিত আছে, তাহারা কীৰ্ত্তিলাভের নিমিত্ত অভয়দানরূপ ধৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করে, আর যেসকল ব্যক্তি ধৰ্ম্মবিষয়ে সমধিক পারদর্শী, তাঁহারা ব্ৰহ্মলাভের নিমিত্তই লোকদিগকে অভয়দান করিয়া থাকেন। তপস্যা, যজ্ঞ, দান ও জ্ঞানোপদেশদ্বারা যে ফল লাভ করা যায় একমাত্র অভয়দানদ্বারা সেই ফললাভ হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি সমুদয় প্রাণীকে অভয়দান করে, সেই ব্যক্তির সমুদয় যজ্ঞের ফল ও অভয় লাভ হয়, সন্দেহ নাই। ফলতঃ অহিংসা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ধৰ্ম্ম আর কিছুই নাই। যাহা হইতে কোন প্রাণী কখন ভীত না হয়, কোন প্রাণী হইতেও তাহার কখন কোন ভয়ের সম্ভাবনা নাই; আর লোকসমুদয় গৃহগত সর্পের ন্যায় যাহার ভয়ে সতত উদ্বেগযুক্ত হয়, সেই ব্যক্তি কি ইহলোকে, কি পরলোকে, কুত্রাপি ধর্ম্মলাভ করিতে সমর্থ হয় না। যে ব্যক্তি সৰ্ব্বভূতের আত্মস্বরূপ হইয়া সমুদয় প্রাণীকে আপনার ন্যায় দর্শন করেন, দেবগণও তাঁহার সৰ্ব্বলোকাতিগ [লোকাতিশায়ী গতি অলৌকিক গতি] পদ অন্বেষণ করিয়া বিমোহিত হইয়া থাকেন।
‘অভয়দান সমুদয় দান অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সন্দেহ নাই। কাম্যকৰ্ম্মানুষ্ঠানপরায়ণ ব্যক্তিরা একবার সৌভাগ্যশালী হইয়া কৰ্ম্মফলের ক্ষয়নিবন্ধন পুনরায় দুর্ভাগ্যযুক্ত হয়, এই নিমিত্ত জ্ঞানবান্ ব্যক্তিরা সর্ব্বদা বিনশ্বর কাম্য-কর্ম্মের নিন্দা করিয়া থাকেন। ধৰ্ম্ম অতি সুক্ষ্ম পদার্থ। কোন ধৰ্ম্মই কারণশূন্য নহে। বেদশাস্ত্রে ব্রহ্মলাভজনক ও স্বর্গাদিপ্রাপ্তিসাধন এই উভয়বিধ ধৰ্ম্মই নির্দ্দিষ্ট আছে। তন্মধ্যে স্বর্গাদিপ্রাপক ধৰ্ম্ম স্থূল এবং ব্রহ্মপ্রাপক অভয়দানরূপ ধৰ্ম্ম সূক্ষ্ম। সূক্ষ্মধৰ্ম্ম নিতান্ত গূঢ় বলিয়া অনেকে তাহা পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হয় না। কেহ কেহ সাধুদিগের আচার দর্শন করিয়া ঐ ধৰ্ম্ম জ্ঞাত হইয়া থাকেন। যাহারা গোসমূহের – মুষ্কমোষণ [বিচি ছাড়াইয়া বলদ বানান] ও নাসিকাভেদ [নাসিকায় ছিদ্র করিয়া দড়ি পরান] করিয়া তাহাদিগকে গুরুভারে নিপীড়িত, বদ্ধ ও দমিত করে, যাহারা বিবিধ প্রাণীর প্রাণসংহারপূর্ব্বক তাহাদিগের মাংসভক্ষণে প্রবৃত্ত হয়, যাহারা ভৃত্যগণদ্বারা কাৰ্য্যসম্পাদনপূৰ্ব্বক স্বয়ং সুখসম্ভোগ করিয়া থাকে এবং যাহারা স্বয়ং বধবন্ধনিরোধজনিত [বধার্থ বন্ধনাদিদ্বারা আবদ্ধ করার জন্য] দুঃখ পরিজ্ঞাত হইয়াও দিবানিশি অন্যকে সেই দুঃখে দুঃখিত করে, তুমি তাহাদিগের নিন্দা না করিয়া আমাকে কি নিমিত্ত নিন্দনীয় জ্ঞান করিতেছ? পঞ্চেন্দ্রিয়সংযুক্ত প্রাণীমাত্রেই সূৰ্য্য, চন্দ্র, বায়ু, ব্রহ্মা, প্রাণ, বিষ্ণু ও যম প্রভৃতি দেবগণ বাস করিতেছেন; অতএব যাহারা প্রাণীগণের বিক্রয়দ্বারা জীবিকানির্ব্বাহ করিয়া দেহত্যাগ করে, তোমার মতে কি তাহারা নিন্দনীয় নহে? ছাগে অগ্নি, মেষে বরুণ, অশ্বে সূৰ্য্য, পৃথিবীতে বিরাট এবং ধেনু ও বৎসে চন্দ্র অবস্থান করিতেছেন, অতএব যে ব্যক্তি এই সমুদয় বিক্রয় করে, তাহার কখনই সিদ্ধিলাভ হয় না; কিন্তু তৈল, ঘৃত, মধু ও ঔষধসমুদয়ের বিক্রয়দ্বারা কোন পাপস্পর্শের সম্ভাবনা নাই।
‘মানবগণ দংশমশকবিহীন দেশে অবস্থিত সুখসংবর্দ্ধিত পশুদিগকে মাতার প্রিয় বুঝিতে পারিয়াও কৃষাদিকাৰ্য্যসাধনের নিমিত্ত বিধিরূপে আক্রমণপূৰ্ব্বক বহুদংশসমাকুল কর্দ্দমাকীর্ণ দেশে সমানীত এবং গোসমূহ ভারবহনে অনুপযুক্ত হইলেও তাহাদিগকে গুরুতরভাবে নিপীড়িত করে। আমার মতে ঐ সমুদয় কার্য্য ভ্রূণহত্যা অপেক্ষাও গর্হিত। অনেকে কৃষিকার্য্যের যথেষ্ট প্রশংসা করিয়া থাকেন; কিন্তু বস্তুতঃ উহা অতিশয় নিন্দনীয়। দেখ, লাঙ্গলদ্বারা ভূমি বিদারণ করিলে অসংখ্য প্রাণী বিনষ্ট ও লাঙ্গলসংযোজিত বৃষসমুদয় নিতান্ত নিপীড়িত হয়। গোসমুদয় অঘ্ন[প্রহারাদিদ্বারা পীড়নের অযোগ্য]নামে বিখ্যাত আছে। অতএব তাহাদিগকে বিনষ্ট বা নিপীড়িত করা কাহারও কর্ত্তব্য নহে। যে ব্যক্তি বৃষ অথবা গাভীর হিংসা করে, তাহাকে মহৎ পাপে লিপ্ত হইতে হয়।
‘পূৰ্ব্বে মহারাজ নহুষ মধুপর্কদানসময়ে গোবধ করাতে মহাত্মা তত্ত্বদর্শী ঋষিগণ তাঁহাকে কহিয়াছিলেন—মহারাজ! তুমি মাতৃতুল্য গাভী ও প্রজাপতিতুল্য বৃষকে বিনষ্ট করিয়া যারপরনাই গর্হিত কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছ; অতএব তোমার যজ্ঞে হোম করিতে আমাদিগের প্রবৃত্তি নাই। তোমার নিমিত্ত আমরা অতিশয় ব্যথিত হইলাম। তপোধনেরা রাজা নহুষকে এই কথা কহিয়া তিরস্কার করিতে লাগিলেন, কিন্তু কিয়ৎক্ষণ পরে তপোবলে বুঝিতে পারিলেন যে, নহুষ জ্ঞানপূৰ্ব্বক ঐ পাপের অনুষ্ঠান করেন নাই। তখন তাঁহারা সেই নহুষকৃত পাপকে একাধিকশতসংখ্যক ব্যাধিরূপে বিভক্ত করিয়া সমুদয় প্রাণীর উপর নিক্ষেপপূৰ্ব্বক তাঁহাকে কহিলেন—মহারাজ! তোমার এই গোবধজনিত পাপ অজ্ঞানকৃত হইয়াও সৰ্ব্বলোকের অপকারক হইল। হে জাজলে! তুমি কেবল পূর্ব্বের আচারমাত্র দর্শন করিয়া কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান কর; কিন্তু এইরূপ আচরণ যে নিতান্ত অশুভাবহ, তাহা কখনই তোমার বোধগম্য হয় না; অতএব যে কাৰ্য্যদ্বারা সমুদয় জীবের অভয়লাভ হয়, তাহাই ধৰ্ম্ম বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। কেবল লোকাচার কখনই ধৰ্ম্ম হইতে পারে না। যে ব্যক্তি আমার হিংসা করে, যে আমার প্রশংসা করিয়া থাকে, আমি তাহাদের উভয়কেই সমান জ্ঞান করিয়া থাকি। কেহই আমার প্রিয় বা অপ্রিয় নহে। পণ্ডিতেরা এইরূপে ধৰ্ম্মের প্রশংসা করিয়া থাকেন এবং ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মারা প্রতিনিয়ত এই যুক্তিসম্পন্ন যযাগিগণসেবিত পরমধর্ম্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়েন।”