গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

২৫. স্রোতের ফুল

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ – স্রোতের ফুল

কুহু ও বজ্র যখন স্নানঘাটে আসিল তখন দিনের চিতা নিভিয়া গিয়াছে, আকাশ হইতে যেন সেই চিতার ধূসর ভস্ম নদীর জলে ঝরিয়া পড়িতেছে। যে দশজন যোদ্ধাকে বজ্র ঘাট রক্ষার জন্য পাঠাইয়াছিল তাহারা তখনও ঘাটের স্থানে স্থানে দাঁড়াইয়া শত্রুর প্রতীক্ষা করিতেছিল। শত্রু কিন্তু আসে নাই। হয়তো এদিক দিয়া আক্রমণের কথা জয়নাগ চিন্তা করেন নাই, কিম্বা নৌকা সংগ্রহ করিতে পারেন নাই। পরিপূর্ণ প্রস্তুতির পূর্বেই আক্রমণ করিতে হইয়াছে বলিয়া এই অবস্থা।

বজ্র যোদ্ধাদের বিদায় দিল। তারপর দুইজনে ঘাটের কোণের দিকে গেল। স্তম্ভের ছায়াতলে ডিঙি বাঁধা আছে, দড়ি খুলিয়া উভয়ে আরোহণ করিল।

কুহু বলিল, ‘কিন্তু কোথায় যাব তা তো জানি না।’

বজ্র বলিল, ‘আমি জানি। দাঁড় আমায় দাও।’

দাঁড়ের টানে ডিঙি স্রোতের মুখে পড়িল, তারপর স্রোতের টানে সঙ্গমের দিকে ভাসিয়া চলিল।

বজ্র শিরস্ত্রাণ খুলিয়া জলে ফেলিয়া দিল, বুক হইতে সাঁজোয়া খুলিয়া নদীতে বিসর্জন দিল। তরবারিও সেই পথে গেল। সে গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল— ‘বাঁচলাম।’

দুইজন ডিঙির দুই প্রান্তে বসিয়া আছে, অস্পষ্টভাবে পরস্পর দেখিতে পাইতেছে। কুহু জিজ্ঞাসা করিল— ‘তোমার দুঃখ হচ্ছে না?’

বজ্র বলিল— ‘না। তোমার হচ্ছে নাকি?’

কুহু বলিল— ‘কি জানি। আমরা যে বেঁচে আছি এই আশ্চর্য মনে হচ্ছে।’

বজ্র বলিল— ‘আমার আশ্চর্য মনে হচ্ছে এতদিন নিজেকে চিনতে পারিনি। কিন্তু এবার পেরেছি। আমি শশাঙ্কদেবের পৌত্র, মানবদেবের পুত্র বটে, কিন্তু আমার প্রকৃত পরিচয়— আমি মধুমথন।’

ডিঙি দুই নদীর সঙ্গমস্থলে আসিয়া পড়িল। কিছুক্ষণ জলের প্রবল কল্লোলধ্বনি হইল, ডিঙি টলমল করিয়া দুলিতে লাগিল; তারপর ভাগীরথীর প্রবলতর স্রোতের মধ্যে গিয়া পড়িল। বজ্র তখন দুই হাতে বৈঠা লইয়া উজান টানিয়া চলিল।

আকাশে তারা ফুটিয়াছে; অন্ধকারে চক্ষু অভ্যস্ত হইলে অল্প দেখা যায়, পশ্চিমের তীর নিকটে। ডিঙি আলোকহীন রাজপুরীর প্রাকাররেখা ছাড়াইয়া চলিল। গতি কিন্তু অতি মন্দ; দাঁড়ের জোরে যেমন দুই হাত আগে যাইতেছে, স্রোতের টানে তেমনি এক হাত পিছাইতেছে।

কুহু জিজ্ঞাসা করিল— ‘কোথায় যাচ্ছ?’

দাঁড় টানিতে টানিতে বজ্র বলিল— ‘রাঙামাটির মঠে। সেখানে আমার একজন বন্ধু আছেন, হয়তো দেখা পাব। তারপর গ্রামে ফিরে যাব।

অনেকক্ষণ কথা হইল না। অন্ধকারে কেবল ছপ্‌ছপ্‌ দাঁড়ের শব্দ।

সহসা কুহু বলিল— ‘আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাবে?’ বলিয়াই অন্ধকারে জিভ কাটিল।

বজ্রের নিকট হইতে উত্তর আসিল না। কিছুক্ষণ কাটিয়া গেল; তারপর বজ্র কথা বলিতে আরম্ভ করিল। কুহুর প্রশ্নের উত্তর দিল না; মৌরীতীরের ক্ষুদ্র গ্রামটির কথা, মায়ের কথা, গুঞ্জার কথা, চাতক ঠাকুরের কথা বলিতে লাগিল। যেন কাহাকেও শুনাইবার জন্য বলিতেছে না, আপন মনে বলিয়া চলিয়াছে। জলের কলধ্বনির মধ্যে কুহু কান পাতিয়া শুনিল।

রাত্রি দ্বিপ্রহরে তাহারা রাঙামাটির মঠের ঘাটে পৌঁছিল। বিস্তৃত ঘাটের পাশে বিপুলকায় চৈত্য আকাশে মাথা তুলিয়া আছে, চিনিয়া লইতে কষ্ট হইল না।

ঘাটে জনমানব নাই, সংঘ সুপ্ত। বজ্র ডিঙি ঘাটের পৈঠার উপর টানিয়া তুলিয়া রাখিল, যাহাতে স্রোতে ভাসিয়া না যায়। তারপর দুইজনে শুষ্ক সোপানের উপর পাশাপাশি বসিল। সংঘের কাহাকেও এখন জাগানো চলিবে না, নিশাবসান পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হইবে।

কুহু বলিল— ‘মধুমথন।’

‘কী?’

‘তুমি চলে যাবে, তারপর আমি কি করব, কোথায় যাব বলে দাও।’

স্নেহে ও করুণায় বজ্রের বুক ভরিয়া উঠিল, সে বাহু দিয়া কুহুর পৃষ্ঠ জড়াইয়া লইয়া বলিল— ‘চল, কুহু, তুমি আমার সঙ্গে গ্রামে চল।’

কুহু ধীরে ধীরে বলিল— ‘না, আমি ভুল বলেছিলাম। তোমার সঙ্গে গ্রামে গেলে তোমার জীবনে অনেক দুঃখ অশান্তি আসবে, তাতে কাজ নেই। — কিন্তু একদিন আমি যাব তোমার কাছে। যখন আমার আর যৌবন থাকবে না, তখন যাব। ততদিন আমাকে মনে থাকবে?’

বজ্র গাঢ় স্বরে বলিল— ‘থাকবে। আমি যাদের ভালবাসি তাদের ভুলি না।’

কুহু নিঃশব্দে কাঁদিতে লাগিল, কিন্তু বজ্র তাহার অশ্রু দেখিতে পাইল না।

ক্রমে দীর্ঘ রাত্রি শেষ হইয়া আসিল। গঙ্গার বুক-ছোঁয়া ঠাণ্ডা বাতাস বহিতে আরম্ভ করিয়াছে, পূর্বাকাশে যেন একটু লালিমার স্বপ্ন। সংঘের ভিতর নিদ্রোত্থিত মানুষের ক্ষীণ সাড়া পাওয়া যাইতেছে।

দুইজনে উঠিয়া দাঁড়াইল। বজ্র বলিল— ‘কুহু, এবার তোমায় যেতে হবে। ডিঙি ভাসিয়ে একেবারে গঙ্গার আয়ির ঘাটে যেও, সেখানে কিছুদিন লুকিয়ে থেকো। তারপর— অদৃষ্ট যেদিকে নিয়ে যায়।’

কুহু বলিল— ‘সেই ভাল। আমার তো আর কেউ নেই যার কাছে যাব।’

বজ্র বাহু হইতে অঙ্গদ খুলিয়া কুহুকে দিল, বলিল— ‘এটা রাখো। দেখলে আমাকে মনে পড়বে।’

কুহু অঙ্গদটি আঁচলে বাঁধিল। আলো ফুটিতেছে, দু’জনে অনচ্ছভাবে পরস্পর মুখ দেখিতে পাইতেছে। কুহু জলভরা চোখ তুলিয়া বলিল— ‘শুধু অঙ্গদ দেখলে তোমাকে মনে পড়বে? না হলে পড়বে না?’

বজ্র কুহুকে দুই বাহু দিয়া বুকের কাছে তুলিয়া লইল, তাহার অধরে চক্ষে ললাটে চুম্বন করিয়া নামাইয়া দিল।

কুহু কিছুক্ষণ বজ্রের বুকে মুখ রাখিয়া কাঁদিল, তারপর ডিঙিতে গিয়া উঠিল। ডিঙি স্রোতের মুখে ভাসিয়া গেল।

মণিপদ্ম বজ্রকে ঘাটে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া চমৎকৃত হইয়া গেল।

‘আপনি ফিরে এসেছেন!’

মণিপদ্ম বজ্রের হাত ধরিয়া নিজ প্রকোষ্ঠে লইয়া গেল; তাহাকে আহার্য দিল। বজ্র বলিল— ‘কানসোনায় টিকতে পারলাম না, পালিয়ে এলাম।’

মণিপদ্ম বিমনাভাবে বলিল— ‘হ্যাঁ, আমরাও শুনেছি কি যেন গোলমাল হয়েছে।’ তারপর উৎফুল্ল নেত্রে চাহিয়া বলিল— ‘আর্য শীলভদ্র কাল সমতট থেকে ফিরে এসেছেন। এবার আমরা নালন্দা যাব।’

‘কবে?’

‘তা জানি না। আর্য শীলভদ্র জানেন।’

বজ্র তাড়াতাড়ি আহার শেষ করিয়া বলিল— ‘ভাই, তাঁর সঙ্গে আমার একবার দেখা করিয়ে দাও। তাঁকে কিছু বলবার আছে।’

মণিপদ্ম বজ্রকে শীলভদ্রের নিকট লইয়া গেল। শীলভদ্র পূর্বের ন্যায় গন্ধকুটির কোণের প্রকোষ্ঠে অবস্থান করিতেছিলেন। বজ্র প্রণাম করিয়া তাঁহার সম্মুখে উপবিষ্ট হইলে শীলভদ্র তাহার মুখ ক্ষণেক অভিনিবেশ সহকারে নিরীক্ষণ করিলেন, তারপর বলিলেন— ‘কর্ণসুবর্ণের সংবাদ কিছু কিছু পেয়েছি। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভুক্তিভোগী। সব কথা বল।’

বজ্র সকল কথা বলিল। শুনিয়া শীলভদ্র দীর্ঘকাল নীরব রহিলেন, শেষে হাত নাড়িয়া যেন এ প্রসঙ্গ মন হইতে সরাইয়া দিয়া বলিলেন— ‘বুদ্ধের ইচ্ছা। — এখন কি করবে স্থির করেছ?’

বজ্র বলিল— ‘আপনার কি উপদেশ?’

শীলভদ্র বলিলেন— ‘আমি আগে যা বলেছিলাম এখনও তাই বলি। গ্রামে ফিরে যাও। আর তোমার নাম যে বজ্রদেব তা ভুলে যাও।’

বজ্র নীরবে চাহিয়া রহিল। শীলভদ্র বলিলেন— ‘কিন্তু পথঘাট এখন তোমার পক্ষে নিরাপদ নয়। রাজা হবার পর তোমাকে সকলেই দেখেছে, সকলেই চিনতে পারবে। এ পথ দিয়ে ক্রমাগত সৈন্য যাতায়াত করছে, তারা সব জয়নাগের সৈন্য।’ একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন— ‘কিন্তু তুমি এক কাজ করতে পার। কাল প্রভাতে আমি নালন্দা যাত্রা করব, আমার সঙ্গে কয়েকজন ভিক্ষু থাকবেন। তুমি যদি আমাদের সঙ্গে থাকো তাহলে ধরা পড়বার সম্ভাবনা কম।’

শীলভদ্রকে নিজের কাহিনী শুনাইতে শুনাইতে বজ্রের মন ক্লান্তি ও বিতৃষ্ণায় ভরিয়া উঠিয়াছিল। তাহার মনে হইল, আর কাজ নাই সংসারে ফিরিয়া গিয়া। এই মহাপুরুষের সঙ্গে জ্ঞানের মহাতীর্থে চলিয়া যাই, বুদ্ধের শরণ লই। তিনি আমাকে শান্তি দিবেন। মণিপদ্ম যে আনন্দের স্বাদ পাইয়াছে আমিও সেই আনন্দের স্বাদ পাইব।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাহার মনে পড়িল নিজ গ্রামের কথা। চোখের উপর ভাসিয়া উঠিল চিরপ্রতীক্ষমানা মায়ের মুখ। অর্ধেক জীবন যাহার নিষ্ফল প্রতীক্ষায় কাটিয়াছে বাকি অর্ধেক জীবনও তাহার তেমনিভাবে কাটিবে! স্বামীহারা অভাগিনী পুত্রকেও ফিরিয়া পাইবে না? আর গুঞ্জা! গুঞ্জা দিনের পর দিন ন্যগ্রোধ বৃক্ষের তলে দাঁড়াইয়া তাহার পথ চাহিয়া থাকিবে—

বজ্র মস্তক নত করিয়া বলিল— ‘যে আজ্ঞা। আমি আপনার সঙ্গে যতদূর সম্ভব যাব, তারপর গ্রামের পথ ধরব।’

সেদিন বজ্র সংঘের একটি প্রকোষ্ঠে রহিল।

সারাদিন সংঘের সম্মুখস্থ পথ দিয়া দলবদ্ধ সৈন্যগণের যাতায়াত। পদাতি গজ অশ্ব, অধিকাংশই কর্ণসুবর্ণের দিকে যাইতেছে। সমবেত পদধ্বনির গমগম শব্দ, হস্তীর গলঘণ্টা, চিৎকার কোলাহল। সংঘে কিন্তু কেহ প্রবেশ করিল না, কোনও উৎপাত করিল না।

বজ্র নিজ প্রকোষ্ঠে বসিয়া এই সকল শব্দ শুনিতে শুনিতে ভাবিতে লাগিল— জয়নাগ প্রাসাদ অধিকার করিয়াছেন, নগর তাঁহার করায়ত্ত হইয়াছে। নগরের উপর অধিকার দৃঢ় করিবার জন্য তিনি আরও সৈন্য আনিতেছেন। হয়তো যুদ্ধ বাধিবে। যে সকল সেনাপতি দণ্ডভুক্তির সীমানা রক্ষা করিতেছে তাহারা রাজধানী পতনের সংবাদ পাইয়া ফিরিয়া আসিবে—

বজ্রের জল্পনা সর্বৈব মিথ্যা নয়, কিন্তু তাহার পক্ষে যাহা অনুমান করা সম্ভব নয় এরূপ অনেক ঘটনাও ঘটিতেছিল।

দণ্ডভুক্তি-অবরোধকারী সেনাপতিদের নিকট রাজধানী পতনের সংবাদ পৌঁছিয়াছিল। তাঁহারা প্রথমে হতবুদ্ধি হইয়া রহিলেন; তারপর তাঁহাদের মধ্যে তুমুল বিতণ্ডা আরম্ভ হইল। কেহ বলিলেন, জয়নাগ যখন কর্ণসুবর্ণে গিয়াছে তখন দণ্ডভুক্তি আক্রমণ করিব। কেহ বলিলেন, কর্ণসুবর্ণে ফিরিয়া গিয়া যুদ্ধ দিব। কেহ বলিলেন, রাজাই নাই, কাহার জন্য যুদ্ধ করিব? মতভেদ বাড়িয়াই চলিল। ইতিমধ্যে, দণ্ডভুক্তিতে জয়নাগের যে সৈন্য ছিল তাহারা তীব্রবেগে আক্রমণ করিল। একতাহীন হতোৎসাহ সেনাপতিগণ নিজ নিজ সৈন্য লইয়া ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িলেন। কিন্তু তাঁহাদের ফিরিবার স্থান নাই, উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যগণকে শাসন করিবার শক্তি নাই, তাহাদের বেতন দিবার সামর্থ্য নাই। সৈন্যগণ এরূপ অবস্থায় যাহা করে তাহাই করিল, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হইয়া নিজের দেশ লুণ্ঠন করিয়া বেড়াইতে লাগিল। সমগ্র দেশে গ্রামে গ্রামে আগুন জ্বলিয়া উঠিল।

চতুর জয়নাগ আগুন নিভাইবার চেষ্টা করিলেন না, ইহাতে তাঁহার ইষ্ট বই অনিষ্ট নাই। তিনি জানিতেন সৈন্যগণের এই উচ্ছৃঙ্খলতা একদিন শান্ত হইবে। এখন তাহাদের আশ্রয় নাই, একদিন তাহাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন হইবে। তখন তাহারা নূতন রাজার পতাকাতলে আসিয়া আশ্রয় ভিক্ষা করিবে। নূতন রাজার রাজ্যের ভিত্তি দৃঢ় হইবে।