২৫তম অধ্যায় – শকুনির পুনঃ যুদ্ধায়োজন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! পাণ্ডবগণের শরে কৌরব সৈন্য নিহত ও সমরকোলাহল স্থগিত হইলে গান্ধাররাজতনয় শকুনি হতাবশিষ্ট সাত শত অশ্ব লইয়া সংগ্রামে আগমনপূর্ব্বক সৈন্যগণকে যুদ্ধ করিতে অনুমতি করিয়া ক্ষত্রিয়দিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হে বীরগণ! মহারাজ দুর্য্যোধন এক্ষণে কোন স্থানে অবস্থান করিতেছেন?” তখন ক্ষত্রিয়গণ কহিলেন ‘হে সুবলনন্দন! ঐ যে স্থানে পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় প্রভাসম্পন্ন সুন্দর আতপত্র বিরাজিত রহিয়াছে, যে স্থানে বর্ম্মধারী রথীগণ অবস্থান করিতেছেন এবং যে স্থানে মেঘগর্জনের ন্যায় তুমুল শব্দ হইতেছে, আপনি ঐ স্থানে গমন করুন, মহারাজ দুর্য্যোধনকে দেখিতে পাইবেন। মহাবীর শকুনি যোধগণ কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া বিচিত্র যুদ্ধনিপুণ বীরগণে পরিবেষ্টিত রাজা দুর্য্যোধনের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে আত্মপক্ষীয় রথীগণে পরিবৃত দেখিয়া আপনাকে কৃতকাৰ্য্য বোধ করিয়া রথীদিগকে আনন্দিত করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, মহারাজ! আমি সমুদয় অশ্বারোহী জয় করিয়াছি, তুমি রথীদিগকে পরাজয় কর। এক্ষণে পাণ্ডবগণের রথীগণ নিহত হইলে আমরা অনায়াসে পাণ্ডবগণের সমুদয় গজসৈন্য ও পদাতির প্রাণ সংহার করিতে পারিব।
হে মহারাজ! তখন আপনার পক্ষীয় বিজয়াকাঙ্খী বীরগণ সুসজ্জিত ও রথারূঢ় হইয়া পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক শরাসন বিধূনন ও সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের জ্যানির্ঘোষ, তলধ্বনি ও নির্ম্মুক্ত শরজালের সুদারুণ শব্দে রণস্থল পরিপূর্ণ হইল।
যুদ্ধ সমাপ্তিবিষয়ক অর্জ্জুন কৃষ্ণ পরামর্শ
“ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয় সেই কার্ম্মুকধারী বীরগণকে বেগে আগমন করিতে দেখিয়া বাসুদেবকে কহিলেন, ‘সখে! তুমি অসম্ভ্রান্তচিত্তে অশ্বচালনপূর্ব্বক সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হও, আজ আমি নিশিতশরনিকরে শত্রুগণকে নিঃশেষিত করিব। আজ অষ্টাদশ দিবস হইল, আমাদিগের এই ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে, ইহার মধ্যেই কৌরবগণের সাগর-সদৃশ সৈন্য আমাদিগের বিক্রম প্রভাবে এক্ষণে গোস্পদের ন্যায় হইয়া গিয়াছে। দৈবের কি অনির্বাচনীয় প্রভাব। মহাবীর ভীষ্ম নিহত হইলে আমাদের সহিত সন্ধিস্থাপন করাই দুৰ্য্যোধনের শ্ৰেয়স্কর ছিল; কিন্তু ঐ দুরাত্মা মোহাবেশপ্রভাবে তৎকালে তদ্বিষয়ে সম্মত হইল না। পিতামহ দুর্য্যোধনকে যেরূপ হিতোপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, ঐ নির্বোধ তাহার কিছুই অনুষ্ঠান করে নাই। হে বাসুদেব! সেই ঘোরতর সংগ্রামে মহাবীর ভীষ্ম সমরশয্যায় শয়ান হইলে কৌরবগণ পুনরায় যে কি নিমিত্ত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, তাহা কিছুই বুঝিতে পারি না। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ সকলেই মূৰ্থ, নচেৎ তাহারা ভীষ্মকে নিপাতিত দেখিয়া পুনরায় কি নিমিত্ত আমাদের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইল? যাহা হউক, পিতামহের মানবলীলা সংবরণানন্তর মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য, কর্ণ, কর্ণপুত্র, বিকর্ণ, তায়ু, জলসন্ধ, শ্রুতায়ুধ, ভূরিশ্রবা, শল্য, শাল্ব এবং জয়দ্ৰথ, রাক্ষস অলায়ুধ, বাহ্লীক, সোমদত্ত, ভগদত্ত, সুদক্ষিণ ও দুঃশাসন এবং অবন্তীদেশীয় বীরগণ নিহত হইলেও এই ঘোরতর লোকক্ষয়কাণ্ড উপশমিত হইল না। মহাবলপরাক্রান্ত অক্ষৌহিণীপতি ভূপালগণ ভীমশরে সমর-শয্যায় শয়ন করিলেও ধার্তরাষ্ট্রগণ লোভমোহভাবে যুদ্ধে নিবৃত্ত হয়ে নাই। হায়! মূঢ়মতি দুর্য্যোধন ব্যতিরেকে কৌরবকুলোৎপন্ন আর কোন রাজা এই নিরর্থক বৈরাচরণে প্রবৃত্ত হইতে পারে? হিতাহিতজ্ঞানসম্পন্ন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বিপক্ষকে গুণ ও বলবীর্য্যে সমধিক অবগত হইয়া কদাচ তাহার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েন না। হে কৃষ্ণ! পূৰ্ব্বে তুমি আমাদিগের সহিত সন্ধিস্থাপন করিবার নিমিত্ত দুর্য্যোধনকে হিতোপদেশ প্রদান করিয়াছিলে; কিন্তু ঐ দুরাত্মা তৎকালে তদ্বিষয়ে সম্মত হয় নাই। সে যখন তোমার বাক্য রক্ষা করে নাই, তখন অন্যের বাক্য কিছুতেই রক্ষা করিবে না। মহামতি ভীষ্ম, দ্রোণ ও বিদুর সন্ধিস্থাপনে অনুরোধ করিলে যে দুরাত্মা তাঁহাদের বাক্য উপেক্ষা করিয়াছিল, তাহার আর কিরূপে রক্ষা হইবে? যে পাপাত্মা মূঢ়তা নিবন্ধন হিতবাদী বৃদ্ধ পিতা ও মাতাকে অসম্মানপূর্ব্বক প্রত্যাখ্যান করিয়াছিল, সে এক্ষণে কি নিমিত্ত অন্যের বাক্য শ্রবণ করিবে? হে জনার্দন! দুৰ্য্যোধনের কার্য্য ও দুর্নীতিদর্শনে আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে যে, ঐ হতভাগ্যই কৌরবকুল সমূলে নির্মূল করিবে। এক্ষণে সে কোনক্রমেই সহজে আমাদিগকে রাজ্য প্রদান করিবে না। মহাত্মা বিদুর আমাকে বারংবার কহিয়াছিলেন যে, ধৃতরাষ্ট্রতনয় দুর্য্যোধন জীবন সত্বে কদাচ তোমাদিগকে রাজ্যের অংশ প্রদান করিবে না। সে যতদিন জীবিত থাকিবে, সততই তোমাদের অনিষ্ট-চেষ্টা করিবে! অতএব তোমরা যুদ্ধ ব্যতিরেকে অন্য কোনরূপে সেই দুরাত্মার নিকট হইতে রাজ্যগ্রহণে সমর্থ হইবে না।
“হে মাধব! সত্যবাদী মহাত্মা বিদুর যেরূপ কহিয়াছিলেন, এক্ষণে দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনের সেইরূপ কাৰ্য্যসমুদয় প্রত্যক্ষ করিতেছি। ঐ দুরাত্মা জমদগ্নিনন্দন পরশুরাম হইতে আনুপূর্বিক হিতকর বাক্য শ্রবণ করিয়াও তদ্বিষয়ে অনাদর প্রদর্শন করিয়াছিল। এক্ষণে তাহার নিশ্চয়ই বিনাশকাল উপস্থিত হইয়াছে; ঐ কুলাঙ্গার ভূমিষ্ঠ হইবামাত্র সিদ্ধপুরুষেরা বারংবার কহিয়াছিলেন যে, এই দুরাত্মার পাপেই সমস্ত ক্ষত্রিয় বিনষ্ট হইবে। এক্ষণে তাঁহাদের সেই বাক্য সত্যই হইল। অসংখ্য ভূপাল দুৰ্য্যোধনের সাহায্যার্থ সমুপস্থিত হইয়া বিনাশ লাভ করিয়াছেন। এক্ষণে যে সকল সৈন্য অবশিষ্ট আছে, আজ আমি তাহাদের সকলকেই বিনাশ করিব। দুরাত্মা দুর্য্যোধন ক্ষত্রিয়গণকে বিনষ্ট ও শিবির শূন্য দেখিয়া আমাদিগের হস্তে নিহত হইবার নিমিত্ত অবশ্যই স্বয়ং যুদ্ধার্থে আগমন করিবে। বোধ হয়, তাহা হইলেই এই বৈরানল নিৰ্ব্বাণ হইবে। হে মাধব! আমি ঐ দুরাত্মার কাৰ্য্য দর্শন, বিদুরের বাক্য শ্রবণ ও আপনার বুদ্ধিবৃত্তি পরিচালন করিয়া এইরূপই অনুমান করিতেছি। এক্ষণে তুমি কৌরবসৈন্যমধ্যে অশ্বসঞ্চালন কর। আমি অদ্য নিশিতশরনিকরে দুর্য্যোধন ও তাহার দুৰ্ব্বল সৈন্যগণকে বিনাশ করিয়া রাজা যুধিষ্ঠিরের প্রিয়ানুষ্ঠান করিব। “হে মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন এইরূপ কহিলে মহাত্মা বাসুদেব রথরশ্মি গ্রহণ করিয়া নির্ভীকচিত্তে বলপূর্ব্বক সেই শরশক্তিসঙ্কুল, গদা-পরিঘ-সমাকীর্ণ, চতুরঙ্গবল-সম্পন্ন কৌরব সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিয়া বিচরণ করিতে লাগিলেন। তখন চতুর্দ্দিকেই অর্জুনের সেই বাসুদেব-পরিচালিত শ্বেতাশ্বগণ নয়নগোচর হইল। শত্রুতাপন ধনঞ্জয় এইরূপে সমরাঙ্গনে সমাগত হইয়া, জলধর যেমন জলধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ সুতীক্ষ্ণ শরধারা বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহার নতপৰ্ব্ব শরনিকরের ঘোরতর শব্দ প্রাদুর্ভুত হইল। গাণ্ডীবপ্রেরিত অশনিসদৃশ শরজাল বীরগণের বর্ম্ম-সমুদয় ছিন্ন-ভিন্ন এবং হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণকে নিপাতিত করিয়া শন্দাযমান পতঙ্গের ন্যায় ভণ্ডলে নিপাতিত হইতে লাগিল। ফলতঃ তৎকালে সুবর্ণপুঙ্খ শরনিকরে একেবারে সমুদয় সমরাঙ্গন সমাচ্ছন্ন হইল। তৎকালে কাহারও আর দিঘিদিক-জ্ঞান রহিল না। বীরগণ দাবানলে দহ্যমান গজযূথের ন্যায় অর্জুনের শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়াও তাঁহাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিল না। তখন প্রবল প্রতাপশালী ধনঞ্জয় প্রজ্বলিত পাবক যেমন শুষ্কলতা-পরিপূর্ণ অসংখ্য পাদপসম্পন্ন মহাবন দগ্ধ করে, তদ্রূপ দুৰ্য্যোধনের সৈন্যগণকে শরজালে দগ্ধ করিয়া ফেলিলেন। তিনি কি হস্তী, কি অশ্ব, কি মনুষ্য, কাহারও প্রতি দুইবার শরপ্রয়োগ করিলেন না। পূৰ্ব্বে বজ্ৰপাণি ইন্দ্রের প্রভাবে দৈত্যগণ যেমন বিনষ্ট হইয়াছিল, তদ্রূপ এক্ষণে সেই এক বীর ধনঞ্জয়ের বিবিধ শরনিকরে কৌরব সৈন্যগণ নিহত হইতে লাগিল।”