রচনারীতি : ভাষা
সাধারণ বিচারে ঋগ্বেদে ব্যবহৃত ভাষা সর্বত্র সমান নয় ; সতর্ক ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বোঝা যায় যে জাতিগত ও ভাষাগত সংমিশ্রণ এবং বহু শতাব্দীব্যাপী রচনা, গ্রন্থনা, সম্পাদনা ও আঞ্চলিক বৈষম্যের ফলে ভাষা প্রয়োগে সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা দিয়েছে। শৈলী ও ব্যাকরণের ক্ষেত্রে কতকটা কৃত্রিমভাবেই সামঞ্জস্য রক্ষা করার চেষ্টা হয়েছে, তাতে শব্দভাণ্ডারের অন্তর্গত বৈচিত্র্য ও কথ্য ভাষার উপযোগী ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্যকে নূতন তাৎপর্যে অম্বিত করার সঙ্গে সঙ্গে ভাষাগত শব্দ নির্বাচনের দিকটিও পরিস্ফুট হয়েছে। বৈদিক সংস্কৃত ভাষা তৎকালীন উপভাষাগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টায় একটি বিশেষ কথ্যভাষাকে অধিক গুরুত্ব দিলেও বিভিন্ন উৎস থেকে যে উপাদান সংগ্ৰহ করছিল, তার বহু চিহই ঋগ্বেদের মধ্যে রয়ে গেছে। ঋগ্বেদের ভাষা মূলত কবিদের সচেতন প্ৰয়াসে নির্মিত একটি সাহিত্যিক ভাষা-কোন বিশেষ গোষ্ঠীর বা কোন অঞ্চলের কথ্যভাষার সম্পূর্ণ অনুগামী নয়। তখনকার চারণকবিদের কাছে এই ভাষাটিই আদর্শ বলে বিবেচিত হয়েছিল। যখন কথ্যভাষা রূপে বৈদিক সংস্কৃত প্রচলিত ছিল, সেই সুদূর অতীতেই প্ৰাকপালি এক প্রাকৃত ভাষার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করে। সামাজিক অবচেতনায় তার নিগুঢ় প্রভাবের সঙ্গে বিভিন্ন উপভাষার সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার গভীর সংযোগের ফলে বৈদিক চারণকবিদের কথ্যভাষা ধীরে ধীরে গড়ে উঠে। বৈদিক ভাষা প্রকৃত পক্ষে প্রাচীন ভারতীয় আৰ্য ভাষার সেই প্রত্নরাপ যা পরবতী নব্য আৰ্যভাষাগুলির জন্ম দিয়েছে। ভারতীয় আর্যগণ যখন এদেশে এসেছিলেন ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা-ভাণ্ডারের উত্তরাধিকার ছাড়াও তারা দীর্ঘ পথ অতিবাহনের ফলে বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত শব্দাবলী নিতে নিতে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে প্ৰাচীন ব্যাবিলন ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অংশের সঙ্গে বানিজ্যের ফলে তাঁদের ভাষায় নিজস্ব কিছু বিদেশী শব্দের প্রভাবও দেখা গিয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিজস্ব ভাষা যেমন বিবর্তিত হয়েছিল তেমনি ভারতীয় অনার্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈবাহিক ও দৈনন্দিন নানা আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার ফলে স্থানীয় ভাষাও গঠনমূলক প্রভাব বিস্তার করেছিল। শুধু তাই নয়, অবৈদিক আৰ্যভাষার শব্দও যে ঋগ্বেদে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল, এমন অনুমানেরও যথেষ্ট হেতু আছে।
কৃষি-সভ্যতার দৈনন্দিন জীবন থেকেই অধিকাংশ শব্দ ঋণ হিসাবে গৃহীত হয়েছিল, কেননা গ্রামনিবাসী আৰ্যদের পক্ষে নাগরিক জীবনের কোন অভিজ্ঞতা থাকা সম্ভব ছিল না। ঋগ্বেদের সূক্তসমূহ যখন ভারতভূমিতে রচিত হচ্ছিল, অষ্ট্রিক ও হয়ত অল্প কিছু দ্রাবিঢ় উৎসজাত শব্দ তখনই আৰ্য শব্দ-ভাণ্ডারে প্রবেশ করে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ও বহু শতাব্দী ধরে যেহেতু ঋগ্বেদের সূক্তগুলি রচিত ও সঙ্কলিত হয়েছিল, সেহেতু বৈদিক ভাষার শব্দ-ভাণ্ডারে অনেকগুলি কথ্যভাষার বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় হওয়া স্বাভাবিক ছিল ; কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কোনো নির্দিষ্ট জাতি গোষ্ঠীর কথ্যভাষার পরিধির মধ্যে তা কখনোই সীমাবদ্ধ ছিল না। সংহিতার বিভিন্ন অংশের মধ্যে ভাষাব্যবহারে পার্থক্য লক্ষিত হয়, কেননা অনেক শব্দ, বিশিষ্ট বাক্যাংশ বা বাগবিধির গুচ্ছ ও বাচনিক সঙ্কেতসূত্রকে প্রাচীন সাহিত্য-ভাণ্ডার থেকে উত্তরাধিকার রূপে আহরণ করে বৈদিক কবি বিভিন্ন সময়ে শূন্যস্থান পূরণের জন্য পূর্ব নির্দিষ্ট ভাষা সঙ্কেতরাপে প্রয়োগ করেছিলেন ; অথচ ততদিনে এইসব বাচনিক উপাদান দৈনন্দিন ব্যবহারের বৃত্তবহির্ভূত ও ফলে অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে।
ঋকসংহিতা থেকে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার পদাম্বয়রীতি সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করা কঠিন, যেহেতু কাব্যরচনায় কখনো নির্দিষ্ট কোনো পদাম্বয় রীতি অনুসৃত হয় না। তাছাড়া, প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষায় গদ্য-পদ্য নির্বিশেষে বাক্যের অর্থ পদক্রমের ওপর নির্ভরশীল নয়। সংহিতা যেহেতু মৌখিক সাহিত্য বা শ্রুতিকাব্য, ছন্দ ও শ্বাসাঘাতের প্রাধান্য সেখানে তর্কাতীত এবং পদাম্বয়ে তাদেরই নির্ধারক ভূমিকা। বস্তুত, যজুর্বেদ ও ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থসমূহের গদ্যভাষার সঙ্গে পরিচিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা বৈদিক ভাষার পদাম্বয়-রীতি সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণাই অর্জন করতে পারি না। সাধারণ গদ্য ভাষায় বিশ্লেষণ পদ বিশেষ্যের পূর্বে ব্যবহৃত হলেও পদ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগরীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ; কেননা ছন্দ ও শ্বাসাঘাতের নিজস্ব প্রয়োজনে বিশ্লেষণ বাক্যের যে-কোনো স্থানে ব্যবহৃত হতে পারে। অক্ষরজ্ঞান আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্ববতী পর্যায়ে ভাষা যখন বিভিন্ন প্রজন্মের দ্বারা কেবলমাত্র মৌখিকভাবেই সংরক্ষিত হত, তখন শব্দব্যবহারে চূড়ান্ত মিতব্যয়িতা ও তজ্জনিত সংহতি (সংক্ষেপীকরণ) অনিবাৰ্য ছিল। অতএব আমরা নিঃসন্দেহে এই অনুমান করতে পারি যে সংহিতায় প্ৰযুক্ত বিশেষণগুলি সম্পূর্ণ যথাযথ, অপরিহার্য ও অ-পরিবর্তন সহ এবং কবির পরিকল্পিত ভাবনার অনুগামী সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ততম অভিব্যক্তিরই নিদর্শন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেবতাদের নামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষণসমূহ তাদের প্রত্নপৌরাণিক কার্যকলাপ বা প্ৰকৃত ঐতিহাসিক ঘটনার ইঙ্গিতবহ। হােমারের ইলিয়াড ও অডিসিতেও বিশেষণ প্রয়োগের এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, অবেস্তাতেও। প্ৰাক-লিখন যুগে শব্দব্যবহারের অপরিহার্য একটি লক্ষণ হ’ল যে নিতান্ত প্রয়োজন ব্যতীত কোনো শব্দই প্ৰযুক্ত হ’ত না ; অতএব প্রত্যেকটি শব্দই সুপ্রযুক্ত এবং কবির একান্ত অভীষ্ট। ব্যতিক্রম শুধু কিছু কিছু পাদপূরণার্থক অব্যয়, যেগুলি ছন্দের অনুরোধে ব্যবহৃত। তাই ইন্দ্ৰকে যখন পুরন্দর বা বৃত্ৰহা বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে—তার মধ্যে নিহিত রয়েছে আর্য সেনাপতি ইন্দ্র কর্তৃক প্ৰাগাৰ্য বসতিগুলির প্রাচীরসমূহ চুৰ্ণ করার ইঙ্গিত বা অনার্য কোনো প্ৰবলপরাক্রান্ত গোষ্ঠীপতিকে হত্যার অভ্যাস। আবার অংহােমুক বা পাপক্ষালনকারী কিংবা ওজস্বৎ বা শক্তিশালী অভিধায় ইন্দ্ৰকে যখন বৰ্ণনা করা হচ্ছে, তখন বুঝতে পারি, এই জাতীয় নিহিত বিশেষণে বিশেষ বিশেষ প্রত্নবিশ্বাসের প্রধান্য।
এই সমস্ত বিশ্লেষণ করে আমরা এই সত্যে উপনীত হই যে, সংহিতার ভাষার অধিকাংশেই সাংস্কৃতিক সমরূপতার প্রবণতা। তাই এই সাহিত্য এমন করে বহু বিশিষ্ট সর্বজনীন অভিজ্ঞতার সামূহিক প্রত্নস্মৃতির অমেয় ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে। ‘বৃত্ৰতূর্থ’- এর মতো বিশেষণ-প্ৰয়োগ থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে মন্ত্রের শ্রোতা আৰ্যদের প্রাচীন সমাজ-জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অবহিত, অর্থাৎ সে জানে ঐ বিশেষণের মধ্যে ইন্দ্রের বৃত্ৰবন্ধের কাহিনীর একটি অধ্যায় বিধৃত আছে। সামূহিক জীবনের তাৎপর্যপূর্ণ অতীত বৃন্তান্তগুলির প্রতি তর্জনীসঙ্কেত করে বলেই এই ধরনের বিশেষণ জাতিগোষ্ঠী-বহির্ভূত ব্যক্তির কাছে অর্থাৎ আর্যসংস্কৃতির পরিমণ্ডলের বাইরের ব্যক্তির কাছে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য ও অর্থহীন রূপে প্রতিভাত হবে। পরবতী ধ্রুপদী সংস্কৃতের তুলনায় সংহিতায় ব্যবহৃত সমাসগুলি সবলতর, প্ৰায় কখনোই দুয়ের বেশি শব্দ সমাসবদ্ধ হয় নি এবং সমাস সত্যই সংক্ষেপকরণের এবং সুখশ্রুতির জন্যেই ব্যবহৃত। মৌখিক সাহিত্যের ঐতিহ্যে যেহেতু স্বতঃস্ফুর্তিই প্ৰধান বৈশিষ্ট্য, তাই সেখানে সমাস-ব্যবহারের দৃষ্টান্তও বিরল। সংক্ষিপ্ততা, পরিচ্ছন্নতা ও যথার্থতা-অৰ্থাৎ যে সমস্ত গুণ শ্রীতিকাব্যের পক্ষে অপরিহার্য, বিশেষত পরবতী অলংকার সাহিত্য যাকে ওজঃ ও প্ৰসাদ গুণ বলেছে, তাই। সমাস-প্রয়োগে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় গাঢ়তা ও বহুমুখী ব্যঞ্জনা। যেমন-ইন্দ্র হচ্ছেন শতক্ৰতু ও পুরন্দর ; সৌরদেবতারা হিরণ্যবাহু ; মিত্র ও বরুণকে বলা হচ্ছে ঋতাবৃধা ; অগ্নিকে জাতিবেদা, গৃহপতি ও রত্নধ্যতম, পুরুষকে সহস্রশিরাঃ, সহস্রাক্ষ ও সহস্রপাৎ, অরণ্যানী অঞ্জনগন্ধী, বহ্বল্লা ও অকৃষীবলা। গ্রীক প্ৰত্নকথায় পাচ্ছি একই ধরনের দেবনামগত বিশেষণ (যথা আপোল্লো লুকোকটোনোস, স্মিনথিওস, পার্নোপিত্তস ও নোমিওস কিংবা জিউস অ্যালেক্সিকাকোস, এফেস্টিওস, ফ্যামেলিওস ও এ্যাগাের্যাইয়োস ইত্যাদি) প্রকৃতপক্ষে বৈদিক ভাষায় যে সমৃদ্ধি দেখা যায়, মূল ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগত কাঠামোর অন্তর্নিহিত শক্তিতেই তার উৎস।
ধ্বনিগত বা রূপগত দিক দিয়ে বৈদিক ভাষা অনড় স্থানুপদার্থ নয় ; বহতা নদীর মতো নিজস্ব গতিতে সেই ভাষা ক্রমশ বিবর্তিত ও সরলীকৃত হয়ে শেষ পর্যন্ত যে ধ্রুপদী সংস্কৃতের সমীপবতী হয়েছে—তার বিভিন্ন পর্যায় ঋকসংহিতার মধ্যেই স্পষ্ট। প্ৰাচীনতর পর্যায়ে বৈদিক ভাষায় ব্যাকরণগত বৈচিত্র্য ও বিকল্পের সংখ্যা যে অনেক বেশি, তার কারণ সম্ভবত এই যে, বহু কৌম ও জনগোষ্ঠী উপভাষাগুলির সংমিশ্রণে গঠিত একটি সর্বজনবােধ্য বাচনিক কাঠামোকে ভিত্তি করেই ঋকসংহিতা রচিত। প্ৰতি গোষ্ঠীরই একটা নির্দিষ্ট ক্ষুদ্র শব্দভাণ্ডার ছিলো; সর্বজনীন রূপটি কালের নিয়মে বিবর্তিত হলেও কিছু কিছু অংশ আবার সেই নিয়মকে অস্বীকার করেই প্ৰাচীন বাগবৈশিষ্ট্যকে অক্ষুন্ন রেখেছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে ব্যবহৃত ভাষা তাই স্বভাবতই পূর্ববতী মণ্ডলগুলির তুলনায় অনেকাংশে ভিন্নপথগামী হয়ে পড়েছে। প্রাচীনতর। বৈদিক সাহিত্যের অধিকাংশই খ্রিস্টপূর্ব একাদশ ও দশম শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল। সূক্তসমূহের ভাষা বিশ্লেষণ করে যেহেতু প্ৰাকৃত ভাষাগুলি থেকে ঋণগ্রহণের বহু দৃষ্টান্ত প্ৰমাণ করা যায, তা থেকে এই সিদ্ধান্তেও উপনীত হওয়া যায় যে, কোনো এক সময়ে সাধারণ জনতার ভাষা ও আনুষ্ঠানিক সাহিত্যের ভাষার মধ্যে কোনো একান্ত বা অলঙঘ্য বিচ্ছেদের প্রাচীর বিদ্যমান ছিল না। কাব্যের প্রয়োজনে প্ৰচলিত বাচনিক কাঠামোকে কখনও কখনও কৃত্রিমভাবে পরিমার্জিত করার ফলেই ঋগ্বেদের ভাষা তার নিজস্ব পরিশীলিত অভিব্যক্তি লাভ করেছিল। ঋগ্বেদ সংহিতা যখন সম্পূর্ণভাবে দীর্ঘকালব্যাপী প্ৰয়াসের ফলে সংকলিত হল, তার মধ্যে রয়ে গেল প্রাচীন অলৌকিক আখ্যানের ভগ্নাবশেষ, মহাকাব্যের লক্ষণযুক্ত স্তর যা পরবর্তীকালে কখনোই পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্যে পরিণত হল না, এবং সেই সঙ্গে জাদুগীতি ও কিছু বিরল গীতিকবিতার অংশ। ঋকসংহিতা বহু শতাব্দীব্যাপী এমন এক ধরনের প্রয়াসের ফসল যার মধ্যে স্বতঃস্ফুর্তির অবকাশ খুব কমই ছিল; অভিজাত ও যুদ্ধনিপূণ সভ্যতা সুসংগঠিত ও বিবিধ শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যে বিশেষ যে সাংস্কৃতিক মননের পরিবেশ রচনা করেছিল–ঋকসংহিতা তারও ফলশ্রুতি। বহু প্রজন্মের চেষ্টায় যে সৃষ্টি গড়ে উঠেছে তাতে চিত্রাধর্মিতার চেয়ে নানা বর্ণের প্রস্তরখচিত, কারুকাৰ্যই যেন প্রকট হয়ে উঠেছে বেশি। পরিশ্রমসাধ্য যান্ত্রিক পরিশীলনের অভিব্যক্তি এই সাহিত্য আছে ব’লেই কোনো কোনো সমালোচকের মতে তাতে সুখী ও ধর্মভীরু অদিম সমাজের কোন যথার্থ প্রতিফলন নেই। যে নগর-সভ্যতাগুলিতে লিখনপদ্ধতি প্ৰথম আবিষ্কৃত হয়েছিল, সাধারণভাবে ইন্দো-ইয়োরোপীয় জনগোষ্ঠী এবং বিশেষভাবে বৈদিক আৰ্যরা এই পরিধির বাইরে থাকায় একদিকে যেমন এদের মৌখিক সাহিত্যের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, অন্যদিকে তেমনি গুরুশিষ্যপরম্পরাক্রমে মৌখিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদানেরও প্ৰচলন হয়েছিল। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে মৌখিক সাহিত্য ও শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে যে ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন ছিল, তারই অনিবাৰ্য ফলশ্রুতিরূপে যে কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতার বাতাবরণ ও রক্ষণশীলতার প্রবণতা দেখা দেয় তাতেই বৈদিক ভাষা বিদ্বৎসমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে দৈনন্দিন কথ্য ভাষা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।