দহিজুড়ি ছাড়িয়ে কিছুটা যেতেই জিপ গাড়িটা থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল। ড্রাইভারের পাশে আমি, তারপর স্বাতী। পেছনে কল্যাণ এবং চারটি মুরগি।
প্রথমে একটু একটু ধোঁয়া, তারপর মোষের শিং-এর মতন, তারপর কারখানার চিমনির মতন। আমরা টপাটপ নেমে পড়লুম, ড্রাইভার এসে বনেটটি খুলে ফেললেন। ‘যত্র ধূমাৎ তত্র বহ্নি’ লজিকের এই সূত্রটিকে সত্যি প্রমাণিত করে হুহু করে জ্বলে উঠল আগুন, ড্রাইভার যুবকটি ব্যাটারি সংলগ্ন তারটি টানাটানি করে ছেঁড়ার চেষ্টা করেও পারলেন না। এর মধ্যে পথের দু’মুখে অনেকগুলি গাড়ি থেমে পড়েছে। তার মধ্যে একটা বাস এবং তাদের সবগুলির ড্রাইভার এক যোগে নানারকম বিপরীত পরামর্শ দিতে লাগল ও লাগলেন, ব্যাটারির তারটা টেনে ছেঁড়ার সাধ্য হল না কারুরই।
স্ত্রী জাতি সহজেই উদ্বিগ্ন হয়, আর এখানে তো যথেষ্ট কারণই রয়েছে। স্বাতী শুকনো মুখে বলল, যাঃ। অর্থাৎ আমাদের আর যাওয়া হবে না।
আমি তাকালুম কল্যাণের দিকে! পায়জামা ও পাঞ্জাবি পরা কল্যাণ একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে নির্লিপ্ত মুখে। সে যেন একজন পথের দর্শক, অন্য কারুর গাড়িতে আগুন লেগেছে, সে দেখছে। বেশ সুস্থিরভাবে পকেট থেকে সিগারেট দেশলাই বার করে একটি ধরাল। পায়জামা, পাঞ্জাবিতে কল্যাণকে বেশ নিরীহ দেখায়, প্যান্ট শার্টে তার দৃঢ়-চওড়া চেহারাটা বেশ পরিষ্কার হয়। তখন তাকে মনে হয় বহুযুদ্ধে পোড় খাওয়া একজন সৈনিক।
তার পোড়ার পট পট শব্দ হচ্ছে, আমার ধারণা এক্ষুনি এই পুরো জিপ গাড়িটি দাউদাউ করে জ্বলবে, মালপত্রগুলো অন্তত নামিয়ে ফেলা যায় কি না ভাবছি, এই সময় একজন ড্রাইভার একটা ছোট হাত-করাত এনে ব্যাটারির তার কেটে দিতেই আগুনের মূল প্রতাপটা কমে গেল। তারপর জ্বলন্ত তারগুলোকে নেভাবার চেষ্টা।
কল্যাণ রাস্তার পাশে মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই বলল, দেখেছেন সুনীলদা, এই সময় মাঠ ধানে ভরে যাওয়ার কথা, কিন্তু এবার এখনও ভালো করে বৃষ্টিই হল না—
আমি জিগ্যেস করলুম, গাড়িটার কী হবে! কল্যাণ বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ও ঠিক হয়ে যাবে।
আমি দেখতে পাচ্ছি, গাড়ির বনেটের নীচে যে তারের জঙ্গল থাকে তা অধিকাংশই পুড়ে কালো কালো, এই অবস্থায় গাড়ি চলার কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। তবু কল্যাণের কথায় অবিশ্বাস করতে পারি না।
সেই কবে ছেলেবেলায় পড়েছিলুম রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, তার একটি চরিত্র কাটসিনস্কির কথা মনে পড়ে। যে-কোনও পরিবেশের মধ্যে এই ধরনের মানুষ একটুও ঘাবড়ায় না। সবসময় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলতে পারে, সব ঠিক হয়ে যাবে! কল্যাণ কথা বলে খুব কম, অনেক কথায় উত্তর দেয় শুধু হেসে। ঝাড়গ্রামে ওকে বলেছিলুম, কল্যাণ, অনেকবার তো এদিকে এলুম, কাঁকড়াঝোড়টা একবারও দেখা হল না, স্বাতীরও খুব যাওয়ার ইচ্ছে, একটা জিপ-টিপ জোগাড় করা যাবে? ‘উইদাউট ব্যাটিং অ্যান আইলিড’ যাকে বলে, কল্যাণ বলেছিল, হ্যাঁ, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি ভেবেছিলুম কিছুক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে এ বিষয়ে, কিন্তু কল্যাণ সংক্ষিপ্ততম বাক্যে জানাল, কাল সকাল দশটা-এগারোটায় বেরিয়ে পড়ব।
ঝাড়গ্রামে এসেছিলুম রাধানাথ মণ্ডলদের গল্পচক্রের অধিবেশনে। সন্তোষকুমার ঘোষ মধ্যমণি। এক সন্ধের ব্যাপার। পরদিন সকালে সন্তোষদা সদলবলে ফিরে গেলেন কলকাতায়, বাংলোয় শুধু স্বাতী আর আমি। এগারোটা বেজে গেল, কল্যাণের পাত্তা নেই। স্বাতী কল্যাণকে আগে দু-একবার মাত্র দেখেছে, সুতরাং সেই একটু উতলা হয়ে উঠতেই পারে। সাজ পোশাক করে, জিনিসপত্র গুছিয়ে আমরা তৈরি। এখন যদি কল্যাণ এসে বলে, জিপ পাওয়া গেল না–এই ধরনের চিন্তা।
সাড়ে এগারোটায় কল্যাণ এল, শুধু জিপ নিয়ে নয়। সেই সঙ্গে চাল-ডাল-তেল-নুন-আলু লঙ্কা-পেঁয়াজ-পাউরুটি-ডিম-মুরগি ইত্যাদি যাবতীয় বাজার করে। কাঁকড়াঝোড়ে কিছু পাওয়া যায় না। এসব কথা কল্যাণ আমাকে একবারও বলেনি। জিপ থেকে নেমে শুধু বলেছিল, কাছেই ফরেস্ট অফিস আপনি ডি-এফ-ও-র সঙ্গে একটু কথা বলে বাংলোটার বুকিং করে নিন। গেলুম ডি-এফ-ও’র কাছে। ইনি, শ্রীসুবিমল রায় আমাদের বন্ধু পার্থসারথি চৌধুরীর সহপাঠী, তা ছাড়া কাঁকড়াঝোড়ে বেশি লোক যায় না, সুতরাং বাংলো রিজার্ভেশানের ব্যাপারে কোনও সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। সমস্যা যে কিছু হবে না, সবই যেন কল্যাণের আগে থেকে জানা।
ড্রাইভার যুবকটি পোড়া তারগুলো টেনে-টেনে বার করছেন, অন্যান্য ড্রাইভাররা উপদেশের ঝড় বইয়ে দিচ্ছে, আমার মনে হল, এই অবস্থায় এই গাড়িকে টেনে নিয়ে যাওয়াই একটা সমস্যা হবে, আমাদের যাওয়া তো দূরের কথা।
কল্যাণ বলল, ওই জন্যই তো ড্রাইভার আনিনি!
আমি বললুম, তার মানে?
–যার কাছ থেকে জিপটা এনেছি, তার দুটো জিপ। ভালো, নতুন জিপটা নবগ্রামে চলে গেছে, সেটা পেলে ভালো হত। এটাতেও কাজ চলে যায়।
–কিন্তু এখন কী হবে?
–সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখুন না!
আমাদের জিপ চালক অন্যান্য ড্রাইভারদের কারুর কাছ থেকে একটা সু-ড্রাইভার, কারুর কাছ থেকে প্লাস ইত্যাদি ধার চেয়ে চলেছেন, তারপর শুধু একটা লম্বা তার দিয়ে কীসের সঙ্গে কী জুড়ে দিতেই গাড়ির ইঞ্জিন আবার গ-র-র-গ-র করে উঠল। আমি হতবাক। এতগুলো বড় তারের বদলে মাত্র একটি তার!
কল্যাণ বলল। ওই জন্যই তো ড্রাইভার আনিনি। রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে গেলে ড্রাইভাররা কিছু করতে পারে না। এ একজন মেকানিক। গাড়ির মিস্ত্রি। গ্যারেজে কাজ করছিল, জোর করে তুলে নিয়ে এসেছি।
অর্থাৎ সেইজন্যই কল্যাণের আসতে আধ ঘণ্টা দেরি হয়েছিল।
সত্যিই আবার দিব্যি জিপটি চলতে শুরু করল। দহিজুড়ি ছাড়বার কিছু পরেই তরুণ শালের জঙ্গল শুরু হয়। এ রাস্তা আমার বেশ চেনা। এ পথ দিয়ে অনেকবার বেলপাহাড়িতে এসেছি।
আমরা বেলপাহাড়িতে এসে পৌঁছলাম বিকেলের দিকে। গাড়িকে একটু বিশ্রাম দেওয়া দরকার। আমরা নেমে পড়লুম কল্যাণের চেনা একজন লোকের বাড়িতে। জিপ-চালক আবার বনেট উঁচু করলেন। এবার ব্যাটারির সঙ্গে তারটি লাগানো হয়েছে খুব আলগাভাবে, যাতে আবার কোনও গণ্ডগোল হলে একটানে খুলে ফেলা যায়।
যাঁর বাড়িতে নেমেছি, তিনি জাতিতে সিন্ধি, চমৎকার মেদিনীপুরের টানে বাংলা বলেন, ইনি একজন বিড়ি পাতা ব্যবসায়ী। লক্ষপতি বললে খুব কম বলা হবে, অর্ধকোটিপতি বলাই বোধহয় সঙ্গত। এঁর বাড়িটির ছাদ টিনের, পেছন দিকে দু’আড়াই শো মজুর-মজুরনি কাজ করছে। কল্যাণ নিজেও বিড়ি পাতার ব্যবসায়ে নেমেছিল, বেশ কিছু টাকা লোকসান দিয়ে পিছু হটে এসেছে। বিড়ি পাতার ব্যাবসায়ে যেমন ঝুঁকি, তেমনি লাভ, এরকম জানা গেল, এ অঞ্চলে সিন্ধ্রিরাই একচেটিয়াভাবে এ ব্যাবসা করেছে এতদিন। সরকার আদিবাসী উন্নয়ন সমিতির হাতে বিড়ি পাতার জঙ্গলের ইজারা দিতে চান, কিন্তু যা হয়, সিন্ধ্রি ব্যবসায়ীদের দক্ষতার তুলনায় কেউ কিছু না। সরকারি উদ্যোগে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয় প্রতি বছর।
চকচকে কাঁসার গেলাসে জল এবং পরে সর-ভাসা বেশি দুধের চা খেয়ে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলুম। বেলপাহাড়ি জায়গাটি সমতল ও পাহাড়ি এলাকার ঠিক সংযোগ স্থলে। যতবার আসি, দেখি যে, বেলপাহাড়িতে মানুষ ও বাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সারা পৃথিবীতেই মানুষ বাড়ছে তো বেলপাহাড়িতেই বাড়বে না কেন?
পাহাড় জঙ্গলে ঢোকবার মুখে একজন ফরেস্ট গার্ডকে সঙ্গে নিয়ে নিলুম। কারণ, ঝাড়গ্রামেই ডি-এফ-ও বলেছিলেন, কাঁকড়াঝোড়ে কয়েকদিন ধরে এক পাল হাতি দেখা যাচ্ছে। প্রতি বছরই ওরা আসে, তবে এবার যেন একটু আগে এসেছে। উত্তর বাংলার হাতিদের মতন এখানকার হাতি তেমন হিংস্র নয়, তবে একেবারে সামনাসামনি পড়ে গেলে দুষ্টুমি করে জিপটা উলটে দিতেও পারে।
ফরেস্ট গার্ডটির শুকনো ক্ষয়টে চেহারা। এমনই রোগা যে ওর কোমরের বেল্টে নিশ্চয়ই নতুন ফুটো করতে হয়েছে। হাতে একটা লাঠি, হাতি সামনে এসে পড়লে এই ব্যক্তি কীভাবে আমাদের সামলাবে?
কল্যাণ বলল, জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা হারিয়ে ফেলার খুব ভয়। এ অন্তত রাস্তা চিনবে।
এ কথায় আমাদের জিপ-চালক জানালেন, আমি কাঁকড়াঝোড় সাত আটবার এসেছি, রাস্তা আমার মুখস্ত।
পাকা রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে জঙ্গলের মধ্যে পাথুরে রাস্তায় ঢুকতেই বুঝতে পারলুম, কেন, কাঁকড়াঝোড়ে বেশি লোক আসে না। কলকাতা থেকে কতই বা দূর, দুশো-আড়াইশো মাইলের মধ্যে। আজকাল কয়েকটি বেশ স্মার্ট ট্রেন চলে, তাতে আড়াই বা তিন ঘণ্টায় পৌঁছনো যায় ঝাড়গ্রাম। সেখান থেকে মজবুত জিপ পেলে আর তিন ঘণ্টার মধ্যে কাঁকড়াঝোড়। এবং পথ চেনার জন্যও সঙ্গে কারুর থাকা দরকার, কেন না, বনের মধ্যে দিয়ে চোদ্দো কিলোমিটার যেতে যেতে অনেক শাল পথ, তার যে-কোনও একটি ধরে হারিয়ে যাওয়া খুব সোজা।
এ রাস্তা বিপজ্জনক নয়, দুর্গম। প্রায়ই বড় বড় চড়াই-উতরাই, মাঝে-মাঝে গর্ত। এক একবার কোনও গর্তে পড়ে গাড়িটি লাফিয়ে উঠলেই আমি ভাবি, ব্যাটারির তারটা ছিঁড়ে গেল না তো?
স্বাতী ব্যগ্রভাবে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। যদি হাতি দেখতে পাওয়া যায়। একটু দূরে যে-কোনও গাছপালার জটলার দিকে তাকালেই যেন মনে হয়, ওখানে কোনও হাতি ঘাপটি মেরে আছে। কল্যাণের ধারণা পথে হাতি পড়বেই, কারণ সে এদিকে আগে হাতি দেখেছে নিজের চোখে। এক জায়গায় হাতির ‘গোবর’ পড়ে থাকতে দেখে কল্যাণ বলল, ওই যে এই রাস্তা দিয়েই গেছে। আমি অভিজ্ঞ শিকারির ভাব নিয়ে ওকে জানালুম যে, ওটা অন্তত দু’দিনের পুরোনো।
কল্যাণেরর মতে, এই জঙ্গলে বাঘ নেই বটে, কিন্তু নেকড়ে আছে। ডি-এফ, ও’-ও আমায় বলেছিলেন, জঙ্গলের মধ্যে জিপের পেছনে-পেছনে কখনও-কখনও নাকি কুকুরের মতন কোনও প্রাণীকে ঘাড় নীচু করে ছুটে আসতে দেখা গেছে। যদিও নেকড়ে আজকাল খুবই দুর্লভ। জঙ্গলের নেকড়েগুলোই এখন অ্যালসেশিয়ান হয়ে শহরের অনেক বাড়িতে শোভা পায়।
হাতি কিংবা নেকড়ে কিছুরই দর্শনলাভ ঘটল না। আমরা বাংলোর কাছে এসে পৌঁছলাম বিকেলের ব্রাহ্ম মুহূর্তে। জিপ থেকে নেমেই বললুম, বা!
বাংলোটি এমনই জায়গায়, যেখানে গোল হয়ে ঘুরে তাকালে দেখা যাবে শুধু জঙ্গল-মাখা পাহাড়। এখানে দাঁড়ালে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে আমরা চলে এসেছি পৃথিবীর এক প্রান্তসীমায়, সভ্যতা থেকে অনেক দূরে। যদিও দুপুরবেলাতেই আমরা একটা শহরে ছিলাম।
শেষ বিকেলের রক্তাক্ত আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে বাংলোটি আমাদের মন কেড়ে নেয়। তা বলে এমন নয় যে এর থেকে ভালো বাংলো আমরা আগে কখনও দেখিনি। বস্তুত, ফরেস্ট বাংলোগুলির চেহারা একই রকম হয় প্রায়। তবু এক একটি সময় আসে, যখন সুন্দরের মধ্যে কোনও তুলনার কথা মনে আসে না, চোখের সামনের বস্তুটিকেই মনে হয় পরম প্রাপ্তি। বড় বড় শাল গাছের মধ্যে একটি কাজু বাদাম গাছ দেখে স্বাতী মুগ্ধ। ও আগে কখনও ওই গাছ দেখেনি।
কল্যাণ জিগ্যেস করল, আপনি চন্দন গাছ দেখেছেন?
স্বাতী তা-ও দেখেনি। কল্যাণ সংক্ষেপে জানাল, কাল সকালে আপনাকে দেখাব!
দেখতে না দেখতেই ঝুপ ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। আমরা বাংলোর মধ্যে ঢুকে ব্যাপৃত ছিলাম পোশাক পরিবর্তনে। এবং অল্প ক্ষণের মধ্যেই কল্যাণ জানাল যে চা, ডিম সেদ্ধ ইত্যাদি তৈরি।
বাংলোর বারান্দায় বসে দ্বিতীয় কাপ চা খাচ্ছি, এমন সময় একজন লোক দু-বোতল মহুয়া এনে রাখল কল্যাণের পায়ের কাছে। কল্যাণ বোতল দুটি তুলে প্রথমে টোকা দিয়ে টংটং শব্দ শুনল, তারপর ছিপি খুলে দু-তিনবার ঘ্রাণ নিয়ে বলল, হ্যাঁ, খাঁটি জিনিস। আমি হাসলুম।
কল্যাণের ব্যবস্থার কোনও ত্রুটি নেই। শালের জঙ্গলে এসেছি, মহুয়া তো পান করবই। আমরা পৌঁছনো মাত্রই কল্যাণ ঠিক মনে করে মহুয়া আনতে পাঠিয়েছে। কিন্তু হাসলুম এই জন্য যে, সময়ের কত বিচিত্র রকম খেয়াল! কল্যাণকে আগে যতবার দেখেছি, ওর দুরন্তপনায় হতবাক হয়ে গেছি, ওর শরীরে ও মনে অসাধারণ শক্তি, এক বোতল মহুয়া ও এক চুমুকে শেষ করে দিতে পারে। সারারাত জেগে তাস খেলে, সকালবেলা একটুও না ঘুমিয়ে তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ে, যখন যে জিনিসটি চায় সেটা পেতেই হবে…। সেই কল্যাণ যেন ধীর, শান্ত এবং কিছুদিন আগে তীব্র শ্বাসকষ্টের অসুখ হওয়ায় ও আগামী ন’ মাস এক বিন্দুও অ্যালকোহল পান করবে না। ঠিক ন’মাস কেন, তা অবশ্য রহস্যময়।
নিজেই একটি গেলাসে খানিকটা মহুয়া ঢেলে কল্যাণ বলল, আগে একটু টেস্ট করে দেখুন, সুনীলদা। বউদিও একটু চেখে দেখবেন নাকি? দেখুন না খাঁটি মহুয়ার মতন এমন ভালো জিনিস…
নিজে পান না করলেও অপরকে পান করাবার ব্যাপারে কল্যাণের উৎসাহ একই রকম আছে। একটু পরে সে মাংস রান্নার ব্যাপারে চৌকিদারকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য উঠে চলে গেল।
জঙ্গলটা ডুবে আছে অরব অন্ধকারে। সৌভাগ্যের কথা, আকাশ খুব পরিষ্কার। এত বেশি তারা একসঙ্গে দেখবার জন্য মাঝে-মাঝে অরণ্যে আসা দরকার। আকাশ তার এমন রূপ আর অন্য কোথাও দেখায় না। ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলে মাঝে মাঝে নক্ষত্র পতন দেখা যায়। নক্ষত্র কিংবা উল্কা, পরিষ্কার চোখে পড়ে, একটা আলোর বিন্দু আকাশ থেকে খসে পড়তে পড়তে, যেন আকাশের খুব কাছাকাছি এক দীর্ঘকায় শাল গাছের মাথার কাছে এসে নিভে গেল।
কল্যাণ মাংস রান্নার ফাঁকে-ফাঁকে আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিচ্ছে। একবার সে বলল, বউদি ওই যে দেখুন! ওটা কিন্তু তারা নয়!
আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, একটা আলোর বিন্দু আকাশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে যাচ্ছে, নীচে খসে পড়ছে। সত্যিই সেটা তারা নয়, বিমানও নয়, সেটা কোনও রকেট নিশ্চিত। অসংখ্য রকেট তো এখন আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে খালি চোখে তারই একটাকে দেখতে পেয়ে আমরা বেশ রোমাঞ্চিত বোধ করি।
জঙ্গল আর অরব রইল না, একটু পরে দূরে, বহু দূরে শোনা গেল দ্রিদিম-দ্রিদিম শব্দ। মাদল কিংবা খোল। কিন্তু এমনই আধোজাগা, গম্ভীর সেই শব্দ যে রীতিমতন রহস্যময় মনে হয়। যেন আদিম কালের পৃথিবীতে কেউ কারুর কাছে কোনও সংকেত পাঠাচ্ছে। আমরা চুপ করে শুনি। নৈশভোজের পর আমরা অন্ধকারের মধ্যে একটু হাঁটতে বেরোলুম। স্বাতী একবার খুব মৃদুভাবে জিগ্যেস করল, এখানে সাপ আছে? কল্যাণ বলল, তা তো থাকতে পারেই!
এবং হাতির দলও কাছাকাছি কোথায় রয়েছে সুতরাং রাত্রে বেশি দূর অ্যাডভেঞ্চার করা যায় না। এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে, একদিকে আঙুল দেখিয়ে কল্যাণ বলল, ওইখানে আলো দেখতে পাচ্ছেন?
চোখ সরু করে আমরা দেখলুম, জঙ্গলের ফাঁকে, বোধহয় দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে, একটা আলোর রেখা, অনেক দূরের।
কল্যাণ বলল, ওই দিকে ঘাটশিলা। কপার মাইনসের আলো।
অর্থাৎ ঘাটশিলায় গিয়ে আমরা দূরে যে পাহাড়ের রেখা দেখি সেই পাহাড়েরই কোনও চূড়ায় আমরা রয়েছি। ঘাটশিলায় কতবার গেছি, কখনও ভাবিনি, দূরের ওই পাহাড়গুলোতে কখনও থাকব। চাঁদে যাওয়ার পর কেউ যদি আঙুল দেখিয়ে বলে ওই দ্যাখো, দূরে পৃথিবীর আলো–অনেকটা সেই রকম বোধহয়। সেখানে দাঁড়িয়ে রইলুম কিছুক্ষণ। পাহাড়ের অন্যদিকে কোথাও তখনও দ্রিদিম দ্রিদিম শব্দ–সেই গম্ভীর, রহস্যময় মাদলের শব্দ। বোধহয় সারারাতই সেই শব্দ শুনেছিলাম।
অরণ্যে দিন ও রাত্রি সত্যিই আলাদা! সকাল বেলা অনেক কিছুই আর রহস্যময় বা রোমাঞ্চকর থাকে না। ভারতবর্ষে বোধহয় এমন অরণ্য একটিও নেই, যা সম্পূর্ণ নির্জন। দিনের বেলা আমি সব জঙ্গলেই মানুষের যাতায়াত দেখেছি। শুধু যাতায়াত নয়, বসতিও।
সন্ধের পর আমরা এই বাংলোটিকে যত নিরিবিলি ভেবেছিলুম, সকালে উঠে দেখা গেল, আসলে ততটা নয়। বাংলোটি টিলার ওপরে, একটু নেমে গেলেই বেশ কিছু কোয়ার্টার, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের। এবং জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে কয়েকটি গ্রামও রয়েছে। অনেক জায়গায় চাষ আবাদও হয়। প্রকৃতির শোভা দেখলেই তো চলবে না, মানুষকে তো বাঁচতেও হবে!
সকালের প্রথম চা আমরা পান করলুম বাংলোর পেছন দিকে একটা বেশ উঁচু মিনারের মতন জায়গায়। এখান থেকে পাহাড়ের গোল মালাটি স্পষ্ট দেখা যায়। অরণ্য সবুজ, কিন্তু সবুজ মোটেই একটা রং নয়, অন্তত সাত রকম সবুজ তো এই এখানেই রয়েছে।
কল্যাণ খুব সন্তর্পণে একটি ঘাস ফুলকে আদর করে। তারপর একটি শাল গাছের গা থেকে খানিকটা আঠা ভেঙে এনে স্বা তাঁকে বলে, জানেন, এর থেকেই ধূপধুনোর ধুনো তৈরি হয়? স্বাতী জানত না, এই সম্পূর্ণ নতুন তথ্যে ও অবাক হয়ে বলল, ওমা, তাই নাকি?
আমাদের তুলনায় স্বাতীই সবচেয়ে কমবার বন জঙ্গলে এসেছে। ও শাল ও সেগুন গাছের তফাৎ জানে না। ও জানত না যে কুসুম গাছ বলে কোনও গাছ থাকতে পারে, যার ফলের নাম কুসুম ফল, এবং লোকে তাই খায়। কচি অবস্থায় যে গাছের পাতা থেকে হয় বিড়ির পাতা সেই গাছই বেশ বড় মোটা, আর কালো হয়, তার নাম কেন্দু। তখন তার পাতা কোনও কাজে লাগে না, কিন্তু কেন্দু ফল জঙ্গলের লোকদের খাদ্য। আমাদের তুলনায় স্বাতীর বিস্ময়বোধ অনেক টাটকা বলে, এই জঙ্গলকে ও উপভোগ করছে বেশি।
কল্যাণ আমার একটা অচেনা গাছের পাতা ছিঁড়ে বলল, দেখুন কী সুন্দর শেপ, শিরাগুলো কেমন চমৎকারভাবে ছড়িয়ে গেছে।
প্রতি বছর জঙ্গলের কিছু অংশ ইজারা নিয়ে গাছ কাটা কল্যাণের পেশা। কিন্তু ও গাছটাকে ভালোবেসে ফেলেছে। প্রতিটি গাছ ওর চেনা, ও জানে, কোন-কোন গাছ কাটতে নেই, হঠাৎ হঠাৎ এক একটা গাছের দিকে তাকিয়ে ও বলে, দেখুন দেখুন, কী সুন্দর!
কল্যাণের এই পরিচয় আমি আগে জানতুম না। আগে প্রত্যেকবার দেখেছি এক দুরন্ত কল্যাণকে। সেই দুর্দান্তপনা এবং অনর্গল নেশা করার স্বভাব ত্যাগ করেছে বলে অন্য অনেকদিকে ওর মন খুলে গেছে। ও খালি চোখে আকাশের রকেট দেখতে পায়, দারুণ মুরগির মাংস রান্না করে, গাছের পাতার গড়নে মুগ্ধ হয় এবং আদিবাসীদের জীবন নিয়ে চিন্তা করে। এখন ওর হাতে অনেক সময়।
জঙ্গলে এসে সবচেয়ে ভালো লাগে এইটাই যে কিছুই করবার থাকে না। যতক্ষণ ইচ্ছে চুপচাপ বসে থাকা যায়, অথবা ইচ্ছে করলে যে-দিকে খুশি ঘুরে বেড়ানোও যায়। অলসভাবে সেখানে অনেকক্ষণ কাটিয়ে তারপর আমরা বেরিয়ে পড়লুম একটা মন্দির দেখবার উদ্দেশ্যে।
স্বাতীর খুব মন্দির দেখার শখ, বিশেষত যদি পুরোনো মন্দির হয়। কল্যাণ ইতিমধ্যেই এই মন্দির সম্পর্কে একটা রোমহর্ষক গল্প শুনিয়েছে। কাল ভৈরবের মন্দির, এককালে নাকি ওখানে নিয়মিত মানুষ বলি হত, এখনও মাঝেমধ্যে হয় লুকিয়ে চুরিয়ে। মন্দিরের ঠিক মাঝখানে গর্তের মধ্যে একটা বিরাট সাপ আছে, বলির রক্ত সেই সাপটা এসে চুকচুক করে খেয়ে যায়।
বাংলো থেকে বেরিয়ে আমরা প্রথমে চন্দন গাছ দর্শন করলাম। কিছুদূরে কমলালেবুর গাছও লাগানো হয়েছে। চন্দন গাছের পাতায় বা ডালে কোনও গন্ধ নেই শুনলাম, ওই গাছে সুগন্ধ আসতে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে। শিকড়ে একটু-একটু গন্ধ পাওয়া যায়, তাই কারা যেন মাটি খুঁড়ে খানিকটা শিকড় কেটে নিয়ে গেছে।
এদিকে জঙ্গল অনেক পাতলা। পরপর দুটি মকাই-খেত। তারপর একটি লাল রঙের ঝরনা। হাঁটু-জল সেই ঝরনা পেরিয়ে, একটা ছোট পাহাড় ডিঙিয়ে আবার এলাম একটা সমতল মতন জায়গায়, যার পাশে একটি বেশ ছোট্টখাট্টো খরস্রোতা নদী, আলগা-আলগা ভাবে দাঁড়ানো কয়েকটি বহু পুরোনো বিশাল শাল তরু। তার মধ্যে একটি গাছের গায়ে হাত দিয়ে কল্যাণ বলল, এ গাছটার দাম কম করেও অন্তত দশ হাজার টাকা!
বিস্ময়ে আবার স্বাতীর ভুরু উঠে যায়। সানগ্লাস খুলে সে শ্রদ্ধার সঙ্গে ভালোভাবে গাছটিকে দেখে।
কল্যাণ বলল, তবে এত বড় গাছনা-কাটাই উচিত।
এখানে মাঝে মাঝেই ছোট-ছোট মাটির তৈরি হাতির মূর্তি ছড়ানো। মন্দিরের তীর্থযাত্রীরা মানত করে গেছে। বাঁকুড়ায় যেমন ঘোড়া, এখানে সেরকম হাতি। তবে, মন্দিরটি আমাদের হতাশ করল। কল্যাণকেও। আগে সে দেখে গিয়েছিল, খুব পুরোনো একটি মাটির ঘর, খড়ের ছাউনি–তাতে পুরোনো-পুরোনো গন্ধ ছিল। এখন তার বদলে ইট-সুরকি দিয়ে একটা বদখত চেহারার মন্দির বানানো হয়েছে।
জায়গাটি অবশ্য সম্পূর্ণ জনশূন্য। মন্দিরের পূজারি-টুজারিও কেউ নেই। মন্দিরের সামনে একটি কাঠগড়া, তাতে এখনও শুকনো রক্ত লেগে আছে। মানুষের রক্ত নিশ্চয়ই নয়। মোষ বলিরই চলন বেশি আদিবাসীদের মধ্যে। মোষের নাম এখানে কাড়া। কল্যাণের মুখে শুনলাম, এখানে কাড়া বলির পর মুণ্ডুটা পায় পূজারি, আর বাকি মাংস ভাগ-যোগ করার উপায় তাকে না। তার আগেই সব লোক ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে যে যতখানি পায় নিয়ে পালিয়ে যায়।
জায়গাটা বেশ পরিচ্ছন্ন, শান্ত ও আবিষ্ট ধরনের। আমরা তিনজনে তিনদিকে বসে রইলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে কল্যাণ বলল, ভুল হয় গেল, একটা মহুয়ার বোতল সঙ্গে আনলে ভালো হত। এটাও ওর নিজের জন্য নয়, আমার জন্য। ওর পূর্ব জীবনের স্মৃতি, এইরকম পরিবেশে একটু মহুয়ায় চুমুক দিলে বেশ জমে।
কতক্ষণ বসে ছিলাম খেয়াল নেই। কথা বলারও প্রয়োজন হয় না। বড় বড় শাল গাছগুলো মাথার ওপর ছত্রছায়া বিছিয়ে রেখেছে। মাঝে-মাঝে উড়ে যাচ্ছে টিয়া পাখির ঝাঁক। এই বনে পাখিদের মধ্যে টিয়ারই প্রাধান্য। মুনিয়া পাখির চেয়েও ছোট একটা পাখির ঝাঁক দেখেছিলাম। আর দূরে কোথাও একটা কুবো ডেকে চলেছে।
সাপটাকে প্রথমে স্বাতীই দেখল। জঙ্গলে আমাদের প্রথম সাপ। খানিকটা যেন অবিশ্বাসের সুরেই স্বাতী বলল, ওটা কী, সাপ না? আমরা থমকে তাকালুম।
সাপটা আমাদের তিন জনের মাঝখানে ফাঁকা জায়গাটায় কী করে কখন এল বুঝতেই পারিনি। আমরা যেমন অবাক হয়েছি, সাপটাও তার চেয়ে কম অবাক হয়নি। কয়েক মুহূর্ত আমাদের দেখেই সে বিদ্যুতের মতন এঁকেবেঁকে একটা ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
কল্যাণ বলল, চন্দ্রবোড়া!
এটাই সেই মন্দিরের সাপ বলে বিশ্বাস করা যায় না। সাপটি বয়েসে বেশ তরুণ। বহুঁকাল ধরে এ বলির রক্ত পান করে যাচ্ছে, এ কথা মানতে পারি না, এর পিতৃ-পিতামহ কেউ এ কাজ করলেও করতে পারে। সাপটা এখনও ঝোঁপের মধ্যেই রয়েছে, সুতরাং এ সংসর্গে আর বেশিক্ষণ থাকা উচিত নয়, শাস্ত্রের নিষেধ আছে।
ফেরার পথে কল্যাণ এক জায়গায় এসে দুঃখিত হল। একটি মাঝবয়েসি শালগাছ পরাজিত যোদ্ধার মতন মাটিতে শুয়ে আছে। কোনও কাঠ-চোর এটিকে কেটেছে, সবটা নিয়ে যেতে পারেনি। হেঁটে নিয়ে গেছে ডালগুলো। শুয়ে থাকা গাছ দেখলে আরও কষ্ট হয়। বিশেষত, ‘দা সিক্রেট লাইফ অব প্লান্টস’ বইটা পড়বার পর থেকে গাছ সম্পর্কে আমার ধারণা আমূল বদলে গেছে।
আর একটু এগোবার পর আমরা একটি উপহার পেলাম। একটি কাঁচ পোকা কিংবা টিপ পোকা। সমস্ত বন মাতিয়ে বোঁ-বোঁ শব্দ করতে-করতে উড়ে এসে সে আমাদের সামনেই একটা নীচু গাছে এসে বসল এবং কল্যাণ অমনি খপ করে ধরে ফেলল সেটাকে। এত বড় টিপ পোকা আমি আগে কখনও দেখিনি। কী অপূর্ব সুন্দর তার রং, উজ্জ্বল নীল ও সোনালি। পাখিদের মধ্যে যেমন ময়ূর, পোকাদের মধ্যে তেমন এই টিপ পোকাদের কেন যে এত রঙের সৌভাগ্য, তা কে জানে! মজা এই যে, পোকাটিকে ধরে কল্যাণ ওর বাঁ-হাতের তালুতে উলটো করে শুইয়ে রাখতেই সে দিব্যি গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইল। যেন তাকে কেউ দেখছে না।
লাল রঙের ঝরনাটা পার হওয়ার পর আমরা মাদলের শব্দ শুনতে পেলুম। কল্যাণ বলল, কাছেই একটা ছোট গ্রাম আছে, চলুন, সেদিক দিয়ে ঘুরে যাই।
গ্রাম মানে কী। আট দশটা কাঁচা বাড়ি। তারই একটা বাড়ির মধ্যে একজন লোক মাদল বাজাচ্ছে, আর একজন নাচছে, আর তাদের ঘিরে হাসছে অনেকে। বাজনদার বানাচুনে, কারুরই শরীর নিজের বশে নেই, পা টলমল, মহুয়ার নেশায় একেবারে চুর চুর। কিন্তু বাজনা বা নাচের উৎসাহ ওদের একটুও কম নয়।
আমাদের খাতির করে একটা খাঁটিয়ায় বসতে দেওয়া হল।
এই জঙ্গলে তিন জাতের মানুষ থাকে। লোধা বা শবর, তারা এখনও বাউণ্ডুলে, শিকার টিকার করে খায়, বা দিন মজুরির কাজ করে, চুরির দক্ষতার ব্যাপারেও তাদের সুনাম আছে, কিন্তু তারা চাষবাস জানে না। দ্বিতীয় দল সাঁওতালরা বেশ সুসভ্য, তারা শিকার ও চাষ দুটোই জানে এবং দুপুরবেলা মহুয়া খেয়ে নাচ-গান নিয়ে আনন্দ করতে জানে শুধু তারাও। আর আছে মাহাতোরা, তারা অন্যদের তুলনায় কিছুটা সচ্ছল।
এ বাড়িটা যে সাঁওতালদের, তা দেখেই বোঝা যায়। লোকজনের পায়ে পায়ে ঘুরছে–কয়েকটি একেবারে সদ্যোজাত, একদিন বা দুদিন বয়েসি মুরগির ছানা। ওগুলোকে ঠিক চলন্ত কদম ফুলের মতন দেখায়। একটু দূরে বাঁধা একটা ছাগলও নাচ দেখছে একদৃষ্টে। স্বাতীর কাছে এ সবই নতুন। আগেকার দিনে হলে আমিও মহুয়া খেয়ে ওদের সঙ্গে নাচে যোগ দিতাম। স্বাতী সঙ্গে রয়েছে বলেই শান্ত, সুশীল হয়ে বসে রইলুম। কল্যাণ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
দরজার কাছে দাঁড়ানো একজন মাঝবয়েসি রমণী মাঝে-মাঝে নাচ চাঙ্গা করবার জন্য একটা গান ধরেছে। বেশ গলাটি। গানের ভাষা কিন্তু একেবারেই দুর্বোধ্য নয়, পুরোপুরি বাংলা, পথের মাঝে বৃষ্টি আসিল, বন্ধু আমার বান্ধা পড়িল–এই ধরনের। যে নাচছে এবং যে ঢোল বাজাচ্ছে, এই দুজনের মধ্যে কেউ একজন ওই মহিলাটির স্বামী, ঠিক কোনজন তা বুঝতে পারলুম না, বাজনার তালে ভুল হলে কিংবা নাচনেটি বেশি ঢলে পড়লে সে বকছে দুজনকেই। নাচুনেটির স্বাস্থ্য চমৎকার, চকচকে কালো শরীরটি ঘামে ভেজা, এত নেশাগ্রস্ত অবস্থাতে সে কিন্তু একবারও মাটিতে পড়ে যাচ্ছে না। সে যেন আজ সারাদিন ধরে নাচবার জন্য বদ্ধপরিকর। মহিলাটির গানের প্রতি আমি একবার তারিফ জানাতেই সে অপ্রত্যাশিতভাবে বলল, বাবু, আমার ন’খানা ছেলেমেয়ে। অর্থাৎ সে যেন জানাতে চায় যে নটি সন্তানের জননী হওয়া সত্বেও সে গান গাইতে পারে। এটা একটা জানাবার মতন কথাই বটে।
আমি একটু কৌতুক করে বললুম, পুরোপুরি দশটা হলেই তো ভালো হত! তার উত্তরে সে উদাসীন গলায় বলল, হয়ে যাবে। দশটাও হয়ে যাবে। এই তো আমাদের একমাত্র সুখ!
স্বাতী আমার দিকে চেয়ে দ্রুভঙ্গি করল। প্রায় ঘণ্টাখানেক নাচ দেখার পর আমরা উঠে পড়লুম। একটু দূরে এসেছি, তখন দেখি পেছনে-পেছনে সেই মহিলাটিও আসছে। অযাচিতভাবেই সে বলল, ওটা আমার বাড়ি নয়, আমার বাড়ি ওই সামনে। আমার বাড়ি দেখবে না?
বিশেষত সে স্বা তাঁকে বলল, ও মেয়ে, তুমি আমার বাড়ি দেখবে না?
গেলুম তার বাড়িতে। এর বাড়ির উঠোনটিও অত্যন্ত পরিচ্ছন্নভাবে নিকোনো। এক পাশের চালাঘরে একটি টেকি, তার পাশের খাঁটিয়ার বসলুম আমরা। মহিলাটি কথা বলতে ভালোবাসে।
আমাদের সব বৃত্তান্ত জিগ্যেস করে জানবার পর সে বলল যে তার বড় মেয়ে অনেকদিন পর বাপের বাড়িতে এসেছে বলে সেই আনন্দের চোটে তার মেয়ের বাপ মহুয়া খেয়ে নাচতে গেছে। ব্যাপারটা যেন অত্যন্ত কৌতূকের, এইভাবে সে হাসতে লাগল খিলখিল করে।
তিন গেলাস কুয়োর জল খেয়ে আমরা উঠে পড়তে যাচ্ছি, তখন মহিলাটি অত্যন্ত বিস্মিতভাবে বলল, এ কি, তোমরা চলে যাচ্ছ? খেয়ে যাবে না, আমি যে ভাত চাপাচ্ছি?
আমরাও হতভম্ব। এদের দারিদ্রের প্রকৃত স্বরূপ বোঝা আমাদের পক্ষে সত্যিই বুঝি অসম্ভব। অচেনা কোনও মানুষ বাড়িতে এলে আমরা কোনওদিনই তাকে খেয়ে যেতে বলতে পারব না।
রমণীটি আবার দুঃখিতভাবে বলল, আমার বাড়িতে এসে তোমরা না খেয়ে চলে যাবে?
আমরা অত্যন্ত অপরাধীর মতন, বিনীতভাবে বললুম আজ নয়, আর একদিন আসব, নিশ্চয়ই এসে খেয়ে যাব!
সে অবিশ্বাসের সুরে বলল, হ্যাঁ, আর এসেছ!
সারা বছর ভাত খাওয়া ওদের কাছে বিলাসিতা। মন্দির থেকে ফেরার পথে একজন স্ত্রীলোককে দেখেছিলাম, তার কাঁকালে একটি রোগা শিশু। মাথায় এক বোঝা শুকনো ডালপালা আর হাতে দুটি সবুজ পাতায় মোড়া কী যেন। সে স্ত্রীলোকটি বাংলা বুঝতে পারে না, কল্যাণ তার সঙ্গে আদিবাসীদের ভাষায় কথা বলে ঠোঙা দুটি দেখতে চাইল। তাতে আছে কিছু থেঁতলানো বুনো জাম আর কিছু ব্যাঙের ছাতার মতন জিনিস।
কল্যাণ আমাদের বলেছিল, ওইগুলোই ওই মা-ছেলের সারাদিনের খাদ্য। এই জঙ্গলের অনেকে মাটি খুঁজে খুঁজে এক ধরনের বুনো আলু পায়, তাই খেয়েই দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়। অনেকে শাল গাছের ডগার কচি পাতাও সেদ্ধ করে খেয়ে নেয়। আর ওই স্ত্রীলোকটি আমাদের তিনজনকে অকারণে ভাত খেয়ে যেতে বলছিল। হয়তো, কিছু বিক্রি করে হাতে কিছু ধান এসেছে।
বাংলোয় ফিরে এসে আমরা খানিকক্ষণ চুপ করে বসলুম। এখান থেকে সেইসব বাড়িঘর কিছুই দেখা যায় না। শুধু দিগন্ত-ছোঁয়া জঙ্গল আর পাহাড়। চোখকে আরাম দেওয়া প্রকৃতি। এরই মধ্যেমধ্যে রয়ে গেছে ক্ষুধার্ত মানুষ, আবার দুপুরবেলা নেশা করে নাচবার মতন মানুষ, অতিথি সেবার জন্য ব্যাকুল মানুষ। কয়েকটি ক্ষুধার্ত, অসহিষ্ণু হাতিও ঘুরছে কাছাকাছি।
কল্যাণ টিপ পোকাটাকে পাতায় মুড়ে লতা দিয়ে বেঁধে একটা প্যাকেট বানিয়ে নিয়েছিল। সেই প্যাকেটটা বারান্দার ওপর রাখতেই পাতার একটু অংশ কেটে টিপ পোকাটি মুখ বার করল। বেশ কৌতূহলী চোখ দিয়ে দেখতে লাগল আমাদের।
স্বাতী বলল, ওটাকে ছেড়ে দিন। পোকাটাকে মেরে টিপ পরবার ইচ্ছে আমার নেই।
কল্যাণেরও সেই রকমই ইচ্ছে। পাতাটা খুলে সে পোকাটাকে হাতে করে উড়িয়ে দিল।
টিপ পোকাটা বোঁ শব্দ করে দু-পাক ঘুরল আমাদের মাথার ওপরে, তারপর দুর্দান্ত গতিতে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে।