তিন দিকে বিফল হইল অন্বেষণ।
দক্ষিণ দিকের কথা শুনহ এখন।।
দক্ষিণেতে যত ঠাট করিল প্রয়াস।
বিন্ধ্যগিরি অন্বেষিতে ঘেল একমাস।।
মাসেকের অধিক হইলে লাগে ডর।
জীবনের আশা ছাড়ে সকল বানর।।
বিষম দণ্ডক বন, নাহিক উদ্দেশ।
তাহাতে বানর-সৈন্য করিল প্রবেশ।।
পূর্ব্বে তথা ছিল এক ব্রাহ্মণ-তনয়।
দশ বর্ষ বয়স্ক সুন্দর অতিশয়।।
ঐ বনের বন্যজন্তু তাহারে মারিল।
পুত্রশোকে ব্রাহ্মণ বনেরে শাপ দিল।।
তদবধি ফল জল নাহিক প্রচার।
কোন জীব জন্তু তথা নাহিক সঞ্চার।।
হেন বনে বানরেরা করিল প্রবেশ।
তথা না পাইল তারা সীতার উদ্দেশ।।
অন্য বন দেখিলেক তাহারা সম্মুখে।
জানকীর অন্বেষণে সেই বনে ঢুকে।।
সকল বানর গেল বনের ভিতর।
দেখে এক রাক্ষস দেখিতে ভয়ঙ্কর।।
ধাইয়া আইল সে বানর খাইবারে।
রুষিল অঙ্গদ বীর যুঝিতে হাঁকারে।।
আয় বেটা, বুঝি তুই লঙ্কার রাবণ।
আমরা ভ্রমিয়া করি তোর অন্বেষণ।।
অঙ্গদে ও রাক্ষসে লাগিল হুড়াহুড়ি।
হুড়াহুড়ি হইয়া উভয়ে জড়াজড়ি।।
কেহ কারে নাহি জিনে, দুজনে সোসর।
আঁচড়ে কামড়ে দোঁহে হইল জর্জ্জর।।
ক্ষণে হেঁট অঙ্গদ, সে ক্ষণেক উপরে।
টলমল করে ক্ষিতি উভয়ের ভরে।।
অঙ্গদ মুকুটি মারে রাক্ষসের বুকে।
অচেতন হইল সে, রক্ত উঠে মুখে।।
রাক্ষসেরে মারিয়া রহিল সেই বনে।
কিন্তু সীতা না পাইয়া সবে দুঃখী মনে।।
বিষাদেতে কপি পাইয়া সবে দুঃখী মনে।
অঙ্গদ উঠিয়া সব বানরের বলে।।
আইলাম জানিতে জানকীর বিশেষ।
হইল মাসের ঊর্দ্ধ না যাইব দেশ।।
সীতা না দেখিয়া যাব সুগ্রীবের পাশ।
জীবনের আশা নাই অবশ্য বিনাশ।।
অঙ্গদের বাক্যে সব হয়ে একমতি।
বন ডাল উটকিল করি পাতি পাতি।।
না পাইয়া অঙ্গদ কহিল খেদকথা।
দেখিলাম সর্ব্ব বন আর পাব কোথা।।
সত্য করিয়াছেন যে খুড়া মহাশয়।
সীতা উদ্ধারিতে আমি করিলাম নিশ্চয়।।
চারিদিকে বীরগণ গেছে দূরদেশে।
দেখ দেখি কোন্ বীর কি করিয়া আসে।।
যে হৌক সে হৌক ভাবি আপন কল্যাণ।
সমস্ত দক্ষিণ দেখি যাব রাম-স্থান।।
সীতা না পাইলে হবে সবার মরণ।
আগে মরিবেন রাম শেষে অন্যজন।।
তারপর লক্ষ্মণ মরিবে তাঁর শোকে।
অনন্তর সুগ্রীব যাইবে যমলোকে।।
চাহিতে চাহিতে দেখে এক গোটা বিল।
জল নাই, পক্ষী তথা করে কিলকিল।।
খাল জোল না দেখি নিকটে নাহি জল।
নানা পক্ষী কলবর শুনি যে কেবল।।
আশ্চর্য্য দেখিয়া তারা ভাবে মনে মনে।
জল নাহি শব্দ শুনি কিসের কারণে।।
দাণ্ডাইয়া ভাবে তথা সব কপিগণ।
বড় গাছ আছে এক সে বিলের পাড়ে।
লাফ দিয়া কপিগণ সেই গাছে চড়ে।।
চারিদিকে চাহে নাহি হয় দরশন।
শাখায় শাখায় ফিরে শাখা-মৃগগণ।।
গাছে থাকি দেখে তারা সুড়ঙ্গের দ্বার।
চন্দ্রসূর্য্য-দীপ্তি নাই মহা অন্ধকার।।
সুড়ঙ্গ দেখিয়া তারা ভাবে মনে মনে।
যাইব ইহার মধ্যে আমরা কেমনে।।
যে হউক সে হউক সাহসে করি ভর।
সকল বানর যায় সুড়ঙ্গ ভিতর।।
হাতাহাতি করি যায় সকল বানর।
যাইতে যাইতে যুক্তি করিল বিস্তর।।
দৈবে হয় হউক আমা সবার মরণ।
বুঝিব ইহার মর্ম্ম, জানিব কারণ।।
সুড়ঙ্গে প্রবেশি এই করিয়া বিচার।
সুড়ঙ্গে চলিল সবে মহা অন্ধকার।।
অন্ধলোক যায় যেন হাতে করি লড়ি।
হুড়াহুড়ি করে কেহ কার গায় পড়ি।।
হাতাহাতি যায় সবে, না পায় সঞ্চার।
সকল বানর তবে ভাবিল অসার।।
দেখিতে না পাই কিছু যাইব কেমনে।
ফিরে চল উঠি গিয়া মরি কি কারণে।।
কেহ বলে নামিয়াছি, যা হবার হবে।
এসেছ সুড়ঙ্গ-পথে কেন ফিরে যাবে।।
অন্ধকারে চলি যায় নাহি দেখে বাট।
পিপাসায় সকলের গলা হৈলা কাঠ।।
অন্ধকারে যায় সবে আগে হনুমান।
হাতে লড়ি করে যেন হৈয়া যায় কান।।
আগ হনুমান বীর চলিল সাহসে।
অন্ধলোক চলে যেন পড়ে আশে পাশে।।
বীরগণ বলে শুন পবন-নন্দন।
প্রকাশ হইব গেলে কতেক যোজন।।
আর কত পথ গেলে পাইবে প্রকাশ।
হনুমান কহে, কেহ না করিহ ত্রাস।।
আমি সঙ্গে যাব তবে ক্ষতি কিবা আছে।
সকল বানরগণ আইস মোর পাছে।।
যোজন সাতেক গেলে তবে হব পার।
এই গৃহ আছে তথা অদ্ভুত আকার।।
হনুমানের বাক্যেতে সাহসে করি ভর।
ধীরে ধীরে চলে তথা সকল বানর।।
হনুমান মহাবীর বুদ্ধে বৃহস্পতি।
সবারে করিল পার করি হাতাহাতি।।
ধর্ম্মে ধর্ম্মে সকলে সঙ্কটে হয়ে পার।
দেখিতে পাইল গৃহ অদ্ভুত আকার।।
সোণার প্রাচীর তার স্বর্ণময় গাছ।
স্বর্ণপদ্ম জলে দেখে, স্বর্ণময় মাছ।।
পুরীখান দেখিল সকল স্বর্ণময়।
দেখিয়া বানরগণ হইল বিস্ময়।।
অপূর্ব্ব পুরীর শোভা স্বর্গের বিশেষ।
সবে বলে, হনুমান এই কোন্ দেশ।।
নানা ফুল ফল আছে সুগন্ধ বাতাস।
ক্ষুধাতুর সকলে খাইতে করে আশ।।
অন্ন জল পেটে নাই ক্ষুধায় দুঃখিত।
ফল ফুল দেখি মনে বড় হরষিত।।
পুরীর ভিতর মাত্র এক কন্যা আছে।
সকল বানর গেল সে কন্যার কাছে।।
ত্রিশত প্রকোষ্ঠ গেল ভিতর আবাস।
কন্যার রূপেতে করে জগৎ প্রকাশ।।
সুন্দরী সে কন্যা, বুঝি হরের ঘরণী।
রম্ভা তিলোত্তমা কিম্বা ইন্দ্রের ইন্দ্রাণী।।
শোভিত যুগল ভুরু যেন কামধনু।
কপাল সিন্দূর-ফোঁটা প্রভাতের ভানু।।
চন্দন চন্দ্রমা কোলে কজ্জলের বিন্দু।
ভ্রূযুগ উপরেতে উদয় অর্দ্ধ-ইন্দু।।
বিন্দু বিন্দু গোরোচনা শোভা করে অতি।
অলকা তিলকা রেখা অর্দ্ধ অর্দ্ধ পাঁতি।।
রতন রঞ্জিত তার পদাঙ্গুলি সব।
রাজহংস জিনি ধ্বনি নূপুরের রব।।
করে শঙ্খ কঙ্কণ কিঙ্কিণী কটি মাঝে।
রতন নূপুর পায় রুণুঝুনু বাজে।।
পৃষ্ঠে লোটে স্পষ্টরূপে প্রবালের ঝাঁপা।
গৌর গায় গন্ধ করে গন্ধরাজ চাঁপা।।
ছড়া ছড়া বাজুবন্দ শঙ্খের উপর।
যেখানে যে শোভা করে পরেছে বিস্তর।।
দুই পায়ে শোভিত করেছে গোটা মল।
ব্রহ্মচারী আদি লোক দেখিয়া পাগল।।
পুরীর ভিতর কন্যা আছে একেশ্বরী।
কন্যারূপে আলো করে রসাতল-পুরী।।
তাহারা সকলে বন্দে কন্যার চরণ।
যোড়হাতে বলে বীর পবন-নন্দন।।
আমরা বানর পশু, বনে করি বাসা।
ক্ষুধায় না দেখি পথ, লাগিয়াছে দিশা।।
রাজভার গজিয়াছে জীবন অসার।
খাল জোল বন আদি চাহিনু সংসার।।
দুর্জ্জয় পাতালেতে আমরা সবে আসি।
তোমা দেখি বাঁচিলাম, মনে হেন বাসি।।
হইলাম বড় তুষ্ট তোমারে দেখিয়া।
পরিচয় দেহ কন্যে, তুমি কার প্রিয়া।।
বড়ই কাতর মোরা হয়েছি এখন।
পরিচয় দেহ কন্যে, তুমি কোন্ জন।।
কাহার বসতি ঘর, কার সরোবর।
কৃপা করি কহ কন্যা, শুনি অবান্তর।।
কার পুরী আইলাম বড় বাসি ডর।
আইলাম বড় বাসি ডর।।
কন্যা বলে, শুন বীর মম পরিচয়।
সুমেরু পর্ব্বতশ্রেষ্ঠ মম পিতা হয়।।
সম্ভবা আমার নাম, হেমা মোর সখী।
হেমার বচনে আমি এই পুরী রাখি।।
এই আবাসের রক্ষা আছে মম করে।
আমা অগোচরে কেহ আসিতে না পারে।।
ময় নামে দানবের রচিত আবাস।
হেমা সহ ময় করে এখানে বিলাস।।
নৃত্যেতে নর্ত্তকী হেমা গানেতে গায়নী।
রূপে বেশে গুণে হেমা ত্রিভুবন জিনি।।
রূপে ময়দানবের মুগ্ধ করে হেমা।
অবিরত রতি করে তার নাই ক্ষমা।।
রাত্রি দিন রমণে হেমার হয় ক্লেশ।
উঠিতে না পারে হেমা প্রায় তনু শেষ।।
দানবের শৃঙ্গারে পলায় হেমা ত্রাসে।
দানব চলিল, সেই হেমার উদ্দেশে।।
যেখানে পাইবে তারে আনিবে ধরিয়া।
এই বেলা পলাও হে সেই পথ দিয়া।।
বড়ই দুরন্ত সে দানব দুষ্ট জন।
এখান হইতে যাহ সব কপিগণ।।
কোন্ জন হইতে পাইলে উপদেশ।
দুর্জ্জয় পাতালে কেন করিলা প্রবেশ।।
শীঘ্র যাহ, বিলম্ব কি হেতু কর আর।
দানব আইলে কার নাহিক নিস্তার।।
হনুমান বলে, কন্যা শুন বিবরণ।
আমরা রামের দূত সব কপিগণ।।
রামচন্দ্র দশরথ-রাজার কুমার।
সর্ব্ব জ্যেষ্ঠ গুণশ্রেষ্ঠ মহিমা অপার।।
আইলেন পিতৃসত্য পালিতে কানন।
তাঁর সঙ্গে আইলেন অনুজ লক্ষ্মণ।।
শ্রীরাম-রমণী সীতা পরমা সুন্দরী।
স্বভাবতঃ সতত রামের সহচরী।।
বনে বাস করিয়াছিলেন তিন জন।
রামের রমণী সীতা হরিল রাবণ।।
সীতার বিরহে রাম হইয়া কাতর।
বনে বনে ভ্রমণ করেন নিরন্তর।।
দৈবযোগে সুগ্রীবের সহিত মিলন।
হইলেক উভয়ের সখ্য সংঘটন।।
বালি বধি রাম রাজ্য দিলেন সুগ্রীবে।
সুগ্রীব করিল সত্য, সীতা উদ্ধারিবে।।
সুগ্রীবের আদেশেতে বেড়াই নানা দেশ।
অদ্যাপি না পাইলাম সীতার উদ্দেশ।।
মাসেকের তরে রাজা করিল নিশ্চয়।
মাসেক অধিক হৈলে বড় বাসি ভয়।।
গাছ হৈতে দেখিয়া আমরা এ সকল।
জলের উদ্দেশে আইলাম এই স্থল।।
মুখে কথা কহে তারা ফল পানে চায়।
মনে তোলাপাড়া করে কন্যারে ডরায়।।
বানর দেখিয়া ফল হইল বিকল।
সাধ হয় পেড়ে খায় কাঁচা পাকা ফল।।
বানরের ইচ্ছা বুঝি কন্যা মনে গণে।
ফল খাইবারে কন্যা বলিল আপনে।।
বড়ই ক্ষুধার্ত্ত দেখি হইল মমতা।
কন্যা বলে ফল খাও, দিলাম সর্ব্বথা।।
ইচ্ছামত ফল খাও যত আছে মনে।
শুনিয়া হরিষ চিত যত কপিগণে।।
একে চায় আর আজ্ঞা পাইল বানর।
লাফ দিয়া উঠে গিয়া গাছের উপর।।
দুই হাতে ফল খায়, ভাঙ্গে আর ডাল।
মদগন্ধে পাতা খায় পূর্ণ করি গাল।।
পক্কতাল লইয়া বসিল পীঠোপরে।
ক্ষুধায় কাতর খায় যত পেটে ধরে।।
কতগুলো পাকা ফল নিঙ্গুড়িয়া খায়।
আধখাওয়া করি কত টানিয়া ফেলায়।।
কত ফল কামড়ে খায়, কত ফল চূষি।
উদর পূরিল রসে মনে মনে খুসি।।
ফল ফুল খাইয়া করিল মাথা হেঁট।
নড়িতে চড়িতে নারে নেউয়া হইল পেট।।
করিয়া বানরগণ উদর পূরণ।
নিবেদন করি বন্দে কন্যার চরণ।।
তোমার প্রসাদেতে খণ্ডিত সব ক্লেশ।
কোন্ পথে বাহিরাব কহ উপদেশ।।
যাবৎ এখানে কন্যে দানব না আসে।
তাবৎ বাহির হৈয়া যাই অন্য দেশে।।
বড় ভয় হয় কন্যে দানবের তরে।
ত্বরায় বাহির কর সকল বানরে।।
পথ দেখাইতে কন্যা আপনি চলিল।
সকল বানর তার পাছে গোড়াইল।।
পলায় বানরগণ, পাছু পানে চায়।
দানব আসিয়া পাছে পশ্চাতে খেদায়।।
পরাণে মারিবে তবে কার নাহি রক্ষা।
উপায় কেবল দেখি এ কন্যা সপক্ষা।।
সুড়ঙ্গের দ্বারে কন্যা হইয়া বাহির।
দেখায় বানর প্রতি সাগর গভীর।।
এই জল দেখ সবে সাগর দক্ষিণ।
বিন্ধ্যাদি মলয়-গিরি দেখহ প্রবীণ।।
শ্রীরামের আগে ষাটি সহস্র বৎসর।
অনাগত পুরাণ রচিল মুনিবর।।
বাল্মীকি বন্দিয়া কৃত্তিবাস বিচক্ষণ।
শুভক্ষণে প্রকাশিল বেদ রামায়ণ।।
অসীম রামের গুণ কি বলিতে জানি।
মরা মন্ত্র জপিয়া বাল্মীকি হৈল মুনি।।
তারকব্রহ্ম রামনাম অনন্ত মহিমা।
চারি বেদে বিচারিয়া দিতে নারে সীমা।।
চণ্ডালে করিল দয়া বড়ই করুণা।
পাষাণে নিশান কৃত্তিবাসের রচনা।।